এক_ফালি_রোদ ৩১তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
৩১তম_পর্ব

ডাক্তারের কাছে যেয়ে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন,
– মেয়েটি এমনি ভালোই আছে, শুধু একটা অপূর্নতা মেয়েটির সারাজীবন নষ্ট করে দিলো।
– ডাক্তার একটু খুলে বলবেন?
– ও কখনোই মা হতে পারবে না। অবশ্য কখনোই মা হতে পারবে না বললে কথাটি ভুল হবে। এক্সিডেন্টের কারণে মেয়েটির মাথার পেছনে ভীষন চোট পেয়েছে। দেখুন আমাদের ব্রেইনে পিটুইটারি গ্রন্থি নামক একটি গ্রন্থি রয়েছে। সেটা সাধারণত আমাদের সকল হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেহের ফাংশনগুলোর নিয়ন্ত্রণ এই হরমোনগুলোই করে। মেয়েটির মাথায় চোট লাগার কারণে হরমোনার ডিসব্যালেন্স হয়েছে। যেকারণে এখন থেকে তার ঋতুস্রাব খুব অনিয়মিত হবে। যে দুটো হরমোন তার ঋতুস্রাব, প্রেগন্যান্সি কন্ট্রোল করে তাদের ক্ষরণটা এতোটাই অনিয়মিত হচ্ছে যে ভবিষ্যতে বাচ্চা কন্সিভ করাটা খুব দুষ্কর হয়ে যাবে ওর জন্য। বাচ্চা কন্সিভ করলেও তা ধরে রাখার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। তাই মেয়েটি কখনো মা হতে পারবে না কথাটা আমি বলেছিলাম

আবরার স্থির হয়ে দাঁড়য়ে রইলো। তার পায়ের মাটি যেনো ধপ করে খসে পড়লো৷ আজ তার জন্য অজান্তেই একটি মেয়ের এতোবড় ক্ষতি সে করে ফেললো। নিচু স্বরে সে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
– এর কোনো চিকিৎসা নেই!
– দেখুন চিকিৎসা বিজ্ঞান এগোলেও সব কিছুর চিকিৎসা সত্যি আমাদের হাতে থাকে না। প্রাণ দেবার মালিক তো এক জন, যিনি উপরে বসে রয়েছেন। আমরা শুধু রিপোর্ট দেখে বইয়ের কথাগুলোই বলি। মেয়েটির এখন স্বাস্থ্যের যে অবস্থা তাতে বাচ্চাটা নেওয়াটা ঝুকি ছাড়া আর কিছু হবে না। তবে এখন স্যারোগেসি, টেস্টটিউব বেবির অনেক সুবিধা রয়েছে। মাতৃত্বের স্বাধ সে হয়তো নিজ গর্ভ থেকে পাবে না, কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। আসছি

ডাক্তার চলে গেলেন। আবরার যেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটির মা হাউমাউ করে কাঁদছেন। অজান্তেই আবরারের কঠোর চোখে নোনা জলের আবির্ভাব হলো। এই অশ্রুও বেশ ছোয়াছুয়ি, একজনকে কাঁদতে দেখলে অটোমেটিক অন্যের চোখে এসেই পড়ে। আবরার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাদের কাছে। তাকে দেখে মেয়েটির বাবা অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কে বাবা? আমার মেয়ে কে চিনতে তুমি?

কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারলো না আবরার। কথাগুলো গলা অবধি এসেও আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিটা তো স্বীকার করতেই হবেই। মাথা নত করে হাত জোর করে বলতে শুরু করলো,
– আমাকে ক্ষমা করে দিন। আজ আপনার মেয়ের যে অবস্থা সব কিছু আমার জন্য। অজান্তেই হোক কিন্তু আমি ই দোষী

