এক_ফালি_রোদ
৪২তম_পর্ব
আবরারের কলিজায় কামড় লাগলো। মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেলো। খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে “আব্বা” নামটি ভেসে উঠলো। আব্বা বলে সে ইসমাইল সাহেবকেই সম্বোধন করে৷ উদ্বিগ্ন হয়ে সে ফোনটি রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করতেই ইসমাইল সাহেবের কন্ঠে কানে ভেসে আছে আবরারের। ইসমাইল সাহেব উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলতে থাকেন,
– আবরার, রাইসা সব জেনে গেছে। বাসায় এসে হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়েছে। এখন দরজা দিয়ে বসে রয়েছে। আমি, তোমার মা ধাক্কাচ্ছি কিন্তু তাতেও তার সারা মিলছে না। তুমি তাড়াতাড়ি আসো, বাবা
– জ্বী আব্বা। আসছি
আবরার ফোনটা রেখে দিলো। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সে। রাইসা তাদের বোনা মিথ্যের জাল ভেদ করে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো কতোটুকু ভেদ করেছে! সম্পূর্ণ নাকি শুধু খানিকটা! আবরার কি তার সামনে দাঁড়াতে পারবে! নাকি সেই অধিকারটুকু হারিয়েছে? আবরারের মাথাটা ধরে গেছে। এই মিথ্যের ভারটুকু অনেক বেশি। এতোটা দিন সে এই ভারটুকু একা বয়ে বেরিয়েছিলো। আজ এই মিথ্যের দেয়ালটুকু ভেঙ্গে গেছে। এখন দেখার পালা এই ভগ্ন অংশগুলো কি তাকে ক্ষতবিক্ষত করে নাকি তাকে ভারমুক্ত করে! ফুলি চা নিয়ে এসেছে। আবরার গরম চায়েই চুমুক দিলো। ঠোঁট, জিহ্বা পুড়ে যাচ্ছে কিন্তু আবরারের অনুভূতি শুণ্য। তার উদ্বিগ্ন মন রাইসার কাছে যাবার জন্য ব্যাকুল। নিজেকে প্রস্তুত করছে আগাম ঝড়ের আঘাত মোকাবিলা করার জন্য_________
অন্ধকার রুমে বসে রয়েছে রাইসা। চোখ মুখ ফুলে উঠেছে। চোখের সামনের পর্দাটুকু বিনা নোটিসেই সরে গেছে। অপ্রিয় সত্য কতটা বাজে হতে পারে আজ সে বুঝছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে সে আবরারের রেগুলার ডাক্তার ডাক্তার মাহিনের চেম্বারে যায়। ডাক্তার মাহিন আবরারের বন্ধু। সে সেখানের ডাক্তার ও। ডাক্তার মাহিনকে যখন প্রশ্ন করতে থাকে তখন ডাক্তার মাহিন প্রথমত উত্তর দিতে চান না। তিনি বলেন,
– দেখুন ভাবী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আবরারের রিপোর্টে কোনো ভুল নেই।
– আপনি ডাক্তার হয়ে এতো বড় ভুল কিভাবে করতে পারেন? আপনি প্রতিনিয়ত আমার স্বামীকে ভুল চিকিৎসা করে গিয়েছেন। সে তো আপনার বন্ধু নাকি! বেশ আপনার উত্তর দিতে হবে না। আপনি সোজা অথোরিটিকে জবার দিবেন। আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে। আমার হাসবেন্ডের ইনফার্টিলিটির রিপোর্টটি সম্পূরর ভুল। আমিও দেখবো আপনি কতোদিন এভাবে মানুষকে ঠকাতে পারেন!
-……..
– আপনাদের এই হসপিটালের রেপোটেশন যদি আমি না শেষ করি আমার নাম ও মিসের রাইসা আবরার নয়।
বলেই রাইসা যেতে নিলে মাহিন মুখ খুলে। মাথা নিচু করে বলে,
– ভাবী এই সব কিছুর মাস্টারমাইন্ড আপনার স্বামী ই। আমি আবরারের কথায় ই এই নাটকটা সাজিয়েছি।
– এখন আপনি আমার হাসবেন্ডকে দোষ দিচ্ছেন? আরে সে তো আপনার বন্ধু৷ এতোটা নিচু কিভাবে নামতে পারেন আপনি?
