একটু_একটু_ভালোবাসি
পর্বঃ১৭ শেষ
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
— আচ্ছা আজ যদি আপনার কাছে কোনো অন্যায় আবদার করে বসি, আপনি রাজি হবেন?
সিরাতের বোকাসোকা কণ্ঠ শুনে ফোনের ওপাশে থাকা সাবির হালকা হাসলো। আজকাল প্রায় সময় সিরাত এটা-সেটা আবদার করে বসে। সেদিন বললো, ছেলেদের মতো সিগারেট টেস্ট করবে। সাবির মানা করেনি। একটা জলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া টানাতেই সিরাত কাশতে কাশতে শেষ। এরপরের আবদার ছিল, খোলা আকাশের নিচে ঘুড়ি উড়াবে। আরও কত অবুঝ আবদার! সাবির কখনো মানা করেনি। শুধু ভাবে, মেয়েটা নিজের ভেতর আরও কত ইচ্ছে চেপে রেখেছে কে জানে! যতটা চুপচাপ ভেবেছিলাম আসলে তেমন না। উফফ! আমি পাগল হয়ে যাবো…..
সিরাত অবাক হয়ে বলে, আমি এতো কিছু চাই আপনার কাছে, যেখানে বারণ করা দরকার সেখানেও আপনি তাল দেন। কিন্তু কেন? আমাকে বকেন না কেনো আপনি?
—- যা ইচ্ছে করো রাত! যখন মানা করার দরকার হবে আমি ডাকবো। জীবনে সবকিছুর স্বাদ নিতে হয়।
সিরাত খুশি হয় খুব সাবিরের কথা শুনে। ভালো লাগে লোকটাকে তার। ভীষণ ভালো লাগে। যা মনে আসে বলে দেয়া যায়, যা করতে ইচ্ছে করে প্রকাশ করে দিতে পারে, কোনো সংকোচ নেই কিচ্ছু নেই, আছে শুধু একরাশ ভালোলাগা আর বিশ্বাস। ঝটপট দেরি না করে তাই সে, আজকের আর্জিটা শোনালো,
—– আমি আপনারা সাথে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে চাই। আমার আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে। পুরো আকাশটাই স্বচ্ছ। আমি আপনার সাথে হাঁটব। মৃদু বাতাস বইবে। সোডিয়াম লাইটের আলোতে পুরো রাস্তা ঝলমল করবে। রাস্তায় কিছু পথশিশু আছে। ওরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে জেগে আছে,ভাত রান্না করছে। আমি ওদের সাথে দেখা করবো। আমার এই ইচ্ছেটা কি পূরণ হবে?
সাবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বুকটায় হঠাৎ ধক করে উঠলো। এখন দেখা করতে হবে? ক’টা বাজে? রাত এগারোটা। ইশশ! সিরাতের মতো যদি সেও হুটহাট এমন পাগলামি করতে পারতো? তার তো ইচ্ছে হচ্ছে, এক্ষুনি সিরাত নামের মেয়েটাকে তুলে এনে সামনের চেয়ারে বসিয়ে রেখে ঘন্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে সাবির বললো,
—- ঠিক আছে। আমি আসছি। তুমি সবকিছু মেনেজ করে নিচে এসো।
সিরাত কল কেটে আনন্দে লাফাতে লাগলো। এতো খুশি লাগছে কেন! তানিশা আন্টিকে বলে সিরাত রেডি হয়ে সোফায় বসে পা ঝুলিয়ে নাচাতে লাগলো। তানিশা এইসকল বিষয়ে সিরাতকে খুব সাপোর্ট করে। বিয়ের আগে হবু বরের সাথে লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করার মাঝেও একটা আলাদা আনন্দ থাকে।
সেদিন সিরাত পরিবারের সবার আড়ালে সাবিরের সাথে দেখা করতে চলে যায়। সাবির নিচে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আগেই। সিরাতকে দেখেই একটা হাসি উপহার দিলো। সিরাত মুগ্ধ হয়। ছেলেদের হাসিও এত সুন্দর হয়! কই আগে তো নজরে আসেনি। নাকি এখনই সুন্দর লাগছে! কে জানে! সিরাতে বাইকের হেলমেট পড়িয়ে সাবির ছুটে চলে অজানায়। একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি রেখে, দুজনে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। চাঁদের আলোয় চারদিকে আলোকিত। সাথে আরো আছে ল্যাম্প পোস্টের একগুচ্ছ কৃত্রিম আলো। সিরাত তো এমন একটা পরিবেশই চেয়েছিলো। আহা! কি নির্মল বাতাস, কি সুন্দর এই রাতের শহুরে রুপ। পথিমধ্যে একঝাঁক পথশিশুদের সাথে তাদের দেখা হয়। সিরাত একনজরে তাকিয়ে থাকে। এতো না পাওয়া, অভাবের মাঝে থেকেও তাদের মুখে একটুকরো হাসি লেগে আছে। সাবির তাদের কিছু টাকা দিয়ে সিরাতকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।
হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্রিজেরর উপর এসে থাকলো দুজনে। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে স্বশব্দে চলে যাচ্ছে। নিচে নদীর পানির ঝিলিমিলি অথৈ জল চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। নদীর এককোনায় কয়েকটা নৌকা সারিবদ্ধভাবে ভিড়িয়ে রাখা। উজান থেকে ধেয়ে আসা বাতাস, এই আঁধারিয়া রাত, দুজন কপোত-কপোতী আর তাদের সুখময় মুহূর্ত। সিরাত একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে আছে। আচমকা বলে উঠলো,
—- আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাকে এতো সুন্দর কিছু উপহার দেওয়ার জন্য।
সাবিরের চোখ সিরাতের উপর স্থির। মেয়েটার মুগ্ধ দৃষ্টি তাকে নাজেহাল করে দিয়েছে। তার বুখ বুুক ধুকপুক ধুকপুক করছে ক্রমাগত। মাথাটা ভনভন করছে। দ্রুত চোখের ফেলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। সামনে চোখ রেখে বললো,
—- রাত! আজ আমার আর তোমার অপরিচিত জীবনের শেষ একাকী মুহূর্ত। কাল আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু। তারপর থেকে আমাদের সম্পর্কের একটা নাম থাকবে। সবাই কত খুশি তাইনা? আজ মা কি করেছে জানো? আবার তোমার শাড়ি, গয়না কিনে এনেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ গিফট দেবে। আমি তোমাকে বলে দিলাম, মাকে বলোনা আবার।
সাবিরের এমন কথা সিরাত আশা করে নি। সাবির তো ভুল কিছু বলেনি। আসলেই তো আজকের রাতটা তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। এরপর থেকে সে হবে কারো স্ত্রী, কারো অর্ধাঙ্গীনি, আরও অনেকগুলো সম্পর্কের সাথে জড়িয়ে যাবে সে। সত্যি জীবনটা কি অদ্ভুদ! হুট করে কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল। কিছুদিন আগেও তার জীবনটা এতো সুন্দর ছিল না। কিন্তু এই পাগল লোকটার কারণে আজ তার মুখ থেকে হাসি সরেই না।
সাবির সিরাতের হাতের আঙুল ধরে আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে দাড়ালো। সিরাত পাশ ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। কেননা, সাবিরের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। হয়তো ভেবেছে অন্ধকারে দেখা যাবে না। কিন্তু চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্টতর। সিরাত বিচলিত কণ্ঠে বললো,
—- কি হলো হঠাৎ আপনার? আপনার চোখে পানি কেনো?
সাবির চোরা চোখে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। সিরাত উদ্বেগ নিয়ে সাবিরের পাশে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,
—- কি হয়েছে বলুন না! আপনি কাঁদছেন কেন?
—- সিরাত আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো। আমি সত্যিই তোমাকে পেতে যাচ্ছি। তুমি সত্যি আমার হবে, আমার ঘরে বউ হয়ে আসবে, লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে আমার সামনে ঘুরে বেড়াবে; এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না রাত! আমি সত্যি তোমাকে অর্জন করতে চলেছি….
