এক_ফালি_রোদ ৩৩তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩৩তম_পর্ব

– তোর তো বাচ্চা খুব ভালো লাগে তাই না! আচ্ছা, যদি এমন হয় ও যদি কখনো মা না হতে পারে তাহলেও কি তুই ওকে ভালোবাসবি?

আবরারের প্রশ্নে থমকে যায় অয়ন। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
– রাইসার মাঝে কোনো অপূর্ণ থাকতেই পারে না। সুতরাং এসব কথা আমি চিন্তাও করতে চাই না।
– তবুও নিজেকে সেই পরিস্থিতিতে একবার রেখে তো দেখ।

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তার চোখে মুখে একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। আবরারের একবার মনে হলো সে অয়নকে সত্যিটা বলে দিবে, পরক্ষণে নিজেকে আটকালো। অয়নকে বলে খামোখা সে রাইসার ব্যাপার দশকান করতে চাচ্ছে না। আর সবথেকে বড় ব্যাপার, রাইসা এতো বড় ধাক্কাটা সামলাতে পারবে না। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। অয়ন নিজের চুপটি ভাঙ্গলো৷ বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
– ভাই পরিস্থিতি মানুষকে সব শিখিয়ে দেয়। আমি সত্যি জানি না আমি ওই পরিস্থিতিতে কি করবো। সুতরাং এখন আকাশকুসুম চিন্তা করে লাভ নেই। আমি এখন বললাম আমি ব্যাপারটাকে হাসিমুখে মেনে নিবো কিন্তু ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলে এমনটা নাও করতে পারি। আবার হয়তো সত্যি সত্যি বিষয়টাকে হাসিমুখে মেনে নিবো। মানুষ পরিবর্তনশীল, প্রতিনিয়ত সে বদলায়। আমিও মানুষ আমিও কিন্তু প্রতিনিয়ত বদলাই। সুতরাং এসব চিন্তা করতে চাই না। আমি হয়তো তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তোর কাছে আমার নিবেদন এই বিয়েটা করিস না।

বলেই উঠে দাঁড়ালো অয়ন৷ তার বেশ বিরক্ত লাগছে, কেনো লাগছে তা তার জানা নেই। তবে আবরারের প্রশ্নটি তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি যদি এমনটা হয় কি করবে সে!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ বড্ড দেরি হলো আবরারের। এ কয়দিন খাওয়া দাওয়ার কিছুই ঠিক নেই তার। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলছে, নিজের অনুভূতিগুলোর যাতাকলে প্রতিনিয়ত পিশছে সে৷ সিদ্ধান্তের বোঝাটা এতো বড় হবে কল্পনা করে নি। অয়নের কথাটার মর্মার্থ কি দাড় করানো যায় এটা বুঝতে পারছে না আবরার। কিছু না খেয়েই নিজ রুমে চলে গেলো আবরার। আজকাল ক্ষুধামন্দা রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো আবরার। বিছানায় বসতে বসতে একটা অচেনা নাম্বার থেকে সমানে ফোন আসা শুরু করলো। প্রথমে বিরক্ত হয়ে কেটে দিলেও অপরপাশের বান্দা সমানে ফোন দিয়েই যাচ্ছে। শেষমেশ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলো আবরার। ফোন রিসিভ করতেই একটি মিষ্টি নারী কন্ঠ কানে ভেসে এলো,
– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম সালাম, কে বলছেন?
– আমি রাইসা বলছিলাম। আমি কি মিস্টার আবরারের সাথে কথা বলতে পারি?
– জ্বী, আমি ই আবরার বলছি। বলুন কি বলবেন?
– আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম। কাল কি সময় হবে আপনার?
-……..
– দেখুন ব্যাপারটা খুব জরুরি, নয়তো আমি আপনার সাথে দেখা করার কথা বলতাম না।
– আপনি কি বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারেই আমার সাথে কথা বলবেন?

আবরারের অকপটে করা প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রাইসা। তারপর ধীর গলায় বলে,
– আমি বিয়েটা করতে পারবো না। আমি কাউকে ভালোবাসি। তাকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
– সেটা আমার কন্সার্ণ নয়। আপনার কোনো আপত্তি থাকলে আপনার বাবাকে জানান। বিয়ের প্রস্তাবটি তিনি ই দিয়েছিলো। আমি কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে চাই নি। যাই হোক। এখন আমি কিছুই করতে পারবো না।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো আবরার। আবরারের রাগ লাগছে। কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলো সে অয়ন এবং রাইসার মাঝ থেকে সরে যাবে। কিন্তু হুট করেই বুকের কোনে ছাই ছাপা আগুনের শিখাটি লিকলিক করে জ্বলতে লাগলো। আচ্ছা তাকেই কেনো সব সময় আত্নত্যাগ করতে হবে। তার ভালোলাগা, মন্দলাগার কি কোনো দাম নেই? ভালোবাসা, দায়িত্ব, অপরাধবোধের পাটাতনে তাকেই পিশতে হচ্ছে। রাইসা এবং তার সম্পর্কটা এতোটাই জলঘোলা করা হয়েছে যে এই জলে এখন নিজেদের সুখী থাকার প্রতিচ্ছবিটুকু দেখার কথা চিন্তাও করতে পারছে না সে। আচ্ছা রাইসার মনে একবার ও প্রশ্ন জাগে নি সে যাকে তার ভালোবাসা মনে করছে সেই লোকটি আদৌ তার ভালোবাসা? রাগটা জেদের রুপ নিলো। আর তার প্রায়শ্চিত্ত তাকেই করতে হবে, তার একটু মুক্তি চাই। এই অপরাধবোধ অনুভূতিটা থেকে মুক্তি চাই তার। তাতে যদি রাইসাকে বিয়ে করতে হয় তাই সই। রাগ, জেদে যেনো অন্ধ হয়ে গেলো আবরার। ভালোবাসাটা পাগলামীতে রুপ নিলো। টেবিলের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো সে। এই কদিনে কয় প্যাকেট সিগারেট খাওয়া হয়েছে তার হিসেব নেই। সারাটারাত নির্ঘুমই কাটলো আবরারের। চোখের পাতা এক করতে পারছিলো না সে। বুকের কোনায় লিকলিকে আগুনটা নেভানো যেনো দায় হয়ে গিয়েছিলো সেরাতে________

আবরারের ইচ্ছেতে যেনো উপরওয়ালার কোনো সম্মতি ছিলো। তাই ইসমাইল সাহেবের কেসটাও তার হাতেই এসেছিলো। ইসমাইল সাহেবের ম্যানেজার তার ট্যাক্সে বিপুল ঘাপলা করেছে। ব্যাপারটা এতোই জটিল হয়ে গিয়েছে যে যদি ব্যাপারটায় কোনো একশন নেওয়া হয় তবে লাখ টাকা জরিমানা সাথে জেলের ঘানিও টানতে হবে ইসমাইল সাহেবকে। কেসটাকে ইগনোর করার ও উপায় নেই। তবে আবরারের চাকরির পদটি এতোটা উপরে যে যদি সে চায় তবে সে ইসমাইল সাহেবকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তবে যদি কোনোভাবে ধরা পড়ে তবে তার চাকরি চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কেসটাকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না আবরার। তখনই রাইসা তার কাছে আসে সাহায্য চেতে৷ সেই সুযোগটাই নেয় আবরার। সেটার ফলাফল ই তাদের বিয়ে। অনেকের কাছে আবরার একজন স্বার্থপর মানুষ, রাইসার অসহায়ত্বকে সে ব্যাবহার করেছে। কিন্তু পৃথিবীতে কিছুই শুধু খারাপ কিংবা ভালো হয় না। কিছু কিছু চরিত্র ভালো মন্দের মিশ্রণ হয়। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে আমরা কিছু চরিত্রকে শুধু ভালো বা মন্দের ভাগে ফেলি। কিন্তু সেই মানুষটার পরিস্থিতি কখনোই বিচার করি না। কোনো মানুষ ই পুরোপুরি খারাপ কিংবা ভালো হয় না। এখানে শুধু আবরারের যে দোষ ছিলো তা নয়, সেই সমান দোষের ভাগী ইসমাইল সাহেব ও ছিলেন। আবার সেই দোষের ভাগটি অয়নের ঘাড়ে বর্তায়। আর রাইসা ছিলো উপরওয়ালার সেই সুতো যা দুই ভাই এর ভেতর একটি সুত্ররুপে পরিণত হয়েছে। সে পরিস্থিতির বিদ্রুপের স্বীকার মাত্র। তার জীবনের সাথে শুধু পরিস্থিতি এক বিদ্রুপের খেলাই খেলেছে। অতীতের ধোয়াশা স্মৃতি আবরারের চোখ থেকে এক বিন্দু নোনাজলের রুপে গড়িয়ে পড়লো। বয়স তার কম হয় নি। এবার পয়ত্রিশে পা রেখেছে সে। কিছুদিন পর এমনেই পরিবার থেকে চাপ শুরু হবে। রাইসার অপূর্ণতার সত্যিটুকু কারোর সামনে আনতে সে একেবারেই রাজী নয়। শুধু দয়া করে সে রাইসাকে বিয়েটা করে নি। রাইসাকে সে ভালোবাসে। তখন জেদের বশে বিয়েটা করলেও প্রতিনিয়ত সেই জেদের শাস্তি সে পেয়েছে। ভালোবাসার মানুষটি তাকে কেবল ঘৃণার চোখেই দেখেছে। ভালোবাসার মানু্ষটির ঘৃণার চাহনীটি মরীচা পড়া সূচের মতো মনে হয়। আবারো ঘৃণার পাত্র হবার ইচ্ছে নেই তার। আরো ও একবার নির্ঘুম রাত্রীযাপন করলো আবরার। মাথায় এক চিন্তা দুঃস্বপ্নের মতো হানা দিচ্ছে। হয়তো এবারো খুব কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা________________

প্রাপ্তির ঘুম ভাঙ্গলো সূর্যের তীর্যক রশ্নির উত্তপ্ত গরমে। নিজেকে অয়নের বুকে আবিষ্কার করলো সে। এই দৃশ্য খুব দুষ্কর। হাতে গোনা যাবে এমন সকাল। আজ তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর বিয়ের পর এই দিনটি এই প্রথম। মনে হাজার স্বপ্ন ডানা মেলেছে। তাই আজ মনটা আনন্দে গদগদ হয়ে রয়েছে। অয়নের রোদ একেবারেই পছন্দ নয়। চোখ মুখ কুচকে সে শুয়ে রয়েছে। তখনই………..

চলবে

[আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে গল্পটি দিতে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে। পারিবারিক সমস্যার মধ্যে রয়েছি। জানি না কবে নিস্তার পাবো। আমার জন্য দোয়া করবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here