#কৃষ্ণকলির গল্প-০৩
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম
সময় কত দ্রুত সব কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমার ধবধবে সুন্দর শরীরটা মলিনতায় ঢেকে গেছে। হুরহুর বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উপর দিকে উড়তে থাকা চুল গুলো একটা একটা করে মাটিতে ঝড়ে পড়ছে। হাতে গোনা কয়েক গোছা চুল মাথার উপর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কলেজ মাঠে বাইক ঘুরিয়ে ক্যাম্পাস কাঁপানো সেই শুভ্র আজা বিছানায় শুয়ে অসহায়য়ের মতো ছটফট করছে। কি ভয়ংকর ঘটনা! প্রকৃতির প্রতিশোধ বোধ হয় একেই বলে।
‘কত দিন আয়নায় নিজের মুখ দেখিনা তার ইয়ত্তা নেই। কতদিন নিজেকে সাজাই না। ঐ তো কড়া পার্ফিউম, সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি টাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টেবিলের উপর। ধুলোও জমেছে বেশ। কাঠের সোফা, বারান্দার রেলিং, জানালার গ্রিল, ফুলের টব সব কিছু যেনো কেমন মলিনতায় ছেয়ে আছে, বিষন্নতার চাদরে ঢেকে আছে। আচ্ছা, প্রিয়তা থাকলে কি এ ঘরটা আমার এতো খা খা করতো? হাহাকারে ভরে থাকতো? নাকি বারান্দায় বেড়ে উঠা পর্তুলিকা আর অপরাজিতার মতোই সব কিছু প্রানবন্ত থাকতো,উচ্ছ্বাসে খিলখিল করে হাসতো। হয়তো জানালার পাশে টবে গোঁজা বেলিফুলের মতোই সারা বাড়ি সুভাষে মো মো করতো। তবে কি প্রিয়তার প্রস্থানেই বিধাতা এ স্বচ্ছ বিচার করলেন আমার প্রতি? এটা কি হওয়ার ই ছিলো? নাকি ছিলো না। এতো শত প্রশ্নের উত্তর কে খুঁজে দিবে আমাকে?
‘রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরদিন ই রাফিয়াত চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। জমানো টাকা পয়সা শাড়ি গহনা কিচ্ছু বাদ রাখেনি। সব ই সাথে করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে গেছে। শুধু ফেলে গেছে আমাকে। প্রিয়তা কে হসপিটালে ফেলে আসার পরের দিন গ্রাম থেকে বাবা এসেছিলেন এ বাড়িতে। সারাদিন প্রিয়তা প্রিয়তা করে বাড়ি অস্থির করে তুললেন। উপায় অন্তুর না পেয়ে বেশ রাগ করেই বলেছিলাম,
‘প্রিয়তা এখানে নেই। ওকে বাপের বাড়ির পাঠিয়ে দিছি। ভোর হলেই কালি পুজোর বন্দনা আমার দেখতে, শুনতে ভালো লাগছিলো না। তাই পুজোর বিসর্জন দিয়ে এসেছি।
আমার কথা শুনে বাবা সেদিন আমার গালে কষিয়ে দুটো চড় বসিয়ে ছিলেন। রাগে, ক্ষোভে কেপে উঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলেন,
‘ তোর এই পাপের জন্য নরকও তোকে ঠায় দিবে না রে শুভ্র।
কথাটা বলেই বাবা সেদিন ই রাতের বাস ধরে গ্রামে চলে গেলেন। আমার বাড়ির মেঝেতে ফেলে গেলেন কয়েক ফোঁটা চোখের জল। সেই চোখের জল পায়ে পিষে আমি রাফিয়াত বিয়ে করে বাড়িতে এনেছিলাম। অথচ সেই রাফিয়াত আমাকে পিষে অসহায় বানিয়ে চলে গেলো।
‘বাবার কথা অনুযায়ী আমার এই ঘরটায় আমার জন্য নরক হয়ে দাড়িয়েছে। দিনরাত মনে হচ্ছে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে জাহান্নামের আগুনে জ্বলছি। চোখ বন্ধ করলেই প্রিয়তা কে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এই তো এখনি রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এসে বলবে ‘টেবিলে খাবার দিয়েছি। খেতে চলুন। শাড়ির আচলে সোফার হাতল আর ফুলের টব মুছতে মুছতে বলে উঠবে,
‘সারাদিন এতো ধুলোবালি যে কোথায় থেকে আসে বুঝিনা বাপু। শাড়ির আঁচল আমার ধুলোবালিতেই ক্ষয় হলো। আপনার কপালের ঘাম মোছার সৌভাগ্য আর এ আঁচলের হলো না।
সময় যত যাচ্ছে প্রিয়তার অনুপস্থিত আমাকে তত পুড়াচ্ছে। আমি একাকিত্ব, অনুশোচনার সাগরে হাপিত্যেশ করে মরছি। কোথাও কেউ নেই। আমি একা। নিঃস্ব।
হর হামেশাই চোখ গুলো ভিজে উঠছে আমার। বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম। থমথমে পায়ে ছুটে গেলাম সিড়ির কোনায় পড়ে থাকা স্টোর রুমের দিকে। রাফিয়াত এ বাড়িতে আসার পর প্রিয়তার সমস্ত জিনিস পত্র স্টোর রুমে ফেলে রেখেছিলো। আজ সেই পরিত্যক্ত জিনিসপত্র গুলোই আমাকে চুম্বকের মতো প্রিয়তার কাছে টেনে নিচ্ছে। আমি রুমে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘুটঘুটে আবদ্ধ ঘর। পেছনের জানালার ফাঁক গলে একটু একটু করে আলো আসছে। সেই আলোর সাহায্যে প্রিয়তার জিনিস গুলোতে আলতো করে হাত বুলালাম। মনে হচ্ছে এই প্রথম আমি প্রিয়তা কে এতো কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখছি। এতো আদুরে হাতে তাকে কাছে টেনে নিচ্ছি। অথচ বুকটা আমার ভীষণ ফাঁকা। খুব বাজে রকমের শূন্যতা ভর করেছে বুকের ভেতর। ইশশ! কি ভয়বহ সেই যন্ত্রণা। কত নিষ্ঠুর আজ সময়ের ফোড়!
