এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,পর্ব_১
নিশাত_জাহান_নিশি
“মিস ঐথি! এক শর্তেই আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হব! যদি আপনি এক্ষনি, এই মুহূর্তে আমার বিরুদ্ধে করা মিথ্যে র্যাপের অভিযোগ তুলে নিন! নাও ডিসিশান ইজ ইউর’স। নিজেকে শক্তিশালী ঐ শত্রুপক্ষের হাত থেকে বাঁচাতে আমার প্রস্তাবে রাজি হবেন নাকি এক কথায় উপর মহলের কাছে নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিবেন?”
দু’কদম পিছিয়ে গেল ঐথি! জবজবে ঘামে শরীর তার শ্রান্ত। ভয়ে, জড়তায়, কুন্ঠায় এক দীর্ণ-বিদীর্ণ অবস্থা! হাঁসফাঁস করে ঐথি সাংবাদিক ‘অনল আহসানের’ ক্ষোভ ভরা দৃষ্টিতে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
“ভুল করছেন আপনি অনল আহসান। আমাকে দুর্বল ভেবে আপনি ভুল করছেন! ভাববেন না, আপনাদের কঠোর দু-একটি হুমকির ভয়ে আমি নিজের বিরুদ্ধে করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভুলে যাব! কান খুলে শুনে রাখুন তবে মিঃ অনল আহসান? আপনি এবং আপনার উপর মহলরা যৌথভাবে মিলে যা ইচ্ছে পারুন তাই করুন। আমি কিন্তু কিছুতেই আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ব না! আপনার বিরুদ্ধে করা ধর্ষণের অভিযোগ ও তুলব না! এমনকি আপনার বিয়ের প্রস্তাবে ও রাজি হব না!”
কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যেই পৈশাচিক হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল অনল! সামনের দাঁত কপাটির একটি গজ দাঁত ঠোঁটের মাংসপেশি থেকে বেরিয়ে এলো তার! যদি ও এক সময় ঐথি অনলের এই গজ দাঁতের হাসিতে মুগ্ধ হতো। তবে এই দীর্ঘ দু’বছরের ব্যবধানে অনলের মুগ্ধ করা এই হাসিটি ঐথির মনে ক্ষোভের ভয়াবহতা তৈরী করতে সমর্থ হচ্ছিল! অনলের এই পৈশাচিক হাসির ঝংকারে ঐথির প্রাণবায়ু যেন যায় যায় করছিল! দেয়ালের সাথে কোণ ঠাঁসা হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা রইল না তার! কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই অনল হাসি থামিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে ঐথিকে দেয়ালের সাথে আর ও সজোরে চেঁপে ধরল। ঐথির সন্দিহান দৃষ্টিতে ভয়াল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,
“প্রতিশোধ নিচ্ছ আমার থেকে না? দু’বছর আগে করা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিচ্ছ? এই অনলের প্রতি তোমার এতটাই ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে যে, তুমি একজন মেয়ে হয়ে নিজের সব’চে দামি বস্তুটিকেই পুরো দুনিয়ার সামনে অসম্মান করছ? নিজের চরিত্র নিয়ে এভাবে কুৎসা রটাচ্ছ?”
ভয়ার্ত রূপে ও ঐথি অট্ট হেসে অনলের দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“প্রতিশোধ? আপনার থেকে প্রতিশোধ? যাকে আমি কখন ও ভালোই বাসি নি, তার প্রতি ক্ষোভ থেকে আমি প্রতিশোধ নিব? নিজের চরিত্রকে অসম্মান করে আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করব? ভাবলেন কি করে আপনি? এখন তো আপনার পেশা নিয়ে ও আমার সন্দেহ হচ্ছে! সাংবাদিক হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! শতভাগ বিচক্ষণতা অবশ্যই থাকতে হয়। আপনার মধ্যে তো দেখছি বিচক্ষণতার বালাই মাত্র নেই। এই নির্বোধ মস্তিষ্ক নিয়ে আপনি রিপোর্টার হলেন কি করে?”
ঐথির রুক্ষ অভিব্যক্তির বিপরীতে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অনলের! বাজখাই গলায় ঐথির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“তার মানে কি বলতে চাইছ তুমি? আমি সত্যি সত্যিই তোমাকে র্যাপ করেছি? আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটিকে আমি বিয়ের ঠিক দুদিন পূর্বে র্যাপ করেছি?”
ঐথি দ্বিধাহীন এবং সুদৃঢ় গলায় প্রত্যত্তুরে বলল,,
“হুম, করেছেন! যার প্রমাণ আমি হসপিটালে এবং পুলিশ প্রশাসনকে ও দেখিয়েছি! এবং সেই প্রমানের ভিত্তিতেই পুলিশ আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছেন। সামনে পাবেন তো….
সম্পূর্ণ উক্তি সমাপ্ত করার পূর্বেই অনল ঐথিকে থামিয়ে দিলো। সেকেন্ডের মধ্যেই ঐথির থুতনী চেঁপে ধরে অতি উত্তেজিত গলায় বলল,,
“আমি ও প্রমান দেখতে চাই! কোথায় কোথায় আমি তোমায় স্পর্শ করেছি! সেই ভয়াল নখের আঁচড় দেখতে চাই, কোন অংশে বেশি আঘাত করেছি তাও দেখতে চাই, কোন কোমল অংশে বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে তাও স্ব-চক্ষে দেখতে চাই!”
ভড়কে উঠল ঐথি! তাৎক্ষণিক শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে অনলকে এক ধাক্কায় তার সম্মুখ থেকে সরিয়ে দু’কদম পিছু হটে দাঁড়াল। রুদ্ধশ্বাস নির্গত করে ঐথি উত্তেজিত গলায় বলল,,
“আমি কিন্তু এখন চিৎকার করতে বাধ্য হব অনল। থানায় যোগাযোগ করতে ও বাধিত হব। ভালো এতেই হয় যদি এক্ষনি, এই মুহূর্তে তুমি আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও!
অনলের ঠোঁটের কোণে আবার ও সেই পাশবিক হাসির উৎপত্তি উঠল। ঐথির দিকে ধীর কদম বাড়িয়ে বলল,,
“তোমার এত বড় সর্বনাশ করে দেওয়ার পরে ও তুমি আমার ভালো কামনা করছ ঐথি? লাইক সিরিয়াসলি? তোমার ঘাতককে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছ? আদৌতেই কি তুমি এতটা ভালো এবং কোমল মনের মেয়ে মানুষ ঐথি? নাকি আমার বিরুদ্ধে করা মিথ্যে চাল ধরার পড়ার ভয়ে উল্টে আমায় পুলিশের ভয় দেখিয়ে আপদকে বিদেয় করতে চাইছ?”
ঐথি নিরুত্তর, নিশ্চুপ, নির্বিকার। তবে তেজী দৃষ্টি এখন ও স্থির রইল অনলের প্রশ্নবিদ্ধ আঁখিযুগলে। এর মধ্যেই আচম্বিতে প্রকট শব্দে অনলের ফোন বেজে উঠল। শঙ্কিত দৃষ্টিতে অনল ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিরিক্ষিপূর্ন গলায় ঐথিকে শাসিয়ে বলল,,
“শুধুমাত্র তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম বলেই তুমি আমায় এই মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিলে তাই না ঐথি? ওকে, কোনো ব্যাপার না! অনলের দুদিনের বেশি সময় লাগবে না এই মিথ্যে মামলা থেকে বের হয়ে আসতে! তখন কিন্তু তুমি ও তৈরী থেকো ঐথি! অনল যখন মাঠে নামবে তখন আট ঘাট বেঁধেই নামবে। যদি তুমি সত্যিই ধর্ষিত হয়ে থাক, তবে সেই আসল ধর্ষককে ও অনল খুঁজে বের করবে।”
শেষবারের মত ঐথির দিকে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনল এক রাশ ঘৃণা নিয়ে ঐথির রুমের গোপন দরজা দিয়ে প্রস্থান নেওয়ার পূর্বে পেছন থেকে ঐথিকে অনুরক্ত গলায় বলল,,
“আই হেইট ইউ ঐথি! আই রিয়েলি হেইট ইউ। তুমি আমাকে না দু’বছর আগে বুঝেছিলে, না দু’বছর পর এসে বুঝলে! আমাদের সম্পর্কটা সবসময় নিকষ কালো রাতের গহ্বরে ঢাকা কূয়াশার ধূম্রজাল হয়ে পেঁচিয়ে থাকবে! এই জাল কেটে আমরা কখন ও মিলেমিশে একাকার হতে পারব না ঐথি! কখন ও না!”
