এক_ফালি_রোদ
৩০তম_পর্ব
সিগন্যালটি ছাড়তে বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো আবরার। একেই বৃষ্টির বিকেল, উপরে স্পিডটা ছিলো অতিরিক্ত তাই যখন হুট করে একটা গাড়ি সামনে চলে আসে একেবারেই সামলে উঠতে পারে না আবরার। অমনি দূর্ঘটনা এড়াতে ওভারটেক করতে যায় আবরার। অপর গাড়িটির বেগ এতোটাই বেশি ছিলো যে কোনো ভাবেই দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিলো না। উপরন্তু আবরারের বাইকের স্পিড ও প্রচুর ছিলো। তাই দূর্ঘটনা এড়াতে ওভারটেক করে নিজের দিক পালটে দেয় আবরার। একেই বাইকের স্পিড বেশি উপরন্তু রাস্তাও পিচ্ছিল। ব্রেক চাপলেও কিছুতে বাইক থামাতে পারছিলো না। ঠিক তখনই একটি মেয়ে গাড়ির মাঝেও রাস্তা পার হবার চেষ্টা করছিলো। বাইক না সামলাতে পেরে সেই মেয়েটির সাথেই ধাক্কা লাগে আবরারের বাইকের। মেয়েটি রাস্তার ধারে ছিটকে পড়ে যায়। আর আবরার বাইকটি সহ রাস্তার উপর ছিটকে পড়ে যায়। ছিটকে পড়ার কারণে মাথায় বেশ ব্যাথা পায় আবরার। সাথে সাথেই সেখানে লোক জড়ো হতে শুরু হয়। কিছুক্ষণ আবরারের হুশ অবধি ছিলো না। সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। আবরারের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যায় সে। আশেপাশের মানুষের কোলাহল যেনো শান্ত হয়ে যায়। নিস্তব্ধতায় ঘিরে যায় সে। তবুও একটা কথাই মাথায় ঘুরতে থাকে মেয়েটির কি অবস্থা! সে কি বেঁচে আছে! নাকি আজ অজান্তেই কারোর জীবনের প্রদীপটুকু নিভে গেছে তার হাতে।
আবরারের জ্ঞান ফিরলো সন্ধ্যার আগমূহুর্তে, বৃষ্টির ক্রোধ তখন ও থামে নি। অবিরাম বর্ষণ এখন ও থামে। যদিও হাসপাতালের রুমটি থাই গ্লাসে ঘেরা তবুও বৃষ্টির মৃদু ছন্দ কানে আসছে আবরারের। হাত পায়ের ব্যথাটা এখন বেশ ভালো ভাবেই জানান দিচ্ছে যে সে আছে। তাকে ভুলে গেলে হবে না। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। বুঝাই যাচ্ছে ধকলটা কম যায় নি। কনুই এ ঠেক দিয়ে উঠে বসলো আবরার। আশেপাশে বেশ কয়টি বেডিং রয়েছে। তার বুঝতে বাকি রইলো না সে কোনো হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি৷ চোখ বুঝে নিজের স্মৃতিটাকে রিভাইন্ড করার চেষ্টা করলো আবরার। কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে সে। যার জন্য তার বুক ধরফর করছে। তখন ই একটি নার্স এসে বললো,
– আপনি উঠে গেছেন?
নার্সের কন্ঠটি কানে আসতেই ফেলফেলিয়ে তাকায় আবরার। মহিলাটির বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে হবে। পা খেয়ে মুখ লাল করে রেখেছে সে। আবরারের জ্ঞান ফিরাতে এমন এক চাহনীতে তাকাচ্ছে যেন, আবরারের জ্ঞান ফেরা একেবারেই তার পছন্দ হয় নি। আবরারকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নার্স হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– আপনার কি গায়ে ব্যাথা করছে? কোনো সমস্যা? কি হলো? বোবা হয়ে গেলেন নাকি?
– আমি ঠিক আছি। আচ্ছা আমি এখানে।কিভাবে এলাম?
– রাস্তার লোকেরা এম্বুলেন্স ফোন করেছিলো। এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছে।
– ওহ, আমি একাই ছিলাম কি?
– নাহ একা কেনো হবেন? একটি মেয়েও আপনার সাথে ছিলো
– উনি এখন কেমন আছেন?
– আই.সি.উ তে আছে! জানি না বাঁচবে কি না!
নার্সের কথাটা শুনে আবরার স্তব্ধ হয়ে গেলো। অপরাধবোধের গ্লানি তাকে নিজের চোখেই নামিয়ে দিয়েছে। একটা মেয়ের জীবনটা তার একটা ভুলের কারণে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলো৷ অপরাধবোধ অনুভূতিটাই এমন, জীবিত মানুষকেও জাহান্নামের যন্ত্রণা অনুভব করিয়ে দেয়। আবরারের নিজের উপর ক্ষোভ হলো, শুধু তাই ই নয় আফসোস হতে লাগলো সে কেনো বেঁচে আছে তাই। আকুতির কন্ঠে নার্সকে জিজ্ঞেস করলো,
– আমি কি তার সাথে একটু দেখা করতে পারি?
– এটা কি সিনেমা নাকি? আইসিউ তে প্যাশেন্ট এলাউ নয়।
– আচ্ছা উনার কোনো আত্নীয় কি এসেছেন?
– হু, এসেছেন উনার বাবা আর মা। আইসিউ এর বাহিরে সেই কখন থেকে বসে রয়েছে।
– তাদের সাথে কি একটু কথা বলতে পারবো আমি?
– দেখুন আপনি নিজেই সুস্থ নন। পায়ে ফ্রাকচার হয়েছে। আগে সুস্থ হয়ে নিন৷ তারপর না হয় কথা বলবেন। এখন ডাক্তার রাউন্ডে আসবে তাই একটু ঠান্ডা থাকেন। যতসব
নার্স চলে যায়। তার জামা কাপড় বদলে দেওয়া হয়েছে, হয়তো মোবাইল মানিব্যাগটাও হসপিটালের কাছে। আবরার আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিলো। বুকের উপর কেউ দশ টন পাথর চাপা দিয়েছে এমন অনুভূতি হতে লাগলো। হুট করে মনে পড়লো তার রাইসার সাথে আজ দেখা করার কথা ছিলো। মেয়েটির প্রতি প্রচুর দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। যদিও রাইসার জন্য কেবল ই বন্ধু মাত্র সে। কিন্তু রাইসা তার কাছে বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি। এক কথায় বলতে গেলে ভালোবেসে ফেলেছে সে। না দেখেও ভালোবাসা সম্ভব এই কথাটা তার কাছে একটি মিথ মনে হতো। কিন্তু এখন এসব আর মিথ মনে হয় না। সব কিছু যেনো স্বপ্নের মতো মনে হয়। হুট করেই মনের ভেতর অন্ধকার নেমে এলো আবরারের। রাইসা যদি জানতে পারে আজ তার জন্য একটি মেয়ের জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ছে, সে কি আবরারকে মেনে নিবে! তার অনুভব হচ্ছে ভেতর থেকে সে ভেঙ্গে চুড়ে যাচ্ছে, এটার নামই অপরাধবোধ অনুভূতি________
সপ্তাহ খানেক বাদে আবরার সুস্থ হয়ে উঠে। সে মেয়েটির খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়েছে। অনেক কষ্টে মেয়েটির জিবনের শেষ রক্ষা হয়েছে। মেয়েটিকে আজ আই.সি.উ থেকে শিফট করে ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে। আববারের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে একবার চোখের দেখা দেখতে। ক্ষমা চাওয়ার মুখ তার নেই। তবে তাকে ক্ষমা চাইতেই হবে। বাসার সবার অগোচরে মেয়েটির সাথে দেখা করতে যায় আবরার। মেয়েটির ওয়ার্ডের বাহিরে তার বাবা-মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। কিছুক্ষণ আগে একজন ডাক্তার তার সাথে কথা বলেছেন। আবরার ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। ডাক্তারের কাছে যেয়ে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন,
– মেয়েটি এমনি ভালোই আছে, শুধু একটা অপূর্নতা মেয়েটির সারাজীবন নষ্ট করে দিলো।
– ডাক্তার একটু খুলে বলবেন?
– ও কখনোই মা হতে পারবে না……..
চলবে
[পরবর্তী পর্ব আজ তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি