এক_ফালি_রোদ ২১তম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ ২১তম_পর্ব

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সে অপেক্ষা করছে, প্রাপ্তি এখনো আসে নি। সেই ফাঁকে কিছু ছবি তুললে মন্দ হবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ, মোবাইলের ক্যামেরাটা অন করে সামনে খেলায় ব্যস্ত পথশিশুদের ছবি তুলতে শুরু করলো অয়ন। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ খেয়াল করলো একটি সাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। শ্যাম বর্ণের সেই গোলগাল মুখখানা, একপাশে লম্বা বেনুনি আর কিছু চুল কপালে পড়ে রয়েছে; ঠিক যেমনটা দেখেছিলো সেই রাতে ওভারব্রীজের উপরে। আজ প্রাপ্তিকে সেই এক মাস আগের সেই মেয়েটি ই লাগছে। পার্থক্য কেবল এতোটুকু মেয়েটি এখন তার হবু স্ত্রী। মোবাইলটা নামিয়ে খুব মনোযোগ দিকে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে রইলো অয়ন। কি সাধারণ মেয়েটি অথচ কতোটা অসাধারণ লাগছে। কোনো বাড়তি সাজসজ্জার ঘটা নেই, তবুও চোখ সরাতে পারছে না অয়ন। যদি প্রাপ্তিকে কোনো শিল্পীর নিপুন হাতের চিত্রকর্ম বলা হতো হয়তো ভুল হতো না। এক অজানা মায়া রয়েছে মেয়েটার মুখে যা অয়নকে আকর্ষণ করে, অয়ন পৈথিব জগৎ থেকে যেনো হারিয়েই যায় প্রাপ্তিকে দেখলে। প্রাপ্তি এসে তার সামনে এসে দাঁড়ায়, অথচ অয়নের সেদিকে খেয়াল নেই। সে যেনো অন্য জগতে রয়েছে। এক ধ্যানে ফ্যালফ্যাল করে প্রাপ্তিকেই সে দেখে যাচ্ছে। অয়নের দৃষ্টিতে বেশ অস্বস্তি বোধ হয় প্রাপ্তির। গলা খাকারি দিকে নিচু স্বরে বলে,
– আমরা কি ওদিকটা বসতে পারি? বসে কথা বলি?

প্রাপ্তির কথায় ধ্যান ভাঙ্গে অয়নের, নিজেকে নিপুন ভাবে সামলে নেয় সে। প্রাপ্তির প্রতি তার আকর্ষণকে মোহের নাম দেয় সে। শিল্পীর মোহ, যা শিল্পীকে যেকোনো শিল্পকর্মের প্রতি আকর্ষিত করে। তাকে যেকোনো সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে বাধ্য করে। মাথা নাড়িয়ে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে অয়ন এবং প্রাপ্তি। প্রাপ্তির মনে সহস্র প্রশ্নের ভিড় জমেছে অপরদিকে অয়নের মনে যে কি ভয়ানক খেলার উদয় হয়েছে তা কেবল এই জানে। কোনো ভনিতা বিহীন প্রাপ্তি তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
– আপনি এই বিয়েটা কেনো করছেন? আমি জানি না সব সত্যি জানার পর ও আপনার দাদী এই প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন। তবে আপনি তো না করেই দিতেই পারতেন তাই না?
– তুমি পেরেছো? না করতে?

অয়নের পাল্টা প্রশ্নে চুপ মেরে যায় প্রাপ্তি। তার মুখে কোনো কথা থাকে না। সে আসলেই পারে নি না করতে। সেভাবে ইসমাইল সাহেব তার উপর জোর করেছে তাতে বাধ্য হয়েছে এই বিয়েতে মত দিতে। প্রাপ্তিকে চুপ থাকতে দেখে ধীর গলায় অয়ন বলে,
– আমিও পারি নি। আমিও বাধ্য হয়েছি এই বিয়েটা করতে। কিন্তু এখন সেসব নিয়ে ভাবাটা শুধুমাত্র বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। আমি তোমাকে এখানে ডেকেছি কিছু কথা স্পষ্ট করে বলে দেবার জন্য। সবার জীবনের কিছু মানুষ থাকে; আমার ও রয়েছে। বাবা, মা, দাদী, ভাইয়া, রাইসা। এই পাঁচটা মানুষ আমার জন্য খুব জরুরী। তাদের সুখের জন্য আমার কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমাকে বিয়ে করাটাও সেই একটি সিদ্ধান্ত। আমার মনে সবার জন্য কিছু স্পেসিফিক জায়গা রয়েছে। আমি কাওকে কারোর জায়গায় বসাই না। তুমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলে আমি কি এখনো রাইসাকে ভালোবাসি কি না, উত্তরটা হলো হ্যা, আমি ওকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে নয়; প্রাক্তন হিসেবে। সে এখন আমার ভাইয়ের বউ। ওর সাথে আমার সম্পর্কটাও ঠিক তেমন। সে আমার কাছে কেবল ই আমার আত্নীয় ই থাকবে। সেদিন ওর সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিলো সেদিন সে আমার কেবল অতীত হয়ে রয়ে গিয়েছিলো। ভাই আর রাইসার বিয়েটা বেশ জটিল। আমি চাইলেও এখন রাইসার বন্ধু হতে চাই না। মানুষ বলে প্রাক্তন বন্ধু হতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা প্রাক্তন কেবল একটি সুখময় অতীত ব্যাতীত কিছুই হতে পারে না। সুখময় কারণ রাইসা আমার জন্য একটি সুখময় অতীত ছিলো। সে কখনোই আমার বর্তমান বা ভবিষ্যৎ এর অংশ হতে পারবে না। আমার শুভাকাঙ্গী হতে পারে কিন্তু আমার জীবনের তার নতুন করে কোনো জায়গা কখনোই তৈরি হবে না।
– আপনি আমাকে এগুলো কেনো বলছেন?
– কারণ, তুমি আমার ভবিষ্যৎ

অয়নের এই চারটা শব্দ যেনো প্রাপ্তির বুকে যেয়ে লাগলো। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। অজান্তেই হাতটা বুকের কাছে চলে এলো তার। ফ্যালফ্যাল নজরে অয়নকেই দেখে যাচ্ছে সে। সূর্যের আলোতে শ্যাম চেহারাটা জ্বলজ্বল করছে। অয়ন তার চোখের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,
– আমার মনে না সবার জন্য খোপ কাঁটা, তোমার কিছু করতে অবে না। চুপচাপ শুধু সেই খোঁপটাতে বসতে হবে।
– এমন ও হয় বুঝি?
– হয় তো, আমার ক্ষেত্রে হয়। তোমাকে আমি ভালোবাসি না, তবে ভালোবাসতে চেষ্টা তো করতেই পারি। এই বিয়ে নামক সফরটা একসাথে পাড়ি দেওয়াটা বোধহয় এতোও জটিল হবে না।
– আপনি নিশ্চিত আমরা পাড়ি দিতে পারবো?
– কেনো পারবো না বলতো?
– রাইসার আপুর জায়গাটা আমি কখনোই নিতে পারবো না
– আমি তোমাকে রাইসার জায়গা দিবোও না। তুমি নিজের জায়গায় থাকবে। আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যত হয়ে। আমার বউ হয়ে। লাগবে না আমার অতীতের অংশ হওয়া তোমার। পারবে না?

প্রাপ্তির চোখের কোনায় পানি জমছে। এই প্রথম কেউ তাকে নিজের অংশ হতে বলছে। প্রাপ্তি সবসময় একটা কথাই মেনে এসেছে। এই পৃথিবীতে সে একা, তার কেউ নেই। নিজের একাকীত্ব, দুঃখের সাথে একাই তাকে লড়তে হবে। সবসময় বিয়ের কথা শুনলেই ভয়ে শিটিয়ে যেতো সে। একটা অচেনা মানুষ কিভাবে তাকে কিভাবে বুঝবে, যেখানে তার আপন লোকেরাই তাকে বুঝতে চায় না। কিন্তু অয়ন নামক মানুষটা তার সব চিন্তা যেনো নিমিষেই শেষ করে দিয়েছে, এই মানুষটা যত দেখে তত অবাক হয়। প্রথম সাক্ষাতটি মোটেই মনের মত ছিলো না প্রাপ্তির জন্য। একটা নাক উচু, বিরক্তিকর মানুষ ছিলো অয়ন। কিন্তু আজ তার ধারণা যেনো পুরোই মিথ্যে প্রমাণ করে দিলো অয়ন। এই মানূষটার সাথে বিয়ের পথটা এতো ও কঠিন হবে না। কাঁপা স্বরে প্রাপ্তি বলে,
– পারবো। আপনি অনেক ভালো।
– আমি মোটেই ভালো না প্রাপ্তি। ভালো খারাপ সবই দৃষ্টির উপর নির্ভর করে। তোমার দৃষ্টিতে যদি আমি ভালো হই তবে আমি ভালো। তোমার দৃষ্টিতে আমি খারাপ হলে আমি খারাপ।
– আমরা এই বিয়েতে সুখী হবো তো?

প্রাপ্তির হুট করে এরুপ প্রশ্নে থমকে যায় অয়ন। প্রশ্নটি খুব কঠিন নয়, কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরটি বেশ জটিল। সে শুধু প্রাপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি। কিন্তু তার মনে কি চলছে তা বোঝা বড় দায়______________________

বিয়ের আয়োজন বেশ জোরালো ভাবেই হচ্ছে। রাইসার উপর দায়িত্বের শেষ নেই। একে তার খালাতো বোন অপর দিকে তার দেবরের বিয়ে। প্রাপ্তির পক্ষ থেকে যেমন তার দায়িত্ব রয়েছে ঠিক তেমনই অয়নের পক্ষ থেকেও তার দায়িত্ব রয়েছে। শেফালী বেগমের বিয়ের সব কিছুই বেশ বিরক্তিকর লাগছে। কারণ তার প্রাপ্তি মেয়েটিকে মনে ধরে নি। তাই প্রাপ্তিকেই একা হাতে সব করতে হচ্ছে। সারাদিন কলেজ করে এসে বিয়ের কেনাকাটা করতে হচ্ছে তাকে। আবরার সুস্থ থাকার কারণে সেও তাকে যথেষ্ট সাহায্য করছে। কিন্তু তবুও মেয়েটির উপর কম ধকল যাচ্ছে না। এই তো আজকের কথাই বলি, আজ অয়ন এবং প্রাপ্তির একত্রে হলুদ। হলুদের সকল আয়োজন রাইসাকেই সামলাতে হচ্ছে। শেফালী বেগম নামে মাত্র তাতে অংশগ্রহণ করেছেন আর নাসিমা বেগমের কথা নাই বা বলা হোক। তিনি কাজ করার বদলে আরোও কাজ আরোও বাড়াচ্ছেন। প্রাপ্তিকে সাজিয়ে, হলুদের ডালা সাজিয়ে নিজে তৈরি হতে যেতে বিকেল গড়িয়ে গেলো রাইসার। এখন ও গোসল অবধি করার সুযোগ পায় নি সে। যেহেতু তাদের বাসায় ই সব হচ্ছে। তাই পুরো ড্রয়িং রুম ফুল দিয়ে ডেকোরেট করা হয়েছে সে। সব কাজ শেষ করেই রুমে এসে বিছানায় বসে রাইসা। নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু পায় নি সে। তখনই……………

চলবে

[ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাত সাড়ে নয়টায় ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here