কাঠের দরজায় সজোরে এক ঘুঁষি মেরে বাঁ হাতটা লোহিত রক্তে ভিজিয়ে অনল হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ঐথির দৃষ্টির সীমানা থেকে। অনলের যাওয়ার পথে নির্লিপ্ত নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঐথি! দৃষ্টি তার অপ্রকাশিত শত সহস্র বেদনায় জর্জরিত! অনলের বলা প্রতিটি শেষ উক্তি যেন ঐথির শরীরে লোহার আলপিনের মতো গাঢ় গভীর ফোঁড়ন কাটছিল! শরীরটা তার নির্মম আঘাতে থেতলে যাচ্ছিল! রক্তক্ষরণ হচ্ছিল শরীরের প্রতিটি অঙ্গে-প্রতঙ্গে! অতি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ঐথি মিনিট পাঁচেক পর চাঁপা কান্নায় সিক্ত হয়ে উঠল। এক ছুটে গোপন দরজাটির দিকে এগিয়ে গেল! অনলের তাজা রক্তে ভিজিয়ে যাওয়া কাঠের দরজাটায় আলতো আঙ্গুল ছুঁইয়ে ঐথি ঢুকড়ে কেঁদে উঠল! রক্তের পুরোটা ছাপ ঐথি তার দু’হাতে মিশিয়ে ভগ্ন গলায় মৃদ্যু আওয়াজে বলল,,
“ফরগিভ মি অনল! প্লিজ ফরগিভ মি! আমাদের দূরত্বটা শুধু রাফিন ভাই এবং ইফা আপুর জন্যই তৈরী হয় নি! আমাদের দূরত্বটি তৈরী হয়েছিল সেদিনকার সেই বাচ্চা মেয়েটির বলা- “মৃদ্যুল ভাইয়া রাতে আমায় ঘুমুতে দেয় না আপু! সারা রাত আমায় খুব ব্যাথা দেয়, যন্ত্রণা দেয়। জোর করে আমার সাথে নোংরা কাজ করে!”
মুখে দু’হাত চেঁপে নিশ্চুপ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ঐথি। পাশের রুমেই তার দুঃসম্পর্কের চাচা, চাচী এবং তাদের পাশের রুমেই চাচাতো ভাই রাফিন আছে! কোনো ভাবে ঐথির কান্নার আওয়াজ তাদের কর্ণপাত হলেই তারা কিঞ্চিৎ হলে ও আঁচ করতে পারবে ইতোপূর্বে ঐথির সাথে ঠিক কি ঘটেছিল! আর কে ই বা এতো রাতে ঐথির রুমে এসেছিল!
ইতোপূর্বে ঐথি যে ভয়টার ইঙ্গিত করছিল কিয়ৎক্ষণের মধ্যে সেই ভয়টাই বাস্তবে রূপান্তরিত হলো! রুমের দরজায় কঠোর হাতে কড়া নেড়ে উঠল রাফিন! খর্ব গলায় উচ্চ আওয়াজে বলল,,
“এই ঐথি, দরজা খোল!”
চমকে উঠল ঐথি। বাকশক্তি লোপ পেয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। সম্মতি ফিরে পেতেই ঐথি কান্না থামিয়ে আঁখি জোড়া দু’হাত দিয়ে মুছে নিলো। শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে সে মন্থর গতিতে হেঁটে চলল দরজার দিকে! কম্পিত হাতে দরজার খিল খুলে দিতেই রাফিন তড়িঘড়ি করে রুমে প্রবেশ করে অধীর ঐথির মুখোমুখি দাঁড়াল। সন্দিহান দৃষ্টিতে রাফিন ঐথির ভয়াল দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“কে এসেছিল রুমে?”
“কেকেকে আসবে? কেকেকেউ না!”
“তোর চোখ বলছে তুই মিথ্যে বলছিস। তোর ঘাবড়ে যাওয়া মুখমন্ডল বলছে তুই সাংঘাতিক কিছু আড়াল করছিস!’
“তুমি ভুল বুঝছ রাফিন ভাই! আমি কিছু আড়াল করছি না। ঐ ভয়াবহ রাতের কথা খুব মনে পড়ছে! যে রাতে আমায় ধর্ষণ করা হয়েছিল!”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো রাফিনের। বিক্ষুব্ধ গলায় বলল,,
“অনলকে আমি ছাড়ব না। কোনো অবস্থাতেই না। অনলের জন্যই আজ তোর এই অবস্থা! দু’বছর আগে ও ঠিক অনলের জন্যই আমার এবং ইফার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল! আর আজ এই অনলের জন্যই তোর ইজ্জত হারাতে হলো! সামনে পেলেই ঐ অনলকে আমি পুঁতে রেখে দিব!”
রাগে গজগজ করে প্রস্থান নিলো রাফিন। তাৎক্ষণিক দরজার খিল আটকে ঐথি পর পর কয়েক দফা তব্ধশ্বাস নির্গত করে দরজায় পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়াল। পুনরায় মুখ চেঁপে কেঁদে সে ধীর গলায় বলল,,
“তোমরা কেউই কখন ও আমায় বুঝো নি রাফিন ভাই! তুমি ও যেমন একটা সময় আমার তীব্র অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করেছিলে, তেমনি দ্বিতীয় বারের মত অনল ও আমার তীব্র গাঢ় অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করেছিল! তোমরা দু’জনই আমার আত্মার মৃত্যুর জন্য সমভাবে দায়ী!”
__________________________________________
ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে বেয়াড়া ভঙ্গিতে হেঁটে চলছে অনল। দু’আঙ্গুলের ফাঁক বেয়ে টপটপ শব্দে তাজা রক্ত বাহিত হচ্ছে তার। দু’চোখে তার ক্রোধের অগ্নি, আপাদমস্তকে বয়ে চলছে অঢেল ক্লেশ, ক্লান্তি, হতাশা! কুয়াশায় আবৃত মৃদ্যু ঠান্ডাময় রাতের প্রকৃতি ও যেন কিছুতেই অনলের এই উষ্ণ জেদকে শিথিল করতে সক্ষম হচ্ছিল না। বিপরীতার্থে তার ক্রোধের অগ্নি যেন গগন ছুঁতে চাইছিল। অম্বর জুড়ে আজ চন্দ্রলোকিত রাতের শোভা বিরাজমান। স্বচ্ছ রূপালি ঝড়নার ন্যায় চাঁদের আলো যেন চারপাশটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূর। মেঘেদের ন্যায় কুয়াশার শতদল ছুটে বেড়াচ্ছিল এই মায়াবী গগনে। সেই কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে আলোর বন্যা ছড়াচ্ছিল রূপময় চাঁদটিতে। পূর্ণিমা চাঁদের সেই কিরণ প্রকৃতিকে করে তুলেছে শোভাময়, দীপ্তিময় এবং মাধূর্য্যমন্ডিত! ঠিক এমনি এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় অনল প্রথম বারের মত শুধু এক ঝলকের জন্য ‘ঐথির’ গৌরবর্ণের মুখের আদলটি দেখেছিল! সেই থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ে অনল! দীর্ঘ ছয় বছরের বন্ধুত্ব তাদের। ঠিক চার বছরের মাথায় এসে অনল অতি গাঢ় এবং গভীর ভাবে ঐথির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল! সেই বার কিছু প্রতিকূলতার জন্যই তার ভালোবাসাটি অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছিল! ভালোবাসা প্রকাশের অতি পূর্বেই দু’জন দু’দিকে ছিটকে পড়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবেই তখন ঐথি তার সৎ মায়ের আশ্রয়ে চলে যায়! ঐথি খুব ছোট থাকতেই তার মায়ের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে! ঐথির বাবা ‘রাজন হাওলাদার’ একজন নামকরা জার্নালিস্ট ছিলেন। ঐথি এবং ঐথির মায়ের প্রতি চোখ পড়ার মতো কোনো গভীর টান বিদ্যমান ছিল না উনার! তাই তো ঐথির মা মরে যাওয়ার প্রায় দু’মাসের মাথায় এসেই তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেন! সেই মহিলাটি আর কেউ নন! তিনি ছিলেন ঐথির বাবার অফিস কলিগ৷ তখন থেকেই অতি অযত্নে, অবহেলায়, অনীহায় বেড়ে উঠছিল ঐথি! অসহায়ত্বের দাঁড়প্রান্তে এসে ঠেঁকতেই ঐথির দুঃসম্পর্কের চাচা-চাচীরা ঐথিকে নিজেদের আশ্রয়াধীন করেন। নিজের মেয়ের মত মানুষ করে পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে তেইশ বছরের কোঠায় এনে দাঁড় করিয়েছেন!
রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটতে হাঁটতেই অনল হঠাৎ অনুভব করল একদল ছেলে এসে অনলকে টেনে হেঁছড়ে একটি বড় জীপ গাড়িতে উঠিয়ে নিলো! কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অনল আতঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল গাড়ির ভেতরকার চারপাশে! সঙ্গে সঙ্গেই সেই অতি পরিচিত তিনটি মুখ তার দৃষ্টিতে ঠায় পেলো! উদ্বিগ্নচিত্তে পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটিকে অনল ঝাপটে ধরে মৃদ্যু আর্তনাদ করে বলল,,
“ঐথি আমাকে হারিয়ে দিল নিয়াজ! খুব বাজে ভাবে হারিয়ে দিলো! বুঝতে পারি নি দু’বছর আগের প্রতিশোধ ঐথি এত চরমভাবে নিবে! আমার ভালোবাসাকে ও অতি তীক্ষ্ণভাবে অস্বীকার করবে।”
নিয়াজ অতি উত্তেজিত গলায় ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আহিরকে বলল,,
“শালা! তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিস কি? গাড়িটা ছাড় জলদি। পুলিশ যদি কোনো মতে আমাদের ট্রেস করতে পারে, তবে অনলের ঘোরতোড় বিপদ ঘটে যাবে।”
আহির সম্মতি জানিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়িটি ছেড়ে দিল। গলায় বিদ্যমান কাঠিন্য ভাব দূর করে নিয়াজ শান্ত গলায় অনলকে শুধিয়ে বলল,,
“কেন পড়ে আছিস এখনো ঐ ঐথির পিছনে? ছেড়ে দে না তাকে। তার জন্যই তো আজ তোর এই অবস্থা। মিথ্যে র্যাপ কেইসে তোকে ফাঁসতে হলো! তোর ক্যারিয়ার, ক্যারেক্টার সব নষ্ট করে দিল! বিগত দু’টি বছর ও ঐ মেয়েটি নষ্ট করে দিলো!”
কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যেই অনলের অশ্রুসিক্ত আঁঁখি যুগলে রাগ অতি ক্রুব্ধ ভাবে ফুটে উঠল। এক ঝটকায় নিয়াজকে ছেড়ে অনল ঘাঁড়ের রগ টান টান করে আহিরকে শাসিয়ে বলল,,
“গাড়ি থামা আহির৷ গাড়ি থামা বলছি। কোথাও যাব না আমি তোদের সাথে! আজ থেকে তোরা ও আমার চির শত্রু!”
সিটের লোহার অংশে কোনো ভাবে আঘাত লেগে অনলের কপালের বাঁ পাশ থেকে টপটপ করে রক্ত ঝড়ছিল! সঙ্গে সঙ্গেই আহির, নিয়াজ এবং রুহাজ ভড়কে উঠে অনলকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনজনই অতি ক্ষুব্ধ হয়ে বিস্ফোরক দৃষ্টি অনলের দিকে নিক্ষেপ করতেই অনল উন্মাদের মত সামনের সিটে লাথ, ঘুঁষি, আঁচড় বসিয়ে চিৎকার করে বলল,,
“ভালোবাসি আমি ঐথিকে! পাগলের মত ভালোবাসি! ঐথি যতই নিকৃষ্ট হোক, যতই আমার চরিত্রে দাগ লাগাক, আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিক। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ও আমি ঐথিকে ভালোবাসি। পৃথিবী উল্টে গেলে ও ঐথির প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমান উল্টাবে না!”
#চলবে….?