একটু_একটু_ভালোবাসি
পর্বঃ১৩,১৪
লেখিকাঃশাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পর্বঃ১৩
সময় বহমান। সিরাত আর সাবিরের বিয়ের দিন দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলো সবে। তাদের বিয়ে তেমন একটা জাঁকজমকপূর্ণভাবে হবে না। ইসলামিক শরীয়তে যেমন কম খরচে সাদামাটা বিয়ের কথা বলা আছে ঠিক সেভাবেই হবে। সাবিরের বাবা দেশে নেই। বিয়েতে থাকতে পারবেন না। তিনি দেশে ফিরলেই রিসেপশন করা হবে বড়সড় করে।
সিরাত এখন প্রায়সময় মনমরা হয়ে বসে থাকে। ঠিকমতো খায় না। কলেজেও যায় না। সাবিরের সাথে ইচ্ছে করেই কথা বলে না। ভয়ে দিনদিন কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাবিরকে সে ভয় পায়। খুবই ভয় পায়। তাদের যে বিয়ে হবে, একই বাড়িতে-একই ছাদের তলায় থাকবে সে এটা মেনে নিতে পারছে না। সাবির কল করলে কেটে দেয়। সাবিরের সাথে কথা বলার জন্য বোধহয়, বাবা তার বাটন ফোনটা নিয়ে একটা বেশ দামী মোবাইল কিনে দিয়েছে। একদিন হলো কি, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমোনোর সময় সাবিরের কল এলো। সিরাত প্রতিদিনের ন্যায় কল কেটে ঘুমোতে ব্যস্ত। এদিকে লাগাতার কল আসতে শুরু করলো। একটার পর একটা। সিরাত অবাক হলো ভীষণ। ফোনটা সাইলেন্ট করে পাশের বালিশের উপর রেখে, চোখ পিটপিট করে ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে রইলো। ফোনটা নিঃশব্দে বেজেই চলেছে। একবার কল কেটে যাওয়ার আবার এলো, আবার, আবার…. মোবাইলের স্ক্রিনে স্পষ্ট লিখা আসছে বারবার, সাবির ইজ কলিং ইউ। সিরাত মনে মনে বললো, আপনার একটুও বিরক্ত লাগছে না এভাবে কল করতে? আসলেই আপনি পাগল। একসময় সিরাত ঘুমিয়ে গেলো। রাতটা ওইভাবেই কাটিয়ে দিলো। সকালে ঘুম ভাঙতেই সিরাতের নজর গেলো, পাশের বালিশের উপর রাখা ফোনটার দিকে। ভালো করে তাকাতেই আৎতে উঠলো সে। এখনো সাবির কল করে চলেছে। কল কেটে গেলেই সিরাত ফোন চেক করলো, একহাজার সাতশো ছাপ্পান্নটা মিসডকল। বেকুব বনে হা করে তাকিয়ে রইল সিরাত। আবার ভয়ও হলো কোনো বিপদে পড়েনি তো আবার? ব্যতিব্যস্ত সে কল রিসিভ করলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
—- আপনি কি পাগল?
ওপাশ থেকে সাবিরের ক্লান্তমাখা কণ্ঠ কানে এলো তার,
—- কেনো এতো কষ্ট দাও আমাকে? হুয়াই রাত? লাভ ইউ। প্লিজ একবার দেখা করো….
সিরাত কলটা কেটে দিয়ে থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো। এরপর আর কোনো কল এলো না। ভাবতেও অবাক লাগে, সারারাত একনাগাড়ে কল করে চলেছে ছেলেটা। কি ভীষণ জেদি!
গ্রাম থেকে আত্মীয়রা আসতে শুরু করেছে। সারাদিন গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে ডুবে আছে সবাই। অথচ যাদের ঘিরে এতো আয়োজন, তাদের ভেতরে কিছুই ঠিক নেই। মা ইদানীং সিরাতের ভীষণ যত্ন করছে। শাড়ি পড়া শিখাচ্ছেন, যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন, রান্না করাচ্ছেন, কাঁচা হলুদ মাখিয়ে সিরাতকে নিজের সামনে বসিয়ে রাখেন, রোদে তো বেরই হতে দেননা। সিরাতের গায়ের রং খুলে যাচ্ছে দিনদিন। যদিও আগে থেকেই সে সুন্দর, তবুও এখন যেন অন্যরকম লাগে। মামীমা বলেছে, বিয়ের ফুল ফুটলে মেয়েদের অন্যরকম সুন্দর লাগে। সিরাত লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যায়।
রাতে খাওয়ার সময় সিরাতের মা বললেন, আগামীকাল সাবির আর সাবিরের মা আসবে। এখান থেকে সিরাতকে নিয়ে শপিংমলে গিয়ে, সিরাতের পছন্দসই গয়না আর কিছু জামা-কাপড় কিনবে। সিরাতের গলায় খাবার আটকে গিয়ে খুকখুক করে কাশতে লাগলো। তারমানে সাবিরের সাথে কাল দেখা হবে! তানিশা তাকে বুঝালো,
—- দেখ সিরাত! যথেষ্ট হয়েছে। কোনো ছেলেই এসব মেনে নেবে না। সাবির তোকে আগে থেকে ভালোবাসলেও এটা একটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দুজন দুজনকে সময় দিতে হবে, চিনতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে। ছেলেটা আসলেই তোকে ভালোবাসে নাহলে তোর এই ব্যবহার মানতো না। ভেবে দেখেছিস, তোর এতো অবহেলার পরও সাবির কোনো প্রতিবাদ করেনি। তার মা বা এই বাড়ির কাউকেই কিছু জানায়নি। তোর ভাগ্য ভালো বলে এতোকিছু করতে পারছিস।
তানিশা আরও অনেককিছুই বোঝালো কিন্তু কাজ হলো না। সিরাত থম মেরে বসে রইলো। আসলে, সে নিজেও বুঝতে পারছে না, তার এমন কেন হচ্ছে? সাবিরকে সে মেনে নিতে পারছে৷ এই বিয়ের ব্যাপারটাই সে মেনে নিতে পারছে না। সাবিরের প্রতি কোনো আক্ষেপ, ঘৃণা, অবহেলা বা অতীতের কোনো খারাপ স্মৃতি, কিছুই নেই। নিজেকে কেনো যেন এসবের প্রতি অপ্রস্তুত লাগে। তার আরো সময় প্রয়োজন।
চলবে
#একটু_একটু_ভালোবাসি
#পর্বঃ১৪
লেখিকাঃ #শাদিয়া_চৌধুরী_নোন
পরদিন যথাসময়ে সাবিরের মা সিরাতকে নিতে এলেন। সিরাত আগেই তৈরি হয়ে বসে ছিল। সাবিরের মা এসেছে শোনে ভাবতে লাগলো, সাবির কি আসে নি? ড্রয়িংরুমে শুধু সাবিরের মাকে দেখা গেলো। সিরাতও আগ বাড়িয়ে সাবিরের কথা জিজ্ঞেস করলো না। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে সিরাত নিচে নেমে এলো। যাওয়ার আগে তানিশা ফিসফিস করলো, সাবিরের সাথে সব ঠিক করে নিতে। আর কয়দিন বাদে বিয়ে। এমন দূরত্ব আর মানা যায় না।
নিচে নেমে সিরাত ঝটকা খেলো। সাবির এসেছে! উপরে গেলে কি হতো? মনে মনে অবাক হলেও মুখে প্রকাশ করলো না সিরাত। গাড়ির সামনে আসতেই সাবির তাদের জন্য ডোর খুলে দিলো। সাবিরের মা আইভি গাড়িতে বসলেন। সিরাত গাড়িতে উঠে বসতেই, সাবির ডোর লক করে দিলো। সিরাতের চোখ আপনাআপনি সেদিকে চলে গেলো। সাবির কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাজারো অভিমান নিয়ে একনজরে তাকিয়ে আছে সিরাতের দিকে। সিরাত দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মাথা নিচু করে, হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। সাবির সামনে গিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। গাড়িতেও সিরাত চুপচাপ বসে রইলো। সাবিরও মৌনতা পালন করে চলেছে। গুমোট পরিস্থিতি বিরাজমান। সিরাত আনমনে সামনে সাবিরের দিকে তাকালো। লোকটার আচরণ আজ বেশ অদ্ভুত লাগছে। অন্য সময় হলে আগ বাড়িয়ে কথা বলতো, সবসময় হাসি লেগে থাকতো মুখে কিন্তু আজ একবারও কথা বলেননি। সাবিরের চোখ-মুখ অনেক শুকনো লাগছে, ভালো করে তাকালে বুঝা যাবে চোখ দুটোও লাল হয়ে আছে। রাতে ঘুমান না না-কি? কেনো জেনো সিরাতের খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো। সাবির এমন কেনো করছে? একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, “রাত! কেমন আছো? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
এসময় সাবিরের মা তাদের দুজনকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,
—- “তোমাদের মধ্যে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? মা তুই বল, আমার ছেলের কি অবস্থা কেন? ”
সিরাত শুকনো কাশলো। কিছু বললো না। সামনে থেকে সাবির বললো,
— আম্মু কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।
সিরাত অপমানবোধ করলেও কি বলবে খুঁজে পেলো না৷ এর মাঝেই তারা শপিংমলে চলে এলো। তাদের কথাও আর এগুলো না। সাবির কাকে যেনো কল করতে করতে তার মা আর সিরাতকে নিয়ে মলের ভেতরে চলে গেলো। নিচ তলায় অনেক মানুষের ভীড়। সিরাতের পেছনে সাবির নানা মানুষের হাত বাঁচিয়ে সামনে হাঁটছে। সাবিরের চওড়া বুকের সাথে সিরাতের মাথার সংঘর্ষ হচ্ছে বারবার। সিরাত অস্বস্তিতে মাটিতে মিশে যেতে চাইলেও সাবির নির্বিকার। উপরের তলায় আসতেই ভীড় কমলো। নানা দোকান ঘুরেঘুরে জিনিস কিনছে সাবিরের মা৷ একটা লোক এসে যোগ দিলো তাদের সাথে। লোকটাকে সিরাত চেনে না। সে ফরমাল ড্রেসে শপিংয়ের প্যাকেটগুলো নিয়ে তাদের সাথে হাঁটছে। গয়নার দোকানে ঢুকতেই, সাবির মা বললেন সিরাতের নিজের পছন্দমতো ডিজাইন চুজ করতে। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সিরাত বললো, যা ইচ্ছে কিনতে। তার পছন্দ ভালো না। এসময় সাবির তার পাশে এসে দাঁড়ালো,
—- তুমি কি আমার জন্য আনইজি ফিল করছো? চলে যাবো?
সিরাত অসহায় চোখে তাকালো। সাবিরের আজকের ব্যবহারের সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত সে। সাবির আবার বললো,
—- শুনেছি কেনাকাটার ব্যাপারে মেয়েরা খুব সচেতন। একটা জিনিস কেনার জন্য দশ দোকান ঘুরবে। তুমি তো এমন কিছুই করলে না। অন্তত গয়না কি কি পছন্দ তা তো বলো!
সিরাত হুট করে বললো,
—- আপনারা অনেক বড়লোক তাইনা?
সিরাতের কথা শুনে সাবির জোরে জোরে হাসতে লাগলো। এই মেয়েটা এমন কেন? রাগ করেও থাকা যায় না। হাসি থামিয়ে বললো,
—- না তো৷ সাবির খুব গরিব মানুষ কিন্তু সিরাতের বরের অনেক টাকা।
সিরাত আগামাথা কিছুই বুঝলো না। অবশেষে সাবির আর সাবিরের মা দুজন মিলে সিরাতের গয়না পছন্দ করলো। সিরাত শুধু তাদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ, আর না তে না মিলিয়েছে।
সমস্ত কেনাকাটা শেষে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া সারলো তারা। সাবির ঐ লোকটার সাথে প্যাকেটগুলো গাড়িতে রাখার জন্য নিচে গেলো। এখন টেবিলে আছে শুধু সাবিরের মা আর সিরাত। সিরাত সেই কখন থেকে টেবিলের নখ খুঁটছে। কোথাও মনোযোগ নেই তার। সাবিরের মা তা অনেকক্ষণ আগে থেকেই খেয়াল করে আসছেন৷ তিনি তীক্ষ্ণ চোখে বললেন,
—- তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো?
সিরাত বিষম খেয়ে অপ্রস্তুত হাসলো।
— শোনে মেয়ে কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনো। একটা ছেলে তোমার কথা ভেবে দিন-রাত পার করে। যার ঘরের দেয়ালে দেয়ালে শুধু তোমার ছবি। তোমার একটু কষ্ট যার সহ্য হয় না আর একটু হাসিতে যার মুখে হাসি ফুটে, তোমাকে সন্তপর্ণে আগলে রাখায় যার সুখ সে অন্তত আর কিছু পারুক না পারুক তোমাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসতে জানে। সময় থাকতে মানুষটাকে হাতে করে নাও। এমন না হয় যে, পরে পস্তাতে হয়। পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসার জন্য এই জীবনটা খুব ছোট। কয়েকদিন ধরে আমার ছেলেটা ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে না, খাবার খায় না, আমার সাথে ভালোমতো কথাও বলে না। আমি মা, আমি বুঝি। আমার ছেলেটা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে মা। সাবির আমার ছেলে বলে বলছি না। যেদিন প্রথম তোমাদের বাড়ি এলাম তার আগে কি হয়েছে শুনবে? সাবির আমার পা জড়িয়ে বললো, ‘আম্মু আমি সিরাতকে চাই। প্লিজ ওকে এনে দাও।’ আমহ তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। সময় নাও তবে বেশি দেরি করো না। তাকে একবার সুযোগ দাও, নিজেকে প্রমাণ করতে। ”
সিরাত কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। সাবিরের মা আবার বললেন,
—- আমি কিছু একটার বাহানায় চলে যাচ্ছি। আমার ছেলে আসছে। তোরা কথা বল নিজেদের মাঝে। বোকা মেয়ে কাঁদতে হয় না। আচ্ছা আমি যাই হ্যাঁ?
চলবে