কাগজের_তুমি_আমি
১২তম_পর্ব শেষ
অনলকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার ধারাই ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে মাহি বলে উঠে,
– ফাইনালি তুমি ফোনটা রিসিভ করলে, প্লিজ অনল আমাকে আমার কথাটা রাখার একটা সুযোগ দাও। আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু দেখো আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি। আর তুমিও এমন একতা রিলেশনে আছো যার কোনো ভিত্তি নেই। আমিও উইলিয়ামের সাথে ডিভোর্সড। তাহলে কেননা আমাদের সম্পর্কটাকে পুনরায় শুরু করা যাক!
– আপু আমি অনল নই, আমি ওর স্ত্রী ধারা।
– তুমি ওর ফোন কেনো ধরেছো? অনল কোথায়?
– অনল আপনার ফোন ধরতে ইচ্ছুক নয় বিধায় ফোনটা আমি ধরেছি। আপনার যদি কোনো কথা থাকে আপনি আমাকে বলতে পারেন।
– আমি যতটুকু জানি তোমার সাথে অনলের সম্পর্কটা ভালো নয়। দেখো অনল আর আমার সম্পর্কটা এখনের নয়, আমি জানি এখনো ও আমাকেই ভালোবাসে। তাই অহেতুক আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে থেকো না
– আপনার বলা শেষ? এবার আমি কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবেন।
– কি বলবে তুমি?
– বয়সে তোমার থেকে অনেক ছোট তাও তোমাকে একটা উপদেশ দেই। একবার যা কোনো জিনিস ভেঙ্গে গেলে তা আর জোড়া লাগে না। সম্পর্কগুলো ঠিক সেরকম। তোমার আর অনলের সম্পর্কটা সাত বছর আগেই ভেঙে গেছে। সেটা তুমি নিজে ভেঙেছো, যখন ওর তোমাকে দরকার ছিলো তুমি নিজেকে ব্যস্ত ছিলে। আজ সাত বছর পর সেই সম্পর্কের দোহায় দিলে সত্যি না হাস্যকর শুনায়। আমি বলি কি চলে তো গিয়েছো এবার অনলের পেছন একেবারেই ছেড়ে দাও। জানো তো আমি কিন্তু গ্রামের মেয়ে, ডানপিটে এখনো যায় নি আমার। কখন কি করে ফেলবো তার ঠিক নেই। রাখছি।
ফোনটা কেটে রাখতে যাবে তখনই পেছন থেকে অনল তাকে জড়িয়ে ধরলো। অনলের এভাবে হুট করে জরিয়ে ধরাটা ধারাকে বেশ অবাক করলো। কৌতুহল বশত ই জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে? অফিস যাবে না?
ধারার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে উত্তর দিলো,
– আমার ডানপিটে বউটাকে আজ আদর করতে মন চাইছে।
– তাই বুঝি? হয়েছে ছাড়ো এবার। রেডি হই, স্কুলে যেতে হবে তো।
– ম্যাডাম, কাল শুক্রবার
– তো?
– উফফফ চল না কোথাও ঘুরে আসি আজকে।
– কোথায় যাবে?
– আমার খুব ইচ্ছে তোকে নিয়ে বিকেলবেলা অন্যান্য কাপলদের মতো ঘুরতে যাওয়া।
– ঠিক আছে তাহলে কাল বিকেলে বের হওয়া যাক। কোথায় নিয়ে যাবে আমায়।
– কালকে আমরা রমনা পার্কে যাবো, সিনেমা দেখবো, আইসক্রিম খাবো। সব করবো যা নরমাল প্রেমিক প্রেমিকারা করে
– আমরা স্বামী-স্ত্রী। প্রেমিক-প্রেমিকা নই।
– তো কি হয়েছে? একদিন হতে তো সমস্যা নেই।
– তা নেই হওয়াই যায়।
তখন ধারার ফোনটা বেজে উঠে, ফোন স্ক্রিনে দিগন্তের নাম দেখে অনল ফোনটা লাউডস্পিকারে দিয়ে ধারার হাতে দেয়। অনলকে দেখেই ধারার বুঝতে বাকি নেই সে ক্ষেপে গেছে। ধারা আমতা আমতা করে বলে,
– হ্যালো
– হ্যালো ধারা, কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?
– আমিও ভালোই আছি। আচ্ছা অনলের সাথে মিটমাট হয়েছে?
– জ্বী ভাইয়া, সব ঠিক হয়ে গেছে।
– বেশ তাহলে আজ কিন্তু অবশ্যই ওকে আসতে বলো। আমরা সবাই অনলের সাথে পরিচিত হবার আশায় আছি। তোমার এতোদিনের লুকায়িত বরটি যে আসলে অনল, এটা জানার পর থেকে আমার ওর সাথে দেখা করার ইচ্ছে আরো বেড়ে গেছে। সেদিন খুব সময়ের জন্য দেখা হয়েছিলো। ঠিক মত কথাও হয় নি।
– আচ্ছা ভাইয়া আমি ওকে বলবো আসতে।
– আচ্ছা, রাখি তবে।
– জ্বী ভাইয়া।
ফোনটা কাটার পর থেকে অনল অবাক চোখে ধারার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অনলের কৌতুহলী চেহারা দেখার পর ধারা প্রশ্ন করে,
– কি দেখছো এভাবে?
– দিগন্ত জানে আমার কথা?
– হুম, জানবে না কেনো?
– কবে বলেছিলি ওকে?
– এইতো পরসুদিন। আসলে সেদিন ভালোভাবে কথা কোথায় বলতে দিয়েছিলে তুমি। পরসুদিন কথায় কথায় তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে তোমার পরিচয় ক্লিয়ার করে দিয়েছি।
– ওরে তোর পেটে পেটে এতো শয়তানি? আমি কোথায় ভাবছি এই ছেলেটা না তোকে লাইন মারছে।
– দিগন্ত ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আসছে আমার পেছনে লাইন মারতে। এখন স্কুলে যাবো তো
– আচ্ছা কাল কিন্তু বিকেল ৪টা মনে থাকে যেনো।
– আচ্ছা মনে থাকবে।
পরদিন,
বিকেল ৪টা,
গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছে অনল, অপেক্ষা কখন ধারা আসবে। বাড়ির গেটের দিকে চোখ যেতেই খেয়াল করলো ধারা আসছে। রুনঝুন নুপুরের আওয়াজ ধীরে ধীরে গাঢ়ো হচ্ছে, পরণে তার সাদা শাড়ি। দুধে আলতা গায়ের সাথে শাড়িটা লেগে আছে। অনল নেশাকাতর চোখে ধারার দিকে চেয়ে আছে, পলক পড়ছে না তার। অনলের চাহনী দেখে ধারার লজ্জায় গাল লাল বেগুনী হচ্ছিলো। আর না পেরে ধারা তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? যাবে না?
– আজ আমাকে একেবারে পাগল করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিস দেখছি।
– হয়েছে চলো এবার।
– অগত্যা, আজ নেশাখোরের মতোই গাড়ি চালাতে হবে।
– কেনো?
– জ্বলজ্যান্ত নেশার খনি যে আমার পাশে বসবে।
– ধুর! চলো।
বলে তাড়াতাড়ি গাড়িতে বসে ধারা। অনল হাসতে হাসতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে। আপন মনে গাড়ি চলছে। ধারা শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে অনলকেই দেখে যাচ্ছে। কালো শার্ট এবং কালো জিন্সে খুব সুন্দর লাগছে তার বরকে। হাতাটা কনুই অবধি বটে রেখেছে, চুলগুলো কপালে পড়ে রয়েছে। আচ্ছা কোনো পুরুষ বুঝি এতো মাতালকরা সুন্দর হয়! হয় তার স্বামীটি এতোটাই সুন্দর। গাড়ি চালাতে চালাতেই অনল মুচকি হেসে বলে,
– এভাবে দেখতে থাকলে কিন্তু আমার নিজেরই লজ্জা লাগবে
– ক…কে দেখছে তোমাকে? গাড়ি চালাও তো
লজ্জায় তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয় ধারা। অনল মুচকি হেসে গাড়ি চালানোতে মন দেয়। শেষ বিকেলের দিকে রমনা পার্কে গিয়ে পৌছায় তারা। আজ মনে হচ্ছিলো এক জোড়া কিশোর কিশোরী তাদের নতুন নতুন প্রেমের সুবাধে ঘুরতে এসেছে। সারা পার্ক হাত ধরে তারা হেটেছে। একটা সময় বাদাম খাওয়ার জিদ করলে অনলকে দৌড়ে গিয়ে তার জন্য বাদাম কিনে আনতে হয়। ধারার ঠোঁটে হাসি যেনো ধরছিলো না। আজ অন্যরকম সুখ ছিলো তার মনে। এতোদিন পর নিজের স্বামীকে নিজের করে পেয়েছিলো সে। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর আইসক্রিম কিনে গাড়িতে উঠে অনল এবং ধারা। গাড়ি চালাতে চালাতে শুধু ধারার দিকে চোখ যাচ্ছিলো অনলের। ধারা তখন পুরো বাচ্চাদের মতো আইসক্রিম খাচ্ছিলো। ধারার বাচ্চামি দেখে অনল বলে উঠে,
– ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।
– আমাকে না দেখে গাড়ি চালাও
অনল ধারার থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তায় চোখ দেয়। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে একটা ট্রাক ব্রেক সামলাতে না পেরে এসে অনলের গাড়িটিকে এতো জোরে ধাক্কা দেয় যে অনল চেয়েও গাড়িটি ব্যালেন্স করতে পারে না। ট্রাকটির ধাক্কায় গাড়িটি নিমেষেই উল্টাতে থাকে। গাড়ির কাঁচগুলো ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। নিমেষেই ধারা এবং অনলের চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যায়।
১০মাস পর,
স্থানঃ রমনা পার্ক
একটা কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে রয়েছে অনল এবং ধারা। সামনে কিছু ছোট ছেলেদের দল খেলছে। পড়ন্ত সূর্যের লাল আলোতে ধারার হাত ধরে পাশে বসে বাচ্চাদের খেলার দৃশ্যটি দেখতে খুব ভালো লাগছে অনলের। এই সময়টা পার্কে জনবল বেশি একটা থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে এই সময়ে পার্কে বসে থাকতে বেশ লাগে অনলের। পড়ন্ত সূর্যের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে কোমল কন্ঠে বলে,
– আমার কাধে একটু মাথা রাখবি ধারা?
ধারা মুচকি হেসে অনলের কাধে মাথা রেখে বলে,
– তুমি প্রতিদিন এই বাচ্চাদের এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখো?
– একটা অজানা শান্তি দেয় জানিস তো! ছোটো ছোটো বাচ্চাদের হাসি, চঞ্চলতার মাঝে অন্যরকম আনন্দ আছে। ওদের কলরবের মাঝে আমি তোকে খুজি।
– আমি হয়তো তোমাকে সে সুখটা কোনোদিন দিতে পারবো না গো
– সব সুখ সবার কপালে থাকে না, ভাগ্যটা যে খুব পাষন্ড রে।
হঠাৎ একটা ছোট্ট মেয়ে এসে অনলের হাত ঝাকিয়ে বলে,
– ভাইজান আজকেও আপনি একা একা কথা কইতেছেন?
– একা কইরে আমার ধারা যে আমার সাথেই আছে।
– কই পাশে তো কেউ নাই। ধারা ভাবী কই?
বলে অনলের পাশে মেয়েটি বসতেই ধারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। সেদিন এক্সিডেন্টে ধারাদের গাড়িটাকে ট্রাকটি সম্পূর্ণ পিসিয়ে ফেলেছিলো। ঘটনাস্থলে মানুষ পৌছাতে পৌছাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। ধারা এবং অনলকে হসপিটালে নেওয়ার আগেই ধারা এম্বুলেন্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। অনলের অবস্থাও খুব খারাপ ছিলো, কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়। ১০ দিন পর যখন আই.সি.ইউ থেকে অনলকে বের করা হয় তখন ধারার মৃত্যুর খবর তাকে দেওয়া হয়। ধারার লাশটুকু দেখার ভাগ্য হয় নি অনলের। ধারার মৃত্যুটাকে একদম ই মেনে নিতে পারে নি অনল। পাগল্প্রায় হয়ে কেঁদেছিলো সে সেদিন। এক্সিডেন্টের জন্য মাথায় বেশ চোট পেয়েছিলো অনল। যার কারণে তার vascular dementia হয় যেখানে তার ব্রেইন বাস্তব অবাস্তবের ভেতর পার্থক্য করতে পারছে না। ধারার মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতাকে মানতে না পেরে অটোমেটিক অনলের ব্রেইন ধারাকে হেলুসিনেট করতে থাকে। সুভাসিনী বেগম বারবার অনলকে চিকিৎসা করাতে বলেন, এই রোগের চিকিৎসা না করালে এক না এক সময় পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবে নয়তো মৃত্যুও ঘটতে পারে তার। কিন্তু অনল এক কথা মানা করে দিয়েছে, তার কথা চিকিৎসা করালে ধারাকে আর হ্যালুসিনেট করতে পারবে না। তার ধারণা ধারা শারীরিকভাবে তার সাথে না থাকলেও এই রোগের জন্য সে তাকে দেখতে পাচ্ছে। আর এভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবে সে, এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,
– খুব পাপী মানুষ কিনা আমি তাই আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন আল্লাহ ওকে। ভালো মানুষদের আল্লাহ পৃথিবীতে বেশি দিন রাখেন না বুঝলি। পৃথিবীর কেউ ওকে দেখতে পারবে না। খুব সুন্দর একটা জায়গায় ও ঘুমিয়ে আছে।
– তাইলে যে কইলেন আপনার সাথেই আছে ধারা ভাবী?
– আছে তো, আমার কল্পনায়, আমার মনে সবসময় ও আছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই ওকে দেখতে পাই। যখন কথা বলতে মন চায় বলি। তোর মাথায় ঢুকবে না এটা।
– আজকে বেলি ফুলের মালা নিবেন না?
– আমি কি কখনো নিতে ভুল করি? না নিলে খুব রাগ করবে ও।
বলে প্রতিবারের মতো একটা ১০০ টাকার নোট মেয়েটির হাতে ধরিয়ে একটা মালা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সূর্য ডুবে গেছে, এখনো লাল আভা রয়েছে গেছে আকাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে অনল। মনে মনে একটা কবিতা আওড়ে যাচ্ছে,
“এসেছিলে নীল ভালোবাসা নিয়ে
বেরঙ এক প্রেমীর জীবনে
শেষ বিকালের কোনো এক প্রহরে
লাল সূর্যের স্নিগ্ধ রশ্নির ন্যায়
আলোকিত করেছিলে
নিস্তব্ধ নগরী আমারই অগোচরে
নীল প্রেমের বেদনা দিয়ে
চলেই যখন যাবে
ক্ষনিকের জন্য কেনো এলে তবে
হয়তো একদিন নিষ্ঠুর ভাগ্যকে হারাবে
ক্ষুদ্ধ পরাজিত সেই প্রেমী
সেদিন মিলেমিশে একাকার
হয়ে যাবে কাগজের তুমি আমি____”
।।সমাপ্ত।।
[ আজ গল্পটির সমাপ্তি টানলাম, আশা করি এভাবেই আমার সাথে থাকবেন। গল্পটি কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাতে ভুলবেন না।]
মুশফিকা রহমান মৈথি