এক_প্রহরের_খেলা,২৬
মের্শেদা হোসেন রুবি
সারাটা সকাল ভাবতে ভাবতেই গেলো আজাদের। নাস্তাটাও আজ ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। রুচি হচ্ছিলো না। গত কয়েকটা দিন ধরে যে মানুষটা ছায়ার মতো লেগে ছিলো সে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেলে রুচি হবার কথাও নয়। তার উপর সেই মানুষটা যদি হয় মনের খোরাক তবে তো কথাই নেই। দিনটাই পানসে হয়ে যায়। আজাদের দিনটাই কেবল নয় জীবনটাই যেন পানসে হয়ে গেছে। মাত্র দুটো ঘন্টার মধ্যেই অদিতির অনুপস্থিতি পাগল করে ফেলছে ওকে। নিজের এই আচরণে সে নিজেই বিস্মিত। রুমকির বিয়ের খবরেও এতোটা অশান্তি হয়নি সে। রাগ উঠেছিলো জেদ হয়েছিলো কিন্তু মরে যেতে ইচ্ছে হয়নি। আজ তো মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আজাদের। কারণটা নিজেই খুঁজে বের করেছে বসে বসে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে যখন প্রশ্ন করেছে, এতো খারাপ লাগার কী আছে। একসময় না একসময় তো দেখা হবেই। অদিতিতো আর রুমকির মতো পর হয়ে যায়নি। রুমকি তো পরস্ত্রী। হাজার চাইলেও পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু অদিতি তো তোর বউ, অর্ধাঙ্গীনি, অঙ্কশায়িনী। অভিমান করে চলে গেছে বলে কী আর ফিরে আসবে না। এতো অস্থির হবার কী আছে যে তেলাপোকার মতো চিৎ হয়ে পড়ে থাকতে হবে ! ঠিক তখনই উত্তরটা পেয়ে গিয়েছে। অদিতির সাথে ওর সম্পর্ক রুমকির চেয়ে অনেকাংশে ভিন্ন। অদিতি ওর যত কাছাকাছি এসেছিলো রুমকি তা আসেনি। রুমকি ছিলো আজাদের তরুণ মনের ফ্যান্টাসী যা মা জোর করে বুনে দিয়েছিলো , আর অদিতি হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া সেই রত্ন যা আজাদকে পুরুষ হিসেবে একজন পুর্নাঙ্গ মানুষের উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে। আজাদ এখন কেবল কারো ছেলেই নয়, সে এখন কারো স্বামী। আর অদিতি তার স্ত্রী। আচ্ছা, এই স্ত্রী শব্দটা এমন যাদুভরা কেন।
লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস মেলে বিছানা ছাড়লো আজাদ। অদিতি ফোন রাখার পর থেকে গত একটা ঘন্টা বিছানাতেই পড়েছিলো। মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে আছে ওর। মেয়েটা যে হুট করে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসবে তাও কোনো রকমের আগাম সতর্কতা ছাড়াই ব্যপারটা আজাদের ধারণার অতীত। ঠিক এই রকম একটা অবস্থার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না আজাদ। বরং পরবর্তী দিনগুলো সম্পর্কে যা কিছু ভেবে রেখেছিলো তার উল্টোটা ঘটতে দেখে অসম্ভব খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। এই প্রথম নিজেকে একা মনে হচ্ছে আজাদের। ভীষণ একা। অদিতি আসলেই ওর অভ্যাসটা খারাপ করে দিয়ে গেছে। একা কিভাবে থাকতে হয় ভুলেই গেছে আজাদ। বুক চিরে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো ওর। চোখের কোণে জমে থাকা আফসোসটুকু মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুলির চাপে মুছে নিয়ে মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিলো। কয়েক সেকেন্ড স্থির বসে থেকে ডায়াল করলো রাজনের নম্বরে।
দু’বার রিঙ হতেই রিসিভ করলো রাজন।
-” আস্সালামুআলাইকুম আজাদ ভাই। কী খবর আপনার বস। ইস্, কদ্দিন পর। নাম্বারটা দেখেই চমকে উঠেছি। মাঝে কয়েকদিন ট্রাইও করেছিলাম আপনার নম্বরে। বন্ধ পেয়েছি। এখন আপনি কোথায় বস ? ” একটানে কথাগুলো বলে দম নিলো রাজন। আজাদ সবটা শুনে কেবল সালামের জবাব দিলো।
রাজন আবার বললো, ” বস কী ঝিনেদা আসছেন নাকি না অন্য কোথাও ? ”
-” কেন, তোর নতুন বসকে জানিয়ে নিজের ভাও বাড়াবি নাকি ? ”
-” এরকম একটা কথা বলতে পারলেন বস ? আমি আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি ? ”
-” লিটনের লোকদেরকে আমার মায়ের কাছে কে নিয়ে গিয়েছিলো? ” আজাদ সরাসরি বললো। রাজন থতমত খেয়ে গেলো প্রথমে। বললো,
-” কসম কইরে বলতেসি বস আমি কিছু করিনাই। ওটা হয়তো ওরা আমাকে ফলো করে বের করে থাকবে। আমিতো আপনার কোনো খবর খালাম্মার সাথে পর্যন্ত শেয়ার করিনাই বস। আপনি তো আমারে চেনেন বস।”
-” অনেক চেনাই তো মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। আস্থা রাখতে পারছি কই। যাই হোক, একটা কাজ করে দিতে হবে।”
-” খালি হুকুম করেন বস।”
-” অদিতির মোবাইল এর ফুল কল লিস্ট লাগবে আমার। কিভাবে যোগাড় করবি সে তুই জানিস কিন্তু অদিতির কল লিস্ট চাই আমার। ”
-” ওকে বস, সায়মনের মাধ্যমে নিতি পারবো। ওর কোন বুক পিঠ নাই। টাকাই সব। আজকাল লিটন সমাদ্দারের দলে গিয়ে ভিড়েছে। ইয়ে বস, রাগ না করলে একটা কথা জানতি চাই।” আজাদ নিরব। মৌন সম্মতি পেয়ে রাজন ফের বললো,” অদিতি ভাবি আপনার সাথে আছে তো ? ”
-” না। সে আমার সাথে নাই। ”
-” কী বলেন। এটা তো বিপদের কথা। বস ভাবি কনে আছে জানিনা তবে লিটনের থেকে সে যেন সাবধান থাকে। হারামজাদা কুত্তাপাগল হয়ে আছে। ”
-” জানি। বাস্টার্ডটা আমাকে ফোন করে থ্রেট দিয়ে রেখেছে। আলটিমেটামও দিয়েছে।”
-” কন কী। তাহলে তো চিন্তার কথা। এখন কী করবেন বস?”
-” দেখা যাক। তুই আমাকে অদিতির ফোন থেকে পুরো কল লিস্টের স্ক্রিণশট সেন্ড কর!”
-” আমি খুব চেষ্টা করবো। কাজ হলেও হতে পারে। সায়মন শালারে মালপানি খাওয়াইলেই দশ মিনিটের জন্য মোবাইল হাত করা ব্যপার না। শালা তো এখন লিটনের আস্থাভাজন।”
-” সায়মনরা কারো আস্থাভাজন হতে পারেনা রাজন। গত পাঁচ বছরে যখন আমার আস্থাভাজন হতে পারেনি তাহলে মাত্র একসপ্তাহে লিটনের আস্থাভাজন হওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হবেনা আর এটা সমাদ্দারদেরও জানা উচিত।”
-” ওকে, বস। আমি আপনাকে এক ঘন্টার মধ্যে জানাবো কী হয় না হয়।”
-” হম…!” বলে আজাদ ফোন কেটে দিয়ে লিটনের নম্বরে ফোন দিলো আজাদ। নম্বরটা ওর নিজের কাছেই আছে। অদিতির ব্যপারে কথা বলার সময় লিটন নিজেই ওকে দিয়েছিলো। আজাদ নিশ্চিত এটা ওর পার্সোনাল নম্বর না। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় তাদের জন্যেই হয়ত এটা। আজাদের নিজেরও তাই।
ফোন করতে লিটনই ধরলো। কল রিসিভ করেই বলে উঠলো, ” বাব্বাহ, টান তো ভালোই। মাত্র তিনদিনেই ? তা বলেন জনাব আজাদ মুনতাসীর। এবার কী বলবেন।” আজাদ লিটনের খোঁচাটা গায়ে মাখলো না।
জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ” আগেও একবার বলেছিলাম। আজাদ মুনতাসীরের সময় নাই তোর মতো পোলাপানের সাথে খেলার। তারপরেও তুই বল্লার চাকে বল্লম মারার চেষ্টা করেছিস। কাজেই সামাল তো তোকেই দিতে হবে। আপাতত কয়েক ঘন্টা শুধু তোর জন্যই মোবাইলটা খোলা রাখবো।” বলেই ফোনটা কেটে দিলো আজাদ। লিটন নিশ্চয়ই এখন বিভ্রান্ত হয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে বসে যাবে। কিন্তু সে ধারণাও করতে পারবে না আজাদ কী করতে যাচ্ছে। আগুন নিয়ে খেলার যখন এতো শখ হয়েছে। দু চারটা ছ্যাঁকা শালারে না দিলেই না। এটা ছিলো প্রথম ছ্যাঁকা। বড়টা দেবে রয়ে সয়ে। ওর অস্ত্রেই ওকে ঘায়েল করবে আজাদ। ভাবতে গিয়ে রাগে মুখ লাল হয়ে উঠলো ওর। সরাসরি ফোন দিলো এস.আই আজিমের নম্বরে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো আজাদের। আজিমই ফোন ধরলেন। না ধরলেও সমস্যা ছিলো না। আরো পরিচিত লোক আছে সেখানে। যারা শুধু পরিচিতই না, কথার আগে মাটিতে লুটায় এমন পাবলিকও আছে সেখানে। কিন্তু আপাতত আজিম ভাইকেই ওর দরকার।”
এস. আই আজিম ফোন রিসিভ করেই দরাজ গলায় বললেন,
-” হা রে আজাদ ভাই ! কতদিন পর। আজকাল তো আপনারে পাওয়াই যায়না রে ভাই।”
-” পাবেন কেমনে মিয়া। সারাদিন থাকেন তো মেয়েদের হোস্টেলে। সব খবরই পাই ! পাঁচ আঙ্গুল তো ঘি তে ডুবানো। কত বার ফোন দিয়েছি মামুনকে জিজ্ঞেস করেন। ”
আজিম বিনয়ী হেসে বললো, ” আরে না রে ভাই। বহুত পেরেশানিতে আছি। আপনার ভাবি দিনে তিনবার ফোন করে জীবন তেজপাতা করে ফেলতেসে। তার ধারণা আমি সারাদিন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আচ্ছা, আমার কথা বাদ দেন, আপনার খবর টবর কী বলেন।”
-” খবর অনেক আজিম ভাই। সময় করে বলবো। আপাতত, একটা খবর দিচ্ছি সেটাই আমলে নেন।”
-” তাই নাকি। ব্যপার কী বলেন তো? ” আজিম সিরিয়াস হলেন।
-” একটু পর রাজন আসবে আপনার কাছে। আমার মা’কে নিয়ে। একটা কিডন্যাপিং এর দরখাস্ত লিখবেন। অপহরন মামলার সাত ধারায় নারী শিশু নির্যাতন।”
-” বলেন কী ? কার বিরুদ্ধে ? ”
-” লিটন সমাদ্দার। ভিকটিম তার আপন মামাতো বোন অদিতি হক।”
-” এটা আবার কবে পয়দা হলো। আপনার কাজিন তো…!”
-” আরে ধুর, কাজিনের গুল্লি মারেন। অদিতি হক এমপি সমাদ্দারের আপন বোনের মেয়ে। সমাদ্দাররা অদিতির সম্পত্তি গিলবে বলে জোর করে অদিতিকে তার বড় ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো। অদিতি রাজী হয়নি বলে সমাদ্দারের ছোট ছেলে লিটন সমাদ্দার তার লোকজন দিয়ে কিডন্যাপ করিয়েছে অদিতিকে। বেচারী ডাক্তারখানায় গিয়েছিলো। লিটন সমাদ্দারের মা’কে ধরলে সেই বলবে। ভাইটাল পয়েন্ট হলো অদিতি আন্ডার এইটিন। কাজেই নারী শিশুতে মামলা হবে এটা। আপনি মামলা ফাইল করেন বাকী কাজ রাজন করবে। আপাতত এটুকু করেন আজিম ভাই। আমি একটু ফ্রি হলেই আপনার ব্যপারে ঢাকায় আলাপ করবো বড় ভাইয়ের সাথে। দেখি আপনাকে ঢাকা পাঠানো যায় কিনা।”
-” সত্যি বলছেন আজাদ ভাই ।” আজিম আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হাসলেন।
-” মিথ্যা কখনও বলেছি বলে তো মনে পড়েনা। ”
-” ইয়ে, আসল কথাই তো বললেন না। বাদীর জায়গায় নাম কার হবে ?”
-” আমার মা জাহানারা বেগমের। একটু পরেই রাজন আম্মাকে নিয়ে আসবে। আপনি মামলা ফাইল করে পারলে আজই এটা কোর্টে তুলবেন। ওয়ারেন্ট ইস্যু করবেন। তিন দিনের মধ্যে আমি লিটন আর শাহানকে ভিতরে দেখতে চাই। বুড়ো শয়তানটাকে লিস্টেড করার দরকার নেই। আপনি জাস্ট লিটনকে আগে ভিতরে ঢুকান । বাদী পক্ষের লা’ইয়ার হিসেবে জাহিন অনিরুদ্ধকে নেব আমি। লিটন তো লিটন ওর বড়টারও ঘাম বের করে দেবে অনি।”
-” জি চিনি ওনাকে। জাঁদরেল লইয়ার। কিন্তু আজাদ ভাই, এতে কিন্তু আপনি সমাদ্দার সাহেবের রোষানলে পড়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া অদিতির ব্যপারে এতোবড় ঝুঁকি কেন নিচ্ছেন সেটাও বুঝিনি।”
” বোঝা উচিত ছিলো। আমার মা অদিতির বাদী হয়ে মামলা ফাইল করতে যাচ্ছে। তারমানে অদিতি আমার মায়ের আত্মীয়। আরো বলবো ?” কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আজাদ বললো, ” সে আমারও আত্মীয়। একেবারে আত্মার আত্মীয়। আমার স্ত্রী সে। আমার মা তার শ্বাশুড়ী।”
-” ম্মাই গুডনেস। আপনি এতোক্ষণ বলেন নি কেন ? ”
-” এখন তো বললাম। কিন্তু এটা অফ দা স্ক্রিণ। মনে রাখবেন। অন দা স্ক্রিণ আমি অদিতির স্রেফ পরিচিত আর শুভাকাঙ্খী। সে বিগত পঁচিশ তারিখে ডাক্তারখানা থেকে আমার বাসায় আমার মায়ের কাছে যায় বিশেষ দরকারে। সেখান থেকে বেরোবার পথে সায়মন ওকে ব্লাফ দিয়ে নিয়ে যায় এবং তারপর থেকে অদিতি লাপাত্তা। এটাই হবে এজাহার। বাকি জাহিন সামলাবে। এইজ সার্টিফিকেট এন্ড এটসেটরা।”
-” ঠিক আছে আজাদ ভাই। সব বুঝে গেছি। এবার রাজনকে পাঠান। খালাম্মার জবানিতেই আমি এফআইআর লিখে দিচ্ছি। ”
-” গুড। আমি আপনাকে অদিতির কিডন্যাপিং দুটো তথ্য দিচ্ছি। অদিতিকে কিডন্যাপ করার জন্য লিটন সমাদ্দার সায়মনকে হায়ার করেছে যে এখন ওর সাথেই থাকে। সায়মন আর লিটনের কনভারসেশনের অডিও ভিডিও দুটোই আপনাকে পাঠাবো আমি। আর যেহেতু লিটন সমাদ্দারের হুকুমেই অদিতি কিডন্যাপ হয়েছে। এবং কিডন্যাপ করেছে সায়মন। কাজেই এরা দুজন হবে এক নম্বর আসামী, সায়মন আর লিটন। দুই আর তিন নম্বরে থাকবে শাহান আর ওর বাপ। সমাদ্দার পত্নীকে এসবের বাইরে রাখবেন। আর কোনো তথ্য লাগলে রাজন তো আছেই। তো আমি রাখি আজিম ভাই।”
ফোন রেখেই মা’কে ফোন করলো আজাদ। জাহানারাই ফোন ধরলেন। তার এই এক গুন। ফোন বাজামাত্রই ছোঁ মেরে রিসিভ করেন।
-” হ্যালো কে আজাদ ? ”
-” হ্যাঁ, মা। ” শান্ত স্বরে বললো আজাদ।
-” আহারে বাপ আমার। এতো রাগ করিস কথায় কথায়। ঐদিনের পর আর ফোনই করলিনা। কেমন আছিস বাপ ? ”
-” ভালো। তুমি কেমন আছো ? ”
-” আর আমার ভালো থাকা। চোখের সামনে মেয়েটার এই পরিণতি দেখতে হচ্ছে। আব্দুল্লা ভাইয়ের তবু হুঁশ হইলো না। মেয়েরে ধরে দিয়ে দিলো এক ঢাকার ছেলের কাছে। এরা দুনিয়ার স্বার্থপর।”
-” কে রুমকির বর ? বেঁচে আছে সে ? ” আজাদের কণ্ঠে আনন্দের সুর।
-” ওমা, বাইচে থাকবে না তো মইরে যাবে নাকি। ছেলের বাপ তো পুতেরে নিয়ে সেদিনই ঢাকার হাসপাতালে দৌড় দিসে। বড় সেয়ানা লোক। নিজের ছেলে বাঁচাতে ঢাকা দৌড়। আর ছেলের বৌ বাঁচলো কী মরলো খবর নাই। আমরা হলি কী রুমকিরে এভাবে ফেলায়ে থুইতে পারতাম ? পারতাম না। আব্দুল্লা ভাই সারাজীবনই আমারে ভুল বুঝলো।”
মায়ের কথা শুনে কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো আজাদ। এও বুঝলো লিটন তাকে ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলে রুমকির প্রতি সফট করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আজাদকে এখন অদিতির বাইরে কোনো ভাবনা আক্রান্ত করতে পারছেনা। আর এ ঘটনায় প্রমান হয় যে আজাদ অদিতিকে ভালোবাসে, রুমকিকে নয়। মা ওপাশ থেকে আরো কী বলছেন আজাদ তা শুনতে পেলো না। কেবল বিড়বিড় করে বললো,
-” বাদ দাও মা। পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকেই এমন। যারা শুধু নিজেরটাই বোঝে। তাছাড়া তিনি বাবা হন রূপমের। তার আবেগটাকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই। রূপমকে সুস্থ হতে দাও। দেখবে কদিন বাদে সে নিজেই ছুটে আসবে রুমকিকে নিতে।”
-” হমমম…! সবারই সব হলো। তুই এক ছন্নছাড়া মেয়েকে বিয়ে করে…!”
-” মা। আমার খুব বিপদ মা।”
-” সেকি রে। কিসের বিপদ? ”
-” অদিতির কথা তো জানো মা। সে একজন ধনী পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা না থাকলেও তোমার বউমার সম্পত্তি অনেক। কোটি টাকার উপরে। সে ভালোবেসে আমার নামে পুরো সম্পত্তি ট্রান্সফার করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।”
-” তাই নাকি ? আহারে বড় পয়মন্ত মেয়ে গো। লক্ষী সোনা।”
-” কিন্তু ভেজাল তো লাগিয়েছে ওর মামা আর মামাতো ভাইয়েরা। ওর সম্পত্তির পিছু লেগেছে ওরা। তার উপর সম্পত্তি আমার হাতে চলে আসছে শুনে ওরা অদিতির সাথে আমার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অদিতির মামাত ভাই লিটন সমাদ্দার ওকে চালাকি করে কোথায় যেন সরিয়ে নিয়েছে। আর ওকে সাহায্য করেছে কে জানো ? সায়মন। টাকার জন্য লিটনের গোলাম বনে গেছে সে।”
-” সায়মনের এতো অধঃপতন ? অদিতি না ওর হাত কামড়ে দিসিলো? ঠিক কইরেছিলো।”
-” ঐ লিটন এখন আমাকে সমানে ফোনে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে।”
-” হারামজাদার এতো সাহস ? ওরে সাইজ করা যাবে কিভাবে? ওর জন্য তোর কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু বলবিনা ওকে ? ”
-” আরো বেশী আম্মা। দুই কোটিরও উপরে। অদিতি ওর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। দুজনের সম্পত্তি মিলে অনেক প্রপার্টি।”
-” আহা, তাহলে তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।”
-” সেটাই করবে তুমি। একটু পর রাজন আসবে। ওর সাথে সোজা থানায় গিয়ে মামলা করে আসবা। তোমাকে রাজন সব দেখিয়ে দেবে আর থানার এসআইও আমার পরিচিত। তুমি দরখাস্তকারীর হিসেবে সই করবে। ব্যস্, বাকি কাজ থানা করবে। তবে তুমি নিজের অবস্থানে শক্ত থেকো। ওরা তোমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেও করতে পারে। তখন তুমি বলে দেবে যে অদিতি তোমার দুরসম্পর্কের আত্মীয়। বউমা বলতে যেওনা তাতে আমাকে টানা হবে। তুমি জাস্ট বলবে সেই রাতে অদিতি তোমার বাড়ী বেড়াতে এসেছিলো আর সায়মন ওকে ডেকে নিয়ে গেছে। ব্যস্, এতোটুকুই।”
-” ওটা তুই ভাবিস না। এদেশে সত্য মামলা টিকে না, মিথ্যার জয়জয়কার। তুই আমার সাথে রাজনরে দে। তারপর দেখ আমি কী করি। ”
-” গুড। এই না হলে আমার মা। তুমি তৈরী হয়ে অপেক্ষা করো। রাজন পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। ওর সাথে কথা হয়েছে আমার। ওকে নিয়ে সোজা থানায় চলে যাবে তুমি। ”
ফোন রেখে মুখ উঁচু করে ছাদের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে পেটের বাতাসগুলো বাইরে পাঠিয়ে দিলো আজাদ। এবার শুধু অপেক্ষার পালা। রাজন লিস্ট পাঠালে ওকে ওর কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। আর সব ঠিক থাকলে লিটনকে এবার একটা উচিত শিক্ষা দিতে পারবে আজাদ। এক ঢিলে দুই পাখি। লিটনের অস্ত্রেই ওকে ঘায়েল করবে এবার। রাজন সাহায্য করলে ভালো। যদি নাও করে বা ওর কথামতো মা’কে নিয়ে থানায় না যায় তাহলেও মা একাই পারবে। কোটি টাকার সম্পত্তি বলে কথা। আজাদ মা’কে যতটুকু চেনে। তিনি পথ খুঁজে নিতে জানেন।
=====
পরদিনই রুমকিদের বাড়ীতে হৈ চৈ পড়ে গেলো। আব্দুল্লাহ হতভম্ব বনে গেলেন। তিনি ভাবতেই পারেন নি সাত সকালে এমন দৃশ্য দেখবেন। তার উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে রূপমদের পুরো পরিবার। রুমকির শ্বাশুড়ী, ওর ননদ প্রীতি, খালাতো ননদ রিয়া। এদের সবার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছেন নুরুদ্দিন ভাই। তার স্ত্রী অবশ্য আগেই ভেতরে চলে গেছেন। আব্দুল্লাহ হুজুর কেঁদে ফেললেন আনন্দে। তিনি এতোটাও আশা করেন নি। তার মনের মেঘ অনেকটাই কেটে গেছে। তিনি ধারণা করেছিলেন হয়ত খুব বেশী হলে মহিুদ্দিনের পক্ষ থেকে একটা স্যরি বা অনুতাপের দুটো বাক্যই আওড়াবে। কিন্তু মহিউদ্দিন যে পুরো দলবল পাঠিয়ে দেবে এটা তিনি একেবারেই ভাবেননি। বড় মাইক্রোটা এখনও তার বাড়ীর বাইরে শোভা পাচ্ছে। রুমকির শ্বাশুড়ী আজ রুমকি আর আপানকে তাঁর সাথে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছেন।
এরই মধ্যে মহিউদ্দিনের ফোন এলে সে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে জানালো, তার শরীরটা সামান্য খারাপ করেছে বিধায় নিজে আসতে পারেন নি। নইলে নিজে এসে রুমকিকে নিয়ে যেতেন। এদিকে রূপমের মা’ও বারংবার লজ্জিত হতে লাগলেন রূপমের বাবার এমন আবেগী কান্ডের জন্য। এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহকেই রাশ টানতে হলো।
তিনি রূপমের মা’কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ” এতো লজ্জিত হবেন না আপা। আমি নিজে তো একজন বাবা। আমি বুঝি যে সন্তানকে অমন মৃত্যু মুখে দেখে কোনো বাবা স্থির থাকতে পারবেনা। এতো বার বার স্যরি হবার দরকার নেই। ”
দুপুরেই রীতিমত বিশাল আয়োজন করে বধূ বিদায় উৎসব করা হলো। মায়ের বুকে মাথা রেখে রুমকি আরেকবার বিদায় নিলো আজ। তার চোখের পানি আজ বাঁধ মানছে না। আব্দুল্লাও কাঁদছেন তবে এ কান্না খুশির, আনন্দের।
চলবে…..