মেয়ের মা-বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মেয়ের মা কিছু না বললেও তার বাবার চোখে ক্ষোভ স্পষ্ট ছিলো। সে যদি এখানে আবরারকে অপমান ও করে তবুও আবরারের কোনো আপত্তি নেই। সে মাথা নত করে সব মেনে নিবে। মেয়েটির জন্য যতটুকু সে করতে পারবে সেটাও করতে রাজী রয়েছে সে। তখনই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে মেয়েটির বাবা বলে উঠেন,
– তোমাদের মতো ছেলেদের খুব ভালো করেই জানা আছে। এখন ক্ষমা চাওয়ার নাটকটি না করলেই কি নয়। যা ক্ষতি করার তো করেই দিয়েছো। এখন সহানুভূতির ঢংটা না করলেই ভালো হবে।
– আংকেল আমাকে ভুল বুঝবেন না দয়া করে৷ আমি সহানুভূতি দেখাচ্ছি না। আমি সত্যি ই অনুতপ্ত। আমি এর জন্য যা আমার আয়ত্তে পড়বে আমি করবো। আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। ওর যে সাহায্যের প্রয়োজন আমি সেটা করবো। প্লিজ আমাকে একটি সুযোগ দেন।
– আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে?

লোকটির কথাটা শুনে আবরার স্তব্ধ হয়ে গেলো। এভাবে লোকটা তাকে প্রশ্নটি করবে এটা তার চিন্তার বাহিরে ছিলো। কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। দ্বিধা, কষ্ট, ভালোবাসা, গ্লানি অনুভূতি গুলো তাকে ভেতর থেকে শেকলের মতো আকড়ে ধরছে। মেয়েটির বাবা অট্টহাসি হাসেন। বিদ্রুপের কন্ঠে বলেন,
– বলার সময় সবাই বলতে পারে৷ কিন্তু সময় আসলে কেউ করতে পারে না। যাও যাও। নিজের কাজে যাও। আমার মেয়ের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।

বাহিরে আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আবরারের বাড়ির লোকেরা নিচে অপেক্ষা করছে। তার যেতে হবে, ক্ষমা পাবার আশা সে ছেড়ে দিলো। লোকটির প্রশ্নটি তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত এই দুনিয়াতেই তার করতে হবে। বুকের উপর পাথর চাঁপা দিয়ে হলেও এই কাজটা তাকে করতে হবে।

দিন কাঁটতে থাকে। দেখতে দেখতে একটি মাস কেঁটে যায়। মেয়েটিকে এখনো একবার চোখের দেখা দেখে নি সে। মেয়েটির সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকু নেই তার। তবে তার খোঁজ নেয় নি এমন একটি দিন ও কাঁটে নি। একদিকে রাইসার সাথে এখন আর কথা হয় না তার। ইচ্ছে করে না। কি মুখে মেয়েটির সাথে কথা বলবে! তাকে যে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই রাইসার পিছুটান তাকে ছাঁড়তেই হবে। রাইসা তারসাথে দেখা করার জন্য বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন আবরার একটি বুদ্ধি বের করে, সে অয়নকে ডেকে পাঠায়। অয়ন এবং আবরারের সম্পর্কটা ভাইয়ের থেকে বন্ধুত্বের বেশি। অয়নের কাছে আজ একটি সাহায্যের জন্য হাত পাততে হবে। এবং তার বিশ্বাস অয়ন তাকে এই সাহায্যটি করবে। চিন্তায় মগ্ন ছিলো আবরার, তখনই অয়ন আসে। অয়ন বসতে বসতে তাকে প্রশ্ন করে উঠে,
– কি রে ভাই, যেখানে আমার তোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় সেখানে আজ আমার সাহায্য তোর কিভাবে প্রয়োজন হলো?
– এতো অবাক হবার কি আছে? আসলে খুব ঝামেলায় না পড়লে সাহায্যটা চাইতাম না।
– ব্যাপারটা কি মেয়ে রিলেটেড?
– তুই কিভাবে বুঝলি?
– অনুমান, তুমি যতটা লাজুক তাতে আমার মনে হয় এটা মেয়ে জনিত ই কোনো কারণ। বলে ফেলো, বলে ফেলো।
– আমার একজন বন্ধু হয়েছে, রাইসা নাম। মেয়েটির সাথে প্রোফাউন্ডলি মি থেকে পরিচয় হয় আমার। বিগত ছয়মাস ধরে মেয়েটিকে আমি চিনি।
– ভালো টালো বাসিস নাকি?
– জানি না
– আচ্ছা সমস্যাটা কি?
– আমার কিছু নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। আমি মেয়েটির সাথে সম্পর্কটি আগাতে চাচ্ছি না। সে আজকে আমাকে দেখা করতে বলছে
– তো তাকে বলে দে।
– সাহস হচ্ছে না, যদি ওকে ভালোবেসে ফেলি? তখন
– তাহলে কি চাস তুই?
– আমি চাই তুই ওর সাথে দেখা করিস।
– তুই কি পাগল? এটা কি অন্যায় হবে না?
– আমি ওর সামনে যেতে চাই না। আমার সাহসে সত্যি কুলাচ্ছে না। আমার জীবনটা অনেক জটিল হয়ে গিয়েছে। আমি চাইলেও সেই জটিলতা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারছি না। তুই শুধু ওর সামনে যাবি আর আমার হয়ে ওর সাথে দেখা করবি। তুই আমার নামে ইচ্ছেমতো উলটো পালটা কথা বলবি, যাতে সে আমাকে ঘৃণা করে। মেয়েটি ক্যাফেতে অপেক্ষা করবে। আমি চাই না ও আমার অপেক্ষায় থাকুক। ওর প্রোফাইল আমি ব্লক করে দিবো।

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো৷ তার দায়িত্ববান ভাই এই প্রথম পাগলামী করছে। হয়তো অজান্তেই সে ওই মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। অয়ন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো তারপর বললো,
– ঠিক আছে। মেয়েটিকে কি নাম বলেছিলি?
– না, মেয়েটি আমার নাম জানে না।
– আচ্ছা, নিশ্চিন্তে থাক।

বলেই অয়ন উঠে দাঁড়ালো। আবরার বারান্দায় চলে গেলো। পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেটটি বের করল। একটি সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিলো সে৷ নিজের সদ্য জন্মানো ভালোবাসার উত্তপ্ত আগুনকে ছাই চেপে নিভিয়ে দিলো সে। রাইসা নামক মেয়েটির সকল স্মৃতি মন থেকে মেটানোর ব্যার্থ চেষ্টা করতে শুরু করলো সে৷ কিন্তু তখন সে জানতো না সামনে আরোও পরীক্ষার সম্মুখীন তাকে হতে হবে। এক প্রায়শ্চিত্ত এবং সত্যের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার জন্য একসাথে তিনটি জীবনকে উত্থান পতনের সম্মুখীন হতে হবে এটা তার জানা ছিলো না।

দেখতে দেখতে একটি বছর কেঁটে যায়। মেয়েটির বাবার কাছে আবরার বিয়ের প্রস্তাবটিও দেয়। মেয়েটির বাবা গদগদ হয়ে আবরারের প্রস্তাবটিও মেনে নেন। দিনটি ছিলো এমন কোনো জুলাই এর সন্ধ্যে। আবরারের কথা মতো সিকদার পরিবার হাজির হয় মেয়েটির বাসায় বিয়ের পাকাপাকি কথার জন্য। মেয়েটির নামও রাইসা। আবরার অবশ্য তাতে বেশ একটু অবাক হয় নি। কারণ একই নামের দুজন মানুষ তো থাকতেই পারে। বাসায় যখন মেয়েটির ছবি তখন দেখানো হয়। তখন প্রথমবার আবরার ও মেয়েটির ছবি দেখে। মেয়েটিকে কোনো এক অজানা কারণে বেশ মনে ধরে আবরারের৷ এক রাইসাকে না পেলেও তার ভালোবাসা অন্য কোনো রাইসার জন্য না হয় তোলা থাক। আবরারের হবু বউ এর ছবিটি তখন হাত বদল হতে হতে অয়নের হাতে পড়ে। অয়নের তার হবু ভাবীকে নিয়ে মারাত্নক কৌতুহল ছিলো। কিন্তু ছবিটি দেখা মাত্র…….

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here