এক_ফালি_রোদ
১৯তম_পর্ব
– আজ সত্যি ই কিছু চাইতে এসেছি।
ধীর কন্ঠে কথাটা বলে রাইসা। রাইসার মুখটা অন্ধকারে স্পষ্ট নয়। তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না অয়ন তার মুখের বভাব। কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। নেই কোনো কম্পন। কৌতুহলটা যেনো বেড়েই গেলো অয়নের। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রাইসাকে সে,
– আমার মতো ভিখারী তোমাকেকি দিবে? আমার সেই ক্ষমতা নেই রাইসা।
– শেষবারের মতো চাইবো, আমি জানি তুমি দিতে পারবে। আমাকে আজ ফিরিও না অয়ন। দয়া করো।
– বলে ফেলো
– তুমি বিয়েটা করো প্লিজ।
বেশ স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বললো রাইসা। অয়ন তার কথাটা শুনলো। কিন্তু তার ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন হলো না। অয়নের হাবভাবে বোঝার উপায় নেই যে সে অবাক হয়েছে কি না! তার এতো স্বাভাবিক থাকাটা যেনো আসা করে নি রাইসা। অয়ন চুপ করে আছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাইসার দিকে তাকিয়ে আছে। আধোআলোর পাঁচমিশালি খেলায় রাইসার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে সে। রাইসা অয়নের উত্তর না পেয়ে আবারো বললো,
– প্রাপ্তির সারাটাজীবন নষ্ট হয়ে যাবে অয়ন। অনাথ মেয়েটা আর কতো সহ্য করবে বলো? কোনো একটা ঘটনা ঘটলে সেটায় ছেলেদের কখনোই কোনো সমস্যা হয় না। হয় মেয়েটির। তার চরিত্রে দাগ পড়ে যায়। এই বিয়েটা হলে প্রাপ্তি কলঙ্কের হাত থেকে বেঁচে যাবে। তাই আর অমত করো না।
– তুমি সত্যি চাও এই বিয়েটা হোক?
অয়নের সাবলীল কন্ঠের প্রশ্নটা শুনে চুপ করে যায় রাইসা। তার বুকের চিনচিনে ব্যাথাটা তীব্র রুপ নিচ্ছে। ভেতরে একটা আগুণ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজের কলিজায় কেউ যেনো ভোঁতা ছুরিঘাত করছে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। তার চাওয়া না চাওয়ায় কি আদৌও কিছু যায় আসে। সে এখন কেবলই একটা লেনদেনের অংশ। বাবার সম্মান রক্ষার্থে সে আবরারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলো। সেদিন সেই সিদ্ধান্তটি না নিলে হয়তো আজ এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো না। নিজের ভালোবাসার মানু্ষটিকে অন্যের সাথে বিয়ে দেবার মতো অবস্থা হয়তো হতো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকালো সে। কারণ তার ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। প্রাপ্তির সারাটাজীবন অয়নের এক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। নিজেকে শক্ত রেখে ধীর কন্ঠে বললো সে,
– হ্যা, আমি সত্যি ই চাই এই বিয়েটা হোক।
– আমাকে প্রাপ্তির সাথে মেনে নিতে পারবে তো?
-…….
– ভেবে বলো,, বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়। আর আমি প্রাপ্তিকে বিয়ে করলে আমার জীবনের সাথে সাথে আমার মনেও তাকে জায়গা দিবো। কারণ সেটা তার প্রাপ্য। যেই ভাবনার গহীনে তোমার বিচরণ ছিলো সেখানে তার বিচরণ হবে। আমার প্রতিটি রন্ধ্রে তার অধিকার হবে। মানতে পারবে তো?
রাইসা চুপ করে রইলো। কথাগুলো গলায় জট পেকে আছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু তার বিচলিত হওয়া বারণ। এখন দূর্বল হওয়াটা উচিত হবে না। অয়নের সাথে প্রাপ্তির বিয়ে না হলেও তাদের একসাথে পথ চলাটা আর হবে না। তাদের পথ অনেক আগেই পৃথক হয়ে গেছে। এখন রাইসা৷ চাইলেও অয়নের কাছে ফিরতে পারবে না। এখন অবশ্য তার ইচ্ছেও হয় না। আবরার মানুষটা যেমন ই হোক না কেনো কেনো তার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকা শিখে গেছে রাইসা। পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে৷ সে অভ্যস্ত। স্বরটা নামিয়ে ধীর কন্ঠে রাইসা বললো,
– যদি বলি পারবো। অয়ন আমি যেদিন কবুল বলে আবরারের সাথে বিয়ের বন্ধনে বাধা পড়েছিলাম সেদিন ই আমার মন থেকে তোমার সকল স্মৃতি মুছে ফেলেছিলাম। আজ আমি প্রাপ্তির বড় বোন হিসেবে তোমার কাছে এসেছি৷ এটা তোমার কাছে আমার শেষ আবদার ও বলতে পারো। তোমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক প্রাপ্তি তোমার সাথে জড়িয়ে গেছে। মেয়েটা অসহায়। তাই প্লিজ এই বিয়েতে অমত দিও না। আর এই বিয়েটা করে অন্তত আমাকে মুক্ত করো। তোমার চিন্তা, তোমার সাথে কাঁটানো স্মৃতিগুলো থেকে আমি মুক্তি পাবো। আমি মুক্তি চাই অয়ন। আমিও সুখী হতে চাই। এটা আমার শেষ আবদার তোমার কাছে।
রাইসার কন্ঠ ধরে আসছে। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকাটা সম্ভব হচ্ছে না তার। কথাটা বলেই নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো রাইসা। অয়ন রাইসার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রাইসা-অয়নের অধ্যায়টার অন্ত হয়তো এখানেই৷ ল্যাম্পপোস্টের নিভু আলো তার সাক্ষী। হয়তো আগামী সূর্যোদয় তাদের জীবনের এক নতুন সকাল নিয়ে তাদের সামনে হাজির হবে। সেই সকালে তারা একে অপরের সামনে হয়তো থাকবে কিন্তু তাদের মাঝে থাকবে না অতীত। থাকবে না কোনো মূহুর্ত, থাকবে না কোনো স্মৃতি। অয়ন খেয়াল করলো তার গালটা ভিজে রয়েছে। কখন নোনাজলের স্রোত তার চোখ থেকে মুক্তি পেয়েছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এক অজানা অভিমান বুকের কোনে বাসা বাধলো। সুখে থাকার অগ্নিশিখা জিদের রুপ নিলো,, রাইসা যদি সুখী হবার পথ বেঁছে নিতে পারে তার নিতে ক্ষতি কি____________
চুপিসারে আবরারের পাশে এসে শুয়ে পড়লো রাইসা। না চাইতেও নিজের ঘরে চোরের মতো আচারণ করতে হচ্ছে তার। যখন রুম থেকে বেরিয়েছিলো তখন গভীর ঘুমে লিপ্ত ছিলো আবরার। অয়নের সাথে কথাটা বলা জরুরি ছিলো তার। নয়তো এভাবে চোরের মতো তার বের হতে হতো না। আবরার যেইভাবে ঘুমিয়ে ছিলো এখনো ঠিক সেভাবেই ঘুমিয়ে রয়েছে। এখন তার চলাফেরার কোনো সমস্যা হয় না। অফিসেও যাওয়া শুরু করেছে সে। এটাই ভয় রাইসার। ঘুম ভেঙ্গে যদি তাকে পাশে না দেখতে পারে তবে সারাঘর খুজবে। তারপর যদি একবার বুঝতে পারে রাইসা অয়নের সাহে দেখা করতে গিয়েছিলো তাহলে আজ আর রক্ষা হবে না তার। আবরারকে ঘুমোতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে রাইসা। বিছানায় শুয়ে কিছুসময় এপাশ ওপাশ করে সে। ঘুম আসছে না তার। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশের অন্ধকারটা তার অভ্যন্তরেও বিরাজ করছে। বুকের হাহাকারটা তীব্র হচ্ছে। এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে তার। এই ক্ষতটা নতুন নয়। অনেক পুরোনো একটি ক্ষত। তবুও যেনো মনে হচ্ছে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নিজের সাথে আর অভিনয় করতে ইচ্ছে হলো না রাইসার। পাশে ঘুরে একবার আবরারকে দেখে নিলো সে। আবরার তখন তার দিকে পিঠ করে শুয়ে রয়েছে। গভীর রুমে লিপ্ত সে। এখন হয়তো চোখের নোনাজলের স্রোত বইলেও কেউ দেখবে না। রাইসা বালিশে মুখ গুজে নিজের মনের ঝড়কে শান্ত করতে লাগলো। নিজেকে এই বিশাল রুমে খুব একা লাগছে তার। একটা সময় তার হাতটা আবরারের গেঞ্জির কোনা আকড়ে ধরলো। এদিকে ঘুমের মাঝেও এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আবরারের ঠোঁটে। অন্ধকার রুমটা আজ অনেক কিছুর সাক্ষী। এক নতুন সকালের সাক্ষী_____________
ফযরের আযান এখনো শোনা যাচ্ছে। আলোর কিরণ অন্ধকারকে গ্রাস করতে ব্যাস্ত। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ, গরমের মাত্রা যেনো বেড়েই চলেছে। ফ্যান চলছে তবুও গরম কমার নাম নেই। ওযু করে আসায় একটু স্বস্তি লাগছে মহীমা বেগমের। আযান শেষ হবার আগেই নামাযে দাঁড়ানোটা মহীমা বেগমের চিরচরিত স্বভাব। শীত হোক কিংবা গ্রীষ্ম; আযান শেষ হবার আগেই ওযু করে নামাযে দাঁড়ান তিনি। আজ ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। মুখটা মুছে নামাযে বসবেন তখনই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে মহীমা বেগম,
– কে?
– মা জেগে থাকলে আসবো? কিছু কথা ছিলো
নাসির সাহেবের কন্ঠস্বর শুনে বেশ অবাক হন মহীমা বেগম। এই সময় তার মসজিদে থাকার কথা, কিন্তু তিনি মহীমা বেগমের রুমের বাহিরে। চিন্তার রেখা উদয় হয় মহীমা বেগমের কপালে। ধীর কন্ঠে বলেন,
– আসো নাসির, কি বলবে?
– মা আসলে……
– বলো, কি ব্যাপারে কথা বলবে?
– অয়ন এবং প্রাপ্তির বিয়ের ব্যাপারে মা। আসলে শেফালী চাচ্ছিলো না বিয়েটা হোক।
আমতা আমতা করে কথাটা বলেন নাসির সাহেব। নাসির সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই……….
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব আজ রাত দশটায় ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি