এক_পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়,পর্ব_২

এক_পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়,পর্ব_২
নিশাত_জাহান_নিশি

“ভালোবাসি আমি ঐথিকে! পাগলের মত ভালোবাসি! ঐথি যতই নিকৃষ্ট হোক, যতই আমার চরিত্রে দাগ লাগাক, আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিক। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ও আমি ঐথিকে ভালোবাসি। পৃথিবী উল্টে গেলে ও ঐথির প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমান উল্টোবে না!”

অনলের নির্গত করা প্রতিটি রুদ্ধশ্বাস যেন সত্যি সত্যিই তার শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে! পারিপার্শ্বিক অনুকূল পরিস্থিতি ও তার কাছে অসহ্যকর এবং প্রতিকূল ভাবাপন্ন। নিয়াজ এবং রুহাজ যেন হাজার চেষ্টা করে ও অনলের ক্রোধ শান্ত করতে পারছে না। পরিশেষে দুজনই শ্রান্ত হয়ে অনলের হাত দুখানা শক্ত হাতে চেপে ধরে তব্ধ শ্বাস ছাড়তে লাগল। জীপটি রাস্তার ফুটপাতের এক প্রান্তে দাঁড় করিয়ে আহির অনলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কি চাইছিসটা কি তুই? ঐথির দেওয়া মিথ্যে অভিযোগ কাঁধে নিয়ে গারোদের ওপারে বন্ধী থাকতে? ঐথির অসৎ উদ্দেশ্যকে জিতিয়ে দিতে? আর তুই কার জন্য এত ভয়ঙ্কর পাগলামী করছিস? সে কি আদৌ তোর ভালোবাসার মূল্যায়ন করে? তোর পাগলামোকে গুরুত্ব দেয়?”

কপালের আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটি শক্ত হাতে চেপে ধরে অনল নাক, মুখ খিঁচে বন্ধ করে বলল,,

“ঐথি ও আমাকে ভালোবাসে! আমি যতটা বাসি বিনিময়ে ঐথি ও আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসে! তার চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারি! ক্রোধের বিপরীতে থাকা আমার জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাটা ও ঠিক বুঝতে পারি। নিশ্চয়ই আমাদের অগোচরে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। ঐথি এবং আমার মধ্যে বিরাট কোনো কুটনীতি চলছে!”

রুহাজ তৎপর গলায় অনলের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“তাহলে খুঁজে বের কর সেই কুটনীতি! ঐথিকে তুলে নে জীপে। শুধুমাত্র ঐথিই পারবে সব ষড়যন্ত্র এবং কুটনীতির অবসান ঘটাতে।”

অনল থমকালো। কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণ থেকে উৎকন্ঠিত গলায় আহিরকে বলল,,

“জীপ ঘুরা আহির! সত্যিই এবার ঐথিকে তুলতে হবে! যদি সত্যিই ঐথি ধর্ষিত হয়ে থাকে তবে সেই ধর্ষককে ও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

ইতোমধ্যেই নিয়াজের সেলফোন ভাইব্রেট মোডে বেজে উঠল। অনলকে থামিয়ে নিয়াজ ফোনের স্ক্রিনের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সঙ্গে সঙ্গে আঁখিদ্বয়ে অস্থিরতা নিয়ে বিস্ফোরিত গলায় অনলকে বলল,,

“হায়দার স্যার কল করেছেন!”

অনল ঘাবড়ে উঠা গলায় অনর্গল বলল,,

“কলটা তুল। আর বল, অনল কোথায় আছে জানি না। অনলকে আমরা ও খুঁজছি।”

নিয়াজ সম্মতি জানিয়ে কলটা রিসিভ করল। নম্র গলায় জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম স্যার!”

হায়দার সাহেব ফোনের অপর প্রান্ত থেকে নমনীয় গলায় সালামের উত্তর নিয়ে পরক্ষণেই বাজখাঁই গলায় বললেন,,

“অনল কোথায়?”

“আমার ও তো একই প্রশ্ন স্যার? অনল কোথায়?”

“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড! আর তুমি জানো না?”

“সব ব্যাপার আমাকে কেন জানতে হবে স্যার? তার ও তো কিছু ব্যক্তিগত বিষয় থাকতে পারে। যেখানে প্রশ্ন তার নিরাপত্তার, সেখানে বেস্ট ফ্রেন্ডও তার ঝুঁকির কারন হতে পারে!”

“তার মানে সত্যিই তুমি জানো না অনল কোথায় আছে?”

“না স্যার, জানি না! ইভেন আমরা ও অনলকে গতকাল রাত থেকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোনো পজিটিভ খবরই মিলছে না।”

“অনলকে যদি খুঁজে পাও, তাহলে অবিলম্বে অনলকে বলবে পুলিশের কাছে ধরা দিতে! একজন ধর্ষকের জন্য আমরা প্রতি মুহূর্তে পুলিশের কাছে হেনস্তা হতে পারব না। মিডিয়ায় আমাদের ও একটা সম্মান আছে। সামান্য একজন কর্মকর্তার কু-চরিত্রের জন্য আমরা মিডিয়ার মান সম্মান নষ্ট করতে পারব না!”

“অনল সম্পূর্ণ নির্দোষ। তা যেমন আপনি জানেন, তেমনি আমি জানি এবং আমাদের মিডিয়ার প্রতিটি লোকও জানে! তবুও যেহেতু অনলের দিকে আংগুল উঠেছে সেহেতু অনল দায়িত্ব নিয়েই তার চরিত্রে উঠা দাগ নিশ্চিহ্ন করবে! আমি এবং আমরা সেই আশাতেই আছি। অনলকে খুঁজে পাওয়া মাত্রই আপনাকে ইনফর্ম করা হবে স্যার। এখন রাখছি তাহলে!”

ঝট করে নিয়াজ কলটি কেটে দিলো। অনলের দিকে তৎপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“ঐথিকে তুলতে হবে এট এ্যানি কস্ট। ঐথিই একমাত্র পারবে তোকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে!”

অনল দৃঢ়বদ্ধ হয়ে জীপ থেকে নেমে ড্রাইভিং সিট থেকে আহিরকে সরিয়ে দিলো। অবিলম্বে নিজেই ড্রাইভিংয়ের দায়িত্ব নিলো। ইতোমধ্যেই ফুল স্পিডে জীপ ছেড়ে দিলো অনল। মিনিট দশ একের মধ্যে ঐথির বাড়ির দারস্থ হয়ে অনল জীপে নিয়াজ, আহির এবং রুহাজকে রেখে পুনরায় ঐথির রুমের পেছনের দরজায় করাঘাত করল। চতুর্থ বার নিস্ন আওয়াজে করাঘাত করতেই ঐথি বিক্ষিপ্ত ভাবে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বিশেষ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অনল মুখমন্ডলে রাগী শ্রী ফুটিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে স্প্রে যুক্ত রুমালটি হাতে নিয়ে ঐথির মুখ চেঁপে ধরল! ঘটনার আকস্মিকতায় ঐথি চোখ জোড়া প্রকান্ড করে অনলের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অনল রুমাল খানা আরও জোরে চেপে ধরল ঐথির মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই ঐথি চোখ জোড়া বুজে শরীরের সমস্ত শক্তি অনলের বলিষ্ঠ শরীরে ছেড়ে দিল। অতি দ্রুত রুমালটি পকেটে পুুড়ে অনল তাড়াহুড়ো করে ঐথিকে কোলে তুলে নিলো। জোর কদম বাড়িয়ে অনল ঐথিকে নিয়ে জীপে উঠে বসল। জীপের পেছনের গদিতে ঐথিকে খুব সাবধানকার সহিত হেলানরত অবস্থায় রেখে অনল নিজে ও ঐথির পাশে বসল। ইতোমধ্যেই আহির দ্রুত গতিতে জীপ ছেড়ে দিলো। শাঁ শাঁ শব্দে জীপ ছুটে চলছে উদ্দেশ্যহীন পথে। সামনের সিট থেকে রুহাজ পিছনের সিটে তাকিয়ে উদগ্রীব গলায় অনলকে শুধিয়ে বলল,,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

অনল হাঁফিয়ে উঠা গলায় বলল,,

“আমাদের পুরনো ফার্ম হাউজে। যার হদিস আমরা তিনজন ব্যতীত চতুর্থ ব্যক্তি জানে না!”

আহির সম্মতি জানিয়ে জীপটি বাঁ পাশের রাস্তায় ঘুড়িয়ে নিলো। অনল রুদ্ধ শ্বাস নির্গত করে ঐথির অচেতন মুখমন্ডলে দৃষ্টি স্থির করল। অশান্ত আঁখি জোড়া তার কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই শান্ত হয়ে উঠল। কপালের মাঝ বরাবর থাকা টিপের মতো কালো তিলটায় বরাবরের মতো এবার ও আকর্ষণ বাড়ছে অনলের! বুজে থাকা কুচকুচে কালো এবং সুদীর্ঘ চোখের পাপড়িতে অনল হারিয়ে যাচ্ছে আবারও! গোলাকৃতির গৌরবর্ণ মুখমন্ডলে যেনো গগনে বিরাজমান রূপসী চাঁদটি মাটিতে খসে পড়েছে! সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত যেন বিশ্বভ্রম্মান্ডের চারপাশ! সমস্ত ক্রোধ, ক্ষোভ, দুঃখ, ক্লান্তি, ক্লেশ যেন ঐথির অমায়িক, লাবন্যময় এবং ক্লান্তিহীন মুখমন্ডলে এসে থমকে গেছে। পলকহীন দৃষ্টিতে ঐথিকে দেখতে দেখতেই অনলের ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয়ে এলো। মৃদু হেসে অনল নিজেই নিজের মাথায় চাপড় মেরে বলল,,

“থেমে যা অনল। এত সহজে বিগলিত হলে চলবে না! আবারও কঠোর হয়ে উঠ। ঐথির জেদ যেন তোর কঠোরতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়!”

,
,

ঘন্টা খানিক বাদে। পুরনো ফার্ম হাউজের ঘুটঘুটে অন্ধকার মহলে মোমবাতি জ্বালিয়ে পাঁচ জন পাঁচ দিকে ছিটকে বসে আছে! চারদিকে লোহার যন্ত্রপাতি অগোছালো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিশাল ফার্ম হাউজের মধ্যিখানের ঠিক ফাঁকা জায়গাটায় তাদের পাঁচজনের অবস্থান। অনল, নিয়াজ, আহির এবং রুহাজ চতুর্দিক থেকে ভয়ে জাগ্রত ঐথিকে ঘিরে রেখেছে! হাঁটু গুজে অসহায় চিত্তে কোণ ঠাঁসা হয়ে বসে আছে ঐথি। সেকেন্ডে তার অন্তত দু’বার করে চোখের পাতা পড়ছে! জ্বলন্ত মোমবাতিটি অনল ঐথির দৃষ্টির সম্মুখে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তো বলো? গত পরশু রাতে তোমার সাথে ঠিক কি কি ঘটেছিল?”

শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে ঐথি প্রসঙ্গ পাল্টাতে অনলের দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আমাকে এইখানে উঠিয়ে আনার কারণ কি? কি উদ্দেশ্য তোমাদের হুম?”

“সিরিয়াসলি ঐথি? তুমি সত্যিই কিছু জানো না? তোমাকে কেন এইখানে উঠিয়ে আনা হলো? কেনে তোমাকে এভাবে ঘিরে রাখা হলো? তুমি সত্যিই কিছু জানো না?”

“না জানি না। আর আমি কিছু জানতে ও চাই না। ধর্ষকের সাথে কোনো কথা নেই আমার!”

পুনরায় ক্রোধ চেপে বসল অনলের মাথায়। সহানুভূতি ভুলে অনল ক্ষণিকের মধ্যেই ঐথির থুতনী চেপে ধরে বলল,,

“এইটা তোমার বাড়ি না! যে তুমি খুব সহজেই সত্যিটা অস্বীকার করে পার পেয়ে যাবে। এটা আমার ড্যারা! এই অনলের ড্যারা। আমার সব শক্তিরা আমার পাশেই আছে। তোমার পক্ষে অতো সহজ হবে না আমাদের ফেইস করা।”

নেত্রকোটর বেয়ে অবাধ্য জলের ছুটোছুটি আরম্ভ হলো ঐথির! নাক, মুখ কুঁচকে সে ভগ্ন গলায় বলল,,

“তুমি আমায় কেটে রেখে দিলে ও সত্যিটা বের করতে পারবে না অনল! আমি কিছুতেই মুখ খুলব না!”

“কেন ঐথি? কিসের এত ভয় তোমার? তোমার সাথে যাই ঘটে থাকুক না কেন তুমি এক এক করে সব খুলে বলো আমায়। এভাবে আমায় ধোঁয়াশার মধ্যে রেখো না প্লিজ!”

আহত আঁখি যুগল খুলে ঐথি গলা জড়ানো কন্ঠে বলল,,

“ওরা “মুনাকে” মেরে দিবে অনল! আমার ছোট্ট বোনটিকে মেরে দিবে! মাত্র এগারো বছরের সে। খুব মায়া পড়ে গেছে তার উপর। তাকে আমি হারাতে পারব না অনল! কিছুতেই হারাতে পারব না।”

অনল বিস্মিত হলো। প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল,,

“মুনা কে? কার কথা বলছ তুমি?”

“আমার সৎ বোন!”

“কে তাকে মেরে দিবে বলো আমায়?”

“তোমার মিডিয়ার লোকজন!”

অনল হতভম্বিত৷ একের পর এক ঝটকা লাগছে তার! ঐথির কোনো জবাবের হিসেব মিলাতে পারছে না সে। তার স্তব্ধতা দেখে পাশ থেকে নিয়াজ কপাল কুঁচকে ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“মানে? আমাদের মিডিয়ার লোকজন কেন তোমার বোনকে মারতে যাবে? তারা তো উল্টে তোমাকে মারতে চাইছে! কারন, তুমি তাদের মিডিয়ার কর্মকর্তার উপর রেপের অভিযোগ তুলেছ! তারা তো তৎপর হয়ে আছে তোমার সম্ভ্রম নষ্ট করতে!”

ঐথি উচ্চ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে প্রত্যত্তুরে বলল,,

“সব সাজানো নিয়াজ ভাই! সব সাজানো! তারা আমাদের বাঁচতে দিবেন না। মুনা থেকে শুরু করে আমি এবং অনলকে ও তারা ছাড়বেন না!”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here