#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ১৩
-“আপা, আপনার আমার সম্পর্ক ৩০ বছরের উপরে। আমাদের মধ্যে লুকানোর কিছুই নাই। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা কবে আমাদের লুকিয়ে একে অপরকে মন দিয়ে ফেলেছে সেটা আমরা কেউই টের পাইনি। সংসার করবে ওরা, ওরা যদি একে অপরকে পছন্দ করে আমাদের সেখানে মানা করার কিছু নাই। কিন্তু মা হিসেবে আমার কিছু বলার আছে। যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পরবর্তী জীবন সুখে কাটাতে পারে। আমার মনে হয় না আপনার ও তাতে দ্বিমত হবে।” বলেন মুরাদের মা খাদিজা বেগম।
-“আপা আপনাকে আমি ভালো করেই চিনি, জানি। আমার সন্তান মানেই আপনার সন্তান আর আপনার সন্তান মানেই আমার। তাই আমি জানি আপনি এমন কিছু বলবেন না যেটা মানা আমাদের জন্য কষ্টের।” বলেন নাজমা বেগম।
-“হ্যাঁ আপা অবশ্যই তাই। আপা আমি তুলিকে আমার ঘরের বউ করে নেব কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। প্রথম শর্ত নাঈমের কাছে। বাবা তুমি তুলির বিয়ের টাকা জমানোর জন্য যে আলাদা পরিশ্রম কর, সেগুলো বাদ দিতে হবে। মানে তুমি অফিস শেষ করে টিউশনি আর দোকানের হিসাব লেখার কাজ করতে পারবানা। তোমার নতুন বিয়ে হয়েছে, বৌমাকে বেশি বেশি সময় দেয়া উচিৎ। আশা করি ভুল কিছু চাইনি বাবা তোমার কাছে।” বলে নাঈমের দিকে তাকান খাদিজা বেগম।
-“জ্বি খালাম্মা, ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন।” নাঈম উত্তর দেয়।
-“আচ্ছা বাবা, খুশি হলাম তোমার কথায়। দ্বিতীয় শর্ত হল তোমরা বিয়েতে এক টাকাও খরচ করবেনা। বিয়ে পরানো হবে মসজিদে। আমরা সেখান থেকেই বউ নিয়ে চলে যাব। পরদিন ওয়ালিমা হবে আমাদের তরফ থেকে। তোমাদের যাকে যাকে ইনভাইট করতে মন চাইবে, করবে। কোন বাধ্যবাধকতা নাই।”
-“না খালাম্মা তা কি করে হয়? সামাজিকতা আছেনা? আমার একটা মাত্র বোন।”
-“শুন বাবা আমার কাছে সামাজিকতার চেয়েও বড় রাসুলের (সঃ) সুন্নাত। উনার নির্দেশিত পন্থায়ই বিয়ে হবে ইনশাআল্লাহ। তোমার যদি বোনের জন্য কিছু দিতে ইচ্ছে হয় মন ভরে দুয়া দিও, তাহলেই হবে। এখন তৃতীয় শর্ত আপার কাছে। আপা যদিও আমার বাসায় একাধিক কাজের মানুষ আছে তাও আমি চাই আমার ছেলের বউ সর্বগুণ সম্পন্না হবে। ঘরের যাবতীয় কাজ কারো উপর নির্ভর না করেই একাই করতে পারবে। আমি যেন মুখ ফসকেও বলতে না পারি মা কিছু শেখায়নি। তাই আপা বিয়ের আগে আপনি প্লিজ তুলিকে রান্না থেকে শুরু করে টয়লেট পরিস্কার করা পর্যন্ত ঘরের সব কাজ শেখাবেন।”
-“ঠিক আছে আপা। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।” বলেন নাজমা বেগম।
-“আমার চতুর্থ শর্ত হল বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তুলি ইতির সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করতে পারবেনা। কারণ একটা মেয়ে যতই রাগী হোক সে যদি তার ভাইয়ের বউয়ের সাথে মিষ্টি ভাষায় কথা বলে তাহলে সবাই তাকে ভালোবাসবে। কি আপা এই ব্যাপার টা মনিটর করতে পারবেন না? আর ইতি তুমি আমার ফোন নম্বর রাখো, তুলি খারাপ ব্যবহার করলেই আমাকে কল দিবা।” শেষের কথা ইতির দিকে তাকিয়ে বলেন খাদিজা বেগম।
