#একাল_সেকাল
#মনিয়া_মুজিব
|১|
আমার সাত বছর বয়সী ছোট মেয়ে সাফা আজ তার বাবার কাছে আবদার করেছে তাকে যেন বাবা একটা ফোন কিনে দেয়। তাও আবার যে সে ফোন নয়, রীতিমতো আইফোন। ছোট্ট ফুলের মতো মেয়েটা আজ আমার মোবাইলে একটা আইফোনের ছবি দেখে বেশ পছন্দ করেছে। সাথে সাথে বাবার কাছে আবদার করে ফেলেছে। আর তাতে সায়ও জানিয়েছে আমার স্বামী সাইফ শহীদ। মেয়ের কোনো কিছুতেই কখনো না বলতে শুনিনি তাকে। বাচ্চা মেয়ে, বাবার একমাত্র সন্তান, তাই হয়তো না বলতে কষ্ট হয়। সে যাই হোক, আমি কিন্তু সন্তানের হাতে কখনো মোবাইল তুলে দিতে চাই নি। কিন্তু ঐ যে, একহাতে সন্তানকে মানুষ করতে পারলাম না! দাদা, দাদী, ফুপি সবার ভীষণ আদরের বাচ্চা আমার মেয়েটা। আমার স্বামীর একটা মাত্র বোন। বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে। আমার মেয়ের বয়স যখন সবে তিন পেরিয়ে চার এ পড়ল তখনই তার কোমল হাত খানায় শক্ত মোবাইল তুলে দেওয়া হলো। আর সেটাও খুব যত্নের সাথেই করল আমার এই ননদ। বাড়ির একমাত্র বউ হিসেবে স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, মেয়ে সবার খেয়াল আমাকেই রাখতে হয়। কয়েকজন গৃহকর্মী থাকলেও সবার জন্য রান্নাটা আমি নিজের হাতেই করি। আমার হাতের রান্না ছাড়া তাদেরও খাওয়া হয় না ঠিকমতো। রান্নার সময়টাতেই আমার মেয়ে তার ফুপির কাছেই থাকত। মাঝে মাঝে কান্নাও করত অল্পস্বল্প। সেই কান্না থামাতেই আমার ননদ মোবাইল হাতে তুলে দেওয়ার অভিনব পন্থাটা অনুসরণ করল। এখন সেই মেয়ের খেতে, পড়তে সব জায়গায় আগে তার মোবাইল ফোন চাই। এর জন্য মাঝে মাঝে আমি তাকে বড্ড বেশি শাসনও করে ফেলি। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। মেয়ে আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে তার বাবা কে। সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই আমি ওর বাবাকে প্রায়ই বলি,
“সেই কখন থেকে ফোনটা ওর হাতে। চোখের তো বারোটা বেজে যাবে। একটু মানা তো করতে পার নাকি?”
কিন্তু মেয়েভক্ত বাবা মেয়ের আদুরে কথায় গলে যায়। কিছু বলতে চাইলেও আর বলা হয়ে উঠে না। পিতৃস্নেহের কাছে বউয়ের শাসন হার মানে। তখন আমি কিছু বলতে গেলেই তার গাঢ়স্বরে বলা একটা কথাই শুনি,
“আহ্, তুমি তো একটু আধটু শাসন কর ই। আমিও যদি আবার বকাবকি করি তাহলে মেয়েটা যাবে কোথায় বলো তো!”
ইশ, এমন করে বললে কার মুখ না বন্ধ হয়ে পারে। আমি কমবেশি সবই বুঝতে পারি। কিন্তু আমার যে ভীষণ ভয় হয়। মাঝে মাঝে মেয়েকে বুকে নিয়ে খুব করে এটা ওটা বোঝাই। মেয়েও খুব বোঝে। কিন্তু একটু বাদেই আবার যেই লাউ সেই কদু হয়ে যায়। আমিও তাই হতাশার নিঃশ্বাস ফেলি আর ফিরে যাই আমার ছেলেবেলায়।
–
আমি প্রীতি; প্রীতি প্রধান। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার বাবা আগে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। যখন আমার বয়স এক কি দুই বছর, তখনই বাবা ব্যবসা ছেড়ে একটা গার্মেন্টসে চাকরি নিলেন। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো বাবাকে। আমি তখন বাবাকে পেতাম শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলিতে। কারণ সকালে আমার ঘুম ভাঙত বাবা কাজের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পর, আবার রাতে ঘুমিয়ে পড়তাম বাবা কাজ থেকে ঘরে ফেরার আগেই। কিন্তু বাবার ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না জীবনে। যখন আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ায় বয়স হলো, বাবা তখন সংসারের টানাটানির দিকে খেয়াল না দিয়ে আমাকে একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমাদের গ্রামের আশেপাশের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে পড়াশোনা তেমন একটা হতো না। কেন হতো না জানা নেই। তবে যারা তাদের বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে একটু বেশি সচেতন ছিলেন তাদের জন্য সদ্য চালু হওয়া কিন্ডারগার্টেনগুলোই ছিল একমাত্র ভরসা। যখন আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম সেসময়কার একটা ঘটনা ভীষণ মনে পড়ে আমার। আমাদের বাড়িতে ছিল মাটির ঘর। মেঝে, দেয়াল সবকিছুই ছিল মাটি দিয়ে তৈরি। মাসখানেক পর পর কাঁদা মাটি দিয়ে ঘরের মেঝে লেপন করতে হতো। এমনি এক দিনে স্কুলে যাওয়ার সময় মায়ের কাছে খুব বেশি না মাত্র এক টাকা চেয়েছিলাম। মা কাঁদামাখা হাতটি দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জবাব দিইয়েছিলেন,
“আমার কাছে তো টাকা নেই রে মা। আমি কি রোজগার করি না কি। তোর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিতি!”
আমি কিছু না বলে চলে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গিয়েছিলাম। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন শুধুমাত্র একটা টাকার জন্য। ছোটবেলায় যখন কোন ছেলেমেয়েকে বল নিয়ে খেলতে দেখতাম তখনই একটা বলের জন্য মায়ের কাছে আবদার করে বসতাম। কিন্তু এসব বিলাসিতা যে আমাদের মোটেও শোভা পেত না সেটা বুঝতাম না। একনাগাড়ে বায়না করেই যেতাম। তাই মা আমাকে মানাতে না পেরে বলের পরিবর্তে বাধ্য হয়ে ঘরে থাকা আলু অথবা টমেটো বের করে দিতেন খেলার জন্য। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে, ঘরে থাকা শেষ আলুটাও আমি খেলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি। যেটা কিনা ভাতের সাথে খাওয়ার জন্যে রাতের একমাত্র তরকারি হতে পারত। আহ্ জীবন! তারপর তো জীবন চলে গেল জীবনের নিজস্ব গতিতে। আমার বিয়ে হয়ে গেল উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সাইফ শহীদের সাথে। আর বিয়ের বছরদুয়েক বাদেই আমার কোল আলো করে জন্ম নিল আমাদের সকলের আদরের রাজকন্যা সাফা শহীদ। এভাবেই দিনগুলো কাটতে লাগল আমার। অনেক তো হলো অতীতে ঘোরাঘুরি এবার না হয় বর্তমানে ফেরা যাক।
_
সন্তানের ভালো মন্দ আমার কাছে সবার আগে। তাই আজ যখন আমার স্বামী মেয়েকে ফোন কিনে দিতে রাজি হয়েছে তখন থেকেই মাথায় হাজারটা চিন্তা ঢুকে গেছে। আমাকে চিন্তিত দেখে মেয়ের বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
“এই ছোট মাথায় এতো এতো চিন্তা নিয়ে কিভাবে বাঁচবে তুমি প্রীতি? এতো চিন্তা কেন কর? আমি আছি তো নাকি!”
স্বামীর আহ্লাদ পেয়ে আমি এবার অভিমানী হয়ে গেলাম। গাঢ় স্বরে বলে বসলাম,
“তুমি মেয়েকে মোটেও ফোন কিনে দেবে না। আমি ভালোয় ভালোয় মানা করে দিচ্ছি। আর প্রতিদিন মেয়েকে পাঁচশ করে টাকা দিতে হবে কেন তোমার? মেয়ে তো সবে ক্লাস টু’তে পড়ছে। এতো টাকা দিয়ে ও কি করবে? তুমি তো টাকা দিয়েই পগারপাড়। খোঁজ নাও সেই টাকা দিয়ে ও কি করে? সারাদিন এটা ওটা খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখবে, আর ভাত খাওয়াতে গেলেই বলবে পেট ভর্তি। আমাকে কি পেয়েছ কি তোমরা? পাশের বাসার নাবিলা আজ কি করেছে শুনেছ সেসব? ওর মা ওকে পার্টি ড্রেস কিনে দেয়নি বলে মায়ের সাথে তুই-তুকারি করেছে। বিশ্রী বিশ্রী কয়েকটা গালিও দিয়েছে। সাত বছরের বাচ্চার একি হাল! এবার আমার পালা। আমার মেয়েও আমার সাথে এমন বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটাক সেই ষড়যন্ত্র ই করছ তোমরা বাবা মেয়ে মিলে!”
~চলবে~