★
আর এক মুহুর্ত দাড়ালাম না স্টোর রুমে। আর কিছু সেকেন্ড থাকলে আমি আমি দম আটকে মারা যাবো। চলে এলাম ড্রয়িং রুমে। সোফার উপর নড়বড়ে শরীরটা এলিয়ে দিতেই মেঝেতে চোখ পড়লো। স্মৃতি পটে ভেসে উঠলো প্রিয়তার যন্ত্রণায় কাতর সেই মুখশ্রী। কানে ভাসতে লাগলো নারি ছেড়া সেই তীব্র ভয়ংকর গোঙানির আওয়াজ। নাহ। আমি আর পারছি না। যন্ত্রণায়, অনুশোচনায় উন্মাদ হয়ে উঠলাম। চারদিকে শুধু একটা প্রতিচ্ছবি, একটাই প্রতিধ্বনি। প্রিয়তা! প্রিয়তা! প্রিয়তা।
‘কিন্তু প্রিয়তা কোথাও নেই। সারা বাড়ি শূন্য। আমি কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। ঘুমাতে পারছি না, খেতে পারছি না। কোনো কাজ ঠিকঠাক করতে পারছিনা। পুরো বাড়িতে আমার শান্তিতে নিশ্বাস ফেলার এতোটুকু জায়গা খুজে পাচ্ছি না। যেখানে যাই, যেদিকে চাই শুধুই হাহাকার। ঘড়ির কাটা ১০ টা পার হয়েছে অনেক আগেই। আমি তখনও ড্রয়িংরুমে বসে আছি। নিয়তি বলে দিয়েছে এ বাড়িতে আমার একার কোনো জায়গা নাই। প্রিয়তা ছাড়া এ বাড়ি প্রানহীন, বর্বরতার মৃত্যুপুরী।
‘শরীর টা চলছেনা। এই বুঝি মাটিতে গড়িয়ে যাবে। তবুও থেমে থাকলাম না। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ঘন্টা খানিক বিরাম হীন ড্রাইভ করে একদমে গিয়ে থামলাম হসপিটালের সামনে। হন্যে হয়ে ছুটে গেলাম প্রিয়তার কেবিনে। পাগলের মতো খুজেও সেদিনের ডক্টর নার্স কাউকে খুজে পেলাম না। পেলেই বা তাদের সামনে কোন মুখে দাড়াতাম আমি? কি বা জবাব দিতাম?
মিনিট দশেক কেবিন,রিসিপশন,ওটি, ছুটাছুটি করার পর ছিপছিপে গড়নের অল্পবয়সী এক নার্সের মুখে জানতে পারলাম পৃথিবীর কঠিনতম নিষ্ঠুর সেই শব্দ। রিসিপশনের পেপারে দৃষ্টিবদ্ধ রেখেই সে শান্ত,সরল গলায় জবাব দিলো,
‘প্রিয়তা কে হসপিটালে এডমিট করার দিন রাতেই প্রিয়তা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। সে আর নেই।
প্রিয়তা আর পৃথিবীতে নেই’ এই সহজ সত্যি কথা টা যেনো কিছুতেই সহজ লাগলো না আমার কাছে। এই মুহুর্তে এই কথা টি পৃথিবীর সবচেয়ে তেতো,জঘন্য, বিশ্রী একটা শব্দ। আমি মেনে নিতে পারলাম না। নিজেকে মানাতে পারলাম না। আমার কষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কান্না আসছে না। সব টুকু শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি কান্না করতে,দু ফোটা চোখের জল ফেলতে। কিন্তু বরাবরই আমি ব্যর্থ হচ্ছি। খুব শক্ত পোক্ত ভাবেই আবারও ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরে আসলাম। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমার কিছুই হয়নি। আমি আগের মতোই সুস্থ সবল একজন মানুষ। কঠিন মানুষ। বাড়ি ফিরে সরাসরি স্টোর রুমে ঢুকে গেলাম। রুম জুড়ে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাটু গেড়ে বসে পড়লাম মেঝেতে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রিয়তার শাড়ি গুলো দু হাতে বুকে আকড়ে ধরলাম। মুহুর্তেই মনে হলো এই তো! প্রিয়তা আমার কাছে। খুব কাছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমাকে। শাড়িতে ল্যাপ্টে আছে সেই শরীরের ঘ্রান, চুলের সুভাষ। আমি চুপ করে রইলাম। শাড়ি গুলো বুকে জড়িয়ে কাটিয়ে দিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা।
হঠাৎ আমার কি হলো কে জানে। যন্ত্রনাদের ঘুম ভাঙলো।বুকের টনটনে ব্যথা জাগ্রত হলো। চোখের পলকেই সব কিছু হাহাকারে ভরে উঠলো। চাপা আর্তনাদে বুকের পাজর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগলো। আমি নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পেরে উঠছিনা। কিছু সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি হেরে গেলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। কান্না ঝরা কন্ঠ তখন একটি শব্দই আকাশ বাতাস ভারি করে তুলেছে। ইট পাথরের দেয়ালের শক্তপোক্ত বুক ফেড়ে মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়লো,
প্রিয়তা, প্রিয়তা, প্রিয়তা!
চলবে!