সিরাত তাজ্জব বনে গেলো। এ আবার কেমন কথা! একটা ছেলে কান্না করছে তাও এই সামান্য একটা কারণে! সে কি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ? সিরাতের হঠাৎ খুব কান্না পেলো কিন্তু কাঁদলো না। করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। সাবির বলতে লাগলো,
—– জানো? তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। হয়তো তুমি তোমার কলেজ থেকে পিকনিকে এসেছিলে। সেদিন আমার ওখানে ডিউডি ছিলো একজন মিনিস্টারকে নিরাপত্তার বিষয়ে। আমি সারাদিন তোমার উপর লক্ষ্য রাখছিলাম। কেন জানো? কারণ তোমার উপর সন্দেহ হচ্ছিল। চোরা চাহনীতে এদিকওদিক তাকানো, চুপচাপ-গম্ভীর, নিজের মতো থাকতে গিয়ে দলছুট হয়ে গিয়েছিলে। তারপর আবিষ্কার করলাম, তুমি মেয়েটা আসলে এমনই, যেনতেন কারণে ভয় পাও আর কান্না করে দুনিয়া ভাসানোটায় তোমার স্বভাব। সেদিন হুট করে তোমাকে হারিয়ে ফেলি। আমিও খুঁজতে পারিনি কারণ এরপরেই বিদেশে একটা ট্রেনিংয়ে চলে যেতে হয়েছিলো। শুধু তোমার কলেজ ইউনিফর্মে ব্যাজে থাকা কলেজের নামটা মনে ছিল। আমি পাগলের মতো তোমাকে খুঁজতে লাগলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, তোমার মতো কেউ নেই, তোমার মতো কেউ না। তোমাকে আমার চাই…. তারপর একদিন তোমাকে খুঁজে পেলাম সেই রেস্টুরেন্টে। সেই থেকে তোমাকে আর ছাড়ি নি। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কতোটা খুশি হয়েছিলাম। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সবকিছু একটা স্বপ্নের মতো। রাত! তুমি ভাবতেও পারবে না, আমি কতটা চাই তোমাকে। তোমার আগমন আমাকে কতটা বদলে দিয়েছে।
সিরাতের চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। নিষ্পলক তাকিয়ে সাবিরকে অবলোকন করার চেষ্টা করছে। হুট করে সাবিরকে জড়িয়ে ধরলো সে। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ায় সাবিরকে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। সিরাত ফুপাতে ফুপাতে বললো,
—- আপনি সত্যি ভালোবাসেন আমাকে?
—- ভালোবাসার চেয়েও বেশি রাত….
সিরাত এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুখের ভাষা হারিয়ে চুপ করে রইলো। ভাবতে লাগলো, এতোটাও ভালোবাসার যোগ্য হয়তো সে না। সাবির মুখ থামে নি,
—- তুমি আমাকে ভালোবাসছো তো রাত?
সিরাত কিছু একটা ভাবতেই লজ্জা পেলো খুব। লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইলো। লজ্জামাখা হাসি দিয়ে সাবিরের দিকে তাকালো। সাবির উত্তরের আশায় তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
—- কি হলো বলো?
—- একটু একটু ভালোবাসি….
—- দুইটু দুইটু কবে ভালোবাসবে রাত?
সিরাতের লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো। পরক্ষণেই নিজের উত্তর শোনে নিজেই হাসলো সে। লোকটাকে সে আসলেই ভালোবেসে ফেলেছে। সাবির এমন একজন মানুষ, যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তার সাথে সারাজীবন থাকতে পারাটা ভাগ্যের বিষয়। সাবিরের বিশেষ কেউ হতে পারাটাও সৌভাগ্য। এইতো আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। তারপর দুজনে একসাথে সাথে গাঁথা পড়বে বিয়ে নামক বন্ধনে। শুরু হবে একসাথে পথচলা। সূচনা হবে এক নতুন অধ্যায়ের। সাবিরকে আরেকটু খুশি করতে সিরাত বললো,
—- আচ্ছা যান, আমি আপনি তিনটু তিনটু ভালোবাসি। এবার খুশি?
সাবিরের প্রশান্তিময় হাসিটা সিরাতের কানে ঝংকার তোলার মতো বাজতে লাগলো। সামনের দিনগুলি ভীষণ সুখকর হতে চলেছে।
সমাপ্ত