এক_ফালি_রোদ অন্তিম_পর্ব

এক_ফালি_রোদ
অন্তিম_পর্ব

রাইসা আলমারি থেকে আবরারের একটি শার্ট বের করে সেটিকে বুকে আকড়ে বসেছিলো তখন ই ফুলি এসে দরজায় কড়া নাড়ে।
– ভাবী, ভাইজান আইছেন। বসার ঘরে বয়ে আছেন, আম্মা আপনারে ডাকছে
– তুই যা আমি আসছি।

ফুলি চলে গেলো। রাইসা আবরারের শার্টটা আলমারিতে তুলে রাখলো। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিলো৷ চুলগুলো আচরিয়ে খোপা করলো। এরপর বসার ঘরে গেলো সে। আবরার তখন বসার ঘরে বসে রয়েছে। কোলে তার অয়ন এবং প্রাপ্তির মেয়ে রোদেলা। মেয়েটি তাদের জীবনে এক ফালি রোদের ন্যায় এসেছে। গোধূলীর মিষ্টি আভা যেনো বাচ্চাটির হাসিতে লেগে থাকে। তাই অয়ন তার নাম রেখেছে রোদেলা৷ আবরার বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করছে। রাইসা এক পলকে শুধু আবরারকেই দেখে যাচ্ছে। লোকটা এই দুমাসে অনেক শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মুখশ্রীতে সেই ঔজ্জ্বল্য আর নেই। চোখের দিকে তাকালে মলিনতা ব্যাতীত কিছুই পাওয়া যায় না। এই আবরার তার আবরার নয়। তার আবরার কোথাও যেনো হারিয়ে গিয়েছে। শেফালী বেগম অভিমানের সাথে বললেন,
– এই দুইটা মাস তুই একা একা চিটাগং থেকেছিস, না একটা ফোন করেছিস না খবর দিয়েছিস। জানিস কি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। অথচ তোর কোন খোঁজ নেই
– আমার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছিলো
– নতুন ফোন কি কিনিস নি নাকি? সেটা দিয়ে কি ফোন করতে পারতি না?
– সত্যি বলতে ইচ্ছে করে নি। একটু আলাদা থাকতে চেয়েছিলাম।

আবরারের জড়তাবিহীন উত্তরে শেফালী বেগমের অভিমানের স্তর বাড়লো বই কমলো না। তিনি হিনহিনে কন্ঠে বললেন,
– যা ইচ্ছে, তাই কর। আমার কি! আমার কথা ভাবার কি সময় আছে তোমাদের? বড় হয়েছো বলে কথা

এবার নাসির সাহেব শেফালী বেগমকে থামাতে বললেন,
– ছেলেটা জার্নি করে এসেছে। একটু রেস্ট নিতে দাও। তুমি কি প্যানপ্যানানি নিয়ে বসেছো।
– আমি প্যানপ্যানানি নিয়ে বসেছি?
– আবরার তুমি ঘরে যাও। ফুলি আবরারকে এক কাপ চা দে তো মা। ছেলেটা অনেক ক্লান্ত। মুখটা কি শুকনো লাগছে। যা বাবা ঘুম দে একটা। বুড়িকে আমার কোলে দে। আমি ওকে নিয়ে হাটটে যাবো।
– এহ, হাটতে যাবো। আমার সোনার নাতনিকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হবে না। প্রাপ্তি তোমার শ্বশুরকে বলে দাও, বুড়িকে নিয়ে সে কোথাও যাবে না।

নাসির সাহেব হুংকার ছাড়তে লাগলেন। শেফালী বেগম ও ছেড়ে কথা বলছেন না। আবরার তার বাবা মার খুনসুটি দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বসা থেকে উঠে গেলো। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে নিজ রুমের দিকে হাটা দিলো। রাইসাও তার পিছু নিলো। প্রাপ্তি ক্লান্ত শ্বশুর শাশুড়ীকে থামাতে। তাই সে আস্তে করে সেখান থেকে সরে রান্নাঘরে চলে গেলো।

