কাগজের তুমি আমি
২য়_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
– আজ তোর শরীরের সব জ্বালা যদি আমি না মিটাই তবে আমার নাম অনল না। [ অনেকেই রিত্ত নামটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, নামটি নাকি খুব কনফিউজ করছে তাই আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি]
যে চোখে ভালোবাসাকে কল্পনা করেছিলো সেই চোখ আজ হিংস্রতায় ঘিরা। বেল্টটা খুলেই শক্ত করে হাত বেধে দিলো ধারার। একটানে শাড়িটা খুলে ফেললো ধারার। তারপর যা হলো তা যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো ধারার; সুন্দর চেহারার আড়ালের হিংস্রতা দেখে মেয়েটির বুক কেঁপে উঠলো। অনল যেনো নিজের মাঝেই নেই; সব রাগ, বিদ্বেশগুলো ধারার শরীরের উপর দিয়ে মেটাচ্ছিলো। অনলের প্রতি ভালোবাসাগুলো যেনো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো; যেমন তার শরীরটা যাচ্ছিলো। সেও তো অনলের ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলো; কিন্তু এখানে তো ভালোবাসা নেই, আছে শুধু জেদ, ঘৃণা, কামনা। এটাকেই স্বামীর ভালোবাসা বলে? যদি এটাকে স্বামীর ভালোবাসা বলে চায় ধারা এমন ভালোবাসা। ফুপু বলেছিলো,
– ধারা মা, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা খুব পবিত্র। অনল তোকে এখন মেনে নিচ্ছে না ঠিক ই। কিন্তু একটা সময় দেখবি ঠিক তোকে মেনে নিবে। তোকে ভালোবাসবে, তুই কিন্তু হাল ছাড়বি না। মাঝে মাঝে এটা ছয় দিন হয়, ছয় মাস হয়; আবার ছয় বছর ও হয়। ছেলেটার জেদটা বরাবর ই একটু বেশী। তোকে মানতে চাইছে না। এটা অবশ্য তোর দোষ নয়; আসলে কি বলতো সবার জীবনে কোথাও না কোথাও কিছু আঘাত থেকেই যায়। অনলের ও ছিলো। এই আঘাত গুলো মিটাতে সময় লাগে; তাড়াহুড়ো করলে হিতে বিপরীত হয়। এখন অনল তোকে পছন্দ করে না; কিন্তু যখন তোকে ভালোবাসতে শুরু করবে দেখবি, তোকে বাদে কাউকে চিনবে না। আমার ছেলেটা এমনই রে কি করবো বল। আজ তোকে আমি আমার মনের মতো সাজাবো দেখবি ও তোর থেকে চোখ সরাতেই পারবে না।
সুভাসিনী বেগমের কথা মতোই সে কাজ করেছে। তাহলে এমনটা কেনো হলো? চোখ থেকে নোনাজলগুলি গড়িয়ে পরছে। ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে বিছানা আকড়ে সেখানেই পড়ে রইলো সে। শেষ রাতে অনল যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, বিছানার অপর পাশে তখন গা এলিয়ে দেয় সে। নিজের চোখে অনেকটাই নিচে নেমে গেছে সে; যতই রাগ হোক রাগের বসে কোনো মেয়ের সাথে এমন আচারণ হয়তো তার দ্বারা শোভা পায় না। ধারা তার দিকে পিঠ করে তখন শুয়ে ছিলো। উন্মুক্ত পিঠে খামচির, কাধে কামড়ের দাগগুলো স্পষ্ট। মেয়েটি এখনো নীরবে কাঁদছে। একবার চেয়েছিলো মেডিসিন লাগিয়ে দিবে, কিন্তু পর মূহুর্তে মনে হলো
‘থাক সে তার মতো, দোষ তো তারই; সে তো এটাই চেয়েছিলো। যা চেয়েছে তাই তাকে শতগুণ রুপে ফেরত দেয়া হয়েছে‘ ____
বেশি মাথা না ঘামিয়ে ঘুমের অতল গভীরে নিজেকে সপে দিলো অনল। ব্যাথার পরিমাণ যখন হালকা সহনীয় হলো তখন ধারা কোনোমতে বিছানা ত্যাগ করলো। ওয়াশরুমে শাওয়ার ছেড়ে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসেছিলো; সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে; নিজেকে আর যখন ধরে রাখা সম্ভব হলো না ঠান্ডা পানির স্রোতে নিজেকে এলিয়ে দিলো সে।
সকাল ৯টা,
সূর্যের আলোর প্রখরতায় ঘুম ভেঙে গেলো অনলের। এতো দেরি তার হয় না; আজ এতোটা কিভাবে দেরি হলো নিজেই বুঝছে না। বিছানায় উঠে বসে পাশে তাকাতেই আৎকে উঠলো সে, বিছানাতে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে। নিজের চোখে নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে; রাগ তাকে এতোটা নিজে নামিয়ে আনবে এটা কল্পনা করতেই নিজের প্রতি ঘৃণা তাকে ঝাঝড়া করে দিচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটা কোথায়? বাচ্চা মেয়ে কেবল নাকি উনিশে পা দিয়েছে। সংসার, স্বামী এসব ব্যাপার তার কাছে একটা নতুন শব্দ যার অন্তরর্থ বুঝার ক্ষমতা তার নেই। কাল রাতে এমনটা না করলে হয়তো ভালো হতো। নিজের হাত জোড়া দিয়ে মাথা চেপে ধরলো অনল। নিজের চোখে নিজেই যে নিচে নেমে গেছে। ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে গেলো সে। ওয়াশরুমের দরজা ভেড়ানো, পানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখে মেঝেতে ধারার অসার দেহটি পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে হাত দিয়েই শিউরে উঠলো গা। বরফ ঠান্ডা দেহটি কতক্ষণ পানিতে পড়ে রয়েছে হিসেব নেই। শ্বাস চেক করে দেখলো এখনো শ্বাস চলছে। কিন্তু অনেক ধীর গতিতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সময় নষ্ট না করে আড়কোল করে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। কোন মতে একটা কাপড় পড়িয়ে সুভাসিনী বেগমকে খবর দিতে ছুটলো সে।
সুভাসিনী বেগম তখন রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। সাধারণত ৮টার দিকেই ধারা রান্নাঘরে তার কাছে চলে আসে; আজ দেরি হওয়াতে মনে মনে খুশী ই হয়েছিলেন। কাল রাতে ছেলে, ছেলের বউ কেউই ঘর থেকে বের হয় নি। ভেবেছেন হয়তো অনল আর ধারার সম্পর্কটা আগাচ্ছে। ঠিক তখনই হাপাতে হাপাতে এসে পৌছায় অনল। অনলের চোখ মুখ যেনো অন্য কিছু বলছে। কোনো মতে অনল বলে,
– মা, ধা……ধারা।
দুপুর ১টা,
সেলাইন লাগানো অবস্থায় গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ধারা। ফ্যামিলি ডাক্তার এবং অনলের বান্ধবী অনন্যা মাহমুদ ধারার চেকাপ করছে। বডি টেম্পারেচার প্রচুর কমে গিয়েছিলো। বেশকিছু ইঞ্জেকশন দেবার পর, তা ঠিক হয়েছে। তারপর ধুম জ্বর এসেছে। সেলাইন লাগিয়ে রেখেছে; সব কিছু মিলিয়ে মানসিক ভাবেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। সুভাসিনী বেগম অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলে অনন্যা বলে,
– আন্টি, একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে যদি পশুর মতো আচরণ করা হয় তাহলে তো এমনই হবার কথা। ভাগ্য ভালো মেয়েটি বেঁচে আছে। যা অবস্থা ছিলো আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হসপিটালাইজড করতে হবে। আন্টি মেয়েটা খুব মেন্টাল ট্রমাতে আছে। যখন জ্ঞান ফিরে আমাকে দেখেও কেঁপে উঠেছিলো। অনল ওর সামনে না যাওয়াটাই ভালো। আপনি সিনিয়র আছেন। আই থিংক আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন।
– ভুলটা আমারই। ভুলেই গেছিলাম; ছেলেটা দিন দিন মানুষ রুপী পশুতে পরিণত হচ্ছে।
– আন্টি আমার প্যাশেন্টস আছে। আমি এখন যাবো।
– হুম।
রুম থেকে বের হতেই দেখে অনল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই জিজ্ঞেস করে,
– ধারা কেমন আছে?
– বেঁচে আছে। কেনো বলতো?
– এভাবে কেনো বলছিস?
– কিভাবে বলবো অনল?
কড়া গলায় বলে উঠলো অনন্যা। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
– একজনের শাস্তি অন্যজনকে দেয়াটা বোধ হয় তোকে মানায় না অনল। মাহির শাস্তি এই মেয়েটাকে দেওয়াটা কি যৌক্তিক। মাহির শাস্তি কেনো বলছি? মানুষের মন সেটা বদলাতে পারে। হ্যা মাহি অন্যায় করেছে, কিন্তু সেটার রাগ এই মেয়েটার জীবনের বিনিময়ে মেটানো খুব পুরুষত্বের প্রমাণ ছিলো বুঝি! তুই তো এমন ছিলি না অনল। তাহলে কেনো? সত্যি বলি, মেয়েটার শরীরের যা পজিশন ছিলো একটু উচুনিচু হলে তোকে আমি জেলে দিতাম। মেয়েটাকে ছয় মাস ধরে দেখে যাচ্ছি, তোকে বিভিন্নভাবে নিজের ভালোবাসার স্বরুপ দেখানোর প্রচেষ্টা ছিলো সে। তুই কিভাবে তার ভালোবাসাটাকে এভাবে পায়ে পিসিয়ে দিলি অনল। ছি!
মাথা নিচু করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে অনল। কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্য। মেয়েটি বিভিন্নভাবে নিজের ভালোবাসা তার সামনে প্রকাশ করে এসেছে এই ছয়মাস; সেটা রাত জেগে তার বাসায় আসার অপেক্ষা হোক কিংবা সকালে ঘুম ভাংগার আগে চা নিয়ে হাজির হওয়া। প্রতিদিন তার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখা হোক কিংবা তার পছন্দের খাবার রান্না করার চেষ্টায় নিজের হাত পুরানো হোক। সবকিছু ঠিক থাকলেও মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা তো দূরে থাক ভালোলাগাটুকুও জন্মায় নি অনলের মনে। আড়াই বছর আগের ঘা যে এখনো শুকায় নি তার। অনন্যা বেশ কিছু কথা শুনিয়ে হাটা দিলো তার গন্তব্যে। অনলের মন চাচ্ছে একবার ধারার মুখটা দেখতে। কিন্তু সুভাসিনী বেগম ঠায় বসা তার কাছে। সব চিন্তা বাদ দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সে। সুভাসিনী বেগম ধারার মাথার কাছে বসে রইলো। মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে, উজ্জ্বল মুখটা মলিনতায় ঘিরে আছে। মায়াবী মুখটা মুর্ছা গেছে এক রাতেই। অনল যখন ধারার কাছে আগাতে যায় তখন ……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি