কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়,১৫তম_পর্ব,১৬তম_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৫তম_পর্ব
অনল বেকুবের মতো শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনটা যেন হাহাকার শুরু করে দিলো অনলের। কিন্তু ভালোবাসা নামক অনুভুতিকে সে স্বীকার করতে নারাজ। হয়তো অনন্যার সাথে পথচলাটা এতোটুকুই ছিলো। তখন তড়িৎগতিতে অনন্যা পেছনে ফিরে আসে এবং ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দেয় অনলের। ঘটনার আকর্ষিকতায় হতচকিত হয়ে যায় অনল। কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠার আগেই অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করে ফোস ফোস করতে করতে অনন্যা বলে,
– কাওয়ার্ড কোথাকার, দুই মাস কাজ কাম বাদ দিয়ে আমার পেছনে ঘুরতে পারছিস আর বিয়ে করার বেলায় চুপ করে মাথা নিচু করে আছিস। যদি ভালোই না বাসিস তবে কেনো আমার পেছনে এই দুইটা মাস ঘুর ঘুর করছিস। সকাল নেই সন্ধ্যা নেই আমি চোখের সামনে শুধু তোকেই দেখেছি। অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোকে। দুররর! এখন আমি তোকে বাদে কাউকে চিন্তাও করতে পারি না। বেয়াদব কোথাকার, কাপুরুষ। শুনে রাখ কান খুলে বিয়ে তো তোকে আমাকেই করতে হবে। তুই ভালোবাসিস কি না তাতে আমার কিছুই যায় না। বুঝছিস?
আঙুল শাসিয়ে ভাঙ্গা কন্ঠে কথাগুলো বলে অনন্যা। অনল এখনো হা করে ওর কথাই শুনে যাচ্ছে। কি বলবে না বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ খেয়াল করলো অনন্যা কিছু খুজছে। অবাক কন্ঠে তখন জিজ্ঞেস করে,
– কি খুজছো তুমি?
– পাথর, আমার মাথা ফাটাবো। এতোক্ষণ একটা মেয়ে তোর সামনে প্রেম প্রস্তাব দিচ্ছে আর তুই এখনো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। এখন একটু সাহস করে মনের কথাটাও বলতে পারিস। তোর মতো ছেলেকে কিভাবে আমি পছন্দ করছি, আল্লাহ। এক কাজ কর তুই তোর মতো থাক, দাঁড়িয়ে থাক। গাধা কোথাকার।
বলতে বলতেই গলা ধরে আসে অনন্যার। অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো অনন্যার। অনন্যার চোখের পানি কোথাও না কোথাও অনলের ভেতরটাকে অস্থির করে তুললো। বুকের অস্থিরতা তাকে পাগল করে তুলছে। চোখের পানিটা অগোচরেই মুখে পেছনে ফিরে হাটা দিতে নিলেই অনল পেছন থেকে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে। অনলের আলিঙ্গনে অনন্যার পা আটকে যায়। অনলের স্পর্শে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো শক্ত হয়ে যায় অনন্যা। হৃদস্পন্দন তীব্রগতিতে বেড়ে যায় তার। অনল ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করে,
– এতোক্ষণ যা বলার বলেছো, এখন আমি বলবো তুমি শুনবে। বলবো না আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ ভালোবাসা নামক বস্তুতে আমার বিশ্বাস নেই। তবে আমার তোমাকে চাই, প্রতি মূহুর্তে, প্রতিটা ক্ষণ। তোমাকে একটা দিন না দেখলে আমার বুকে হাহাকার হয়। সব কাজের মধ্যে তোমার মুখখানা আমার দেখা লাগাই। তোমাকে না দেখলে রাতে ঘুম আসে না। ছটপট করতে থাকি। একটু আগে যখন তুমি চলে যাচ্ছিলো বুকের ভেতর যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। তোমার হাতের মার খেয়েও আমার রাগ উঠে নি, অন্য কেউ হলে তো সেখানেই পুতে ফেলতাম। তোমার চোখের পানি দেখে আমার ভেতর অজানা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এগুলো যদি ভালোবাসা হয় তবে তাই। আমি অন্য ছেলেদের মতো বলবো না তোমাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসি, বলবো না তোমাকে বাদে মরে যাবো, বলবো না তোমার জন্য সব করতে পারি; শুধু একটা কথা বলবো আমার জীবনে তুমি ই প্রথম নারী, হয়তো শেষ নারীও তুমি, তোমার চোখে কখনো দুঃখের ছায়াও ভিড়তে দিবো না। তুমি যখন বলবে তোমাকে বিয়ে করতে আমি রাজি, শুধু একটা কথা যদি কখনো আমার উপর তোমার বিরক্ত হয়ে যাও আমাকে বলে দিও কিন্তু আমাকে চিট করো না। আমি নিতে পারবো না।
অনলের সহজ উক্তির পর অনন্যার বলার কিছুই থাকে না। যা জানতে চেয়েছে সব কিছুর উত্তর তার কথায় নিহীত। ভালোবাসি না বলেই শুরু হয় অনল-অনন্যার ভালোবাসা। কিন্তু এই ভালোবাসার গভীরত্ব এতোটা ছিলো যে কখনোই ভালোবাসি বলতে হয় নি অনলের। অনলের চোখজোড়ার স্বচ্ছতায় নিজের জন্য পাহার সমান ভালোবাসা খুজে নিতো অনন্যা। সময় যেতে থাকে তাদের সম্পর্কের গভীরত্ব বাড়তে থাকে। তাদের সম্পর্কের শুরু যে জায়গা থেকে হয় সেই জায়গাটাই তাদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠে। অনল তার মনের চাপা কষ্টের জানালা অনন্যার কাছে খুলতে থাকে। তার বাবার ছেড়ে যাওয়ার ক্ষতটা অনন্যার হাসির মলমে ভরতে থাকে। অনলের ইন্টার্ণশীপের সময় শেষের দিকে ঘনিয়ে আসে। অনন্যাকে সুভাসিনী বেগমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় অনল। দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়েও ঠিক হয়। তারপর ছোট করে তাদের আকত ও হয়ে যায়। অনলের চাকরির পর মেয়ে তুলে নিবে এই কথাই হয়। দু-দুজনে বেশ সুখী ছিলো কিন্তু ভাগ্যের উপর কারোর হাত থাকে না। আল্লাহ যার জন্য যা লিখে রেখেছেন সেটা হতে বাধ্য। অনন্যার প্রায় কলার বোনের সাইডে ব্যাথা হতো। অসম্ভব ব্যাথা কিন্তু মামীর ভয়ে সে কাউকে বলতো না। একটা সময় ব্যাথাটাকে সহ্য করতে থাকে। রাতে যখন ব্যাথাটা উঠতো গরম ভাব দিয়ে নিজেকে সামলাতো। অনন্যা মামা-মামীকে এব্যাপারে কোনোদিন জানায় নি। তাদের কাছে থাকে বলে তার প্রতিটা সময় খোটা খেতে হয়। এখন তার হাড়ে ব্যাথা কথাটা জানলে আরো কথা শুনতে হবে। আর অনন্যার কাছে এতোটা টাকাও নেই যে সে চিকিৎসা করতে পারবে। কিন্তু হাড়ের ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু তাতে লাভের লাভ হয় নি। অনলকে বলছে না ও চিন্তা করবে বলে। ছেলেটা তার সাথে থাকলে অন্যরকম থাকে, এখন তার সামান্য ব্যাপারে তাকে বিরক্ত করতে চায় না অনন্যা। দেখতে দেখতে অনন্যাকে উঠিয়ে নেবার সময় চলে আসে। ধুম ধাম করে নিজের কাছে নিয়ে আসবে অনল। অনল এবং অনন্যার সম্মতিতে আবারো তাদের বিয়ের আয়োজন হয়।
সকাল ১১টা,
অনন্যা তখন অনলের সাথে দেখা করার জন্য রেডি হচ্ছিলো। আজ শপিং এ যাওয়ার কথা সুভাসিনী বেগমদের সাথে। হঠাৎ কলার বোনের ব্যাথাটা তীব্র হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে তা বাম হাতেও ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। কয়েকদিন ধরে ব্যাথাটা তীব্র রুপ নিয়েছে। যখন ব্যাথা উঠে তখন পাগলের মতো ব্যাথা হতে থাকে। হাতটা চেপে ধরে বসে পড়ে অনন্যা। চোখ থেকে পানি পড়ছে। অসম্ভব ব্যাথা করছে। একটা সময় নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না মামীকে ডাকা শুরু করলো। মামী যখন রুমে আসলেন তখন অনন্যা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। তাড়াতাড়ি অনলকে ফোন লাগালেন তিনি। অনন্যা তখনো ব্যাথায় কাতর। অনন্যাকে তাড়াতাড়ি অনলের চাকরীরত হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। অনন্যার অবস্থার অবনতি দেখে ইমিডিয়েটলি আই.সি.উ তে ভর্তি করা হলো। অনন্যাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে অনলের বুকে কামড় পড়লো। হারিয়ে ফেলবে নাতো অনন্যাকে। হাসপাতালের আই.সি.উ তে কাউকে এলাউ করা হয় না। কিন্তু ওভারটাইম এর উছিলায় প্রতিটা সময় অনল তার কাছে ছিলো। অনন্যার রিপোর্ট আসলে অনলের সিনিয়র ডাক্তাররা তাকে ডেকে পাঠায়,
– স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?
– আসো অনল, বসো।
– জ্বী স্যার।
– তোমার ওয়াইফের রিপোর্টস হয়তো দেখেছো। আমার মনে হচ্ছে ওর হার্টের প্রবলেম রয়েছে। যদিও ট্রপাই নেগেটিভ এসেছে।
– কিন্তু স্যার ও তো কলার বোনে ব্যাথা বলছিলো।
– আই থিংক ওর কিছু ভেইন শুকিয়ে গেছে যার কারণে ওর স্টেবল এনজ্যাইনা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু এখন সেটা আনস্টেবল হয়ে উঠেছে। আমার মতে ওর শুধু ভেইন শুকিয়ে যায় নি। ওর হার্টেও ব্লক থাকতে পারে। কারণ ওর ব্যাথাটা পুরো হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর ওর ব্লাড ক্লট শুরু হয়েছে। আমি এনজিওগ্রাম করতে চাই। এবং কালকেই তুমি পারমিশন দাও।
– স্যার আপনার যা ভালো মনে হয় আপনি করুন
স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনল। অনন্যা তার রক্তে মিশে আছে। অনন্যাকে ব্যাতীত নিজের অস্তিত্ব ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে তার। আল্লাহ কাছে শুধু একটাই দয়া করতে থাকে অনল, যাতে তিনি অনন্যাকে ফেলে যায় তার কাছে। আই.সি.উ কেবিনে তখন ঘুমিয়ে আছে অনন্যা। নিজের চোখ মুখে ধীরে তার কাছে বসে। কি মায়াবী না লাগছে তার মায়াপরীকে। কিভাবে থাকবে ওর কিছু হয়ে গেলে! অনন্যার ক্যানোলা পড়া হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে থাকে,
– প্লিজ সুস্থ হয়ে যাও পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অনল। চোখের পানি ছেড়ে দিলো সে। অনন্যার হাতে ভেজা অনুভব হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো অনল তার হাত ধরে বসে রয়েছে। খুব কষ্টে বলে,
– তুমি কাঁদছো?
হুট করে অনন্যার জেগে যাওয়ায় নিজের চোখের পানি মুছে নিলো অনল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
– তুমি উঠে গেলে কেনো? ঘুম হচ্ছে না এখানে?
– কথা ঘুরাচ্ছো অনল? আমার কি খুব বড় রোগ ধরা পড়েছে?
– না না তেমন কিছু না, এইতো কাল পরসুর মধ্যে আমরা বাসায় চলে যাবো।
– তুমি মিথ্যে বলছো তাই না?
– কেনো এটা লাগছে তোমার?
– ভুলে যাচ্ছো অনল আমি তোমার চোখ পড়তে পারি।
– ভুল পড়ছো। কাল একটা টেস্ট আছে এর পরেই আমরা বাসায় যাবো দেখো।
অনন্যা আর কথা বাড়ালো না, কেনো যেনো নিজের মনেও খচখচানি শুরু হয় তার। অনলের শুকনো মুখটা যেনো তাকে আরো ও দূর্বল করে তুলে।
পরদিন,
ডাক্তার কেবিনে,
এনজিওগ্রাম করার পর অনলকে দেখে পাঠায় তার সিনিওর ডাক্তার। অনল যখন তাকে জিজ্ঞেস করে অনন্যার কি অবস্থা, তখন তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন,
– আমি যা এজ্যুম করেছিলাম, অনন্যার একটা করোনারি আর্টারি ৯০% শুকিয়ে গেছে। একটা ভেইন অলরেডি ৫০-৬০% শুকিয়ে গেছে। আরেকটা আর্টারি ৭০-৮০% শুকিয়ে গেছে। এখন যে জায়গা থেকে ব্লাড বের হয় সেগুলোই শুকাতে থাকে তাহলে তো ব্যাথাটা হবেই। অনন্যা এতোদিন ব্যাথাটাকে সহ্য করে গেছে। ও ভেবেছে কলার বোনে ব্যাথা বাট এটা হার্ট কেস। এখন যে পজিশন আমি চাইলেও রিং পড়াতে পারবো না। বেস্ট অপশন সার্জারি। এবার তোমার ডিসিশন।
– স্যার কবে সার্জারি করতে চাচ্ছেন?
– দেখো প্যাশেন্ট স্ট্যবল। তাই আমি সামনের সপ্তাহে করতে চাচ্ছি। টাকা পয়সার ও ব্যাপার আছে। সো তুমিও সময় নাও।
– ওকে স্যার।
কেবিন থেকে বেরিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। এতোটা অসহায় লাগছে যে কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না অনল। মনের ভেতর একটা হাহাকার শুরু হয়, হাজারো ভয় বুকে জমতে থাকে। অনন্যাকে হারানোর ভয়। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায় অনল। নিজেকে নিজে বুঝায় যেভাবেই হোক অনন্যাকে তার বাঁচাতেই হবে। চোখ মুখ মুছে অনন্যার কাছে যায় সে। অনন্যার কাছে বসতেই অনন্যা মৃদু গলায় বলে,
– এতো চিন্তা করো না অনল, যা আল্লাহ লিখে রেখেছেন তাই হবে। তুমি লুকালে কি হবে আমি জানি আমার খুব বড় রোগ ধরা পরেছে। অপারেশন লাগবে। তাই না?
-…….
– একটা কথা বলি? এতোকিছু করে কোনো লাভ হবে না। আমার সময় চলে এসেছে।
– তুমি থামবে অনন্যা
বেশ কড়া কন্ঠে বলে উঠলো অনল। অনন্যা মলিন হাসি দিয়ে বললো,
– এখনো বকবে? পরে কিন্তু আফসোস করবে বলে দিচ্ছি। হাহাহা
– প্লিজ অনন্যা থামো না
অনল আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। অনন্যার তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
– আমি এতো সহজে মরব না, এতো কাঁদতে আছে। তুমি কাঁদলে আমি নিজেকে শক্ত কিভাবে রাখবো। আর আমি মরে গেলে না একা থাকার কথা চিন্তাও করবে না। একটা পুতুলের মতো মেয়ে দেখে বিয়ে করবে। ঠিক আছে?
– তুমি যদি এই ফাও কথাই বলতে থাকো তাহলে আমি যাচ্ছি।
বলে উঠে যেতে নিলেই অনন্যা হাতটা টেনে ধরে বলে,
– একটা বার ভালোবাসি বলবে?
করুন গলায় বলা কথাটা অনলের ভেতরটাকে চুরমার করে দেয়। কাঁপা কন্ঠে বলে অনন্যাকে,
– ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি
সেদিন ভালোবাসি কথাটাই অনলের বলাশেশ ভালোবাসি ছিল। রাতের মধ্যেই অনন্যার ব্যাথা শুরু হয়। সকল ঔষধ দেওয়ার পর ও লাভ হয় না। একটা সময় সি.পি.আর দিতে থাকে অনল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। রক্ত, গ্যাজা বের হতে থাকে অনন্যার মুখ থেকে। পালস যখন শেষ হয়ে যায় তখনো অনল সি.পি.আর দিতে থাকে।অনল পাগলের মতো অনন্যাকে সি.পি.আর দিতে দিতে বলতে থাকে,
– অনন্য প্লিজ উঠো, প্লিজ। প্লিজ আমার সাথে ফাজলামি করো না। ভালোবাসি বলতে বলেছিলে, বলেছি তাও কেনো এমন করছো আমার সাথে। উঠো না অনন্যা
অনলের সব কলিগরা বুঝাতে থাকে অনন্যা নেই। কিন্তু অনল মোটেই বুঝতে চায় নি। ভাবে এখনই অনন্যা ব্যাক করবে হয়তো। শেষ মেষ একজন কলিগ গালে চড় বসিয়ে তাকে হুসে আনতে চায়।
– অনল, সি ইজ ডেড। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। সি ইজ ডেড
কথাটা কানে যেতেই ধপ করে বসে পড়ে অনল। অনন্যার মৃত্যুর পর যেনো বাঁচার আগ্রহ টুকু শেষ হয়ে যায়। একমাত্র মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে সে। কিন্তু আত্মাব্যাতীত মানুষ লাশের ন্যায় হয়।
বর্তমান,
অনলের গলা ধরে গেছে। অনল কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে। ধারার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনলের কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে ধারার। হঠাৎ…….
চলবে
কাগজের_তুমি_আমি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
১৬তম_পর্ব
বর্তমান,
অনলের গলা ধরে গেছে। অনল কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে। ধারার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনলের কথাগুলো শুনে বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে ধারার। হঠাৎ আনমনেই অনল বলতে থাকে,
– জানিস ধারা, অনন্যা ই প্রথম নারী যাকে আমি “ভালোবাসি” কথাটা বলেছিলাম। এবং সেটাই আমার প্রথম এবং শেষ “ভালোবাসি” বলা ছিলো। অনন্যা সব সময় আমাকে একটা প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতো,
“ভালোবাসো”
আমি কখনো সেটার উত্তর দিতে পারতাম না। যখন ও আমায় ছেড়ে চলে গেলো আমি চিৎকার করে ভালোবাসি বলেছি ওকে; কিন্তু ও ফিরে আসলো না। এই হাত দুটোতে ওর নিথর দেহটা ছিলো। আমার নিজেকে তখন পৃথিবীর সবথেকে অপারগ ডাক্তার লাগছিলো। আমি চেয়েও কিছুই করতে পারছিলাম না। এখন বারবার মনে হয় কেনো ভালোবাসি বলতে গেলাম। সেদিন যদি না বলতাম হয়তো অনন্যা আমাকে ছেড়ে যেতো না। ওর অবস্থা বেশ স্টেবল ছিলো জানিস। আমি কি ভুল করেছিলাম যে আল্লাহ অনন্যাকে কেড়ে নিলো। অনন্যা আমার রুক্তে মিশে ছিলো জানিস। ও না অন্য মেয়েদের মতো ছিলো না, আমার চোখ দেখেই বুঝে যেত আমার কোথায় কষ্ট। যেদিন তোর সাথে আমার বিয়ে হয় আমি ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। ও হাসপাতালে ভর্তির সময় শুধু বলতো, ওর কিছু হলে যাতে আমি একা না থাকি, ওর নাকি কষ্ট হবে তাতে। আচ্ছা আমার সাথে এমন কেনো হয় বলতো!!
অনলের পাগলের প্রলাপ গুলো চুপ করে শুনছিলো ধারা। অনলের জীবনের সাথে এতোকিছু হয়েছে ব্যপার গুলো ধারার অজানা ছিলো। তখন ও মাত্র এস.এস.সি পাশ করে কলেজে উঠেছিলো। অনলের কলমা হয়ে গেছে ব্যাপার গুলো তার বাবা-মা জানলেও সে জানতো না। তার অনল ভাই এর বিয়ে ঠিক হয়েছে, ধুমধাম করে বিয়ে হবে ব্যাপারটা তার জানা ছিলো কিন্তু পরে বিয়েটা কেনো হলো না এটা কখনো জানা হয় নি। আসলে যাকে জমের মতো ভয় পেতো তার পারসোনাল ব্যাপারে কখনোই ধারার ইন্টারেস্ট ছিলো না। একবার শুনেও ছিলো অওভার ড্রাগ করে আই.সি.উ তে ভর্তি হয়েছে অনল। ভেবেছিলো অনলের এসব কাজের কারণে বউ পালিয়ে গেছে। এখন সুভাসিনী বেগম এবং সুরাইয়া বেগমের কথাগুলোর মর্ম বুঝতে পারছে। অনলের জীবনে এতো কিছু হয়ে গেছে সেটা না জানার আফসোসটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ধারাকে। তখন অনল ধীর কন্ঠে বলে,
– তোকে আমি কখনোই বিয়ে করতে চাই নি, অনন্যার জায়গা আমি তোকে কেনো কাউকে দিতে পারবো না। কিন্তু মা বলেছিলো তোকে বিয়ে করলে হয়তো আমি বাঁচার কোনো কারণ পাবো। মা সত্যি বলেছিলো। আজ যখন তোর বাচ্চার হার্টবিটটা শুনেছি, তুই ইমাজিন করতে পারবি না আমার বুকের মাঝে কি অনুভব হচ্ছিলো। অনন্যা যাবার পর এই প্রথম আমি সুখ অনুভব করেছিলাম। আবার ইচ্ছে হয়েছিলো আমি কারোর জন্য আমি বাঁচি। তোর বাচ্চাটা যেনো আমার সব দুঃখের মলম, ওকে কেন্দ্র করে আমি বাঁচতে পারবো। তুই আমাকে একটা কথা দিবি? তুই তোর বাচ্চাকে কখনো আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না। আমি ওকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই ধারা। আমি বাঁচতে চাই।
ধারার হাতদুটো নিজের মুঠোতে নিয়ে কপাল থেকে বলতে থাকে অনল। সে কাঁদছে। সাথে ধারাও। আজ অনলের কষ্টগুলো ধারা অনুভব করছে নিজের হৃদয় দিয়ে। হয়তো এই অশ্রুই তাদের সম্পর্কের সূচনা ঘটাচ্ছে যেখানে দুজন একটা সুতোয় বাধা, ধারার অনাগত সন্তানটি হয়তো তাদের সেই সুতো________
রাত ৮টা,
অনল ধারা কেউ ফোন ধরছে না দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন সুভাসিনী বেগম। এমনেই তাদের মধ্যে কিছু ঠিক নেই। এর উপরে সেই দুপুরে বের হয়েছে এখনো ফিরার নাম নাই। টেনশনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বলা তো যায় না; বিপদের তো হাত পা নেই। আর ধৈর্য ধরতে না পেরে অনলকে ফোন দেন সে। অনল ফোন ধরছে না বলে তার টেনশন যেনো আরো বেড়ে গেছে। না জানি অনল ধারা কোথায় আছে!!
রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে অনল ধারা। দুজনের চোখ মুখ ফুলে রয়েছে। দুঃখের ভার কমিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে তারা। নিতান্ত পরিবহণ না পাওয়ার জন্য হাটা লাগছে তাদের। বহুদিন পর আবার কেঁদেছে অনল। তবে মনটা বেশ হালকা লাগছে। অনল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই অনুভূতিটা কেনো হচ্ছে? বহুদিন পরে কেঁদেছে বলে নাকি ধারাকে নিজের চাঁপা কষ্ট গুলো খুলে বলেছে বলে; উত্তরটা তার জানা নেই, খুজতেও চায় না অনল। হঠাৎ খেয়াল করলো ধারা রাস্তার এক কোনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। অনল কাছে যেতেই দেখে সে লোভনীয় দৃষ্টিতে ফুচকার ঠেলার দিকে তাকিয়ে আছে। অনল হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কি হইছে? পা আটকে গেছে নাকি রাস্তায়? চল হাটি একটা রিক্সা পাইলে উঠে যাবো৷
– অনল ভাই
ধারার মুখের করুণ স্বরে ডাক শুনে পেছনে ফিরে তাকায় অনল। ধারাকে একটা কিউটের ডিব্বা লাগছিলো অনলের কাছে। খুব হাসি পাচ্ছিলো তখন অনলের। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বললো,
– কি হয়েছে?
– আমাকে একটু ফুচকা কিনে দিবে? তোমার তাড়াহুড়োর জন্য পার্সটাও আনি নি। আমার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে।
চোখ কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে অনল বললো,
– কতোটা আনহাইজিনিক জানিস? আমার প্রিন্সেস কোনো আনহাইজিন খাবার খাবে না।
– হ্যা?? কে বলেছে আনহাইজিন? সারাজীবন খেয়ে বড় হলাম কই তখন তো হাইজিন ওর আনহাইজিনের কথা ভাবি নি। আর এক মিনিট মাত্র তো সাত সপ্তাহ এর একটু বেশি হয়েছে বাবুর বয়স। জানলে কি করে সে প্রিন্স না প্রিন্সেস?
– আমি জানি, ও প্রিন্সেস ই হবে। যাক গে জিভ থেকে লোল না ফেলে চল তাড়াতাড়ি। মোবাইলের নেটওয়ার্ক ও নেই। মা টেনসন করবে।
– এক প্লেট ফুচকা, এর পর জোরে জোরে হাটবো। প্রমিস
– একটা ও না। পরে আমাশা হয়ে বাথরুমে দৌড়াতে হবে। আর এখন মিসক্যারেজ হবার চান্স অনেক বেশি। আমি চান্স নিতে চাই না। মাত্র ওর হার্ট বিট পাওয়া গেছে। সি ইজ নট থ্যাট মাচ স্ট্যাবল।
বলেই হাটা শুরু করলো অনল। ধারার খুব ফুচকা খেতে মন চাচ্ছিলো। কিন্তু এই পাজি লোকটা, উফফ সব কিছু তার মতো হওয়া চাই। কেনো বাবা একটু ফুচকা খেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? না তার প্রিন্সেস নাকি আনহাইজিনিক জিনিস খাবে না। ধুররর ভালো লাগে না। এই খচ্চর লোকটা সারাক্ষণ দাদাগিরি করে। ধারার ইচ্ছে হচ্ছিলো অনলের মানিব্যাগটা মেরে ফুচকা খেতে। পরমূহুর্তে মনে হলো, সে যা করবে বাচ্চাও তাই শিখবে। আর নিজের বরের পকেট মারাটা কেমন হয়ে যাবে না!!
– আমাকে গালানো শেষ হলে কষ্ট করে কি হাটবেন?
অনলের কথা কানে আসতেই তাড়াতাড়ি হাটা শুরু করলো ধারা। এই লোক কিভাবে জানে মন ও পরতে পারে। সাংঘাতিক লোক!! লোকটার জন্য মনে মনেও কিছু চিন্তা করা দায় হয়ে উঠেছে ধারার___
যখন বাসায় পৌছায় তারা, তখন ঘটির কাটার নটা ছুই ছুই। সুভাসিনী বেগমের কাছে ধুমায় বকা খেতে হয়েছে অনল ধারাকে। এতোক্ষণ চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি। প্রেগ্ন্যাসির সময় কিছু খাওয়ার ক্রেভিং উঠলে সেটা থামানো অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। ধারার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফুচকা খাবার ইচ্ছেটা এখনো বেশ প্রবল ভাবে জেকে বসেছে মাথায়। উপরে ফুপির বোকায় আরো মন খারাপ হতে লাগে তার। মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে রাখলে সুভাসিনী বেগম বলেন,
– হয়েছে বর কে বকছি বিধায় তোমার মাথা নিচু করা লাগবে না। রুমে যেয়ে ফ্রেস করে নাও।
ধারাও ভদ্র বাচ্চার মতো রুমে চলে যায়। ফুপিকে তো বোঝাতে পারছে না তার যে ফুচকা খাবার ক্রেভিং উঠছে। ধারার রুমে যাবার পর ই অনল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ছেলেটাকে আজ অন্য রকম লাগছে সুভাসিমী বেগমের। কেনো যেনো মনে বেশ প্রশান্তি লাগছে সুভাসিনী বেগমের। আজ ছেলেটার চোখ মুখে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছের ঝলক ছিলো। তবে কি তার ছেলে অনন্যার স্মৃতিকে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!!
রাত ১১টা,
অনল এখনো ফিরে নি, ধারার বেশ চিন্তা লাগছে। লোকটা সেই বেরিয়েছে এখনো আসার নাম নেই। সুভাসিনী বেগমকে জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। বেশি রাত জাগা তার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়, বয়স হয়েছে বলে কথা। তাই ধারাই অনলের ফিরার অপেক্ষা করবে। লোকটা ফোন ও নিয়ে যায় নি। চিন্তার প্রহর যেন কাটছেই না। তখনই কেঁচিগেট খোলার শব্দ পায় ধারা। দরজায় বেল বাজার আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে যায় সে। অনল তখন কেবল সিড়িতে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় সিড়ি দিয়ে উঠতেই খেয়াল করলো একজন রমনী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো যেনো অনন্যাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পরমূহুর্তেই চোখের ভুলটা ধরা পড়ে যায়। দরজা ধরে অনন্যা নয় ধারা দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়িতে মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। নিজের অবাদ্ধ মনকে খুব ক্রে কড়া শাসন করে দিলো অনল। আজকাল মনটা ধারার মাঝে অনন্যাকে খুজছে। এটা তো কখনোই সম্ভব না। ঘরে ঢুকতেই বেশ শাসানো গলায় বলে উঠে ধারা,
– একটু তো বুদ্ধি নিয়ে কাজ করবা নাকি? একটু ফোনটা সাথে নিয়ে গেলে কি হতো। ফুপি চিন্তা করছিলেন। আমি জোর করে তাকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মানুষের চিন্তা হয় তো নাকি, রাত কটা বাজে খেয়াল আছে?
তখন ই……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি