এক_ফালি_রোদ ২৫তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
২৫তম_পর্ব

আজ শ্বশুরবাড়িতে তার প্রথম সকাল, সবার জন্য নিজ হাতে নাস্তা বানাবে এটাই ঠিক করলো সে। যা ভাবা তাই কাজ। কিন্তু রান্নাঘরে যেতেই যা কানে এলো তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না প্রাপ্তি। রান্নাঘরে তখন শেফালী বেগমের আফসোসের বন্যা বইছিলো। রাইসা হাজারো বোঝানোর পর তিনি তার ক্ষোভ ব্যক্ত করেই যাচ্ছিলেন। রাইসা মিনতির স্বরে বলে,
– মা, আজ এই কথাগুলো না বললেই কি নয়? মেহমান এখন বাসায় ই আছেন। শুনলে কি ভাববেন বলুন তো?
– যা ভাবার তাই ভাববে? শোনো রাইসা। তোমরা কেউ মানো বা না মানো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওই অনাথ মেয়েটাকে ঘরে তোলাই আমাদের ভুল ছিলো। খাল কেটে কুমির এনেছি বুঝলে?
– মা, এতে প্রাপ্তির কি দোষ? আর বারবার তাকে অনাথ অনাথ বলবেন না। ও জানতে পারলে কষ্ট পাবে
– পেলে পাবে, রাইসা তোমরা এমন ভাব ধরছো যেনো কিছুই হয় নি! কাল আমার ঘরে বউ হয়ে এসেছে আর আজ আমার ছেলে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আর তোমরা এটাকে এমন ভাব করছো যেনো কিছুই হয় নি।

শেফালী বেগমের কথাটুকু কানে যেতেই থমকে গেলো প্রাপ্তি। অয়ন ঘর ছেড়ে চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? কেনো গেছে? কাল রাত তো সব ঠিক ছিলো। অয়নের বলা প্রতিটি কথা যেনো কানে বাজছে প্রাপ্তির। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হতে লাগলো। যেনো কেউ ভোতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত তাকে আঘাত করে যাচ্ছে। সব স্বপ্ন গুলো যেনো একমূহুর্তে চুরমার হয়ে গেলো প্রাপ্তির। অয়নের প্রতি অভিমান জমতে লাগলো মনের কোনে। ঠিক তখনই কানে এলো,
– মা, ও মোটেই বাড়ি ছেড়ে যায় নি। অয়ন একটা কাজে গেছে। ওকে একটা ম্যাগাজিন কল করেছে তাই ও সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে।
– বিয়ের দিন সকালে কোন পুরুষ মানুষ ভোর হতে কাজে যায় রাইসা? আমাকে বুঝিও না। এই চুলগুলো এভাবে সাদা হয় নি। আসলে কি বলতো আমার ছেলে বিয়েটাকে মানতে পারছে না।
– এমন কিছুই নয় মা, অয়ন বাচ্চা নয়। তার বিয়ে না করার ইচ্ছে থাকলে গত এক সপ্তাহ এভাবে বসে থাকতো না। যাবার হলে চলেই যেতো।

প্রাপ্তির জানে যেনো পানি এলো রাইসার কথা শুনে। নিজেকে কিছুক্ষণ খুব করে বকে দিলো। এভাবে কেউ কাউকে সন্দেহের চোখে দেখে? নিজের প্রতি নিজের রাগ হতে লাগলো প্রাপ্তির। অয়ন তাকে বিশ্বাস করে নিজের অতীত তার সামনে তুলে ধরেছে। একটা নতুন বর্তমান এবং ভবিষ্যতের আশায় সে তাকে আপন করে নিয়েছে। অথচ সে কি না অয়নকে ভুল বুঝছিলো। নিজের গালে নিজে চাপড় দিতে মন চাইলো প্রাপ্তির। কিন্তু পাছে লোক পাগল ভাববে বিধায় কাজটা করলো না। মনের মাঝে নিভু প্রদীপ খানি আশার দহনে আবারো জ্বলে উঠলো। অয়ন তাকে ছেড়ে যাবে না। এই ক্ষীন বিশ্বাস খানা তীব্র হতে লাগলো প্রাপ্তির। ধীর পায়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো সে। শেফালী বেগমের চোখ তার উপর পড়তেই তিনি ভ্রু কুচকে তাকালেন। প্রথমত এই সাঝসকালে প্রাপ্তির বেশভুষা দেখেই তার মনটা বিষিয়ে গেলো। এ নাকি ঘরের বউ। না গায়ে ভালো একটা জামা না কোনো গহনার বালাই। লোক কি বলবে একে দেখে? হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
– তা বলি, তোমার বড় বোনটিকে দেখে কি কিছু শেখো নি তুমি? বিয়ের দিন সকালে শাড়ি পড়তে হয়, একটু সাজতে হয় এটাও কি শিখিয়ে দিতে হবে তোমাকে?
– মা ওকে বকবেন না, আসলে ছেলেমানুষ তো!
– বিশ বছর তো হয়েছে রাইসা! আর কত ছেলেমানুষী। তোমার বয়স তো ওর থেকে অধিক নয়। অথচ তুমি ঘর সামলাও, কলেজ যাও। আর এই মেয়েটি
– মা, আমি ওকে সব শিখিয়ে নিবো। আপনি ঘরে যান, বিশ্রাম করুন।
– হাহ

বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শেফালী বেগম। প্রাপ্তি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। খুব কান্না পাচ্ছে, কিন্তু কাঁদলে তার দূর্বলতা সবাই বুঝে যাবে। তাই ঠোঁট চেপে চুপ করে রইলো। রাইসা কাছে এসে ধীর গলায় বললো,
– তোর কবে আক্কেল হবে প্রাপ্তি? শাড়ি পড়বি না আজকে? শুধু শুধু বকা খেলি তো?
– মা কি খুব রাগী?
– না রে, মা মায়ের মতো। রাগবে চটবে, আবার আদর ও করবে। আসলে তোদের বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে হয় নি তো। তাই কিছুটা ক্ষোভ জমেছে। আর তোর বেকুব বর সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। তার রাগ ও রয়েছে। এখন ছেলেকে বকার জন্য তো পেতে হবে। তাই রাগটা আমাদের উপর দিয়ে গেলো।
– কোথায় গেছে জানো?

রাইসা খানিকটা অবাক হলো প্রাপ্তির প্রশ্নে। তার দৃষ্টি ছোট হয়ে এলো। অবাক কন্ঠে বললো,
– তোকে বলে নি?
– না, আমি ঘুমোচ্ছিলাম তো। আসলে কাল রাতে

বলতে গিয়ে জিভে কামড় দিলো প্রাপ্তি। এতো বোকা তো সে ছিলো না। এভাবে স্বামী স্ত্রীর কথা কি বাইরে কাউকে বলা যায়! কি করতে যাচ্ছিলো সে! রাইসার বুঝতে বাকি রইলো না প্রাপ্তির লজ্জা পাবার কারণ। সে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
– রুটি বেলতে হবে, আসো সাহায্য করো।

প্রাপ্তির নিজের মাথায় একটা গাট্টা দিলো। তারপর রাইসাকে সাহায্য করবার জন্য ওড়নাটা কোমড়ে বেঁধে নিলো। রাইসা এবং প্রাপ্তিকে দেখলে কারোর বলার সাধ্যি নেই এরা এক পুরুষের অতীত এবং ভবিষ্যত।

সব কাজ সেরে রাইসা তার রুমে গেলো তখন নয়টা বাঝে। আবরার তখন ও গভীর ঘুমে মগ্ন। গতকাল রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত বেজেছিলো অনেক। রাইসা এসে ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিলো। এতোক্ষণ নাস্তা বানিয়ে ক্লান্ত সে। চুলের গোড়া থেকে ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়লে। ভেজা চুল শুকানোর বদলে আরোও ভেজা অনুভূত হচ্ছে। আবরারকে ঘুমে মগ্ন দেখে একটা দুষ্ট বুদ্ধি মাথা খেলে গেলো রাইসার। চুলের আগাটা খানিকটা ভিজিয়ে নিলো সে। এরপর আবরারের কাছে গিয়ে এই এক মুঠো চুল নিয়ে তার মুখের কাছে পানির ছিটা দিতে লাগলো। প্রথমে কিছু অনুভূত না হলেও একটা পর্যায়ে বেশ বিরক্ত হলো আবরার। কিন্তু ঘুমের রেশ না কাঁটার দরুণ খপ করে রাইসার হাত খানা ধরে নিলো সে। এরপর এক টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। রাইসাও তাল সামলাতে না পেরে আবরারের বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। মজার ব্যাপারটা নষ্ট করে দেওয়াতে বেশ রাগ হলো রাইসার। অভিমানি কন্ঠে বললো,
– এটা কি হলো?
– কি হবে? উচিত কাজ হয়েছে। এটা আমার সুন্দর ঘুমটাকে নষ্ট করার শাস্তি।
– এহ! বেলা কটা হলো খেয়াল আছে? উঠুন
– উহু, আমার আজ ছুটি। আজ শনিবার। আর এতোক্ষণ আমাকে জ্বালানোর শাস্তি তোমাকেও আমার সাথেই শুয়ে থাকতে হবে।
– ক্ষেপেছে? আমার কাজ আছে। আজ খালা, মামারা বাড়ি যাবেন তাদের জন্য রান্নাটাও তো করতে হবে। প্রাপ্তি একা রাতে এতো কাজ পারবে? আর উঠুন না?
– উহু

বলেই রাইসার গলায় নাক ঘষতে লাগলো আবরার। আবরারের এরুপ আচারণ রাইসার জমে যাবার যোগাড়। আবরারের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তাকে যেনো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অনুভুতিশুন্য হতে লাগলো মস্তিষ্ক। কোন মতে বললো,
– আ….আমি ঘেমে আছি। জামা বদলাতে হবে
– তুমি জানো তোমার কাছে এলে, তোমার গা থেকে একটি মাতালকড়া মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে আসে। গন্ধটা আমার খুব প্রিয়। কেমন যেনো নেশা লেগে যায়। তাই বাড়ে বাড়ে তোমার কাছে আসতে মন চায়। এ যেনো আমার মনের খোড়াক।
– তাই বুঝি?
– না বলতে। মাঝে মাঝে ভাবি, তুমিহীনা আমি কতোটা অসহায়। একটা কথা দিবে রাইসা?
– কি শুনি?
– না থাক। সময় হলে ঠিক চেয়ে নিবো। এখন আমাকে এই সুন্দর সকাল খানা উপভোগ করতে দাও।

রাইসা আর কথা বাড়ালো না। চোখ বুঝে আবরারের উম্মাদনায় সাড়া দিতে লাগলো। লোকটাকে আজকাল বড্ড বেশি মনে টানে। হয়তো অজান্তেই ভালোবাসা নামক মধুরুপি বিষাক্ত ফুলটির বীজ আবারো মনের কোনায় বপন হচ্ছে। এবারের ফুলটি কন্টকময় হবে না কোমল হবে এটা জানা নেই রাইসার। তবে সে অপেক্ষায় রয়েছে, কবে ফুলটি ফুটব।

দিন পেড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে এলো। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। এই এক সমস্যা, বৈশাখের। এই রোদ, প্রখরতা, তপ্ততা। এই ঝড়, বৃষ্টি, উম্মাদনা। অবশ্য এই বৃষ্টিটা দরকার ছিলো। দুপুরের গরমটা অসহনীয় ছিলো। ফ্যান ফুল স্পিডে দিয়েও শান্তি হচ্ছিলো না প্রাপ্তির। অবশ্য তার মন অশান্ত ছিলো। কারণ তখন অয়ন বাসায় আসে নি। এখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, সাথে সাথে শুরু হয়েছে ঝুম বৃষ্টি। বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। মাগরিবের আযান এখনো শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টির তীব্রতা এবং বজ্রপাতের আঘাতে ধ্বনি ক্ষীন হয়ে আসছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রাপ্তির। বুকের বিশ্বাসের প্রদীপটিও ক্ষীন হতে লাগলো। নামায পড়ার উদ্দেশ্যে রুমে যেতেই……..……..

চলবে

[পরবর্তী পর্ব আগামীকাল তারাবীর পর ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here