এক_প্রহরের_খেলা,১২
মোর্শেদা হোসেন রুবি
-” রুমকির সাথে আপনার পরিচয় কতদিনের আসলে ?” নিচের ঠোঁটটা টেনে তাতে কৌটা থেকে খানিকটা গুল ঢেলে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল আজাদ।
আমরা দুজন এখন রুমকিদের বাড়ীর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। অদূরেই একটা পুলিশ জিপ দাঁড়ানো। সেদিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আমাকে এই প্রশ্ন করা হলে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। ভাল করে তাকালাম আজাদ নামের লোকটার মুখের দিকে। গুলের প্রভাবেই কিনা কে জানে তার ঠোঁটের ভেতর ও আশপাশটা কালচে হয়ে আছে।
আমাকে তাকাতে দেখে আজাদ মাথা ঝাঁকাল।
-” এ জাতীয় কোশ্চেনগুলো পরে আসবে আরকি।”
-” কিন্তু এটার সাথে রুমকির হারিয়ে যাবার সম্পর্ক কী ! আর এই প্রশ্নের কারণ কী ! ”
-” না, কোন কারণ আছে তা তো বলিনি। আমি তো এমনিই প্রশ্ন করেছি। কোন কিছু ভেবে বলিনি ! ” প্রশ্নের ধরণই বলে দেয় উদ্দেশ্যের বরণ। আলাদা করে জানান দিতে হয়না। মুখে কিছু বললাম না। আজাদ নিজে থেকেই আবার বলল।
-” আপনি হয়ত ভাবছেন এটা আমার জিজ্ঞাসা। ব্যপারটা তা না। আমার হঠাৎ মনে হল যে, এই কোশ্চেনটা আপনার সামনে হয়ত আসবে।”
-” ঠিক এই কোশ্চেনটাই আসবে বলে ভাবছেন কেন ? ”
-” কারণ তো অবশ্যই আছে। ”
-” সেই কারণটাই তো জানতে চাচ্ছি। পুলিশ শতেক প্রশ্ন বাদ দিয়ে আমাদের সম্পর্কের বয়স জানতে চাইবে কেন ! তার তো জানার মত আরো অনেক বিষয় আছে। এটা তো অযৌক্তিক একটা প্রশ্ন ! ”
-” না, অযৌক্তিক হবে কেন ? আপনাদের হঠাৎ করে বিয়ে হয়েছে । যাকে বলে রাতারাতি । তাছাড়া বিয়ের সাত দিনের মাথায় রুমকির হুট করে একা ঝিনাইদহ আসাটা সন্দেহজনক। মেয়েরা সাধারণত বিয়ের পরপর বাপের বাড়ী আসে স্বামীর সাথে। কিন্তু সে এসেছে একা। এর পরের দিনই সে পুরোপুরি গায়েব। ব্যপারটা বেশ গোলমেলে নয় ? ”
নিরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আজাদ লোকটাকে যতটা ঝামেলাবাজ ধারণা করেছিলাম বাস্তবে সে তারচে আরো অনেক বেশী ঝামেলাবাজ। কথার ধরণে তাকে তা’ই মনে হচ্ছে। কতটা ধুরন্ধর হলে সে আমাকে এভাবে লেপ্টে ফেলার ফন্দী বের করতে পারে। বরং এসব বলে সে তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে ফেলেছে। আমার তো এখন সন্দেহ আরো জোরদার হচ্ছে। ঝামেলাটা নিশ্চয়ই তার তৈরী । কিন্তু সে রুমকিকে কোথায় নিয়ে গেছে আর নিজ থেকেই কিডন্যাপ শব্দটা ব্যবহার করেছে কেন। কথাগুলো সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হত কিন্তু সেটা সমীচীন হবেনা। আর সে নিশ্চয়ই গড়গড় করে সব বলে দেবে না।
আমাকে থমকে যেতে দেখে সে আপোষের সুর তুলল কিন্তু বক্তব্য আগের মতই ধারাল।
-” মাইন্ড করলেন নাকি ? মাইন্ড করবেন না প্লিজ । আসলে এরকম ব্যপার স্যাপার গুলোতে পুলিশ সবার আগে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ীর লোকদেরকেই সাসপেক্ট করে। তারা প্রথমেই ভাবে যে ভিকটিম হয়ত ঝগড়া করে চলে এসেছে। আবার অনেক সময় দেখা যায় স্বামীর বাড়ি থেকেই যৌতুক চেয়ে বউকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হয়। কাজেই আমার ভাবনা অমূলক কিছু না। তবে আমি বলছি না যে আপনিও সেরকম কিছু করেছেন। আমি তো কেবল প্রচলিত সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করছি।”
লোকটার স্যরি হবার ধরণে দুঃখ ভাব নেই বরং আমাকে বেসামাল করে দিতে পেরে সে যেন পুলকে ভাসছে বলে মনে হল। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে চারপাশে তাকালাম। বললাম,
– ” সমস্যা নেই। পুলিশের যা ইচ্ছা হয় সন্দেহ করুক। আমি নিজেই তো পুলিশের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। তাছাড়া এখানে আসার কয়েক ঘন্টা আগেই রুমকির সাথে কথা হয়েছে আমার। ওর ভয়েস রেকর্ড করা আছে আমার মোবাইলে । তাতে রুমকির বলা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা রেকর্ডেড হয়ে আছে। আমার ধারণা ওর ইনভেস্টিগেশনে কথাগুলো কাজে আসবে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার মোবাইল পুলিশের হাতে গেলে সবার আগে আপনার ডাকই পড়বে আগে কারণ সে আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু কথা আমাকে বলেছিল। এবং কথাগুলো খুব অর্থপূর্ণ। আমার মনে হয় ভিকটিমের জবানবন্দী হিসেবে বেশ কাজে দেবে ভয়েস কলটা। ” তথ্য পেশ করার মত করে বললাম কথাগুলো। লোকটার কথাবার্তা এমনিতেই আমার গা জ্বালিয়ে দিয়েছে। পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে বলতে পেরে মন্দ লাগছে না। তবে আমি স্থির করেছি এর সাথে আপাতত কোন ঝামেলায় যাবো না। রুমকিকে ট্রেস করার ব্যপারে ওর কিছু সাহায্য আমার এমনিতেও দরকার হতে পারে। অবশ্য এর সামনে জারিজুরি দেখিয়ে তেমন লাভও নেই কারণ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি বুঝে গেছি লোকটা নিজেকে বেশ ধুরন্ধর। সেকারণেই হয়ত সে আমাকে শহুরে ফুলবাবু ধরে নিয়েছে। তার আচরণেই সেটা স্পষ্ট। আমি নিজেদের তথা বড়চাচ্চুর বাড়ীর দিকে পা বাড়ালাম।
চলে যাবার আগে বললাম,
-” যাই হোক, আমি যাচ্ছি। আমার বড়চাচার বাসাটা চেনেন নিশ্চয়ই। রুমকিদের উত্তর পাশের বাড়ীটাই আমার দাদার বাড়ী। আমি সেখানেই থাকছি । পুলিশ আমার ঠিকানা জানতে চাইলে ওখানে নিয়ে আসবেন। ”
-” আপনি এখন বাড়ী যাবেন ? ” আজাদের কণ্ঠে বিস্ময়।
-” তো কী করব। এই এলাকায় আমি নতুন। এমনও হতে পারে আমি ঢাকা ফিরে যাব। তবে যাবার আগে অবশ্যই পুলিশে রিপোর্ট করে যাব। বাকি যা করার তারাই করবে। বরং ঢাকা গিয়ে আমার বড়মামাকে দিয়ে কিছু একটা করানোর চেষ্টা করতে পারব আমি। এখানে কী করব আমি। পথঘাট কিছুই তো চিনিনা।”
-” আপনার মামা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় ?”
-” করতে পারাতো উচিত। আমার মামাত বোন জামাই মাগুরার ডিসি। তিনি চাইলে হয়ত কিছু একটা করতে পারবেন। দেখি কী করি।” বলে পা বাড়াতে গেলে আজাদ ফের থামাল আমাকে।
-” দেখুন কনফিডেন্ট ভালো কিন্তু ওভার কনফিডেন্ট সবসময় ভাল ফল বয়ে আনেনা। বরং এটা নতুন করে সমস্যায় ফেলে দেয় মাঝেমধ্যে। আপনি যদি ভেবে থাকেন, মোবাইল রেকর্ড দিয়ে আপনি অনেক কিছু করে ফেলবেন তাহলে সে আশার গুড়ে বালি।”
নিরবে আজাদের চাঁদ মুখপানা জরিপ করলাম। দাওয়াই ধরেছে তাহলে। কথাটা বলার সময় অতশত ভেবে বলিনি আমি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যপারটা কাজে এলেও আসতে পারে। এটা তো সত্যি, রুমকি আজ্দের ব্যপারে কিছু কথা বলেছে। তবে আজাদকে ভড়কানো কঠিন। অপরাধ করতে করতে এদের কলিজার পাটা শক্ত হয়ে গেছে। মুখটা শক্ত হল আমার। দৃঢ় স্বরে বললাম,
-” একই বক্তব্য আমারও। রুমকির হারিয়ে যাবার কথা শুনে প্রথমেই কিডন্যাপড শব্দটা উচ্চারণ করে পরিস্থিতি আগেই বিগড়ে দিয়েছেন আপনি। এখন আমি থানায় গিয়ে কেস ফাইল করলে আপনার নামটাই সন্দেহ তালিকায় আগে আসবে। গেট রেডি ফর দ্যাট।
-” আমি নিজেকে সন্দেহ তালিকার মধ্যে রেখেই কথা বলছি। নিজেকে বাদ বললাম কখন। কোথাও আগুন লাগলে তার আশেপাশের দুচার ঘরও পুড়ে যায়। না পুড়লেও আগুনের তাপ থেকে বাঁচতে পারেনা। কাজেই নিজেকে নিয়ে অত ভাবছিনা। আপনার সন্দেহ হলে আমাকে এরেস্ট করুন কোন সমস্যা নেই। তাতে যদি আপনার কাজের অগ্রগতি হয় তাহলে করবেন বৈকী। কিন্তু যা’ই করবেন একটু ভেবে চিন্তে। আজাদ মুনতাসীর সম্পর্কে একটু জেনে নিয়ে করলে ভাল করবেন। আপনার অচেতন শ্বশুর সাহেব জেগে উঠলে তার সাথে পরামর্শ করেও নিতে পারেন। উনি আপনাকে অনেক ভালো ভালো তথ্য দিতে পারবেন আমার ব্যপারে।”
কথাগুলো বলার সময় আজাদের স্বরের দৃঢ়তা লক্ষ্য করার মত। কোনরকম কাঁপন নেই বলার ভঙ্গিতে । ইস্পাতের নার্ভ বুঝি একেই বলে। তার কনফিডেন্টের উৎস কোথায় ভাবতে চেষ্টা করলাম। এবার আজাদ নিজেই আমাকে ফেলে এগিয়ে গেল। চলে যাবার আগে ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
-” বাই দা ওয়ে, থানার ব্যপারে যে কোন সাহায্য লাগলে এই অধমকে ফোন দেবেন। আমি সোজা চলে আসব। থানায় আবার আমার একটু চলে কিনা। নিন, আমার ফোন নম্বরটা রাখুন।” বলে সে চট করে একটা কার্ড গুঁজে দিল আমার পকেটে।
সে চলে যাবার পর কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বেশ দামী কার্ড। ক্যাপিটাল লেটারে তার নাম লেখা আছে। নামের নিচে যে সব ডেজিগনেশন দেয়া আছে সেগুলোর কোনটাই লেখাপড়া করে অর্জন করতে হয়না। তারপরেও এসব ডেজিগনেশন ক্ষমতার উৎস হিসেবে কাজ করে। কার্ডটা পকেটে পুরে সোজা বাড়ী চলে এলাম ।
আপান জেগেই ছিলেন। আমাকে দেখে ফোকলা দাঁতে হাসলেন তিনি। বুঝলাম ঐ বাড়ীর ঝড়ের প্রভাব এ বাড়ীতে এখনো পৌঁছেনি। তবে আপানের হাসি নিভে গেল আমাকে দেখে। আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন তিনি। বললেন,
-” ওমা , বাই তুই ? তুই আইসে পড়ছিস ? শ্যাষতক আমার নাতিনের টানে তোরে আসতিই হলো ? দেখা হইসে রুমকির সাথি ? ওরে নিয়ে আসলি না কেন বাই ? নাকি তুই আইজ ও বাড়ি থাকবি? ”
আমি জবাব দিলাম না। মুখ কালো করে চৌপায়ার উপর বসে পড়লাম। হতাশার গ্লানি আমার অবয়বে স্পষ্ট। রাত যত বাড়ছে, মনের অস্থিরতা তত বাড়ছে । আপানের কোন কথার জবাব দেবার ইচ্ছে নেই আমার। এই বুড়ি আমার রুমুকে টেনে এনে বিপদে ফেলেছে। সে মাতব্বরী করে রুমকিকে এখানে টেনে না আনলে এতবড় বিপদ ঘটত না। রাগে ক্ষোভে বাকহারা হয়ে বসে রইলাম আমি। ঠিক বুঝতে পারছিনা এখন আমি কী করব।
-” কী হইসে বাই ? তোমার মুখখানা অমন কালো ক্যান ? ” আপানের হাতের ছোঁয়া পেলাম কাঁধে। এতক্ষণ নিজেকে যেটুকুও ধরে রেখেছিলাম এই মুহূর্তে আপানের স্নেহের উষ্ণতার স্পর্শে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ঝুঁকে থাকা চোখের কোল থেকে টপটপ করে পানির বড় দুটো ফোঁটা আমার উরুর উপর পড়লে প্যান্টের ঐ অংশটুকুর রঙ বদলে গেল। আপান ছটফটিয়ে উঠে আমার থুতনী নিজের দিকে ফেরাল।
-” বাই তুমি কাইনতেস ক্যান সোনা ? কী হইসে তোমার ? রুমকির সাথে বিবাদ কইরেসো ? ”
-” রুমকিকে পাওয়া যাচ্ছেনা আপান..!” বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এতটুকু বলেই কথা আটকে এল আমার।
=====
তিন চাকার রিক্সাটায় আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে রুমকি। টানা দেড়ঘন্টা ঝোঁপের ভেতর বসে থাকতে থাকতে ঘাড় মাথা সব আঁকড়ে গেছে ওর। বহু কষ্টে দোয়ার জোরে রিক্সাটা মিলেছে। এতক্ষণ ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছে একটা রিক্সার জন্য। প্রায় মিনিট বিশেক অপেক্ষা করার পর এই রিক্সাটা মিলেছে। পুরো রাস্তায় দু একটা কুকৃর ছাড়া জনমনিষ্যি নাই।
রিক্সাওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোক। তবে সে ভাল না মন্দ যাচাই করার সুযোগ নেই। সে জন্যে দাঁড়ায়ওনি রুমকি। একটু ঝুঁকি নিয়েই উঠে পড়েছে। রিক্সাওয়ালা নিজেও কম বিস্মিত হয়নি। অন্ধকার ফুঁড়ে অমন ভুতুড়ে বোরকাওয়ালী বের হলে কেইবা না চমকাবে। লোকটা প্রথমে সামান্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল। হয়ত জিন ভুত ভেবে বসেছিল। কিন্তু রুমকি যখন নিজেই দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার পথরোধ করেছে। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে জায়গাটার নাম উচ্চারণ করে সেখানে পৌঁছে দেবার অনুরোধ করেছে তখন লোকটা রিক্সা থামিয়ে করুণার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছে,
-” কোন বাড়ির মেইয়ে গো আপনি আম্মা ? কনে যাবেন আপনি ? ”
রুমকি বেশী কিছু বলতে পারে নাই। শুধু কোনমতে শায়লাদের বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করতে পেরেছে। এরপরই হাঁচড়ে পাঁচড়ে রিক্সায় উঠে পড়েছে। সিটে বসে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছে রিক্সার সাথে। কোনদিন ভাবেনি যে এমন দিনও জীবনে আসবে যেদিন সে শুনশান রাস্তা ধরে একা পথ চলবে আর চারপাশে কেউ থাকবেনা । এর আগে কোনদিন সে কোথাও একা যাওয়া আসা করেনি। সবসময় বাবা নয়ত মা নতুবা বড়পা সাথে ছিল। শেষ কবে এতটা দুরে এসেছিল তাও মনে নেই রুমকির। বাবা সবসময় বলতেন, শহরে পথেঘাটে আজেবাজে লোক ভর্তি। মেয়েদের কোথাও একা চলাফেরা করা উচিত না। কিন্তু তারপরেও আজ রুমকি একা চলার ঝুঁকি নিয়েছে কারণ ডাক্তারখানা থেকে বেরোবার আগেই সে আজাদ ভাইকে দেখেছে। আজাদ ভাই ডাক্তার খানার রিসেপশান পর্যন্ত এসে ওকে খুঁজে গেছেন। ওকে দেখেই ফার্মেসীর আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল রুমকি। ওর সন্দেহ দানা বাঁধে তখন থেকেই। আজাদ এখানে কেন ? পরে সে সরে গেলে দ্রুত আম্মুকে নিয়ে রিক্সায় তোলে সে। ভেবে রেখেছিল ঔষধ পরে কিনবে। দরকার হলে বাবাকে দিয়ে কাল কিনিয়ে নিলেই হবে। আজ কোনোরকমে এখান থেকে বেরোতে পারলেই জান বাঁচে। চারিদিকে চোখ রেখে আম্মুকে রিক্সায় তোলামাত্রই একটা ইয়ং ছেলে এসে ওকে সালাম দেয়। ওর হাতের প্রেসক্রিপশন দেখতে চায়। ছেলেটাকে রিপ্রেজেনটেটিভ মনে হলেও খটকা দুর হচ্ছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল এটা আজাদের লোক। কারণ ছেলেটা সন্দেহজনক ভঙ্গিতে বারবার রুমকি আর রিক্সাওয়ালাকে দেখছিল। আম্মু তখন চুপচাপ রিক্সায় বসা। ছেলেটা হঠাৎ প্রেসক্রিপশনটা রুমকির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, ” আচ্ছা, এটা দেখুন তো ! এই ঔষধটা কী উনি সবসময় খান ? ”
ছেলেটার কথা শুনে রুমকি ঝুঁকে পড়েছিল প্রেসক্রিপশনের ওপর। ঔষধের নামটা পড়তে গিয়েই টের পায় ওর বমি বমি লাগছে। মাথাটা যেন হঠাৎ ঘুরাতে শুরু করেছে আর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কী মনে হতে ছেলেটাকে কোনমতে ‘ঔষধ কিনে আসছি’ বলে সরে পড়ে ওখান থেকে। তারপর ফার্মেসীর পেছনে বুনো ঝোঁপটার আড়ালে বসে পড়ে। তখনও মাথা পুরোপুরি আউট হয়ে যায়নি কিন্তু মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবে সে। আর ওকে বেসামাল দেখলে তো এরা সুযোগ পেয়েই যাবে। রুমকির তখন একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল, কোন অবস্থাতেই এদের হাতে ধরা পড়া চলবে না। জানের আগে মান। এখন মান বাঁচানো ফরজ। রুমকি ঝোঁপে বসেই ব্যাগ থেকে বোতল বের করে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়েছিল। আর তাতে মাথা ঘোরানো কিছুটা কমেছিল। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার দরুণ ঘাড় মাথা সমানে ব্যথা করছে। এর মধ্যে ছেলেগুলোর চাপা স্বরে চিৎকার আর খোঁজ চলতে দেখেছে স্বচক্ষে। সম্ভবত ছেলেটা ওকে রিক্সার কাছে ফেরত যেতে না দেখে কাউকে ফোন করেছিল। তারপর দুজনে মিলে ডাক্তারখানার ভেতর বাহির চষে ফেলেছে। একজন তো ঝোঁপের আশেপাশে টর্চ পর্যন্ত মেরেছে রুমকিকে দেখার আশায়। রুমকি মনে মনে আল্লাহকে অশেষ শোকর জানিয়েছে কারণ আজ এই ভুতুড়ে বোরকাটার জন্যই ওরা রুমকিকে খুঁজে পায়নি। মনে মনে ভাবছিল আম্মু ওকে ফিরে যেতে না দেখে কতটা হতাশ হবেন আর ভেঙ্গে পড়বেন। বাবার কানে গেলে উনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন কিন্তু তারপরেও রুমকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাণ থাকতে এদের হাতে ধরা দেবে না। এরপরেই সে সরে পড়েছে।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া এগিয়ে দিল রুমকি। লোকটা আসলেই ভাল, একশ টাকার নোট নিয়ে খুচরো টাকাটা পর্যন্ত আবার ফেরত দিয়ে দিল রুমকিকে। রুমকির হাতে তখনও আম্মুর প্যাথলজি রিপোর্টের বিশালাকার ইনভেলপটা ধরা। সেটাকে আঁকড়ে ধরেই শায়লার বাড়ীর সামনে নামল রুমকি। শায়লা ওর স্কুল জীবনের বান্ধবী। বেশ অনেকদিন ধরেই ওর সাথে যোগাযোগ নেই। একটা সময় দুজনে একসাথে ঝিনাইদহ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত। কলেজে ভর্তি হবার পর রুমকি ঢাকায় বড় বোনের কাছে পাড়ি জমিয়েছে আর শায়লা এখানেই থেকে গেছে। তারপর থেকে অকেশন ছাড়া যোগাযোগ হতো না দু বান্ধবীতে। আজ শায়লার কথাই ওর মনে পড়েছে সবার আগে। ইচ্ছে করলে বাড়ীর পথ ধরতে পারত কিন্তু রুমকি ভাল করেই জানে ওর বাড়ী ফেরার পথের প্রতিটা গলির মোড়ে আজাদ ভাইয়ের লোক দাঁড়ানো থাকবে। যার ফলে উল্টো পথ ধরতে হয়েছে রুমকিকে। এখন একটাই আশঙ্কা। শায়লা যেন বাড়ী থাকে।
রুমকি যখন শায়লাদের গেটে নামল তখন রাত প্রায় একটা। বাড়ীর সামনে একটা নেড়ি কুকুর সমানে ডাকছে। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল ওর। এই মুহূর্তে দুটো ভয় কাজ করছে ওর মনে । প্রথমত রাত অনেক গভীর আর রাস্তায় সে একা। দ্বিতীয় ভয় যদি শায়লা বাড়ী না থাকে তাহলে সে কোথায় যাবে ? এ পর্যন্ত অনেক বড় ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে।
চলবে….