কুঞ্জবাড়ি,পর্ব-৪
মাহফুজা মনিরা
রাতের বেলা চন্দিকাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে নেহাল। রাতের খাওয়া দাওয়া সেড়ে চন্দ্রিকা আর নেহাল ঘুমিয়ে পড়ে। চন্দ্রিকার মা স্বরবানু জেগে ছিলেন। থালাবাসন ধুয়ে রান্নাঘরটা গুছাচ্ছিলেন এমন সময় কারো গোঙানির আওয়াজ কানে ভেসে আসে। আওয়াজ টা হচ্ছে খুব আস্তে আস্তে কিন্তু রাত আর চারপাশ একেবারে নির্জন দেখে আওয়াজ টা জোরেই শোনা যাচ্ছে….
চন্দ্রিকার মা ভ্রু কুঁচকে আসে। সে দ্রুত কাজ গুছিয়ে নিজের থাকার রুমটায় চলে আসে। চন্দ্রিকার মুখে বারবার গোঙানির শব্দ শোনা যায় কথাটা শুনতে শুনতে তার অবচেতন মনেও শুনতে পাচ্ছেন তিনি। দরজা আটকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। লাইট নিভানো কিন্তু ড্রিম লাইট জ্বলছে। মিনিট পনেরো কেটে যায়। চোখ লেগে এসেছে তার। এমন সময়ে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তার কানে এসে বাজে। কেউ হাউমাউ করে কাঁদছে। আবার চুপ। আবার গোঙাচ্ছে। আবার হাউমাউ করে কাঁদছে। কি অদ্ভুত! চন্দ্রিকার মা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন। এসব হচ্ছে টা কী? চারিদিকে চোখ বুলাতে গিয়ে বারান্দায় তার নজর এঁটে যায়। খোলা চুলে নীল শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে দাঁড়ানো৷ কে ও?
স্বরবানুর ভেতরের আত্মা কাঁপতে থাকে। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলো,
-” কে ওখানে? চন্দ্রি তুই?”
উত্তর এলো না। হঠাৎই একটা দমকা হাওয়া এলো আর মেয়েটা বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেলো যেন। স্বরবানু এবার আর ঘরে থাকতে পারেন না৷ দৌড়ে গিয়ে চন্দ্রিকা নেহালের বেডরুমের দরজায় জোরে জোরে কড়াঘাত করে। চন্দ্রিকা ঘুমালেও নেহাল জেগে ছিল অফিসের কাজের জন্য। এভাবে দরজায় শব্দ শুনে অনেকটা ভরকে যায় সে। চন্দ্রিকারও ঘুম ছুটে গেছে। উঠে বসে নেহালের গা ঘেষে। নেহাল বলল,
-” ভয় নেই। আমি দেখছি।”
নেহাল এসে দরজা খুলতেই স্বরবানু ভেতরে ঢুকে কেঁদে ফেলে।
-” বাবা,এই বাসায় কিছু একটা আছে। জ্বিনের দখলে আছে এই বাসা।”
নেহাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” মানে?”
-” আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। অনেক শব্দ পাই তখন। গোঙানোর আওয়াজ। আমি ভাবলাম হয়তো চন্দ্রিকার কথা শুনতে শুনতে আমার মাথায় এসব ঢুকে গেছে তাই শুনতেছি। পরে রুমে এসে শুইলাম। তারপর কিছুক্ষণ বাদেই শুনলাম কেউ হাউমাউ করে কাঁদছে। আবার গোঙাচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে উঠে বসি। দেখি বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে। নীল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে।”
এপর্যায়ে চন্দ্রিকা মুখ খুলে।
-” সেদিন মণিকা নামের যে মেয়েটা এসেছিল,ওর পরনেও নীল শাড়ি ছিল।”
নেহাল চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে আবার চন্দ্রিকার মার দিয়ে তাকায়। বলে,
-” তারপর?”
-” হঠাৎ বাতাস এলো। আর বাতাসে মেয়েটা মিলিয়ে গেলো। আমি স্পষ্ট দেখলাম।”
নেহাল কিছুই বলল না। ভারী টেনশন হচ্ছে তার। চন্দ্রিকার মা আসতে পারলো না আর কীসব বলছে। তবে সত্যিই কি এইবাসায় কিছু আছে? আর যদি থেকেই থাকে তবে সেটা কেনো নেহাল ফেস করছে না? নেহাল সাতেপাঁচে অংক মেলাতে পারে না। তার কেন জানি এসব কিছু মিথ্যা মনে হয়।
চন্দ্রিকার মা বলল,
-” কালকেই একটা হুজুর নিয়ে আসবে। বুঝছো?”
নেহাল মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। বাকি রাত টা চন্দ্রিকার মা আর চন্দ্রিকা খাটে ঘুমিয়ে আর নেহাল নিচে ঘুমিয়ে পার করে।
.
পরেরদিন সকাল সকাল নেহালকে উঠায় চন্দ্রিকার মা। বলে,
-” হুজুর আনবো। চলো।”
-” এত সকালে?”
-” হুম। সকালে আসাই ভালো। যে অবস্থা বাড়ির। কখন কি ঘটে যায় কে জানে!”
নেহাল উঠে ফ্রেশ হতে যায়। বাথরুম থেকে বের হয় কাচুমাচু হয়ে। প্রচন্ড পেটে ব্যথা করছে তার। চন্দ্রিকা আর চন্দ্রিকার মা ধরে ধরে তাকে বিছানায় এনে শোয়ায়। হুজুর আনতে আর যাওয়া হয়না কারোরই। সারা সকাল দুপুর তীব্র পেটে ব্যথায় নেহালের অবস্তা খারাপ। চন্দ্রিকা হাসপাতালে নিতে চাইলে নেহাল বলে,
-” কাল অফিসে ভাজাপোড়া খাওয়া পড়ছিল বেশি। বোধহয় গ্যাস্ট্রিক টা বেড়েছে। হাসপাতালে যাওয়া লাগবে না। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলেই চলবে।”
চন্দ্রিকাও তাই ভেবে আর হাসপাতাল যায়না। ওষুধ খাওয়ায়। বিকেলের আগে আগে ব্যথা সেড়ে যায়। নেহাল চন্দ্রিকা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। চন্দ্রিকা রাগী গলায় শাসায়,
-” আর কখনো যদি ভাজাপোড়া খাও তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
নেহাল বাচ্চাদের মতো করে হাসে। যার অর্থ,শত সমস্যা হলেও ভাজাপোড়া দেখলে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারেনা সে….
.
সেদিনকার মতো ব্যথা কমে গেলেও পরদিন সকালে আবারো একই ব্যথা। তবে পরেরদিন এত তীব্র হয় না। হালকা চিনচিনে ব্যথা৷ নেহাল পাত্তা দিলো না। ব্যথা নিয়েই দিব্যি অফিস করে পুরোদিন। তারপর দুদিন সুস্থ ছিল সে। কোনো ব্যথা হয়নি। এদিকে চন্দ্রিকা বা চন্দ্রিকার মাও আর কোনো কিছুর সম্মুখীন হয়নি। তাদের মন থেকেও ভয়টা কেটে গেছে। দিন যাচ্ছিল ভালোয় ভালোয়। কিন্তু কে জানতো যে সামনে কত বড় ঝড় আসতে চলেছে??
চলবে….