এক_ফালি_রোদ
১২তম_পর্ব
সিগারেটের আগুন ধরিয়ে সুখটান দেয় অয়ন। দৃষ্টি বাহিরের দিকে। হঠাৎ কানে এলো,
– খাবারটা খেয়ে নাও। কখনো খাবারের উপর রাগ করতে নেই।
কন্ঠটি কানে আসতে ঘুরে তাকায় অয়ন। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
– তুমি?
– কেনো আসতে পারি না?
রাইসার এমন কথায় খানিকটা ভড়কে যায় অয়ন। ভ্রু কুচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। রাইসার চোখ জোড়া স্থির। সে মজা করছে তা সিরিয়াস ব্যাপারটা বুঝে উঠা দুষ্কর। কিছুক্ষণ পর চোখ সরিয়ে নেয় অয়ন। বেশ অপ্রস্তুত লাগছে তার। তাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা দেবর ভাবীর মতো নয়, সম্পর্কটা মোটেও বন্ধুত্বের নয়। অন্ততঃ অতীতের স্মৃতিগুলী না ভুলে যাওয়া অবধি কখনোই হবে না। তাই রাইসার এভাবে তার রুমে আসাটা আপত্তিজনক লাগছে তার। অয়ন মুখ ফিরিয়ে নিলে মলিন হাসি হাসে রাইসা৷ হতাশ কন্ঠে বলে,
– ভয় পেও না, আমি তোমার অস্বস্তির কারণ হতে আসি নি। আসতেও চাই নি, মা পাঠিয়েছেন। তুমি খাবার না খেয়েই উঠে এসেছো। তিনি চিন্তা করছিলেন। খেয়ে নাও
– আমি খাবো না, তুমি খাবারটা নিয়ে যাও রাইসা।
– খাবারের উপর রাগ করতে নেই অয়ন। পেটের দায় বড় দায়। না খেয়ে ঘুমোলে কষ্ট হবে তোমার। খেয়ে নাও। আর এইটা তো প্রথম নয় বাবা এমনধারা আচারণ করেছেন। তাহলে? কেনো অযথা গায়ে নিচ্ছো? বাবার জায়গায় তুমি থাকলে
– বাবার জায়গায় আমি নই রাইসা। আমি আমার জায়গায়। আর তুমি অন্তত একথা বলো না। নিজে কি করেছিলে মনে নেই তোমার? আমার উপর বিশ্বাসটুকু ছিলো না তোমার। তাই তো ভাইকে, যাক গে বাদ দাও। যাও এখান থেকে আমার ভালো লাগছে না। আমি চাই না, বাড়ির মানুষের চোখে আমাদের অতীতের পাতা গুলো পড়ুক।
ক্ষুদ্ধ কন্ঠে কথাগুলো বলে অয়ন। রাইসা চুপ করে অপবাদগুলো মাথা পেতে নেয়। কোনো প্রতিবাদ করে না। খাবারটা টেবিলের কোনায় রেখে ধীর কন্ঠে শুধু বলে,
– নিজেকে অন্যের জুতোয় কখনো ফিট করে দেখো অয়ন, দেখবে জীবনটার উপর আর বিতৃষ্ণা থাকবে না। আমি আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি। তুমিও মানতে শিখো। অতীত ঘেটে কি লাভ? অতীতকে ফেরাবার ক্ষমতা কারোর নেই। আর সেদিন প্রাপ্তিকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় রাইসা। অয়ন তার যাবার পানে চেয়ে থাকে। চোখ থেকে অজান্তেই এক ফোটা অশ্রু বেড়িয়ে আসে। মনে মনে বলতে থাকে,
” ক্ষমা করো আমায়, আমিও নিরুপায়”
রুমে প্রবেশ করতেই পা জোড়া আটকে যায় রাইসার। আবরার তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখজোড়া রক্তবর্ণ হয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির, চোয়াল শক্ত। মুখখানা বিবর্ণ। আবরারের এমন মুখখানা দেখে বুকে কামড় পড়ে রাইসার। হুট করেই বিয়ের পর দিনের কথা মনে পড়ে গেলো রাইসার। সে আজকেও অয়নের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। তাহলে কি আজও তেমন ব্যাবহার করবে আবরার? নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো রাইসা। আমতা আমতা করে বললো,
– আসলে
– রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো।
শান্ত গলায় কথাটা বললো আবরার। তারপর, খুড়িয়ে খুড়িয়ে বারান্দায় চলে গেলো সে। তার কন্ঠে একটি সুপ্ত আর্তনাদ ছিলো। আবরারের এরুপ আচারণ মোটেও কাম্য ছিলো না রাইসার। বিস্ফোরিত চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আজকাল আবরারের মাঝে সেই হিংস্রতা দেখতে পায় না রাইসা। অনেকটা শান্ত নদীর ন্যায় তার আচারণ হয়ে গিয়েছে। সে অসুস্থ হবার পর থেকে যেনো এমন হয়ে গেছে। আজ আবহাওয়াটা ভালো নয়, সকালের তাপমাত্রা ছিলো পয়ত্রিশ ডিগ্রী। আবার এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এই ঠান্ডা গরমে জ্বর হবার প্রবণতা আরোও বেড়ে যায়। আর আবরারের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, পায়ের পোড়া থেকে সামান্য ইনফেকশন হয়েছে। জ্বর হলে আরোও খারাপ হয়ে যাবে শরীর। এই ভেবে আবরারের পিছু পিছু ছুটলো রাইসা। আবরার তখন একটি সিগারেটে আগুন দেয়। দৃষ্টি বাহিরের দিকে তার। নিশ্চুপ সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে সে, মনের ভেতরের লিকলিকে আগুনটা যেনো আরোও প্রখর হচ্ছে। কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে না সে, হারালে রাইসাকে হারিয়ে ফেলবে সে। সেদিন দাদীজানের কথাগুলো শোনার পর থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাইসাকে আর জোর করবে না আবরার। জোর করে তাকে পেয়েও কি লাভ, একটা জ্বলজ্যান্ত প্রাণহীন শরীর মাত্র। আর নিজেকে রাইসার চোখে ছোট করতে চায় না সে। রাইসা মেয়েটিকে সে করেই চিনে, কষ্ট পেলেও কখনো অয়নের কাছে ফিরে যাবে না। হয়তো ফিরে যেতো যদি সেই রাতে, হঠাৎ করেই অনুশোচনায় বুকটা ভরে গেলো। ভালোবাসা পাবার লোভে সে কতটা নিচু কাজ ই না করেছে। তবে আজ ডাইনিং টেবিলে অয়নের ব্রাজিলে যাবার কথাটা শুনে ভালো লাগলো। তার দুইটি কারণ রয়েছে, প্রথমত অয়ন তার ক্যারিয়ারে নতুন পদর্পণ করবে। অয়নকে সফল হতে দেখার ইচ্ছে আবরারের প্রচুর। ছোটবেলা থেকে ছেলেটা কখনই কোনো কাযে অসফল হয় নি, তবে যেদিন ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ফটোগ্রাফার হবার শখ পুষেছিলো সেদিন থেকেই তার জীবনটা বিষিয়ে তুলেছে তার পরিবার। ব্রাজিল গেলে সে তার জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে পারবে। আর দ্বিতীয়ত হয়তো অয়ন ব্রাজিল গেলে রাইসা এবং অয়নের মাঝের দূরত্বটা বাড়বে, অতীতের স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে। সবই হয়তো! হয়তো এমন একটি শব্দ যা মানুষকে নতুন আশা দেয়, নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়।
– আপনি ঘুমাবেন না?
রাইসার প্রশ্নে পেছনে ফিরে তাকায় আবরার। রাইসা কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তা জানা নেই আবরারের৷ মেয়েটি বেশ আস্তে আস্তে হাটে। অনেকটা বিড়ালের মতো, আবরার টের ও পায় না মেয়েটি তার চারপাশে বিচরণ করছে। আবরার হালকা হাসি দেয়, হতাশ কন্ঠে বলে,
– আমার জন্য তোমার চিন্তা করতে হবে না, শুয়ে পড়ো।
– আপনার শরীর খারাপ করবে, ঘরে আসুন। এই গরম ঠান্ডা আবহাওয়াটা ভালো না। আর আপনার তো ঠান্ডার ধাজ আছে
– তুমি জানতে কি করে?
– দাদীজান বলেছেন।
– ওহ
– আর সিগারেট খাওয়াটা কি ছাড়া যায় না?
– নাহ, এটা আমার সঙ্গী। জীবনের খোরাক বলতে পারো।
– ফাও কথা? কেবল নিকোটিনে পুরা স্লো পয়জন। খানিক সময়ের জন্য মাথাটাকে ফাকা করে দেয় কেবল। আর তার বিনিময়ে লিভার, কিডনী আর হার্ট কে ভীষণভাবে ড্যমেজ করে। লাভ কি এই ক্ষুদ্র আনন্দের।
– আমি তো আমার হার্ট, কিডনী কিংবা লিভার ডোনেট করছি না!
– ডোনেট করবেন না বলে সেটাকে ড্যামেজ করতে হবে?
– ভালো রেখে কি লাভ? যেদিন মরার সেদিন মরবই। দেখা যাবে এক্সিডেন্টে মরে গেলাম? কিংবা টাইফয়েডে মরে গেলাম। মরণ কারোর জন্য আটকায় না।
আবরারের মুখে মৃত্যুর কথাগুলো কেনো জানে ভালো লাগছে না রাইসার। খুব রাগ হচ্ছে, আবার টিপটিপ ভয় করছে, আবার খানিকটা কষ্টও হচ্ছে। কিন্তু কেনো? হিনহিনে কন্ঠে রাইসা বলে উঠলো,
– আর যেনো এই কথা আমার কানে না আসে। চলুন ভেতরে। নয়তো সত্যি সত্যি টাইফয়েড বাধাবেন।
– হাহাহাহা
– হাসছেন কেনো বোকার মতো?
– আমার মতো মানুষের সাথেও এভাবে কথা বলা যায় বলো?
আবরার হাসতে হাসতে কথাটা বললো। রাইসা আবরারের কথাটা শুনে চুপ করে গেলো। কথানা বাড়িয়ে ভেতরের দিকে হাটা দিলো সে। আবরার বারান্দার সিলিং এ সিগারেটটা নিভালো। রাইসার পিছু পিছু রুমের ভেতর প্রবেশ করলো সে৷ রাইসা বিছানা করছে আর আবরার তার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাইসার তার উপস্থিতি টের পেয়েও কোনো কথা বলছে না। ভালো লাগছে না তার। কিছু বললেই হয়তো তার অন্য মানে বের করবে! কি দরকার! একটু ভালো করে কথা বলাও দায় হয়ে ঠেকেছে। আবরারের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। মনের ভেতর সুক্ষ্ণ আশা, হয়তো তারাও আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো হয়ে উঠবে তারা, হয়তো___________________
সন্ধ্যা ৭টা,
ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্ট এর আর্ট রুমে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। ফাকা ক্যানভাসের সামনে তুলি হাতে এক মনে বসে রয়েছে। ক্যানভাসে তুলির আচড়ে কিছু আকা রয়েছে। কিন্তু তার মানে বুঝা ভার। একটি মেয়ে, সে খিলখিল করে হাসছে অথচ তার চোখে যেনো দুঃখের সাগর জমা হয়েছে। প্রাপ্তি ছবিটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই রুমে আসলেই কেবল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে সে। নয়তো ও বাড়িতে সেটাও নেবার জো নেই।
– একা একা এখানে কি করছো তুমি?
কন্ঠটা কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকায় সে। অয়ন দাঁড়িয়ে আছে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে। একটা সাদা শার্ট আর নেভী ব্লু কালারের প্যান্ট পরেছে সে, চুল গুলো এলোমেলো, চোখের চশমার উপর ও ময়লা পড়ে আছে। অয়নকে দেখে কেনো যেনো ভালো লাগলো না প্রাপ্তির। সেদিন হাসপাতালে তাকে প্রশ্ন করাতে উত্তর স্বরুপ হিনহিনে কন্ঠে বলেছিলো,
– মানুষের ব্যাপারে এতোও কৌতুহল ভালো না।
অথচ আজ সেই মানু্ষটা এসেছে তার ব্যাপারে কৌতুহল দেখাতে। প্রাপ্তি বিরক্তির স্বরে বললো,
– মানুষের ব্যাপারে এতোও কৌতুহল ভালো নয়।
প্রাপ্তির উত্তরটা শুনে বেশ হাসি পাচ্ছে অয়নের। এট্টুন্না মেয়ে অথচ তেজের কি বাহার। অয়ন নিজের হাসি দমিয়ে নরম কন্ঠে বললো,
– সেদিনের জন্য সরি, আসলে ব্যাক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঘাটা আমার অপছন্দ।
– আমারও
– কিন্তু এটা তোমার বাসা নয়, কলেজ শেষ হয়েছে সেই কখন। আর তুমি কিনা এখানে বসে রয়েছো। বাড়ি যাবে না? এই সন্ধ্যাবেলা এখানে বসে থাকাটাও ভালো নয়। সেফটি ইস্যুর একটা ব্যাপার থাকে৷
– আমার কোনো বাড়ি নেই।
– মানে?
– মানে কিছু না।
বলেই প্রাপ্তি পুনরায় রঙ তুলিতে হাত দেয়। তার অয়নের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অয়ন প্রাপ্তির কথায় খানিকটা অবাক হয়। সে যতদূর জানে প্রাপ্তি রাইসার বাড়ি ই থাকে। তাহলে কি কিছু হয়েছে? অন্য সময় হলে হয়তো মাথা ঘামাতো না। কিন্তু মেয়েটি এই সন্ধ্যা বেল এখানে একা। গার্ডদের ও ভরসা করা যায় না। তাই অয়ন খানিকটা জোর কন্ঠেই বললো,
– প্রাপ্তি, বাসায় যেতে হবে। উঠো। চলো বাড়ি পৌছে দিচ্ছি।
– আমি যাবো না। আমাকে জ্বালিয়েন না।
প্রাপ্তির কন্ঠে এবার খানিকটা ক্ষোভ ছিলো, ছিলো সুপ্ত রাগ। মেয়েটিকে কম দিন হয়নি অয়ন দেখেছে। এই প্রথম তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখছে। কিন্তু এখানে জেদের ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা তার সেফটির। তাই সে না চাইতেও তাকে জোর করতে হবে। প্রাপ্তির কাছে গিয়ে তার হাত থেকে তুলিটা জোর করে কেড়ে নিলো অয়ন। এরপর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
– এখানে জেদকে প্রাধান্য দিতে পারছি না সরি। চলো আমার সাথে?
বলেই জোর করে টেনে নিয়ে যেতে নিলে…………
চলবে
[ পরবর্তী পর্ব আজ রাতে ইনশাআল্লাহ পোস্ট করবো। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না ]
মুশফিকা রহমান মৈথি