– আমার বন্ধু বলেই আমি তাকে এই সাহায্যটা করেছিলাম৷ আবরার আমার স্কুলের বন্ধু। আমি নিশ্চয়ই আমার বন্ধুর ক্ষতি চাবো না। ও আমার কাছে এই সাহায্যটা চেয়েছিলো বিধায় ই আমি করেছিলাম। ও জানতো আপনি মা হতে পারবেন না। সেজন্যই এই নাটকের সূচনা। আপনার বাবা চান নি আপনি এতোবড় ধাক্কাটা কখনো জানতে পারেন। আপনি নিজেকে সামলাতে পারবেন না। আপনার এক্সিডেন্টের পর তিনি পাগল প্রায় হয়ে পড়েন। তখন আবরার এগিয়ে আসে। আবরার এবং আংকেলের মিলিত পরিকল্পনায় আপনাদের বিয়েটা হয়। আপনি যেনো সমাজের সামনে কখনো প্রশ্নবদ্ধ না হন তাই আবরার এই মিথ্যে রিপোর্টটি বানায়
– আমার বাবা আবরারকে আগ থেকে চিনতো!
– জ্বী চিনতো। আসলে আপনার এই অক্ষমতার জন্য ও কোথাও না কোথাও ওই দায়ী৷ সেদিন আপনার এক্সিডেন্টটা ও ওর কারণেই হয়েছিলো। ওই বাইকওয়ালা আবরার ই ছিলো। কিন্তু এটা ওর ইচ্ছাকৃত ছিলো না।
– শুধু নিজের কৃতকর্মটুকু লুকাতে এতোবড় মিথ্যে নাটক সাজালো আবরার?
রাইসার চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। আজ সব কিছু মিথ্যে লাগছে তার কাছে। যে পিতৃস্নেহের জন্য নিজের ভালোবাসাটুকুকেও সে ছেড়ে দিলো সেই মানুষটা তাকে এভাবে মিথ্যের চাদরে ঢেকে রাখলো। যে মানুষটা তার জীবনের সকল সুখ কেড়ে নিলো সেই মানুষটার সাথে তাকে কিভাবে বিয়ে দেবার মিথ্যে নাটক সাজালো! আর আবরার, এই মানুষটার প্রতি তার চিন্তা ঠিক ই ছিলো। সে একজন অমানুষ। মিথ্যের ভ্রমে রাইসা তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। নিজের ভুলের উপর নিজের রাগ হচ্ছে রাইসার। ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠলো তার। রাইসা মাহিনের রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে মাহিন বলে উঠে,
– আপনি কিন্তু আবরারকে ভুল বুঝছেন। শুধু নিজের কৃতকর্মটুকু লুকাতে সে আপনাকে বিয়ে করে নি। সে আপনাকে ভালোবাসে। একটা মানুষ কাউকে না ভালবাসলে এতো বড় সিদ্ধান্ত কখনোই নিতে পারে না। এতোবড় স্যাক্রিফাইস করার জন্য একটা সাহসী এবং ভালোবাসতে পারা হৃদয়ের প্রয়োজন হয়।
– কাউকে সমোবেদনা দেখানো কিংবা নিজেকে গ্লানির চোরাবালির থেকে বাঁচানোকে আমি অন্তত ভালোবাসার নাম দিতে পারছি না।
রাইসা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। তার পা যেনো অবশ হয়ে আসছিলো। নিজেকে ফেলনা মনে হচ্ছিলো। নিজের আপন জনের এতোবড় ছলনাকে সে মেনে নিতে পারছিলো না। সেখান থেকে সে ইসমাইল সাহেবের বাসায় পৌছায়। নাসিমা বেগম তার বিধ্বস্ত চেহারাটি দেখে ভয় পেয়ে যায়। রাইসা বাড়িতে ঢুকেই নিজের রুমে চলে যায়। নাসিমা বেগম কিছু জিজ্ঞেস করলে এটুকুই বলে,
– আমার অক্ষমতাটাকে তোমার আমার জীবনের সত্যি বানিয়ে ফেলেছিলে। কি ভেবেছিলে আমি এই সত্যটা জানলে কষ্ট পাবো? কিন্তু এটুকু ভাবো নি? মিথ্যে বেশীদিন টিকতে পারে না। যখন আমি তোমাদের ছলনার কথা জানবো তখন কতোটা কষ্ট পাবো?
বলেই রুমের দরজা দিয়ে দেয়। এখনো দ্বার দিয়ে বসে রয়েছে সে। কখন রাত হয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। তার জীবনটাই অন্ধকারে ঢেকে গেছে। বাহিরের আলো এই অন্ধকার ভেদ করার ক্ষমতা রাখে না। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ে। আবরারের কন্ঠ কানে ভেসে আসে। সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে রাইসাকে ডাকছে। আবরারের কন্ঠ রাইসার কানে বিষের মতো লাগছে। সে প্রথমে উত্তর দিলো না। কিন্তু যখন আর সহ্য হচ্ছিলো না তখন বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার অনেক প্রশ্ন আছে। আজ সে তার সব প্রশ্নের উত্তর বুঝে নিবে আবরারের কাছে। সব কিছুর উত্তর চাইবে সে।
আবরার ক্রমাগত দরজা ধাক্কাচ্ছে। তার বুকে যেনো ভোঁতা ছুরিঘাত হচ্ছে। সে ব্যাকুল হয়ে আছে রাইসাকে দেখার জন্য। একটা পর্যায়ে দরজাটি খুললো। আবরারের সামনে রাইসা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখজোড়া রক্তিম লাল৷ সে চোখে আজ তার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। বরং ঘৃণার তীর্যক দৃষ্টিতে আবরারকে ক্ষতবিক্ষত করছিলো রাইসা। আবরার কিছু বলার আগে রাইসা বলে উঠলো,
– এবার কি মিথ্যে বলতে এসেছেন?
– রাইসা, আমার কথাটা
– একটা মানুষের ভেতর কতোটা মিথ্যে লুকায়িত থাকতে পারে আপনাকে না দেখলে আমি জানতাম না। আপনি এতোটা নিচ, অমানুষ এটার পরিচয় আমি আজ পেয়েছি। কি ভেবেছিলেন ভালোবাসার মিথ্যে নাটক করবেন আর আমি সেই নাটকের মাঝে সারাটা জীবন কাটাবো? মিস্টার আবরার আজ আপনার সব নাটকের পর্দা উঠে গেছে। আর আমাকে ঠকাতে পারবেন না আপনি। কি ভেবেছিলেন আমি কিছুই জানবো না? আমার জীবনটাকে নিয়ে আপনি ইচ্ছে মতো খেলবেন তাই না?
– রাইসা ভুল বুঝছো তুমি!
– কোনটা ভুল? বলুন!
রাইসা আবরারের কলার চেপে ধরলো৷ তার কন্ঠ কাঁপছে। রাগে, দুঃখে সে ভেঙ্গে পড়েছে। তার রক্তিম চোখগুলো আবরারকে প্রশ্ন করছে। ঘৃণা জড়ানো কন্ঠে বললো,
– কোনটা ভুল? আমার জীবনের অস্তিত্ব নষ্ট করে দেওয়াটা? আমার সুখ কেড়ে নেওয়াটা? আমার ভালোবাসা থেকে আমাকে দূর করে দেওয়াটা? আমাকে ব্যবহার করাটা? আমাকে নিজের সাথে আটকে রাখার জন্য আমার শরীরকে জোর করে আয়ত্তে নেওয়া? আমাকে প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলা? আজ আমি আমার ভাগ্যটাকে দোষ দিবো। কেনো ভাগ্য আমাকে আপনার সাথে পরিচয় করালো? আপনি আমার জীবনে না থাকলে এতোটা অসহায় আমি হতাম না।
– রাইসা আমার কথাটা একবার কি শোনা যায় না?
– আর মিথ্যে শোনার ক্ষমতা নেই আমার। আমি মুক্তি চাই। আপনার মিথ্যে থেকে, ছলনা থেকে। আপনার থেকে। একটা শেষ উপকার করবেন? আমার জীবন থেকে একেবারের জন্য সরে যেতে পারবেন? এই একটা উপকার করুন
– রাইসা!
– চলে যান
– ভেবে বলছো তো?
– হ্যা, ভেবেই বলছি। আমার জীবনে আপনি একটা অভিশাপ। আপনি না থাকলে আমার কষ্ট থাকবে না। আল্লাহ যেনো আমাকে আপনার ছায়া থেকেও দূরে রাখে।
আবরার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাইসার দিকে৷ তার চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। রাইসার প্রতিটা কথা তার বুকে ছুরিঘাত করছে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটি তাকে ঘৃণা করছে। তার ছায়াকেও সহ্য করতে পারছে না সে। এই ঘৃণার স্তরটা কতটা বেশি হতে পারে, এটা যেনো অকল্পনীয়৷ মলিন হাসি হাসলো আবরার৷ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– তুমি আমাকে কখনোই বুঝলে না রাইসা৷ যদি বুঝতে তাহলে আমার এবং অয়নের মাঝে কনফিউজ হতে না। যে মানুষটাকে না দেখে ভালোবেসেছিলে সেই মানুষটাই কি তোমার সাথে দেখা করেছে কিনা এটা তুমি বোঝো নি। তোমাকে আমি ঠকাই নি, ভালোবেসেছি, আগলে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু আমার এই কাজগুলোই আমাকে তোমার চোখে নামিয়ে দিয়েছে। যাক গে, তোমার দোয়া যেনো আল্লাহ পূরণ করে। এই কামনাই করি
বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো আবরার। রাইসা তখন………………
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি