কাগজের_তুমি_আমি
১১তম_পর্ব
মুচকি হেসে হাত বাঁড়িয়ে দিতেই হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো অনল ধারাকে। দু হাত দিয়ে আলতো হাতে ধারার লজ্জায় লাল হওয়া মুখটা খানিকটা উঁচু করে। অনলের নিঃশ্বাস ধারার মুখোমন্ডলে ছিটকে পড়ছে। ধারার চোখ তখন অনলের চোখজোড়ায় স্থির। সেই চোখ আজ ভালোবাসার নেশায় টুইটুম্বুর। যে নেশা ধারাকে ভাসিয়ে নিতেও সক্ষম। অনল ধীরে ধীরে ধারার পাতলা ঠোঁটজোড়াকে নিজের আয়ত্তে করে নিলো। অজানা আবেশেই চোখ বন্ধ হয়ে গেলো ধারার, এ যেনো অন্যরকম নেশা, অন্যরকম অনুভূতি। ধারার ভেতরে উথাল পাথাল করে দিচ্ছিলো এই অনুভুতিগুলো। এক নিমিষেই রক্তগুলো শিরদাড়া বেয়ে উষ্ণ পরশ দিচ্ছিলো। চোখ থেকে অজান্তেই অশ্রুধারা বয়ে যাচ্ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর ধারা থেকে একটু দূরে গিয়ে ধারালো অনল। দুষ্ঠু হাসি দিয়ে বললো,
– বাকিটুকু তোলা থাক যেদিন তুই নিজ থেকে আমাকে সেই অধিকার দিবি সেদিনের জন্য।
আস্তে করে ডিঙ্গি নৌকায় ধরে বসালো ধারাকে। নৌকাটায় শুধু ধারার আর অনল ব্যতীত আর কেউ ছিলো না। তাই সংকিত গলায় ধারা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
– নৌকাটা কে চালাবে? মাঝি কই?
– আজ আমার প্রেমেতরীতে তোকে তুলেছি অবশ্যই মাঝি আমি
– এ বাবা? ডুবে গেলে?
– সাঁতার তো পারিস ই, নৌকা উলটালেও সমস্যা নেই। আর আমি তোকে ডুবতে দিবো না।
– তুমি জানো কিভাবে নৌকা চালাতে হয়?
– জানবো না কেনো? এই তিনদিন কি ঘাস কাটছি নাকি!
– তুমি তিনদিন ধরে এটার প্রস্তুতি নিছো?
– তা কি বলতে? ভেবেছিলাম প্রথম রাতেই তোকে নিয়ে বের হবো। পরে ভাবলাম আগে নৌকা চালানোটা শিখে নেই, তারপর একেবারে তোকে চমকে দিবো।
ধারার সামনে এখন যে অনল রয়েছে তাকে বড্ড অচেনা লাগছে ধারার। এতো অন্য মানুষ, যে কিনা তার সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে ধারার বেরঙ জীবনটাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। এতোটাও ভালো কেউ বাসতে পারে জানা ছিলো না ধারার। নৌকা চলছে আপন গতিতে, একটা ঝিলের মতো জায়গায় এসে অনল নৌকা বাওয়া থামালো। আশেপাশের মাঠ গুলো এখনো পানির নিচে। যতদূর চোখ যাচ্ছে কেবল ই পানি আর পানি। আর মাথার উপর স্বচ্ছ নীল আকাশ আর মস্ত বড় চাঁদ। চাঁদের আলোতেই পরিবেশটা মনোরোম হয়ে আছে। খুব সাবধানে এসে ধারার পাশে গিয়ে বসে অনল। ধারার হাতটা নিজের হাতের উপর রেখে বলে,
– একদিন এই হাতজোড়াকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি এতোগুলো বছর তোকে অনেক কাঁদিয়েছি। জানি না সেই কষ্টগুলোর কোনো ক্ষমা হয় কিনা। হয়তো না, আমি বলবো না আমাকে ক্ষমা করে দে, বলবো না সব ভুলে যা। শুধু এটুকু বলবো বড্ড বেশি ভালোবাসি তোকে; আমাকে একা করে দিস না কখনো। আমার রক্তে মিশে আছিস তুই, তোকে ছাড়া এক মূহুর্তের কথা ভাবতে ভয় লাগে।
– সারাজীবন এভাবে ভালোবাসবে তো আমাকে?
– শেষ নিঃশ্বাস অবধি; কথা দিচ্ছি। তোকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি ভালোবেসে যাবো।
– তবে আজ আবার বলছি, ভালোবাসি তোমাকে
ধারার কথাশুনে অনলের চোখ চিকচিক করছে, হয়তো এখনই অশ্রুগুলো চোখজোড়াকে মুক্তি দিবে। পরম আদরে ধারার কপালে উষ্ণ পরশ দিলো অনল। আজ সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েছে। এটা যে তার সর্বোচ্চ পাওয়া। আজকের জ্যোৎস্না সাক্ষ্ণী দিচ্ছে তাদের ভালোবাসার পূর্ণতার। পরম যত্নে ধারার পায়ে হাত দিতেই ধারা খানিকটা কেঁপে উঠলো।
– কি করছো?
– আগে তো সারাদিন নুপুর পড়ে থাকতি পায়ে, তোর নুপুরের আওয়াজে ঘর মম করতো। এখন পা খালি থাকে যে?
– জানো না কেনো পরি না? রাগের মাথায় নুপুরগুলো ভেঙে ফেলেছিলে যে!
– এগুলোর কথা বলছিস?
ধারা খেয়াল করলো পকেট থেকে একটা বাক্স অনল বের করেছে। বাক্সের মুখটা খুলতেই ধারার বিষ্ময় উচ্চ শীখরে পৌছায়। অবাক চোখে অনলের মুখ পানে চেয়ে থাকে সে। অনল পরম যত্নে ধারার পায়ে নুপুর গুলো পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
– রাগে মাথায় এগুলো ভেঙে ফেলেছিলাম, পরেরদিন অবশ্য ঠিক করে এনেছিলাম কিন্তু দিতে ইচ্ছে হয় নি। পাঁচ বছর কেটে গেছে; নুপুরগুলো আমার কাছেই গচ্ছিত ছিলো। এই পাঁচটা বছর যখন তোর কথা মনে পড়তো এগুলোকে দেখতাম। এই কয়দিনে দেওয়ার কথা ভাবি নি তা নয়। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আজ নুপুরগুলো তার মালিকের কাছে ফেরত গেলো।
– হয়তো তখন দিলে আমাদের এতোদিন নষ্ট হতো না!
– হয়তো। একটা আবদার করবো রাখবি?
– এতোক্ষণ তবে কি করছিলে?
– হাহাহা, আমাদের কাধে মাথাটা রাখবি? আমার হাতে হাত রেখে জ্যোৎস্না দেখবি?
ধারা কোনো উত্তর না দিয়েই মাথাটা অনলের কাধে রাখলো। একটা মিষ্টি মাতালকরা গন্ধ অনলের নাকে লাগলো, ওর বুঝতে বাকি রইলো না এটা ধারার চুলের মিষ্টি সুভাস। অনল ডান হাতটি দিয়ে ধারার কোমড় চেপে ধরলো, বা হাতে ধারার হাতটি পরম যত্নে ধরলো। অনল এবং ধারার কাছে মনে হচ্ছিলো, যাক না থেমে সময়টা। এভাবে কত সময় কেটে গেলো, তাদের কারোর ই খেয়াল নেই। আজ নাহয় তাদের ভালোবাসার মূহুর্তগুলো সময়কে হার মানাক, দু হাতে সুখ কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ুক দুজন মানব মানবী। ক্ষতি কি!
রাত ৩টা,
ঘাটলার দিকে নৌকা ভিড়ায় অনল। আজকের রাত জীবনে শ্রেষ্ঠ রাতের একটি ছিলো অনল ধারার কাছে। কোনো অভিমান, মনোমালিন্যের ছাপ ছিলো না আজ রাতে। শুধু ভালোবাসার কিছু মূহুর্ত ছিলো। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাড়ি ছেড়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়লো ধারা। গায়ের পাঞ্জাবীটা খুলে টিশার্ট আর শর্টস পড়ে নিলো অনল। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসেই দেখলো ধারা শুয়ে পড়েছে। গ্রামে আসার পর থেকে একই রুমে থাকলেও এক বিছানাতে তারা থাকে নি। ধারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলো অনলের সাথে বেড শেয়ার সে করবে না। নিচে শোয়ার জন্য ধারা জেদ করাতে অনল তাকে বারণ করে। ঘরে কোনো সোফা বা কোনো অন্য শোয়ার ব্যবস্থা না থাকায় অনল নিচে মাদুর পেতে শুয়েছে। তাই আজও কিছু না বলে প্রতিদিনের মতো বালিশটা নিয়ে নিচে মাদুর বিছাতে গেলেই ধারা জিজ্ঞেস করে,
– কি করছো? মাদুর পাতছো কেনো?
– তুই তো বলেছিলে যদি এক রুমে থাকলেও এক বিছানায় তুই আমার সাথে থাকবি না।
– হয়েছে, আর নিচে শুতে হবে না। উপরে আসো, আমিতো তোমার জন্য জায়গা রেখেই শুয়েছি। আসো
অনলের কানে যেনো বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনের মাঝে এক অজানা খুশি বয়ে যাচ্ছিলো অনলের। মাদুরটা রেখে ধারার পাশে শুয়ে পড়লো। একই বিছানায় আবার পাঁচ বছর পর, ইচ্ছে করছে আবার ধারাতে মিশে যেতে। কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা বাধা যেনো রয়েই গেছে। লোকে সত্যি বলে একবার কোনো সম্পর্কে ফাঁটল ধরলে সেটা সারানো সত্যি কষ্টকর। যেমনটা ঘটছে অনল এবং ধারার মাঝে। কোথাও না কোথাও ধারার দিকে এগুতে গেলে পাঁচ বছর আগের অনলের বিভৎস কাজের কালো স্মৃতিগুলো মনে ভাসছে। তখন আপনাআপনি নিজেকে ধারা থেকে সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে অনলের। ধারা তখন অনলের পিঠ করে অপর পাশে মুখ করে শুয়ে ছিলো। একটা সময় আর না পেরে, সে পেছন থেকেই ধারাকে জরিয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ধারা খেয়াল করলো অনল তাকে পেছন থেকে জরিয়ে কাধে মুখ ডুবিয়ে আছে। অনলের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ধারার ভেতরটাও পুড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো তপ্ত নোনাজল ধারার গলা বেয়ে পড়ছে। প্রথমে অবাক হলেও খেয়াল করলো লোকটা কাঁদছে। এবার আর নিজেকে আটকাতে না পেরে অনলের দিকে ফিরে ধারা।
– কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?
– তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম, কিভাবে পারলি এই জানোয়ারটাকে এতো ভালোবাসতে?
– সত্যি বলি? জানি না। আমি সত্যি জানি না।
– অনুতাপেরা খুব পাষন্ড জানিস তো। কুড়ে কুড়ে খায় এই অনুতাপগুলো। আমি এতো অন্যায় করার পর ও এ বাড়ির কাউকে কিচ্ছু জানাস নি কেন?
– এমনি, দরকার পড়ে নি তাই। ভেবেছিলাম যদি ডিভোর্স ফাইনাল হয়ে যায় তবেই জানাবো। খামোখা তাদের সামনে তোমার সম্মানটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় নি।
– এখানে আসার পর থেকে আমার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে রয়েছিলো। খুব অনুতাপ হচ্ছিলো জানিস যখন মামীমা আমাকে এতো আদর আপ্পায়ন করছিলো।
– পুরোনো কথা মনে করে কি হবে বলো? এখন তো আবার নতুন করে নিজেদের সুযোগ দেয়ার বেলা। পুরোনো কথা মনে করলে শুধুমাত্র কষ্টই পেতে হবে। বাদ দেও।
– তোকে মিশিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– আমি কি বাধা দিয়েছি?
– উহু
বলেই পরম যত্নে ধারাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো অনল। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। দুজন দুজনাতে মিশে কখন যে ঘুমের অতল সাগরে ডুবে গেলো খেয়াল ই ছিলো না।
তিনদিন পর,
সকাল ৮টা,
রান্নাঘরে নাস্তার আয়োজন করছে ধারা। গ্রাম থেকে ফিরেছে দুদিন হয়েছে। ভাঙা সম্পর্কটা জোড়া তো লেগেছে কিন্তু কোথাও যেনো একটা ফাকা জায়গা ধারার অনুভূতি হচ্ছে। সব ঠিক থাকলেও অন্যান্য সম্পর্কের ন্যায় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠে নি তাদের। হয়তো সময়ের সাথে সাথে সেটাও ঠিক হয়ে যাবে। নাস্তার টেবিলে সুভাসিনী বেগম এবং অনলের আগমণ ঘটলে ধারার চিন্তার ভেদ ঘটে। নাস্তা সেরে অনল নিজের রুমে যায়। সব গুছিয়ে ধারাও স্কুলের জন্য রেডি হতে অনলের রুমে যায়। রুমে এসে আলমারি খুলতে নিলে ধারা শুনতে পায় অনলের ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আবার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো অনলের। অনলের মুখ দেখে খুব শান্ত ভাবেই ধারা বলে,
– মাহি আপু, এতোদিন যাবৎ তোমাকে ফোন দিচ্ছে। ধরছো না কেনো?
ধারার এমন প্রশ্নে অনলের বিষ্ময়ের সীমা থাকে না। অনলকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার ধারাই ফোনটা রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই……………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি