এক_পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়,পর্ব_৪
নিশাত_জাহান_নিশি
“ইফা শুধুমাত্রই আমার ভালো লাগা ছিল! তোমাকে ভালোবাসার অতি পরেই আমি বুঝতে পেরেছি তা! ভাবতে পারি নি, আমার খামখেয়ালিপনাকে সত্যি ভেবে ইফা ও পরিশেষে রাফিন ভাইকে অতি অনায়াসে বর্জন করবে। আমার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে আমার কাছে ছুটে আসবে। তোমার এবং আমার মধ্যে বিচ্ছেদের দেয়াল তৈরী করবে!”
ঐথি গাঢ় গভীর রাগে ফোঁস করে উঠল। চোয়াল শক্ত করে আকস্মিকভাবে অনলের কপালের ঠিক কাঁটা অংশটায় বৃদ্ধা আংগুল দ্বারা জোরে চাপ বসিয়ে ব্যগ্র গলায় বলল,,
“আরও শাস্তি পাওনা আছে তোমার! আরও শাস্তি!”
ঘটনার আকস্মিকতায় তীব্র ব্যথায় অবিলম্বে অনলের নাক, মুখ খিঁচে এলো! কাঁটা অংশটায় আলতো হাত ছুঁইয়ে অনল ধীর গলায় বলল,,
“আঘাতটা যার কারনে পেয়েছি, সেই ব্যক্তিটিই আবার তার দেওয়া জখমে পুনরায় আঘাত করল? এতটাই ভয়ঙ্কর তোমার শাস্তি?”
ঐথি থমকালো। উদ্বিগ্নতা এবং প্রখর মায়ায় ভরা পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অনলের যন্ত্রণাহত মুখমন্ডলে। মধ্যিখানে বিরাজমান বিস্তর দূরত্ব ঘুচিয়ে ঐথি চূড়ান্তভাবে অনলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল! অনল পূর্বের ন্যায় ডানে বায়ে না তাকিয়ে অত্যধিক যন্ত্রণায় নাক, মুখ কুঁচকে মন্থর পা ফেলে একাগ্রচিত্তে হেঁটে চলছে। ঐথির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানোর অকল্পনীয় ঘটনাটি অনলের এখনও দৃষ্টিপাত হয় নি! আচম্বিতে ঐথি অনলের ব্যাথাযুক্ত হাতটি চেপে ধরল! কাঁটা অংশের চিনচিনে ব্যথায় অনলের যাবতীয় কর্মকান্ডে ব্যাঘাত ঘটল। হাঁটা থামিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল অনল! ভগ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ঐথির দিকে। ঐথি ফ্যাল ফ্যাল চাহনিতে আবদার সূচক গলায় বলল,,
“অনল? বাস স্ট্যান্ডের সামনে কোনো ফার্মেসী পেলে টিট্রমেন্ট করাবে তো তোমার হাত এবং কপালের?”
কিয়ৎক্ষণ অনল মৌণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ঐথির অস্থির আঁখি জোড়ায়! মুহূর্তের মধ্যেই মৌণতা ভেঙ্গে অনল অট্ট হেসে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“মায়া জন্মাচ্ছে আমার প্রতি না? দু’বছর পর হুট করে আমার প্রতি মায়া জন্মাচ্ছে?”
ঐথি নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। উদ্বেগি দৃষ্টি তার অনলের হটকারি আঁখি জোড়ায় সীমাবদ্ধ। অতি যত্নে গোপন করে রাখা মনের সুপ্ত অনুভূতিদ্বয়কে এভাবে হেয় করতে পারছে না ঐথি! অনলের নিচ হাসির ঝংকারে যেন ঐথির শরীরে আগুনসম জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। কিছুতেই অনলের করা বিদ্রুপাত্নক আচরণ সে সহ্য করতে পারছে না। সমস্ত বিষয়টি সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যেতেই ঐথি এক ঝটকায় অনলের হাতটি ছেড়ে শোঁ শোঁ বেগে হাঁটা ধরল অনলকে অনেকটা পিছনে ফেলে! নিয়াজ, আহির এবং রুহাজের কাতারে নিজেকে সন্নিবেশিত করল প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। এরপর না একটি বার পিছু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছে ঐথি! জেদ বজায় রেখে ঐ তিনজনের পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলছে দ্রুত গতিতে। নিয়াজ অনেক খানি বিস্মিত হয়ে পাশ ফিরে ঐথির রাগান্বিত মুখমন্ডলে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“অনলকে ছেড়ে হঠাৎ এখানে?”
“জাহান্নামে যাক ঐ অনল! আপনার বন্ধুকে সেই দু’বছর আগেই আমি ছেড়েছি। নতুন করে ছাড়ার কিছু নেই!”
নিয়াজ ভড়কে উঠল। ঐথির সমস্ত মুখমন্ডলে ঈর্ষা, ক্ষোভ এবং একগুঁয়ে ভাব স্পষ্টত। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না, দুজনের মধ্যেই তুখার ঝগড়া এবং কথা কাটাকাটি হয়েছে! ঐথির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়াজ আগ্রহী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে অনলের দিকে তাকাল। অনল মাথা নুইয়ে মাত্রাতিরিক্ত শীতে বুকে দু’হাত গুজে ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে প্রথম সারির উদ্দেশ্যে। অনলের থেকে ব্যথীত দৃষ্টি সংযত করে নিয়াজ পুনরায় ঐথির ক্রোধান্বিত মুখমন্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ধীর গলায় ঐথিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কি নিয়ে ঝগড়া করলে?”
ঐথি প্রত্যত্তুরে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,
“অফ টপিক! আপনার জানতে হবে না।”
“কবে তোমরা ঠিকঠাক টপিক নিয়ে ঝগড়া করেছিলে একটু বলবে? প্রতিবারই তো তোমরা ভুলভাল টপিক নিয়ে ঝগড়া করে দুনিয়াটা আউলাইয়া ফালাও! পাঁচ বছর যাবত তো এই আউলা ফাউলাই দেখে আসছি!”
“বুঝলাম না! বন্ধুর হয়ে কি আপনি ও এখন আমার সাথে ঝগড়া করবেন? দুর্বল পেয়েছেন আমাকে না? মাঝরাতে একটা ভদ্র বাড়ির মেয়েকে জীপে তুলে এনে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন আপনারা সব বন্ধুরা মিলে?”
নিয়াজ তদ্ধিত! মুখমন্ডলে তিক্ততার ছাপ ফুটিয়ে নিজেই নিজের কপালে ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চাপড় বসিয়ে বলল,,
“কোন মহা মুসিবতে ফেঁসে গেলাম আল্লাহ্! হাতে ধরেই মহা মুসিবত গলায় ঝুলিয়েছি আমরা! ভালো কথা বললে ও এর কাছে ঝগড়া মনে হয়! উড়নচণ্ডী মেয়ে একটা!”
অনর্গল অভিপ্রায় গুলো ব্যক্ত করে নিয়াজ দম নেওয়ার ও জো পেল না! এর অতি পূর্বেই ঐথি হাঁটা থামিয়ে জোর গলায় চিৎকার করে বলল,,
“কি বললেন আপনি? আমি উড়নচণ্ডী?”
অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল নিয়াজের! মনে হলো যেন কিছু মুহূর্তের জন্য এই স্থানে ভূ-কম্পন হয়েছে! নিস্তব্ধ রাত, রাস্তায় জনমানুষ এবং যান চলাচলের ও তেমন কোনো কোলাহল নেই। পিন পড়ার আওয়াজ ও এই স্থানে বিকট আওয়াজ বলে সমীচিন হবে। সেই জায়গায় তো ঐথির বুক ফাঁটা চিৎকার! ভূ-কম্পনের চেয়েও কম নয় কিন্তু! বুকে হাত দিয়ে তব্ধ শ্বাস নির্গত করতে ব্যস্ত নিয়াজ। আহির এবং রুহাজ ও চমকে উঠল। বেকুব দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ঐথির দিকে। পেছন থেকে অনল আতঙ্কিত হয়ে দৌঁড়ে এলো ঐথির কাছে। রুদ্ধশ্বাস নির্গত করে অনল ঐথিকে কিছু জিগ্যেস করার পূর্বেই ঐথি বেগহীন গলায় অনলকে বলল,,
“নিয়াজ ভাই আমাকে উড়নচণ্ডী বলেছেন। আমি এক্ষুনি এর বিচার চাই!”
অনল বিস্মিত! মানব মূর্তি প্রায়! সামান্য উড়নচণ্ডী বলেছে বলে এত জোর চিৎকার? তার উপর এর বিচার ও চাই? এমন হাস্যকর কার্যকলাপ এবং জোর বিচারের দাবিতে অনল তার হাসি আটকাতে পারল না। ফিক করে হেসে দিলো সে! সঙ্গে সঙ্গেই ঠোঁট ভেদ করে তার আকর্ষনীয় গজ দাঁত টি বেরিয়ে এলো। ঐথি এবার বিন্দু পরিমান ও মুগ্ধিত হলো না অনলের এই মনোমুগ্ধকর হাসিতে। উল্টে মুখমন্ডলে তেজস্বিনী ভাব ফুটিয়ে অনলের কপালের কাঁটা অংশটায় পুনরায় দু’হাতের দুু দু’টো আংগুলের জোর চাপ বসিয়ে অগ্রে হাঁটা ধরল আর ফুসফুস করে বলল,,
“আমাকে নিয়ে অযথা হাসলে এই অবস্থাই হবে! যতক্ষণ অবধি না এই ক্ষতস্থান শুকাবে ততক্ষণ অবধি এই ক্ষত স্থানে আমার ভয়াল থাবা বসবে!”
অনল ব্যথাযুক্ত স্থানে হাত ঠেকিয়ে তাজ্জব দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঐথির যাওয়ার পথে! নিয়াজ শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে অনলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,,
“কি রে দোস্ত? এটা মেয়ে না ধানী লঙ্কা? কার সাথে প্রেম করেছিস তুই? তোর সাথে সাথে তোর বন্ধুদের ও হেনস্তা করছে! বিশ্বাস কর? হার্টবিট এখনও টিউটিউ করছে আমার। যেভাবে ধমকেছিল আমায়! বাপরে, বাপ!”
পাশ থেকে আহির এবং রুহাজ সমস্বরে তৎপর গলায় অনলকে বলল,,
“প্রথমেই বলেছিলাম, এই ধানী লঙ্কার সাথে প্রেম করা যাবে না! তবুও তুই করেছিস! দু’বছর আগেই এর প্রেমে ফেঁসে গেছিস। এবার বুঝ মজা। না গিলতে পারবি, না উগলাতে পারবি!”
অনল স্মিত হাসল! কপালের অংশে লেপ্টে থাকা চুল গুলো হালকা টেনে বলল,,
“উঁহু! উগলানোর কোনো প্রশ্নই আসছে না। একে তো আমি গিলেই ছাড়ব!”
নিয়াজ, আহির এবং রুহাজ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অনলের দিকে। অনল ভ্রু যুগল ঈষৎ উঁচিয়ে তাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তারা ফোঁস করে বলে উঠল,,
“নরকে যা!”
,
,
ঘড়িতে রাত দুটো ছুঁইছুঁই! দীর্ঘ চার ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগে মাত্র তারা রাঙ্গামাটির আবাসিক একটি লজে উঠেছে। দুটো কামরা তাদের বুকড করা। প্রথম কামরায় অনল, নিয়াজ, আহির এবং রুহাজ। অন্য কামরাটিতে ঐথি একাই থাকবে। ঐথিকে বাজিয়ে দেখার জন্য আহির মজার ছলে ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“পারবে? অনলের সাথে একই কামরা শেয়ার করতে?”
অনল রাগান্বিত হয়ে কিছু বলার পূর্বেই ঐথি দাঁতে দাঁত চেপে মুহূর্তের মধ্যে অনলের হাত থেকে কামরার চাবিটি ছিনিয়ে নিয়ে দু’তলার দিকে অগ্রসর হয়ে বলল,,
“বাজিয়ে দেখতে হবে না আমায়! অন্যের প্রেমিকের সাথে কামরা শেয়ার করতে পারব না আমি!”
অনল ক্রোধান্বিত হয়ে প্রথমেই আহিরের মাথায় গাড্ডা মেরে বলল,,
“শান্তি হয়েছিস? এর উস্কানিমূলক কথা শুনে শান্তি হয়েছিস? জেচে পড়ে যাস কেন আগুনে কেরোসিন ঢালতে?”
অনল হনহনিয়ে হাঁটা ধরল তার কামরার দিকে। আহির, রুহাজ এবং নিয়াজ অট্ট হেসে অনলকে অনুসরন করল। চারজনই কামরায় প্রবেশ করে দরজার খিল আটকে দিলো। ঐথি তার কামরায় প্রবেশ করে প্রথমেই পুরো কামরাটিতে পূর্ণ দৃষ্টি বুলালো। প্রত্যাশার তুলনায় কামরাটি খুবই ছোট। দু’জনের অধিক ব্যক্তি এই কামরাটিতে থাকতে স্বস্তিবোধ করবে না। কামরাটির মধ্যিখানে মাঝারি ধরনের একটি জানালা। এর পাশ ঘেঁষেই শক্তপোক্ত একটি খাট। খাটটি সুবিন্যস্ত ভাবেই সাজানো। লাল রঙ্গের একটি কম্বল ও খাটটিতে শোভা পাচ্ছে। একটি খাট ব্যতীত আর কোনো আসবাবাপত্রই কামরাটিতে চোখে পড়ছে না। কামরাটির ডান পাশ ঘেঁষে ছোট দেখতে একটি ওয়াশরুম ও আছে। তবে বারান্দার কোনো সু- ব্যবস্থা নেই।
স্যাঁতস্যাতে ওয়াশরুমটিতে কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে ঐথি কামরায় প্রবেশ করল। আচম্বিতে ভয়ে তার শরীরের লোমকূপদ্বয় কেঁপে উঠল। মনে হলো যেন কামরাটিতে দ্বিতীয় কোনো পক্ষ আছে! যার উপস্থিতি ঐথি টের পাচ্ছে। পুরো কামরা জুড়ে কারো পদধ্বনি কর্নগোচর হচ্ছে ঐথির। ঝুনঝুন নূপুরের শব্দে পা ফেলে কেউ ক্রমাগত হেঁটে চলছে কামরাটিতে! তাৎক্ষণিক গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে ঐথি এক ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল! প্রচন্ড ভয়ে মুখে দু’হাত গুজে ঐথি পাশের কামড়ায় করাঘাত করে অনলকে ডেকে বলল,,
“অনল প্লিজ, দরজাটা খোলো। আমার কামরায় কেউ আছে। কোনো চন্দ্রমল্লিকা লুকিয়ে আছে! তার নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ আমি শুনেছি!”
অনল হন্ন হয়ে দরজার খিল খুলে ভয়ার্ত ঐথির মুখোমুখি দাঁড়াল। ভয়ে ঢকঢক করে কেঁপে ঐথি কম্পিত গলায় বলল,,
“আআমার রুরুমে কেককেউ আছে!”
ঐথিকে উপেক্ষা করে অনল হনহনিয়ে ছুটে চলল ঐথির কামরার ভেতর। পরমুহূর্তে ঐথি ও অনলকে অনুসরণ করে তার কামরায় প্রবেশ করল। ঝুনঝুন শব্দটি এবার অনলের কানে ও ভেসে আসতে লাগল! কিয়ৎক্ষণ অনল খাটের আশেপাশে গোয়েন্দা ভঙ্গিতে হেঁটে আচমকা খাটের নিচে উঁকি দিলো! অমনি খাটের তলা থেকে একটি ধবধবে শুভ্র রঙ্গের বিড়াল বেরিয়ে এলো! আক্রোশিত গলায় ডেকে উঠল,,
“ম্যাও!”
#চলবে…?