#একজন_রূপকথা
#পর্ব_১০,১১
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব_১০
শোভন বেশ কয়েকদিন ধরে কথার কাছে কবিতার বিষয়টা বলতে চাচ্ছে , পারছে না, কোথাও যেনো বাঁধছে। স্ত্রীর ছোট বোনের চরিত্র সম্পর্কিত কথা স্ত্রীকে বলা যায় না, তার উপর যদি হয় নিজেও জড়িত। কথার হয়তো তার উশখুশ করাটা নজরে পড়লো। রাতে ঘুমোবার সময় শোভনকে জেগে বসে থাকতে দেখে সে বলল,
“ঘুমাবেন না, জেগে বসে আছেন কেনো?”
শোভন আমতাআমতা করলো, তার ঘুম আসছে না। কথাকে বিষয়টা না জানানো অবদি শান্তি ও লাগছে না।
সে বলল,
“এইতো ঘুমাবো, এখনই।”
“আজ এত রাত অবদি জেগে আছেন? শরীর খারাপ করলো নাতো?”
কথা বিছানায় উঠে এসে শোভনের কপালে হাত রাখলো। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। তবে কী হলো।
সে বলল,
“কাল অফিস নেই?”
“আছে তো।”
“তবে ঘুমাচ্ছেন না কেনো? সকাল সকাল উঠতে হবে তো।”
শোভন আকস্মিক কথার একহাত চেপে ধরলো। তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা। কথা নিজেও চমকে গেছে।
“কী হয়েছে? এমন করছেন কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমাকে তুমি বিশ্বাস করো কথা?”
শোভনের আকুল কন্ঠস্বর শুনে কথা কিছুটা কেঁপে উঠলো। এমন ভাবে বলছে কেনো লোকটা? কি হলো তার? বিশ্বাসের কথা কেনো উঠবে? পরক্ষনেই নিজেকে সামলালো। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
“নিজের থেকেও বেশি, আপনি জানেন না?”
“আমি তোমার বা কবিতার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে মানতে পারবে?”
কথা এবার মন থেকেই হাসলো।
“কী আশ্চর্য! আমার যেকোনো বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ অধিকার আছে আপনার!”
“আর কবিতার?”
“বা রে কবিতা আমার বোন হলে আপনার বোন নয় বুঝি? আপনি কী আমাদের পর?”
শোভন তড়িৎ কথা ঘোরালো, বিষয়টা এগিয়ে নিতে তার বুক কাপছে, অসস্তি হচ্ছে।
“পর নয় বলছো? তাহলে আপনি আজ্ঞে করো কেনো?”
কথা লাজুক হাসলো।
“কতবার যে চেষ্টা করেছি তুমি করে বলার, আপনার অগোচরেই চেষ্টা করেছি, পারিনি। তাছাড়া সম্বোধনে কী যায় আসে? ভালবাসা মেশানো থাকলেই তো হলো।”
শোভন মৃদু হাসলো।
সেদিন বলতে না পারলেও পরদিন ঠিকই সে কথার সামনে মনের কথাটা প্রকাশ করলো। একেবারে হড়বড় করে বলল,
“কবিতার বিয়ে ঠিক করেছি কথা, ভাল ছেলে, আমারই অফিসের ম্যানেজার। আমার চেয়েও উচু পদ, ভালো বেতন। কবিতার ছবি দেখে খুব পছন্দও করলো। দাবিদাওয়া তার কিচ্ছু নেই, শুধু কনে সুন্দরী হলেই চলবে।”
কথা সামান্য অবাক হলেও শোভনের আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া করলো না। শোভন ভেবেছিলো কথা রাগারাগি করবে অথবা অভিমান। তাকে না জানিয়ে তার নিজের বোনের বিয়ে ঠিক করেছে, এতটুকু রাগ করার অধিকার তার অবশ্যই আছে। অথচ কথা মৃদু গলায় বলল,
“ভালো করেছেন, আমিও কবিতার জন্য ছেলে দেখার কথা বলতে চেয়েছিলাম। ”
শোভনের খুব বলতে ইচ্ছে হলো,
“কেনো কথা? কেনো ছেলে দেখতে বলতে চেয়েছিলে? কবিতার পড়াশোনা তো শেষ হয়নি, অনার্স ও কমপ্লিট হয়নি। তুমি না বলেছিলে ওর অনার্স শেষ হবার আগে বিয়ে দেবে না। তবে কেনো?”
মনের কথা মুখ ফুটে বের হলো না। পাছে অপ্রত্যাশিত কিছু শুনে ফেলে।
কথা বলল,
“বিয়ের পর পড়াশোনাটা করতে দেবে?”
“হু।”
“ওর সব শখ আহ্লাদ পূরণ করবে?
” হু।”
“সুখে রাখবে?”
“সে আর বলতে।”
কথা উদাস গলায় বলল,
“আমি নিজেকে এককালে চালাক ভাবতাম জানেন! অথচ আমি বড্ড বোকা, একটু বেশিই হয়তো। যে আমার ক্ষতি চায় আমি তবু কেনো তার ভালো চাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি না? বলতে পারেন?”
শোভন উত্তর দিতে পারলো না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরলো।
—
মেয়েটার নাম মালোতি। খুব বেশি বয়স না, কবিতার থেকে দু-এক বছরের বড় হতে পারে। তবে সাজপোশাক দেখলে বয়স আরও বেশি লাগে। মলিন রংচটা শাড়ির ওপর মোটা চাদর টাইপের ওড়না পরে সে কাজে আসে। সারাদিন রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ সামলায়, বিকেলে বাড়ি ফিরে যায়। শোভন তাকে কোথা থেকে এনেছে সেটা কথা জানে না, জানতেও চায়নি৷ উল্টো সে শোভনের উপর বেজায় ক্ষেপে আছে। লোকটা সত্যি সত্যি কাজের মেয়ে নিয়ে এলো? কেনো? কথা কাজ পারে না?
শোভন নির্দোষ ভঙ্গিতে বলল,
“আমার উপর রাগ না দেখিয়ে মাকে বলো, তার কথা শুনতেই তো মালোতিকে নিয়ে এলাম।”
কথা তার শাশুড়ীকে সোজাসুজি কিছু বলতে পারলো না। তিনি কখন ভালো মনে থাকেন আর কখন রেগে যান বোঝা যায় না। তবে এক ভরা দুপুরে চুলে তেল লাগিয়ে দেবার সময় মিনমিন করে বলল,
“মালোতিকে রাখার কী দরকার আছে মা? আমিই তো কাজ করতাম। তাছাড়া কী এমন কাজ আছে, অতটুকু করতে কোনো কষ্টও হতো না। শুধু শুধু আপনার ছেলের টাকা নষ্ট হচ্ছে। ”
রোজিনা বেগম কথার কথায় কান দিলেন না।নিজের মতো বললেন,
“কাজের মেয়েটা বড্ড বেয়াদব, এটাকে তাড়িয়ে অন্য মেয়ে খুজতে হবে।”
কথা উত্তর দিলো না। কেননা শাশুড়ীর সাথে সেও একমত। মালোতি নামের মেয়েটা কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলে না, নিজের মতো কাজ করে চলে যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ত্যাড়াবেকা উত্তর দেয়। এই তো সেদিন যখন রোজিনা বেগম তার নাম জিজ্ঞেস করলো তখন সে কড়া গলায় বলল,
“নাম না জেনে কাজে রাখছেন? এত ভালো মানুষ আপনারা? বাহ্!
রোজিনা বেগম দাতে দাত চিপলেন,
” বেয়াদব মেয়ে মানুষ।”
“জ্বি আমি বেয়াদব, আর কিছু বলবেন? তরকারি কাটতে অসুবিধা হচ্ছে। ”
কথা নিজেও আগবাড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলো না। তবে একটা বিষয় ঠিক লক্ষ্য করলো। মেয়েটা কথাগুলো স্পষ্ঠ শুদ্ধ ভাষায় বলে, ব্যক্তিত্ব টাও চোখে পড়ার মতো। এ বাড়ি থেকে সে এক দানা খাবারও কখনও মুখে তোলে না। কেউ খেতে বললেও না। তার এক কথা, এ বাড়িতে টাকার বিনিময়ে কাজ করতে এসেছি, বাড়তি সুবিধা কেনো নেবো? পরে খোটা শোনার জন্য?”
তাছাড়া তার কাজে খুশি হয়ে মাস শেষে যখন কিছু বাড়তি টাকা যোগ করে দেওয়া হলো। তখন সেটাও সে ফিরিয়ে দিলো। কথার সাথে সাথে রোজিনা বেগমও অবাক হলেন। মেয়েটা বেয়াদব হলেও আত্মসম্মান প্রবল।
এরমাঝে কবিতার বিয়ের ব্যাপারটা চাপা পরে গেলো। শোভন নিজেও এ ব্যাপারে আর কথা বলল না।
—-;
ছুটির দিনে বিকেল বেলাটা শোভন ছাদে কাটায়। অফিসে নিয়মিত বদ্ধ রুমে যান্ত্রিক জীবন কাটাতে কাটাতে সে হাপিয়ে ওঠে। একটু খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। আর্থিক কারনে দুরে কোথায় বেরিয়ে আসা সম্ভব না।
সেইজন্য ছাদের খোলা আকাশটায় তাকিয়ে নিজেকে হালকা করার প্রয়াস চালায়।
নিচে একবার কথাকে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসেছে। এখনও কথা আসেনি। মিনিট দশেক তো হলোই।
সে আবার ডাকতে পা বাড়ালো। কবিতা এসেছে, হাতে চায়ের কাপ। শোভন বলল,
“কথা কোথায়? তুমি কেনো চা নিয়ে এসেছো?”
কবিতা নিঃশব্দে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো। ঠোঁটের কোনে তার মৃদু হাসির রেখা। বলল,
“আজ আমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে?”
শোভন থমকালো, চমকালো, হতবাক হলো। কবিতা তাকে তুমি করে বলছে?
কবিতা এবার একটু কাছ ঘেঁষে দাড়ালো।
“বললে না? যাবে? তার আগে এই চা টা খেয়ে দেখো, আমি নিজে বানিয়েছি, নিজের হাতে। নাও!”
শোভন হাত এগোলো না। বরং গুটিয়ে নিলো। তার মাথা কাজ করছে না। একটা মেয়ে এতটা নির্লজ্জ, এতটা সার্থপর, লোভী কী করে হতে পারে? কষ্ট হয় না? আয়নার সামনে দাড়ালে চোখে চোখ রাখতে ইতস্তত লাগে না?
কবিতা চায়ের কাপ পাশে রেখে শোভনের দিকে খানিক ঝুকে পড়লো। ততক্ষণে ওড়না গড়িয়ে পড়েছে নিচে। কবিতার চোখে মুখে অর্থবহ হাসি।
তবে সেটা বিষাদে রুপ নিতে সময় লাগলো না।
শোভনের পুরুষালী হাতের চড়টা ততক্ষণে তার দুগাল লাল করে ফেলেছে।
পেছন থেকে ভেসে এলো ভগ্ন এক কন্ঠস্বর,
“কবিতা?”
চলবে…..
#একজন_রূপকথা
#পর্ব_১১
#নুশরাত_জেরিন
কবিতার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। সপ্তাহখানেক পরেই বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়েছে। রোজিনা বেগম এর মাঝে শোভনকে ডেকে বললেন,
“গয়নাগাটি কিছু দিতে হবে তো বাবা, বিয়ের খরচও আছে। এত টাকার জোগাড় করতে পারবি?”
শোভন একগাল হেসে বলল,
“চিন্তা করো না মা, অফিস থেকে লোন নিয়েছি। মেয়েটা এতদিন এ বাড়িতে ছিলো, নিজ বোনের মত ভালবেসেছিলাম একসময়, জায়গাটায় নিজ দোষে ময়লা জমিয়েছে সে, তবে জায়গা থেকে কী অত সহজে সরিয়ে ফেলা যায়? সে আমাকে যাই ভাবুক আমি তাকে ছোট্ট বোনটিই ভাবি মা।”
রোজিনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার ছেলেটা একসময় ছেলেমানুষী করতো, বাচ্চামো করতো। সে আজ এত বড় হয়ে গেলো? চোখের পলকেই? এই না সেদিন হাফপ্যান্ট পরে তার কাছে এটাওটার জন্য বায়না করতো?
—
কবিতা কথার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বিয়ে ভাঙার কম চেষ্টা করেনি সে ।ছেলের নম্বর জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলো, পারেনি৷ বিকেলে শোভনের ফোন চুরি করে তন্ন তন্ন করে নম্বর খুজেছে। অফিসের ম্যানেজর সে। ম্যানেজর বা রোহান নামেই তো সেভ করার কথা। কিন্তু নাহ্। এ নামের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রোজিনা বেগমকে বারবার বুঝিয়েছে, সে এত দ্রুত বিয়ে করতে চায় না, বিয়ের বয়স হয়নি। তার বন্ধু বান্ধবদের কারো এখনও বিয়ে হয়নি।
রোজিনা বেগম থমথমে গলায় বলেছেন,
“কারো হয়নি তো কী হয়েছে, তোমার হবে।
তাছাড়া বিয়ের বয়স হয়নি অথচ বোনের সংসার ভাঙার বয়স হয়ে গেছে?”
কবিতা আর কিচ্ছু বলতে পারেনি। অবশেষে বাধ্য হয়ে কথার শরণাপন্ন হয়েছে। সেদিন বিকেলের পর থেকে কথা তাকে একদম এড়িয়ে চলে৷ সামনাসামনি পড়লেও টু শব্দটি করে না।
কবিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমায় এত বড় শাস্তি দিস না আপা, সামান্য ভুলের এত বড় শাস্তি হয় না।”
কথা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সামান্য ভুল?”
“সামান্যও তো না রে আপা। আমার তো কোনো ভুলই নেই৷ দুলাভাই তোকে ভুলভাল বুঝিয়েছে। আসলে তুই একটু সেকেলে তো, অন্যরকম। তাই আরকি তোকে দিয়ে তার আর পোষাচ্ছে না, এখন আমার পেছনে….!”
কবিতা কথা শেষ করতে পারলো না। কথার রক্তচক্ষু দেখে থেমে গেলো।
কথা বলল,
“উনি তোর নামে কিচ্ছু বলেনি কবিতা, তুই এত বেয়াদবি করার পরও বলেনি। যা জানার আমি নিজে জেনেছি, নিজের চোখে দেখে জেনেছি।”
কবিতা চুপসে গেলো। মুখে আর কোনো কথা ফুটলো না, মুলত কথা খুঁজে পেলো না।
কথা আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। বরাবরই সে শান্ত মেয়ে। মামির হাজার বকাবকি, অশ্রব্য গালাগালি শোনার পরও সে কখনও রাগ করেনি, কঠিন কঠিন কথাও সে শান্ত গলায় বলেছে। হঠাৎ শান্ত মেয়েটার এমন অশান্ত রুপ দেখে কবিতা ভয় পেয়ে গেলো।
কথা তার দুবাহু দুহাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কেনো করলি কবিতা, কেনো করলি এমন?
আমি তো তোর নিজের বোন বল? আপন বোন? তবে আমার সাথেই কেনো কবিতা?
এটা সেই কবিতা তো, যে মামির ভয়ে আমায় আকড়ে জড়িয়ে রাখতি, আমাকে আকাশসম ভালবাসতি? আসিফের ধোকার পর শোভনের সাথে বিয়ে হওয়ায় তুই কতটা খুশি হয়েছিলি মনে আছে তোর? তবে এসব কেনো?”
কবিতা উত্তর দেবার আগে সে আবার বলল,
“আমি জানতাম আমার বোনটা একটু লোভি, একটু বাচ্চা, বয়সের তুলনায় বুদ্ধি কম। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালবাসাটা কম না। আমি এতটা ভুল ছিলাম কবিতা? এতটা ভুল চিনলাম তোকে? মা চলে যাবার পর তোকে আমি মানুষ করেছি, নিজের শখ আহ্লাদ পায়ে পিষে তোকে খুশি রাখবার চেষ্টা করেছি। তাহলে আমিই কেনো কবিতা?”
এতক্ষণে কবিতা মুখ খুললো,
“তুই আমার বোন আপা, তবে আমার বোন বাক্যটাতে বোনের আগে কিন্তু আমার কথাটা আসে, ভেবে দেখেছিস? মানে কী জানিস?
আগে আমি তারপর আমার বোন তুই। তাহলে আমার কথা না ভেবে আগে তোর কথা কেনো ভাববো? আমার নিজের খুশিকে কেনো প্রাধান্য দেবো না?”
কথা প্রতুত্তর করতে পারলো না। কবিতা কখনই এমন শক্ত কথা বলতে পারতো না, সে তো নরম মনের মেয়ে ছিল, একটু ধমকেই যে কেঁদে দুনিয়া ভাসাতো। তার হঠাৎ এত পরিবর্তনের কারণ কী? সময়, নাকি পরিস্থিতি? নাকি অসৎ সঙ্গ? ভার্সিটির উশৃংখল বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিশেই কী কবিতার এই অধঃপতন?
—
বিয়েতে খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান না করলেও একেবারে সাদামাটাও হলো না। শোভনের আত্মীয় স্বজনরা না থাকলেও কলিগরা এসেছে। বসার রুমটা সবাই হাসি আনন্দে মুখরিত করে রেখেছে।
একজন কলিগ তো কথায় কথায় বলেই ফেলল,
“শোভন ভাইয়ের শালীকার সাথে সাথে তার নিজেরও কপাল খুলে গেলো। ম্যানেজারের সাথে আত্মীয়তা হচ্ছে, এবার প্রমোশন ঠেকায় কে?”
শোভন কথাটা আমলে না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিলো। কী সব উদ্ভট কথাবার্তা। আত্মীয়র ক্ষমতা থাকলেও বা কী? শোভন তো আর সুবিধাবাদী না, সে নিজের যোগ্যতায় প্রমোশন নেবে, অন্যথায় নয়।
মালোতিকে খাবার আনা নেবার কাজ দেওয়া হয়েছে। কথা এতগুলো মানুষের সামনে যেতে সাচ্ছন্দ্যবোদ করে না। রোজিনা বেগমও নিষেধ করে দিয়েছেন।
রোহান বসেছে কোনার সোফাটায়। তার মুখ জুড়ে তৃপ্তির হাসি। কবিতাকে সে কয়েকদিন আগে থেকেই নজরে রেখেছিলো। শোভন তো এর আগেও তাকে ভার্সিটি নিয়ে গেছে।
মালোতি বসার ঘরে পা রাখার সাথে সাথে উল্টো ঘুরে কিচেনে ফেরত গেলো। কথা বলল,
“কী হলো মালোতি? খাবার নিয়ে ফিরে এলে কেনো?”
মালোতি উত্তর দিলো না। তার মুখ গম্ভীর।
মিনিট দুয়েক বাদে সে গম্ভীর খোলস ছেড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো।
কথা তখন হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।
—
মালোতি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। গ্রামের টিনের চালাওয়ালা ছোট্ট ঘরটায় সে, বাবা মা আর তার দু’ভাইয়ের সুখী সংসার ছিলো, যেখানে খাবারের অভাব হলেও সুখের অভাব ছিলো না।
তারপরও মালোতি লোভ করে ফেলেছিলো, আরেকটু ভালো থাকার লোভ, ভালবাসার মানুষের লোভ। সেই লোভের লোকটার হাত ধরে পারি জমিয়েছিলো অজানা অচেনা শহরটায়। নতুন করে সংসার পেতেছিলো। তার স্বামী তখন ভালো বেতনের চাকরী পেয়েছে, টাকা পয়সা, শাড়ি গয়নার ছড়াছড়ি। শুধু ভালবাসাটাই যেন ফিকে হয়ে গেলো। বছর খানেক যেতে না যেতে ভালবাসা শব্দটাও আর রইলো না।
লোকটা কেমন মুখের ওপর ডিভোর্স লেটার ছুড়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিলো,
“তোমাকে আমার সাথে মানায় না মালোতি, তুমি গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, আর আমি এত ভালো বেতনের মাইনে পাওয়া লোক। তোমার সাথে আমায় যায় বলো?”
মালোতি তখন কাগজটায় সই করে একটা কথাই বলেছিলো,
“আসলেই তোমার সাথে আমার যায় না, এত জঘন্য মানুষটার সাথে অন্তত আমার মত মেয়েকে মানায় না।”
কথা এসব কথা মালোতির মুখ থেকেই শুনেছে। শোভনের কলিগদের মধ্যে মালোতির স্বামীও আছে। বিয়ে করেছে সম্পৃতি, ভালো ঘরের মেয়েকে। মেয়েটা এসেছেও এ বাড়িতে। সাজ পোশাক দেখলে তাকে নির্দ্বিধায় উশৃংখল বলে আখ্যায়িত করা যায়। কথা মালোতির মাথাটা বুকে চেপে চুপচাপ বসে রইলো।
চারপাশে এত মুখোশধারী মানুষ কেনো কে যানে? তাদের বাইরেটা কত চাকচিক্যে ভরা অথচ ভেতরটায় পচন ধরা।
এই যে এই ছোট্ট মেয়েটা, তার সাথে এত খারাপ হবার কী খুব বেশি দরকার ছিলো? তার দোষটা কোথায় ছিলো, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করা, সেই দোষেই বুঝি এখন লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়? কথা নিজেও কী ভুল করেনি? কবিতাকে বিশ্বাস করে?
কিন্তু বিশ্বাস করাটা দোষের নাকি বিশ্বাস ভাঙাটা?
বিয়ের আগমুহূর্তে বাতাসের মতো ছড়িয়ে পরলো, কনে পালিয়েছে। বিয়ে বাড়ির কোনায় কোনায় সব জায়গা খোজা শেষ, কনের হদিস পাওয়া যায়নি।
তবে কথার রুমে একটা চিঠি খুজে পাওয়া গেলো,
কবিতা লিখেছে,
“তুই সত্যি আমাকে এতদিনেও চিনিস নি আপা। আগের আমি আর এই আমির ভেতর বিস্তর তফাত। আগের কবিতা ভীতু ছিলো, এই কবিতা সাহসী। সাহসটা কে জোগান দিয়েছে জানিস? তোর প্রচন্ড কাছের কেউ!”
চলবে…..