#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ৯
পরদিন দুপুরে ইতি স্কুল থেকে ফিরে দেখে ওর মা এসেছে। সাথে বড় একটা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার, এক বস্তা চাল ও অনেকগুলো বাজার যেগুলো ফ্রিজে রেখে অনেকদিন খাওয়া যাবে। ড্রইংরুমে বসে আছে ওর মা আর শাশুড়ী বা তুলির কোন চিহ্ন নেই আশেপাশে। ইতি ওর মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলে -“মা, এতো কি এনেছ বলত? কেন এতো কষ্ট করতে গেলে?”
-“মারে তুই দুপুরে খাবার পাসনা জানার পর থেকে নাঈমের আশ্বাস সত্ত্বেও অস্থির লাগছিল। তাই রান্না করে নিয়ে এলাম সামনে বসিয়ে তোকে খাওয়াবো বলে। বাসার সবার জন্যই রান্না করে এনেছি আজ। আর তোর বাবা বাজার করে দিল যাতে নেক্সটে এমন দেখলে নিজের জন্য রান্না করে নিতে পারিস।” নরম স্বরে বলেন ইতির মা।
-“মা, কোন দরকার ছিলনা এতো কষ্ট করার। আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আর দেখোনা আমার কত ওজন কমেছে আলহামদুলিল্লাহ।” ইতি বলে মাকে।
-“তুই সবসময়ই ওজন কমানোর বিপক্ষে ছিলি মা। আজ তোর এই কথা যে আমার বুকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে কি বলব? যাক, বেয়ানকে ডাক। উনাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাই সব।” বলেন ইতির মা।
-“মা,মা, এদিকে আসুন প্লিজ। আমার মা এসেছেন, চলে যাবেন এখন।” শাশুড়িকে ডাকতে ডাকতে বলে ইতি।
ঘরের ভিতর থেকে গজগজ করেন নাজমা বেগম -“তোমার মা আসছে তো আমি কি করব? তুমি আদর কর গা যাও।”
-“আম্মু সবার জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছে মা। চলেন খাবেন।” ইতির উত্তর।
-“আমরা কি কোনদিন খাইনি যে তোমার মা খাবার আনছে আর আমরা হামলে পড়ব? তোমার মা আনছে, তুমিই গিলোগা। তোমার নাকি দুপুরে খাওয়া হয়না।” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন নাজমা বেগম। ইতি আর কথা বাড়ায়না।
মাকে বিদায় দিয়ে খেতে বসেছে এমন সময় নাঈম ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল দেয়। খেতে খেতেই কল রিসিভ করে ইতি। নাঈম দেখতে চায় ও দুপুরে খেয়েছে কিনা সেজন্য জাস্ট ক্যামেরা পিছনে দিয়েছে তখনই তুলি এসে হ্যাচকা টানে টিফিন ক্যারিয়ারের সব খাবার ফেলে দেয় মেঝেতে। ভিডিও কলে সব দেখে নাঈম কিন্তু তুলি সেটা জানেনা। প্রচন্ড রেগে যায় নাঈম। কিন্তু অফিসে বসে ভিডিও কল দিয়েছে তাই বেশি কিছু বলেনা। শুধু ইতিকে বলে আমি এসে দেখছি।
সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে টিউশনিতে যায়না নাঈম। সোজা বাসায় চলে আসে। ওর তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে নাজমা বেগম জানতে চান কি হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি কেন ফিরল বাসায়? নাঈম কোন উত্তর না দিয়ে তুলিকে ডাকে। তুলি এলে সপাটে ওকে একটা চড় মারে। হতভম্ব তুলি গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে -“কেন মারলি তুই আমাকে?”
নাঈম পালটা ধমক দিয়ে চুপ করে দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে -“মা, তুমি না দায়িত্ব নিলা যে ইতির অসম্মান হতে দিবানা? ইতিকে দেখে রাখবা। তাহলে আজ তুলি ইতির ভাতের থালা টেনে মেঝেতে ফেলে দেয় কি করে? তাও যে খাবার ওর মা রান্না করে দিয়ে গেছেন?”
-“ওহ আচ্ছা এর মধ্যে নালিশ করাও হয়ে গেছে ম্যাডামের?” ফোঁস করে উঠে তুলি।
-“তোকে চুপ করতে বলছি তুলি। ইতির যদি নালিশ করা স্বভাব হত তাহলে এতো দিন ওকে দুপুরে না খেয়ে থাকতে হত না। তুই যখন আজ দুপুরে ওর সাথে এই নোংরামি করিস তখন আমি ছিলাম ভিডিও কলে। আমি সব দেখেছি আর শুনেছি। তোর এতো বড় সাহস হয় কি করে যে তোরা তো ওকে খেতে দিসই না উল্টো ওর মা খাবার রান্না করে দিয়ে গেছেন সেটাও ফেলে দিস। এর মানে কি? এসব কি? এসব শিক্ষা দিছি আমরা তোকে? তোকে ভালোবাসি তার মানে এই না যে তোর ভুল গুলো শুধরে দিব না।” বোনকে বলে নাঈম।
-“মা, আমি আজ থেকে তুলির বিয়ের টাকা জমানোর জন্য যে টিউশনি করতাম আর দোকানের হিসাব লিখতাম তা বন্ধ করে দিয়েছি। তোমাদের জন্য, তোমার মেয়ের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি নিজের দিকে না তাকিয়ে আর তোমরা আমার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করছ। আর না মা। যে সময়টা আমি বাইরে দিতাম সেটা এখন থেকে ঘরে দেব। তোমাদের সংসারে কত কাজ আছে দিও করে দেব। আমাকে ক্ষমা কর মা, আমি আর এভাবে ভুতের বেগার দিতে পারবোনা।” বলতে বলতে গলা ধরে আসে নাঈমের। কথা শেষ করে ইতির হাত ধরে ঘরে চলে যায়।
ইতি ঘরে গিয়ে নাঈমকে বলে -“তুমি বস, আমি এক গ্লাস শরবত বানিয়ে আনি। রোদের মধ্যে হেঁটে এসেছ।”
-“তুমি কিভাবে জানলে আমি হেঁটে এসেছি?” অবাক নাঈম জানতে চায়।
-“মানিব্যাগ ফেলে গেছ, শার্ট প্যান্ট অন্যটা পরে গেছ, আমি ধোয়ার সময় পকেট চেক করে দেখি টাকা। তাহলে হেঁটে এসেছ এটা তো বুঝাই যাচ্ছে।” ধীর কন্ঠে বলে ইতি।
-“তুমি এই কয়দিনে আমাকে এতোটা খেয়াল কর সেটা আমি বড় হবার পর থেকে কখনোই পাইনি ইতি। এইজন্যই হয়তো এতো অল্প সময়ে বুঝে গেছি তুমি আমার কতটা আপন।” বলে জড়িয়ে নেয় ইতিকে।
-“মা তোমার সুখের সংসারে ডাইনি ঢুকছে গো। শেষ তোমার সংসার। ছেলে তোমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। দেখ দুইদিন পরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।” ইতি শরবত বানাতে কিচেনে গেলে ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে তুলি। ইতি চুপচাপ শরবত বানিয়ে নিয়ে ঘরে চলে যায়। দরজা ভেজিয়ে দেয়ার সময় তুলিকে এগিয়ে আসতে দেখে শব্দ করে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দেয়।
নাঈম ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখে ইতি শরবত হাতে দাঁড়িয়ে। এরমধ্যে টুক করে লিপস্টিক লাগিয়েছে। সামান্য একটু লিপস্টিক লাগিয়েই অপুর্ব লাগছে ইতিকে। এক চুমুকে শরবত শেষ করে ইতিকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে নাঈম। অন্যসময়ের মতো দরজা খোলা আছে অজুহাতে ইতি উঠে যাওয়ার জন্য ছটফট না করে সেও নাঈমকে জড়িয়ে ধরে, উপভোগ করে বোনাস পাওয়া এই সময়টুকু। ভালোবাসাবাসি শেষ হলে ইতি নাঈমকে অনুরোধ করে টিউশনি আর দোকানের হিসাব লেখা বন্ধ না করে দিতে, হাজার হোক তুলি তার ছোট বোন, বড় ভাই হিসেবে তার দায়িত্ব আছে।
ইতির কথা শুনে হেসে উঠে নাঈম, বলে -“আরে পাগলি আমি কোনটাই বন্ধ করিনি। একেতো তোমার সাথে তুলির অমন ব্যবহার দেখে মেজাজ খারাপ লাগছে তার উপর দেখি পকেটে টাকা নাই। তাই আজ ফোন করে বলে দিলাম আসবোনা। গেলে আজ বউয়ের সাথে এই সুন্দর সময় উপভোগ করতে পারতাম?”
ইতি জিজ্ঞেস করে -“আজ যেহেতু বাসায় আছ, সবাই একসাথে ডিনার করব। কি রান্না করব বল? আম্মু হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল, কবুতর, ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, রুই মাছ দিয়ে গেছে। কোনটা খাবে বল?”
-“আম্মু এতো কিছু দিয়ে গেছে এখন আমারই লজ্জা লাগতেছে।” নরম স্বরে বলে নাঈম।
-“আরে লজ্জার কি আছে? আমি কি আম্মুর পর? শুন রাতে ইলিশ পোলাও করি, রোস্ট করি। তুমি মুরাদ ভাইকেও খেতে বলে দাও আমাদের সাথে।”
-“হ্যাঁ ভালো কথা বলছ তো। ওই ব্যাটার সাথে অনেকদিন কথা হয়না। ওকে আসতে বলি।” খুশি হয়ে যায় নাঈম। ইতি মনে মনে ভাবে – এই ছেলেটা এতো অল্পেই খুশি হয়। অথচ ওর নিজের মা বোন ওর খুশির জন্য ভাবেনা।
ইতি গোছল করে ভেজা চুলেই যায় ওর শাশুড়ির কাছে। উনার পাশে বসে বলে -“মা আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনার ছেলেকে বুঝিয়েছি। ও কাল থেকে আবারও টিউশনিতে যাবে। আজ রাতে মুরাদ ভাইকে দাওয়াত দিয়েছে। ইলিশ পোলাও আর রোস্ট করতে বলল। আসলে মা, আপনার ছেলে দিনরাত পরিশ্রম করে ওরও মন চায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে একবেলা ভালোমন্দ খেতে।”
নাজমা বেগম ইতির দিকে তাকিয়ে ওর ভেজা চুল দেখেই মনে মনে রেগে যান কিন্তু রাগ চেপে রেখে বলেন -“ভালোতো। ভালোমন্দ খেতে চেয়েছে রান্না কর। আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?”
-“মা, আমিই রান্না করতে চাইলাম কিন্তু আপনার ছেলে বলে আপনার মতো ইলিশ পোলাও পুরো বিশ্বে কেউ রান্না করতে পারবেনা। আর আপনার রোস্ট যে না খেয়েছে তার জীবনের ১২ আনাই মিছে। আসলে মা আপনার ছেলে আপনার হাতের রান্না খেতে চাচ্ছে। বলতে সাহস পাচ্ছেনা, তখন আপনার সাথে জোরে কথা বলছে সেজন্য। আপনি প্লিজ রান্না করুন না মা। আমি সব এগিয়ে দিচ্ছি। কিভাবে কি কাটতে হবে, বাটতে হবে আপনি দেখিয়ে দিন মা।” বলে ইতি। নাজমা বেগমের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা উনার রান্নার প্রশংসা করা। যদিও উনার রান্না ইতির খুব একটা পছন্দ না কিন্তু নাঈমের মায়ের হাতের রান্না নাঈমের কাছে অমৃত। এটাই স্বাভাবিক। তাই আজ ইতি চাইছে রান্নাটা নাজমা বেগম করুক।
কিছুক্ষণ ভেবে নাজমা বেগম বলেন -“ঠিক আছে, রান্না আমি করব কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
-“কি শর্ত মা?” জানতে চায় ইতি।
আপনারাও জানতে চান? চোখ রাখুন পরের পর্বে।
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