এক_ফালি_রোদ ৩৮তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩৮তম_পর্ব

আজ অয়নের কক্সবাজার যাবার কথা সুতরাং জরুরি কিছু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সব দ্বিধা ছেড়ে ফোনটি রিসভ করলো সে। ফোন রিসিভ করতেই এমন কিছু সে জানতে পারবে এটা কল্পনা করে নি। অপরপাশ থেকে একটি অপরিচিত পুরুষ কন্ঠে ইংলিশে কিছু বলছে। প্রাপ্তি শুধু ইয়েজ, ওকে বলে ফোনটি রেখে দিলো। অয়ন এখনো ঘুমে বিভোর। প্রাপ্তি শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অয়নের দিকে চেয়ে রইলো। অয়নের ঘুমন্ত চেহারাটা তার সর্বদা বেশ ভালো লাগে কিন্তু আজ বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। কারণ এই শান্ত, সুন্দর চেহারাটার পেছনে কিছু অপ্রিয় সত্য রয়েছে। যে সত্যগুলো আজ তার তাশের ঘর ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। প্রাপ্তি অয়নকে ডাকলো না, তার মনে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু সে জানে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অয়নের কাছে নেই। সে নিঃশব্দে বাহিরে চলে গেলো। রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো। এখন ঘাসগুলো ভেজা রয়েছে। হাটলে ভেজা ঘাসের কোমল স্পর্শ পাওয়া যাবে। হয়তো প্রকৃতির কাছে তার মনে দাউদাউ করে জ্বলন্ত আগুনকে শান্ত করার কোনো উপায় থাকবে। হয়তো বুকের রক্তক্ষরণের কোনো ঔষধী পাবে সে৷ নগ্ন পায়ে ভেজা ঘাসের উপর হেটে যাচ্ছে প্রাপ্তি। চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্রষ্টা তার নসিবে সব কিছু দিয়েছে শুধু সুখ টুকুই লিখতে ভুলে গেছেন। এটা তাকে মেনে নিতে হবে। সে ভেঙ্গে পড়বে না, জীবন তাকে অনেক কিছু এটুকু বয়সেই শিখিয়ে দিয়েছে। এই শিক্ষাটুকু সে ফেলনা করে নিজেকে হতাশা, কষ্ট এবং দুঃখের ছায়ায় বিলীন করে দিবে না। তাকে সে অনেকটুকু পথ চলতে হবে। শুধু আফসোস একটাই সুখগুলো সে ধরে পারলো না সুখের দেখা পাওয়ার পরও_________

অয়নের ঘুম ভাঙ্গলো সূর্যমামার প্রকোপে। তীর্যক প্রখর সূর্যের রশ্নি তার ঘরে আছড়ে পড়ছে। অন্ধকার শীতল ঘরটি মূহুর্তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। পিটপিট করে চোখ খুললো অয়ন। হাতটা আপনাআপনি পাশের ফাঁকা স্থানটি হাতরাতে থাকলো। জায়গাটি ঠান্ডা, প্রাপ্তি গতরাতে তার বুকেই ঘুমিয়েছিলো। তাহলে এতো সকালে মেয়েটি কোথায় গেলো। একেই গ্রাম, উপরে অজানা জায়গা। সকাল সকাল মেয়েটি কোথায় গেলো! এই চিন্তায় লাফিয়ে উঠলো অয়ন। ঘরের চারপাশে চোখ ঘুরালো সে। কিন্তু ঘরটি ফাঁকা। বালিশের পাশের শার্টটি গায়ে জড়িয়ে ছুটলো প্রাপ্তিকে খুজতে। ছাঁদ, অন্যঘর, পুকুর পাড়, উঠোন, যত সম্ভব জায়গায় প্রাপ্তির যাওয়া সম্ভব সব জায়গাতে খুজলো অয়ন। আলম মামাকে ও জিজ্ঞেস করলো কিন্তু তিনি উত্তর দিতে পারলেন না। অবশেষে ঘন্টা খানেক পর ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরলো অয়ন। বাড়িতে পা রাখতেই দেখলো রান্নাঘরে কারোর ছায়া দেখা যাচ্ছে। প্রাপ্তি ভেবে ছুটে গেলো অয়ন৷ রান্নাঘরের কাছে আসতেই শান্ত হয়ে গেলো অয়ন। প্রাপ্তি চা বানাচ্ছে। চুল গুলো বেশ উঁচু করে খোঁপা বেধে রেখেছে যে। ঘাড়ের পেছনের তিলটি অয়নের চোখ এড়ালো না। ধীর পায়ে গিয়ে পেছন থেকে প্রাপ্তির কোমর আঁকড়ে ধরলো। প্রাপ্তি অবিচলিতভাবে চায়ের পাতিলে চায়ের পাতা দিচ্ছে। আজ তার মনে কোনো কৌতুহল নেই। অয়ন তার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,
– এতো সকালে এখানে কি করছো? তোমাকে না পেয়ে আমি কতোটা ঘাবড়ে গেছিলাম!
– আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তাও হয় বুঝি?
– তা হয় না বুঝি?
– ওহ, আমি এখানে ছিলাম। আপনি হয়তো আমাকে দেখতে পান নি। মাঝে মাঝে কাছে থেকেও মানুষের দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যায় মানুষ৷ তাই এটা অস্বাভাবিক কিছু না। আচ্ছা আমরা কখন বের হবো?

অয়ন কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো৷ একেই ঘুম থেকে ধরফর করে উঠেছে উপরে এতোক্ষণ পাগলের মতো প্রাপ্তিকে সে খুঁজেছে তাই প্রাপ্তির গোলকধাধার মতো কথাগুলো তার মাথায় ঢুকে নি। বিরবির করে বললো,
– কয়টা বাজে?
– সাড়ে নয়টা।
– শিট, আমাদের দশটার মধ্যে ঢাকা পৌছাতে হতো। এখন যে জ্যাম, তাতে মনে হয় না। বারোটার আগে ঢাকা পৌছাতে পারবো। আমি ইডিটর স্যারকে ফোন করে দিচ্ছি যাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে। বাসায় যেয়ে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে দুপুরের আগে বের হয়ে পারবো না বোধ হয়।
– আপনি কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে আসুন, নাস্তা তৈরি। আমরা নাস্তা করেই বেরিয়ে যাবো।

প্রাপ্তির কন্ঠ শীতল। সে যান্ত্রিক ভংগিমাতে কথা বলছে। অয়ন চোখ কুচকে কিছুক্ষণ প্রাপ্তিকে পর্যবেক্ষণ করলো। গতরাতের প্রাপ্তি এবং সকালের প্রাপ্তির মাঝে বেশ তফাৎ লক্ষ করতে পারছে সে। কিন্তু তফাৎ এর রেখাটা খুব সূক্ষ্ণ তাই সেটা ধরতে পারছে না অয়ন। চিন্তিত হয়ে রুমের দিকে হাটা দিলো সে। প্রাপ্তির মাঝে কিছু একটা খুজে পাচ্ছে না সে। কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে না। পরক্ষণে ভাবলো এসব চিন্তা করার অনেক সময় পাবে সে। নিরিবিলি একটা সময় না হয় জিজ্ঞেস করে নিবে, আপাতত ঢাকায় পৌছানো জরুরি। অয়ন চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাপ্তি৷ তার মুখটা জানালার দিকে। চোখ দুটো নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রয়েছে। চায়ের দুধ উতলে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই প্রাপ্তির। নিজেকে গুছাতে ব্যাস্ত সে_____________________

রাইসা কি ভাবছে সেটা খুব ভাবাচ্ছে আবরারকে। তার মিথ্যেটুকু রাইসা ধরতে পারে নি। কিন্তু সত্যরুপী মিথ্যেটুকু রাইসাকে বেশ হতবিহ্বল করেছে। সে তিনদিন যাবৎ আবরারের সাথে কথা বলছে না। হয়তো মাতৃত্বের স্বাধ না পাওয়াটি সে এখনো মানিয়ে নিতে পারে নি। আবরার তাকে ঘাটছে না। এমন একটি সত্য কোনো নারীর পক্ষে সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বাচ্চার জন্মের জন্য নারীকেই দোষারোপ করে। বাচ্চা হচ্ছে না, মেয়েটির দোষ। বাচ্চা মেয়ে হয়েছে, মায়ের দোষ। কিন্তু কখনো পুরুষের পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে না। কিংবা পুরুষের দিকে আঙ্গুল উঠে না। তাই আমাদের মাথায় এই চিন্তাধারাগুলো বসে গিয়েছে। সুতরাং কোনো পুরুষের সমস্যার জন্য কোনো দম্পতি বাচ্চা নিতে পারবে না ভাবতেই কেমন একটা গা শিরশির করে। আবরারের ধারণা রাইসার হয়তো সেই ধারণাটি ই মাথায় ঝেকে বসেছে। হয়তো আবরারকে তার কোনো নিম্নবর্গের মানুষ মনে হচ্ছে৷ তার অক্ষমতার কথাটি জানতে পেরে মনে প্রশ্ন জাগছে। হয়তো তাকে ছেড়ে যাবার কথাও চিন্তা করছে। আবরার সিগারেটটি নিভিয়ে নিজের রুমে গেলো। এর মধ্যেই পিয়ন এসে বললো,
– স্যার, আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন কেউ!
– কে এসেছে হামিদ?
– একজন মহিলা স্যার। নাম বলেন নি
– পাঠিয়ে দাও।
– জ্বী স্যার

হামিদ যাবার মিনিশ পাঁচেক বাদে রাইসা রুমে প্রবেশ করলো। তার হাতে কিছু কাগজপত্র। আবরার কিছু বলার আগেই সে বললো,
– আমি ডাক্তার ইকবালের কাছে সিরিয়াল দিয়েছি। আজকে ডেট পড়েছে। চলো একবার ভিজিট করে আসি।
– তাতে লাভ?
– তোমার সমস্যাগুলো তাকে দেখালাম। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। হয়তো আমরা কোনো উপায় পাবো। আর সত্যি বলতে চেষ্টা তো করতেই পারি তাই নয় কি!
– যদি লাভ না হয়?
– এডাপ্ট করতে পারি

অকপটেই কথাটা বললো রাইসা। আবরারের ভ্রু আরো দু সে.মি কুঁচকে গেলো। রাইসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– বিয়েটা যখন হয়েই গিয়েছে আর ভালো যখন বেসেছি তোমাকে তোমার সব কিছু মিলে ভালোবাসতে চাই। তুমি নিজেকে হীন চোখে দেখো না প্লিজ। সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু কোনো সমস্যা স্থায়ী নয়! আমরা চাইলেই সমস্যার সমাধান করতে পারি। একবার চেষ্টা করে দেখি না। যদি কোনো চিকিৎসা কাজ না করে তবে আমরা একটা বাচ্চা এডাপ্ট করবো না হয়। তবে তখন পরিবারকে কি জানাবো! এটা বুঝতে পারছি না।
– আমি তাদের সত্যিটা জানিয়ে দিবো৷ তুমি সেটা নিয়ে ভেবো না।
– কিন্তু লোকে কথা তুলবে! নানা হাবিজাবি কথা বলবে। এর থেকে আমি বরং বলবো আমার পক্ষেই বাচ্চা ক্যারি করা পসিবল না।

আবরার কিছু বললো না। ছুটে গিয়ে রাইসাকে জড়িয়ে ধরলো। তার ধারণাগুলোকে সে মিথ্যে করে দিয়েছে। আজ খুব আনন্দ লাগছে আবরারের। রাইসা তার এরুপ কান্ডে মনে মনে হাসলো। লোকটার প্রতি ভালোবাসাটা এতোটা গাঢ় হয়ে গিয়েছে যে তার জন্য সে শ্রেষ্ঠ সুখের ত্যাগ করতেও রাজী। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। হয়তো সময় ই তাদের কোলে সুখের ঝুলি ঢেলে দিবে।

আজ পাঁচদিন হয়েছে প্রাপ্তি এবং অয়ন কক্সবাজারে এসেছে। এই তিনটি দিন তাদের দাম্পত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। প্রাপ্তি তার জীবনের সর্বোচ্চ সুখ এখানে কুড়িয়ে নিয়েছে, এই পাঁচটি দিন তার প্রাপ্যের খাতায় শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। অয়নও তার খোলসময় জীবনের থেকে নিজেকে বের করে এনেছে। তার ভেতরের হারানো বেদনার ছায়া কাঁটিয়ে হারানো জীবশক্তি এই পাঁচদিনে ফিরে পেয়েছে। প্রাপ্তি মেয়েটার সাথে অভিনয় ব্যাতীত এই পাঁচটি দিন সে থেকেছে। তার মনের কোনায় নিভু নিভু ভালোবাসার প্রদীপটি সমুদ্রের সূর্যোদয়ের সাথে নতুন ভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছে। সে আজান্তেই প্রাপ্তির মোহে ঢুবে গিয়েছে। ভালোবাসা নামক বিষটি মধু ভেবে আবারো পান করতে রাজী সে। কিন্তু এগুলো কিছুই প্রাপ্তিকে বলা হয় নি। আগামীকাল ঢাকা ফিরবে তারা। অয়ন ঠিক করলো আজ সূর্যাস্তের সাথে সাথে এই অভিনয় ইতি টানবে সে। প্রাপ্তির কাছে ক্ষমা চাইবে। নতুন ভাবে তাদের বৈবাহিক জীবনটি শুরু করবে সে। তবে তার ব্রাজিল যাবার প্লানটি এই সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে। তবে এতে তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। প্রয়োজনে প্রাপ্তির সাথেই তার পথচলা শুরু করবে সে। পাশের একটি দোকান থেকে একটি ঝিনুকের মালা কিনলো অয়ন। এই প্রথম নিজ থেকে কিছু কিনেছে সে। প্রাপ্তি সমুদ্রের ধারে পানিতে পা ঢুবিয়ে ধারিয়ে আছে। গাঢ় লাল সূর্যটি সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে। নীল সমুদ্র লালচে হয়ে আসছে। এই মনোরম দৃশ্যটি মন ভরে দেখছে সে। হঠাৎ কেউ চোখ চেপে ধরলে প্রাপ্তি নির্বিকার চিত্তে বলে,
– অয়ন।
– কিভাবে বুঝলে?
– আমি বুঝি
– প্রাপ্তি তোমাকে কিছু বলার আছে।
– আমি জানি, কি বলবেন
– তাই বুঝি?
– হুম, আপনি সামনের সপ্তাহে ব্রাজিল চলে যাচ্ছেন, তাই তো?……………..

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here