কায়নাত_২,পর্বঃ_৪
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান
ডাইনিং এ পৌঁছে দেখি এ তো এলাহি কান্ড! এত এত আয়োজন! অথচ টেবিলে মাত্র তিনজনের প্লেট দেওয়া। একটি চেয়ারে দাদাজান বসে আছেন। আর সামনের দুটোতে আমার আর ইবাদতের জন্য জায়গা রাখা। দেখলাম মা টেবিলের পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বলল
— এসো মা এসো! এই চেয়ারে বসো। ইবাদত কোথায়?
–জী ও আসছে।
— ওর (ইবাদতের) অনেক আগেই ক্ষুদা লেগেছিল কিন্তু খায়নি। বলছিল তোমার সাথে একসাথে খাবে।( মা)
আল্লাহ! ও এখনো কিছু খায়নি? থাকুক খালি পেটে! এটাই ওর শাস্তি। (মনে মনে আমি )
ইবাদত এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল। বসে আমাকেই দেখছে।আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। দাদাজান গলায় হাক দিয়ে বললেন
— দেখো নতুন বউ, আমাদের এখানে কিছু নিয়ম আছে যা তোমাকে মানতেই হবে, যদি এখানে থাকতে চাও। যেমন তিনতলার কোন কামরাতেই তুমি প্রবেশ করতে পারবে না। যত যাইই হোক না কেনো। কারন ওটা আমাদের জ্বীন জাতির উপাসনাগার। ঐ জায়গা তোমার জন্য হারাম। তোমাকে কি বোঝাতে পারলাম?
–জী।
— যেহেতু তুমি মানুষ আর এখানে সব জ্বীনের বসবাস সেহেতু এখানে যে কোন জ্বীনই তার আসল রুপে চলাফেরা করতে পারে। এতে ভয় পেলে চলবে না।
–জী।
— ইবাদতকে কখনো কখনো দীর্ঘ দিনের জন্য ঘর থেকে দুরে থাকতে হতে পারে । সেক্ষেত্রে ওকে বিরক্ত করা যাবে না।
–জী
— তোমাকে পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে।
–জী
— আর সব শেষ কথা তোমার মনে রাখতে হবে তুমি কোনো জ্বীন নয়। আর একটি বিষয়, কোন ঘরেই এভাবে উঁকিঝুঁকি দেওয়া যাবে না। উঁকিঝুঁকি কারীকে আমরা শাস্তি দেই। মনে থাকবে?
— জী।
— আচ্ছা আমার খাওয়া শেষ, তোমরা খেয়ে নিও। আমি এবার উঠি, আমার বিশ্রামের সময় হয়ে গিয়েছে।
বলে দাদাজান চলে গেলেন। মা এবার চেয়ারে বসলেন। বসে ইবাদতের কথা বলছে
— জানো মা ইবাদত কিন্তু বড় হয়েও আমার হাতে খাবার খেত। এই ইদানিং ওর অভ্যাসটা বদলেছে।
এইই কথা শেষ হতে না হতেই ইবাদত আমার সামনে বসে আমারই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে । এক পর্যায়ে ও টেবিলের নিচ থেকে আমার ডান হাতটা টেনে ধরলো। ও জ্বীন সেজন্য হয়তো এত দুরত্বে বসেও আমার হাত ধরতে পেরেছে। আমি ছাড়ানোর আপ্রান চেষ্টা করছি কিন্তু ছাড়াতে পারছি না। আর মা ইবাদতের কথা বলেই যাচ্ছে। ওর দুষ্টুমির কথা গুলো শুনে বোঝা যাচ্ছে কি পরিমাণ মাকে জ্বালাতো ও। যেমনটি এখন আমাকে জ্বালাচ্ছে। মা বলছে
–কি ব্যাপার কায়নাত! তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না?
— জী মা এইতো খাচ্ছি।
মাকে কি করে বোঝাব যে তার ছেলে আমার হাত ধরে রেখেছে! (মনে মনে আমি )
তারপর ইবাদত বলল
–মা কায়নাত কে বিরিয়ানি দাও। ওর কিন্তু বিরিয়ানি অনেক পছন্দ!
— তাই নাকি?তাহলে একটু দেই মা?
–জী, মা।
— খাচ্ছ না কেন মা?
— জী, খাবো। (ইবাদত আমার হাতটা ধরেই রেখেছে। আমি ইশারা করে বলছি ছাড়ো। ও মিটিমিটি হেসে ওর গাল দেখিয়ে দিচ্ছে)
মা আমাদের দেখে আন্দাজ করতে পেরেছেন যে কি ঘটনা ঘটছে। তাই তিনি দাড়িয়ে থাকা চাকরদের চলে যেতো বলল। তিনিও মুচকি হেসে বললেন
–আচ্ছা তোমরা খাও আমি একটু আসছি।
বলে চলে গেলেন। তারপর আমি বললাম
— ছাড়ো?আমাকে! দেখেছো মা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছে তুমি কি করছো। তাই লজ্জা পেয়ে চলে গেল।
–তাই, বুঝলে তো ভালই।
— তাহলে ছাড়ো!
–না! (আবারও গাল দেখিয়ে দিচ্ছে)
— কি থাপ্পড় দিবো?গাল দেখাচ্ছে কেনো বারবার?
–ইশ! বরকে কেও থাপ্পড় দেয়? আদর দিবে, আদর!
— নাহ! ছাড়ো বলছি, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমি খাবো।
–আমি খাইয়ে দিবো, তাও ছাড়বো না।
–দেখো ভালো হচ্ছে না কিন্তু!
— এর চেয়ে খারাপ হতেই পারে না! ছাড়বো না।
–ঐ যে দেখো দাদাজান এসছে,এখন ছাড়ো!
ও হতভম্ব হয়ে আমার হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো।আমি ফিক করে হেসে দৌড়ে আমার রুমে চলে আসতে চাইলাম কিন্তু সব গুলো রুম একই রকম।দৌড়ে যতই যাচ্ছি ততই সব এলোমেলো করে ফেলছি। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ অনিশার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। ও ছিটকে দেওয়ালে বারি খেয়েছে। এর মধ্যে ইবাদতও চলে এলো। আমি মেঝেতে পরে আছি আর অনিশা দেওয়াল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। ইবাদত আমাকে ধরে উঠালো এতে আমি দেখতে পেলাম অনিশার চোখে আগুন জ্বলে যাচ্ছে! সেটা দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ইবাদত বলল
–সরি অনিশা খুব বেশী লাগেনি তো?
— না ঠিক আছি তবে এভাবে দৌড়াদৌড়ি করাটা কি ঠিক? তোমারা বড় বড় দুইজন এভাবে দৌড়াচ্ছ যে কেওই তো ব্যাথা পেতে পারতো! আজ ব্যাপারটা না হয় আমার উপর দিয়ে গেলো।
–আসলে আমরা সত্যিই দুঃখিত। এটা বলে ইবাদত অনিশাকে দেখিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল যাতে ও আরো ক্ষেপে যায়। কেনো ইবাদত ওকে ক্ষেপিয়ে দিল আমি জানি না। এভাবেই ইবাদত আমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসলো। তারপর আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলছে
— আজ কিন্তু আমাদের বাসর অথচ তোমাকে ভালোভাবে একটু দেখবো সেই সময়টাও পাচ্ছি না।
–তা পাবে কোথা থেকে! এত এত পরী আশেপাশে সময় পাবে কিভাবে!
— আমি তোমাকে ছাড়া আজ পর্যন্ত কাওকেই দেখিনি।
–মিথ্যা।
— সত্য।
–তাহলে ও যে তোমাকে জড়িয়ে ধরলো? আর তুমি তো ওকে কিছুই বললে না?
— হুম, তাইতো ওর সামনেই তোমাকে কোলে তুলে নিলাম। যাতে ভবিষ্যতে ও আমার আর কাছেই না আসে! আচ্ছা তুমিতো কিছুই খাও নি। আর তোমার তো বিরিয়ানি খাওয়াও পাওনা আছে! তোমার মনে আছে? ছাদে? ঐ যে সেদিন রাতে?
— হুম।
— একটা কথা জানো?
–কি?
–আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। যেমনটা আমি তোমাকে ভেবেছি তার চেয়ে বেশী সুন্দর লাগছে তোমাকে।
বলে ও আমার একদম কাছে চলে আসলো। জানিনা আমার কেনো যেনো ওকে খুব লজ্জা হচ্ছিল। আমি চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ও হাত দিয়ে আমার চেহারায় পরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে মুখটা উচুঁ করে ধরে আমার ঠোঁটে আদরের স্পর্শ এঁকে দিল। খুব প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। তারপর আমাদের ভালোবাসা এক হয়ে গেল। সেদিন দুজন দুজনকে খুব আদর করলাম। এভাবে ভালোবাসায় আমাদের রাত কেটে সকাল হয়ে গেল।সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন ইবাদতকে পাশে না পেয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম কিন্তু ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। এভাবে সকাল গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। ওর কোনো খবর নেই। ওর এমন করার কথা না! আমাকে না জানিয়ে ও কখনো এভাবে যাবে না। আবার যেতেও পারে, যেহেতু গতকাল দাদাজান বলেছিল ইবাদত কাজের সুবাদে বাড়িতে নাও থাকতে পারে। হয়তো কোনো কাজে গিয়েছে।
কাজে গেলেও আমাকে তো বলে যেতে পারতো! নাকি সময় পায়নি! না আমিই কোনো ভুল করেছি? এভাবে কথা বলে নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছিলাম। একা একা খুব বোর লাগছিল।ইবাদতের দুষ্টুমি গুলো খুব মিস করছিলাম।। সারাটা দিন আমার এভাবেই গেল। কাওকে যে জিজ্ঞেস করবো সেই সাহসও হচ্ছিল না। এভাবে বসে বসেই গভীর রাত হয়ে গেল। কিন্তু তাও ওর কোনো খবর নেই। নিরাশ হয়ে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারবো না। সকালে কিছু একটার শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে ভাবলাম হয়তো ইবাদত এসেছে। উঠে পুরো রুম খোঁজ করলাম। পেলাম না। পরে মনে করলাম হয়তো ওয়াশরুমে আছে। তাই ওয়াশরুমের সামনে দাড়িয়ে দরজা নক করলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই।এইবার আমি ইবাদতের জন্য পাগল হয়ে গেলাম। চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে দৌড়ে ইবাদতের মার কাছে গিয়ে বললাম
–মা? কাল সারাদিন রাতে আমি ইবাদত কে দেখিনি। রাতেও ও আসেনি! ও কি কোনো কাজে গিয়েছে?
— ও বাড়িতে নেই? কোথায় গিয়েছে?
— আমাকে কিছু বলে যায়নি বা জানায়ও নি যে কোথাও যাবে। আমি ভাবলাম আপনারা হয়তো জানেন!
— না, ও মাঝে মাঝে আমাকে বলে যায়। আচ্ছা আমি দেখছি, তুমি নাস্তা করো।
–না মা, ওকে না দেখা পর্যন্ত আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না।
–দাড়াও, তাহলে তোমার শ্বশুর কে জিজ্ঞেস,সে হয়তো জানে।
কিছুক্ষণ পর মা চেহারায় চিন্তা নিয়ে এসে বলল
— না মা, সেও জানে না। তোমাকে কোনো ধারনা দিয়েছিল যে কোথাও যাবে?
–না মা। যদি আমি জানতাম তাহলে চিন্তাও করতাম না।
এর মধ্যেই পুরো প্রাসাদে একটা সোরগোল পরে গেল যে ইবাদত কে খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি চেয়ারে বসে আছি। মা আমাকে পানি খেতে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তখনই দাদাজান চিৎকার করে বলল
— নতুন বিয়ে হলো আমার নাতির আর এখন এই অবস্থা? বউ কোনো খবরই রাখে না তার স্বামী নিরুদ্বেশ? এ কেমন অলক্ষুনি কথা! কি অপয়া বউ যে প্রথম রাতেই স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছে?
কথাগুলো আমার শরীরে কাঁটার মত বিধল।শরীরটা ছারখার হয়ে গেল। নতুন জায়গায়, নতুন মানুষের ভীড়ে আপনজনকেই হারিয়ে ফেললাম। আসলেই তো ঠিকই বলল অপয়া আমি। এক রাতেই স্বামীকে খেয়ে ফেললাম। চোখ গড়িয়ে পানিতে আমার গাল ভিজে যাচ্ছে। দাদাজান অনেকক্ষন চেচিয়ে, আমাকে ইচ্ছামত গালমন্দ করে চলে গেলেন। মাও কান্না করছে। ইবাদত কোনো জায়গায় গেলে আর কেও জানুক আর না জানুক, দাদাজানের কাছে খবর থাকে। যেহেতু তিনিও কিছু জানেন না তাহলে ও কি কোনো বিপদে পড়লো?
এ জীবনে বোধহয় আমার কপালে আর সুখ নেই। উঠে আমার রুমে চলে আসলাম। কাওকে মুখ দেখানোর মত অবস্থা নেই। আমার সাথেই কেনো এমন হয়। বিছানায় বসে বসে কাঁদছি।
একটা অন্ধকার ঘরে জ্বলন্ত রশি দিয়ে হাত পা বাঁধা অবস্হায় বেহুঁশ হয়ে ইবাদত পরে আছে। পাশে একটা মেয়ে ওর মুখের দিকে শত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাকিয়ে আছে। কখন ও জেগে উঠবে আর কখন ভালোবাসার মানুষকে একটু ছুঁয়ে দেখবে। আর তার পাশেই পেঁচিয়ে আছে একটা বৃহদাকার সাপ।
(চলবে)