রুমে এসে ব্যাগটা খুলে কাপড় বের করতে লাগলো আবরার। তার মুখে কোনো কথা নেই। রাইসা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। রাইসার অনেককিছু জানার আছে। অনেককিছু বলার আছে। কিন্তু কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই দু মাসের দূরত্ব তাদের মাঝে একটি অদৃশ্য দেয়াল টেনে দিয়েছে। এই দেয়ালটি ভাঙ্গা হয়তো রাইসার একার পক্ষে সম্ভব নয়। শেষ যেদিন কথা হয়েছিলো সেদিন শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো রাইসা। সে আবরারের কোনো কথা শুনতেও চায় নি। বরং মুখের কটু কথা দিয়ে আবরারের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো সে। রাইসার ইতস্ততবোধ হচ্ছে, কিন্তু সম্পর্কের ভেতরে জমে থাকা অভিমান, মনোমালিন্য তাকেই দূর করতে হবে। মনে এক রাশ সাহস নিয়ে ধীর কন্ঠ বললো,
– কেমন আছো?

আবরার তখন কাপড় বের করছিলো। এক মূহুর্তের জন্য থমকে যায় সে। আজ দুমাস পর রাইসার কন্ঠ কানে আসছে। জং ধরা ভালোবাসাটা আবারো সজীব হতে লাগলো থাকে আরোও বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো। মলিন হাসি ঠোঁটের কোনায় একে বললো,
– ভালো আছি
– আবরার, আসলে

রাইসা কিছু বলা আগেই আবরার তার দিকে ফিরে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– জানি তুমি আমাদের ব্যাপারটা কাউকে জানাতে চাও না। তাই এখানে দাঁত কামড়ে পড়ে রয়েছো। তবে তুমি চিন্তা করো না
– আমি তো কোনো অভিযোগ করি নি আবরার
– ওহ, আচ্ছা আজ বিকেলে সময় হবে তোমার?
– কেনো?
– তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতাম। আপত্তি থাকলে দরকার নেই।
– আমার আপত্তি নেই। কখন যাবে?
– বিকেলে৷ রেডি থেকো।

বলেই আবরার ওয়াশরুমে চলে যায়৷ রাইসা আবরারের চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে। আবরারের মনে কি চলছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। তবে নিজেদের সাথে একটু সময় কাটালে হয়তো সম্পর্কে জমা জংটা সরে যাবে________

বিকেল ৪টা,
রাইসা একটা নীল শাড়ি পড়ে ছিলো। নীল রঙটা বরাবরি তার পছন্দের। আজ আবরারের সাথে দুমাস পর সে বাহিরে যাচ্ছে। কারণ অজানা হলেও রাইসা বেশ সুন্দর করে সাজলো৷ যেমনটা আবরারের পছন্দ। চোখে মোটা করে কাজল, ঠোঁটে মিষ্টি রঙ্গের লিপস্টিক। কোনো বাড়তি সাজ নেই। ঢেউ খেলানো চুল গুলো খোলা ছেড়ে দিয়েছে সে। রাইসা তৈরি হবার পর জানালা দিয়ে নিচে তাকালো। আবরার তার বাইকের কাছে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে। একটা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পড়েছে সে, ফর্সা কপালে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে। আজ তার বরটা বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। আবার ও প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। রাইসা নেমে আসে নিচে। আবরার এক পলক রাইসাকে দেখে বাইক স্টার্ট দেয়। বাইকে বসে রাইসা জিজ্ঞেস করে,
– কোথায় যাচ্ছি?
– দিয়া বাড়ি যাবো। আমার কাশফুল ভালো লাগে। এখন কাশফুলের সিজন। পুরো দিয়াবাড়ি কাশফুলে সাদা হয়ে আছে। তোমার ভালো লাগবে। আসলে বিয়ের পর কখনো আমাদের ঘোরা হয় নি। আজ একটা বিশেষ দিন। আমি চাই না আমাদের মাঝের ঝামেলাগুলো আজকের বিশেষ দিনটা নষ্ট করে দিক।
– আজ কোন বিশেষ দিন?
– আমি জানতাম তুমি ভুলে যাবে। আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। আমাদের বিয়ের এক বছর হয়েছে আজ। রাইসা আমাদের ভেতর ভালোবাসাটা মরে গেছে আমি জানি। কিন্তু শুধু আজকের দিনের জন্য সেটাকে জীবন্ত রাখতে চাই। আজকের পর আর এই আবদার করবো না।

বলেই বাইকটা স্টার্ট দিলো আবরার৷ বাইক চলছে। রাইসার হাত আবরারের কাধে। আজ অক্টোবরের ২ তারিখ। আজ তাদের বিয়ের একটি বছর সম্পন্ন হয়েছে। আজকের তারিখটাও মনে নেই রাইসার। আজকাল সে পার্থিব দুনিয়া থেকে অনেকটাই ছন্নছাড়া। সময় মতো কলেজ যায়, বাসায় আসে। ঘরের কাজ করে, সবার সাথে হাসে। কিন্তু জীবনটা যেনো এই দুমাস থেমে ছিলো। আবরার বিহীন তার জীবনটা উদবাস্তুর মতো। রাইসা এবং আবরার দিয়াবাড়িতে যখন পৌছালো তখন বিকেল পাঁচটা। সত্যি বেশ সুন্দর লাগছে। শ্বেত কাশফুলের চাঁদরে ঢাকা দিয়াবাড়ি দেখতে অন্যরকম লাগে। আবরার রাইসার হাতটা তার মুঠোতে নেয়। ইটের রাস্তা থেকে নেমের কাশফুলের ভেতরে নিয়ে যায় রাইসাকে। রাইসাও আজ কোনো বাধা দেয় নি। সব ভুলে, আজকের দিনটাকে বাঁচতে চায় সে। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করে পা ব্যাথা করছে রাইসার। অয়ন তাকে একটি টেবিলে বসায়। চটপটি এবং আইসক্রিম ওর্ডার করে সেও তার পাশে বসে। রাইসা তখন তাকে জিজ্ঞেস করে,
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।
– আমার ও তোমার সাথে অনেক কথা রয়েছে। কথাগুলো শুনতে তোমার ভালোলাগবে না। তাই একটা চিঠিতে লিখেছি। দাঁড়াও

বলেই পকেট থেকে চিঠিটা বের করে রাইসাকে দেয় সে। রাইসা চিঠিটা খুলতে গেলে আবরার বাধা দেয়। বলে,
– আজ না, কাল পড়ো।
– কাল কেনো?
– আমি চাই না আমার সামনে তুমি চিঠিটা পড়ো। কাল আমি থাকবো না।
– কোথায় যাবেন?
– চিটাগং
– কেনো?
– আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। অনেকদিন যাবৎ এই ঝামেলার মাঝে ছিলাম। অবশ্য এটা খারাপ হয় নি। তোমার এবং আমার জন্য এর থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। আমার মুখ তোমার দেখা লাগবে না, আমার ছায়াও তোমার আশেপাশে থাকবে। যদি এ বাড়িতে না থাকতে চাও তার ব্যাবস্থা ও আমি করে রেখেছি। ওর্ডার কমপ্লিট হয়ে গেছে। আমি নিয়ে আসছি৷

রাইসা চুপ করে আবরারের কথাগুলো শুনে। কথাগুলো গলা অবধি এসে দলা পাকিয়ে আছে। সে আবরারকে ছাড়া এক মূহুর্ত থাকতে পারবে না। কিন্তু কোন মুখে সে এই কথাটা তাকে বলবে! না চাইতেও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু আবরারকে সে তার চোখের পানি দেখাতে চাচ্ছে না। আবরারের প্রতি আবারো অভিমান বাসা বাধতে লাগলো। আবরার যখন চটপটি দিয়ে এলো তখন রাইসা মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। আবরারের উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে,
– কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো? তোমার ভালো লাগছে না এখানে? বাসায় যাবে?
– তুমি সবসময় কেনো নিজে নিজেই সব সিদ্ধান্ত নেও? তুমি ভাবলে আমাকে বিয়ে করে আমার জীবনকে সাজিয়ে তুলবে। আমাকে জিজ্ঞেয়া অবধি করলে না। মিথ্যে বললে! আমার অপূর্ণতা ঢাকতে নিজের গায়ে অপবাদ নিলে আমাকে একটি বার জিজ্ঞেস করলে না। আজ ও একই কাজটা করলে। আচ্ছা আবরার আমার মতামতের কি কোনো দাম নেই?
-……
– আমি তো এমন টা নাও চাইতে পারি তাই নয় কি? কিন্তু তুমি আমার চাওয়া না চাওয়ার কথা চিন্তা করবে কেনো? তোমার তো মহৎ হওয়া লাগবে। আমি বাসায় যাবো। আমার ভালো লাগছে না আর।

বলেই হাটা শুরু করলো রাইসা। আবরার তার পিছু নেয়। হাতটা টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– আচ্ছা, আমি যাই করি তাতেই কেনো সমস্যা হয় বলতো? আমি তো তাই করেছি যা তুমি চেয়েছো। আমি তো তোমার জীবনের অভিশাপ। আমি সরে যাচ্ছি।
– সেদিন আমি ইমোশনালি হ্যাজার্ড অবস্থায় ছিলাম। কি বলেছি না বলেছি নিজেও ভাবি নি। অভিমান হয়েছিলো, রাগ হয়েছিলো, কষ্ট হয়েছিলো। এটা কি স্বাভাবিক নয়? আমার অস্তিত্ব আমার সামনে উঠে এসেছিলো। কিন্তু আমার রাগ ক্ষোভ সব জল হয়ে গেছে যখন আমি এটা বুঝতে পেরেছি তুমি আমার জীবনে কি! আমার কতোটুকু জুড়ে তুমি রয়েছো। আমি প্রতিটা মূহুর্ত তোমাকে মিস করেছি। আমি তোমায় ভালোবাসি আবরার। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝবে না। কখনোই বুঝো নি। ছাড়ো।

রাইসা আবরারের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো কিন্তু পেরে উঠলো না। আবরার তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কিছু বললো না। শুধু রাইসাকে নিজের বুকে আগলে রাখলো। রাইসাও কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হয়ে গেলো। বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘাপটি মেরে আবরারের সাথে মিশে রইলো। তাদের আশেপাশের কোনো খবর নেই। কতটা সনয় এভাবে রইলো তার খেয়াল নেই। আজ তাদের অভিমানের অন্ত হচ্ছে। নতুন ভালোবাসার সূচনার জন্য______

বাইক চলছে, বাসার দিকে যাচ্ছে তারা। রাইসার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। অনেক কেঁদেছে আজ। আবরারের শার্ট ভিজে গেছে। কিন্তু তাতে কোনো মালিন্য নেই তাদের। কারণ তাদের সম্পর্কের নতুন সূচনা হয়েছে আজ। হঠাৎ আবরার বললো,
– রাইসা, আমার হেলমেটটা খুলো।
– কেনো?
– যা বলছি করো না।
– ধুর এখন কিভাবে
– খোলো হেলমেটটা, গরম লাগছে আমার। আর হেলমেট তুমি পড়ো
– কিন্তু কেনো?
– যা বলছি করো না।
– ঠিক আছে

রাইসা আবরারের হেলমেটটা খুলে নিজে পড়ে নিলো। আবরার কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে বলে,
– রাইসা, ভালোবাসি।

রাইসা কিছু বুঝতে পারলো না। তার আগেই একটা ট্রাক এসে তাদের বাইকটিকে গুড়িয়ে দেয়। রাইসার চারপাশে আধার নেমে এলো__________

আজ দশদিন পর জ্ঞান ফিরেছে রাইসার। চোখ খুলে আশপাশে চোখ ঘোরালো সে। আইসিউ তে রয়েছে সে। কারণ এই জায়গাটা তার পরিচিত। কিছুই মনে নেই এতোদিন কি হয়েছে। শুধু এটুকু মনে আছে তারা সেদিন বাড়ি ফিরছিলো। একটি নার্স পাশে রিডিং নিচ্ছিলো। খুব কষ্টে তাকে ইশারা করে ডাকে রাইসা। নার্সটি কাছে আসলে তাকে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আমার স্বামী?
– জ্বী
– আমার স্বামী কোথায়?
– তা তো আমি জানি না। আপনি একাই এখানে ভর্তি হয়েছেন।
– অহ

রাইসা আর কথা বলে না। বিকেলের দিকে অয়নকে খব দেওয়া হয় রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। অয়ন ভিজিটিং আওয়ারে তাকে দেখতে আছে। অয়নকে দেখে রাইসা একটা প্রশ্নই করে,
– আবরার?

অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার ঠোঁট কাঁপছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
– ভাই ভালো আছে, ও পাশের আইসিউ তে আছে
– মিথ্যে বলছো?
– মিথ্যে কেনো বলবো?
– আচ্ছা, আমার ব্যাগটা পেয়েছিলে?
– হ্যা, কেনো?
– তাতে একটা চিঠি আছে।
– ওইটা দিয়ে তুমি কি করবে?
– দরকারী। কাল এনো।
– আচ্ছা।
– আমি ঘুমোবো। যাও এখন

অয়ন বের হয়ে গেলো আইসিউ থেকে। বেঞ্চে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে। আবরার নেই, সে এক্সিডেন্টে স্পট ডেড ছিলো। মাথা থেতলে গিয়েছিলো৷ আজ রাইসা বেঁচে আছে কারণ সে হেলমেট পড়েছিলো। কিন্তু এই কথাটা রাইসাকে সে জানাতে পারবে না। কারণ রাইসার অবস্থা এখনো স্টেবল নয়। অয়ন উঠে দাঁড়ালো চোখ মুছে বাড়ি চলে গেলো।

পরদিন চিঠিটা নিয়ে এলো অয়ন। রাইসা চিঠিটা হাতে নিলো। যদিও আইসিউর নার্স অনেক কথা বলছিলো। তবুও রাইসা জোর করলো। তার অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো বিধায় নার্স আর জোর করলো না।

রাত নয়টা,
রাইসার খাওয়া শেষ। নার্স বাহিরে গল্প করছে। রাইসা বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা বের করলো। ধীর হাতে চিঠিটা খুললো, গোটাগোটা করে কালো কালিতে লেখা চিঠিটা। মোট দুটি পাতা রয়েছে। এপিঠ ওপিঠ করে লেখা। কাটাকাটি নেই, ওভাররাইটিং নেই। বোঝাই যাচ্ছে খুব সময় নিয়ে লেখা হয়েছে। রাইসা পড়তে লাগলো চিঠিটা।

প্রিয় রাইসা,
প্রিয় কথাটা লিখলাম কারণ আমার জীবনে তুমি প্রিয় মানুষের লিষ্টে প্রথম সারিতে। চিঠিটা যখন তুমি পড়ছো তখন আমি তোমার অনেক দূরে। তুমি সেই রাতে আমাকে বলেছিলে আমার ছায়াও যেনো তোমার জীবনে না থাকে সেটাই তুমি চাও। আমি আজ তোমার আশাটা পূরণ করে দিয়েছি। আমি কেনো আমার ছায়াটাও তোমার আশেপাশে নেই। জানো রাইসা আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম না দেখে। না দেখে না চিনে ভালোবাসাটা অনেক কঠিন। কিন্তু আমি বেসেছিলাম। তোমার সাথে আমার পরিচয় ছিলো “প্রোফাউন্ডলি মি” তে। ওই সময় আমার জীবনের খুব খারাপ মূহুর্ত ছিলো। আমার একজন ঘনিষ্ট বন্ধু আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলো। সারাদিন কাজে ব্যাস্ত থাকতাম শুধুমাত্র সেই দুঃস্বপ্ন ভুলতে। তুমি আমার জীবনে তখন এসেছিলে যখন আমার কথা শোনার জন্য কেউ ছিলো না। ছোটবেলা থেকে আমি বরাবর ই খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। যত কষ্ট হোক নিজের মাঝেই রাখতাম। অয়নের মতো রাগ, এগ্রেশন দেখাতে পারতাম না। বাবার ভালো ছেলে ছিলাম যে। তুমি আমার জন্য একটা গোপন দরজার মতো ছিলে। তোমাকে আমি নিশ্চিন্তে সব বলতে পারতাম। ছয়মাস তোমার সাথে প্রতিনিয়ত আমার কথা হতো। আমি উৎসুক হয়ে বসে থাকতাম। কখন যে এই বন্ধু থেকে সরে এসে তোমার প্রতি অনুভূতিগুলো দলা পাকাতে থাকে বুঝতে পারি নি। তোমার সাথে আমার দেখা করার কথা থাকে, সেই সপ্তাহে আমার এক্সিডেন্ট হয়। আমাদের ভাগ্যটাই এতো অদ্ভুত একই দিন আমার বাইকে তোমার ও এক্সিডেন্ট হয়। আমার সাথে একটি মেয়ের ও এক্সিডেন্ট হয়। মেয়েটির অবস্থাটা খুব সূচনীয় ছিলো। আমি প্রতিদিন খোঁজ নিতাম মেয়েটি কেমন আছে! যেদিন রিলিজ পাই সেদিন জানতে পারি মেয়েটি এখনো আইসিউ তে আছে। ডাক্তারের সাথে কথা বললে জানতে পেরেছিলাম মেয়েটি নাকি কখনো মা হতে পারবে না। গ্লানি, অপরাধবোধে আমি ডুবে গেছিলাম। ক্ষমা চাইবার মুখ টুকু ছিলো। আমি তখন ও জানি না যাকে আমি ভালোবাসি সেই মেয়েটির জীবনে আমার জন্য আধার নেমে আসে। কারণ হসপিটালের মেয়েটি তুমি। আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি তোমার স্থে দেখা করবো না। কারণ তোমাকে মিথ্যে আশা আমি দিতে চাই নি। আমি আমার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করবো। যার জীবনে আমার জন্য আধার নেমে এসেছে আমি তার জীবনের এক ফালি রোদ হবো। তোমার সাথে আমার দেখা করার দিন ঠিক হয়, আমি আমার বদলে অয়নকে পাঠাই। ওকে শিখিয়ে দেই যেনো ও তোমাকে আমার সম্পর্কে এমন কথা বলে যেনো তুমি আমাকে ঘৃণা করো। আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু ভাগ্যের ফের দেখো তোমার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের কথাবার্তার সময় অয়ন আমাকে তোমাদের সম্পর্কের কথা জানায়। সেদিন আমি জানতে পারি তুমি সেই মেয়ে যাকে আমি এক সময় না দেখে ভালোবেসেছি আবার তুমি ই সে যার জীবনের আধারের কারণ আমি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তার মাঝেই তুমি আমাকে ফোনে বিয়ে ভেঙ্গে দেবার কথা বলো। কারণ তুমি কাউকে ভালোবাসো। আমার জেদ চাপে, তুমি কেনো আমাকে চিনতে পারো নি! কেনো তুমি অয়নকে আমি ভেবে নিলে! প্রশ্নগুলো আমাকে খুব ভাবালো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তার মাঝে তোমার বাবার কেসটা আমার হাতে আসে। তোমাকে আমি শর্ত দেই। তুমি আমার শর্তে রাজি ও হয়ে যাও। তারপর তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়। তোমার জন্য আমার ভালোবাসাটা পাগলামিতে রুপ নেয়। তুমি যাতে অয়নকে পুরোপুরি ভুলে যাও সেই জন্য আমি তোমার উপর আমার ভালোবাসা চাপিয়ে দিতে লাগি। আমি জানতাম তোমার কাছে আমি একজন অমানুষ ছিলাম। কিন্তু আমি তোমার অপূর্ণতাকে কখনোই হাতিয়ার বানাতে চাই নি। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে আমার জন্য ভালোবাসো। তুমি যেনো কখনোই এই কথাটা না জানতে পারো সেই জন্য আমি আমার নকল রিপোর্ট ও বানাই। আমি তোমাকে কখনোই দয়া করি নি রাইসা, না নিজের অপরাধ লুকানোর চেষ্টা করেছি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। সেজন্য মিথ্যে বলেছি, প্রতিনিয়ত মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে ভয় পেতাম। কিন্তু অবশেষে তুমি আমার জন্যই কষ্ট পাচ্ছো। আমি জানি না কিভাবে স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় ভালোবাসতে হয়। আমি শুধু ভেবেছি কিভাবে তোমাকে আগলে রাখব! সব কিছু থেকে! কিন্তু আমি ব্যার্থ। তোমার কাছে ক্ষমা আমি চাইবো না। সেটার মুখ আমার কাছে নেই। তবে আমি তোমার জীবনের অভিশাপ হতে চাই নি। এক ফালি রোদ হতে চেয়েছিলাম। যেমনটা তুমি আমার জীবনে ছিলে। আমি মানুষটা খুব স্বার্থপর। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকে ব্যাকুল করে ফেলতো। কিন্তু দেখো আজ সত্যি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। ডিভোর্স লেটারটি আমার কাবার্ডে রয়েছে। আমি সাইন করে দিয়েছি। তুমিও করে দিও। আচ্ছা রাইসা, আমি কি মানুষটা এতোটা খারাপ! আমি কি তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য নই? উত্তরটা মনেই রেখো। কারণ উত্তরটা আমার শোনা হলো না
ইতি
তোমার অপ্রিয়
আবরার

রাইসা চিঠিটা রেখে দিলো। তার সব প্রশ্নের উত্তর চিঠিতে রয়েছে। শুধু মানুষটাই নেই। তার কানে এখনো আবরারের শেষ বলা কথাটা ভাসছে,
“রাইসা, ভালোবাসি”। আবরার বাইকের উপর বসে যদি হেলমেটটা রাইসাকে না দিতো, তাহলে আজ হয়তো রাইসার জায়গায় সে থাকতো। আবরার নেই এই কথাটা তাকে জানানো হয় নি। তবুও সে বুঝে গেছে। কারণ আবরার তার নিঃশ্বাসে মিশে ছিলো। রাইসা কাঁদছে, আজ দুদিন পর সে কাঁদছে। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। তাদের গল্পের শেষটা এমন হবে তার জানা ছিলো না। তার একটা আক্ষেপ থেকে গেলো। আবরারকে তার বলা হয়ে উঠলো না, তার জীবনের এক ফালি রোদ টাও আবরার ছিলো। আজ সেই এক ফালি রোদটা নেই। বেঁচে থাকার ক্ষীণ ইচ্ছেটুকু ও নেই। রাইসা চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর মেশিনের বিপ সাউন্ডটা শোনা গেলো৷ স্যালাইন লাগানো হাতটা নিথর হয়ে গেলো______________

জানাজা শেষ হয়েছে সকাল দশটায়। আরো ও একজনকে কবরে নামালো অয়ন। ফুলি এক কাপ চা এনে দিলো অয়নকে। অয়ন চায়ের কাপে চুমুক দিলো। এতোটা বিস্বাদ কোনো চা হতে পারে আজ জানলো। শেফালী বেগম পাগলের ন্যায় বিলাপ বকছেন। ছেলের শোক কাটানোর আগেই বউটাও চলে গেলো। মহীমা বেগম আজকাল নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। নিজের পা কবরে চলে যাবার সময় এসেছে অথচ সে এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু দুটো নবীন জান তাদের ছেড়ে চলে গেলো। নাসির সাহেব অয়নের পাশে বসলেন। দুজনের মাঝে কোনো কথা হলো না। কিন্তু নীরবে অনেক কিছু বুঝে নিলো অয়ন। একজন বাবার সন্তান হারাবার যন্ত্রণা সে অনুভব করতে পারে। কারণ সেও একজন বাবা। অয়ন ধীর গলায় বললো,
– বাবা আমি আছি। তুমি ভেবো না।

তারা অনেকক্ষণ এভাবে বসে রইলো। এবার অয়ন উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। রুমে তখন প্রাপ্তি রোদেলাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো। অয়ন এক পলক প্রাপ্তির দিকে তাকালো। এই বারোটা দিন মেয়েটা এক হাতে সিকদার মঞ্জিল সামলেছে। শুধু শুধু মেয়েটিকে সে ভালোবাসে না। মেয়েটি তার জীবনের প্রেরণা, সাহস, উদ্দীপনা, তার এক ফালি রোদ

||সমাপ্ত||

[গল্পটির আজ ইতি টানলাম। এটা আমার লেখা সবথেকে লম্বা গল্প। বিগত দেড় মাস যাবৎ আমি এই গল্পটা লিখেছি। মাঝে অনেক মানসিক ঝামেলাতেও ছিলাম। তবুও আলহামদুলিল্লাহ লেখা শেষ করেছি। প্লিজ জানাতে ভুলবেন না কমেন্টে কেমন লেগেছে এই সিরিজটা। ইনশাআল্লাহ ঈদের দিন সন্ধ্যায় নতুন রোমান্টিক ক্রাইম থ্রিলার #দৃষ্টির_অগোচরে নিয়ে আবারো আপনাদের কাছে ফেরত আসবো। আশাকরি এটার মতোই ভালোবাসা পাবো। ততদিন ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম]

মুশফিকা রহমান মৈথি

1 COMMENT

  1. Allah aita ki holo 🥵🥵😱😱😨😨💔💔
    Abrar o Raisa er shathe ki holo ata..🤯🤯😰😰😰😨😨kolponao kori ni ke arokom hobe 😔😔😐😐😢😢😭😭
    Vebechilam happy ending hobe but ki theke ki hoye gelo….
    Oboseshe aktai kotha bolbo khub khub shondor hoyeche golpo ta❤❤💓💓💓💘💘

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here