খাদিজা বেগমের এই কথায় নাজমা বেগম মনে মনে জ্বলে গেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন -“জ্বি আপা অবশ্যই মনিটর করব। ভাবি ননদ হালকা পাতলা তর্কাতর্কি তো হয়ই সব ঘরে।”
-“অন্যের টা না দেখে আমরা নিজেদের ঘরের দিকে তাকাই আপা। অন্যের ঘরের অশান্তির চেয়ে আমার ঘরের শান্তি আমার কাছে বেশি প্রিয়। আর হ্যাঁ আপা পঞ্চম শর্ত হল বিয়েটা হবে তিন বছর পরে। মুরাদের একটা স্কলারশিপ হয়েছে ইউকে তে। সেখান থেকে ফিরে আসুক। তারপর বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে নিয়ে যাব। ততদিন মেয়ে মায়ের ঘরেই থাকুক। কি বলেন আপা?” খাদিজা বেগম জানতে চান।
৩ বছরের কথা শুনে নাজমা বেগম মনে মনে আরো চটে যান, কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করেন না। কিন্তু ইতি ওর শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে। ও নরম গলায় বলে -“আমি কি কিছু বলতে পারি প্লিজ।”
নাজমা বেগম কটমট করে ইতির দিকে তাকান, পারলে চোখের আগুনেই পুড়িয়ে দিবেন। খাদিজা বেগম ইতির হাত ধরে বলেন -“হ্যাঁ মা অবশ্যই বলবে। তোমার মতামতও গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। বল মা কি বলতে চাও?”
-“আন্টি আমি ছোট মানুষ, ভুল হলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমার মনে হয় কি মুরাদ ভাই যাওয়ার আগে বিয়েটা পরিয়ে রাখলে ভালো হয়। পরে মুরাদ ভাই ফিরলে অনুষ্ঠান করা হল। আপনারা কি বলেন মা, আমি কি ঠিক বললাম?” ইতি বলে।
নাঈমও সায় দেয় -“আমারও সেটাই মনে হয় খালা। কি বলিস মুরাদ?”
-“আমার আপত্তি নেই কিন্তু মা যা বলবে সেটাই হবে তাইনা বাবা?” মুরাদ জানতে চায় তার বাবা হাফিজুর রহমানের কাছে।
-“হ্যাঁ তা তো বটেই। এখন নারীশক্তির যুগ। নারীরা যা বলবে সেটাই হবে।” হাসতে হাসতে বলেন হাফিজ সাহেব।
-“সবাই যেহেতু এটাই চাইছে তাহলে সেটাই হোক। আমার পঞ্চম শর্ত আমি উঠিয়ে নিলাম আর বউ উঠিয়ে নেব বাকি চারটা শর্ত পূরণ হলে।” হাসিমুখে বলেন খাদিজা বেগম -“তাহলে এই কথায় মিষ্টিমুখ হয়ে যাক।”
সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় পরের শুক্রবার বাদ জুমা মসজিদে বিয়ে পড়ানো হবে মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে। তার আগে নাঈম ওর টিউশনি ও দোকানের কাজ বাদ দিয়ে আসবে। যাওয়ার সময় খাদিজা বেগম ইতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন -“আমি সারাজীবন চেয়েছিলাম মা তোমার মতো একটা ছেলের বউ। কিন্তু আমার কপালে আল্লাহ তুলিকে লিখে রেখেছেন, তুমি ওকে যতটা পারো তোমার মতো করে গড়ে দিও তিন বছরে প্লিজ। তবে নাঈমতো আমার ছেলেই। মুরাদ আর নাঈমকে আমি কখনো আলাদা চোখে দেখিনি মা। আল্লাহ তোমাদের সবরকম সুখী করুক।”
এবাড়িতে আসার পরে এই প্রথম কোন নারীর মুখে এতো আদরের কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা ইতি, চোখ ভরে পানি চলে আসে ওর। এটা খাদিজা বেগমের দৃষ্টি এড়ায়না, ইতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন -“তোমার চোখে যাতে আর পানি না আসে সেজন্য তুলিকে নিয়ে যাচ্ছি মা। এরপর থেকে আর চোখে এই পানি দেখতে চাইনা।”
তুলি সন্ধ্যায় ফিরে সব শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনা। তারপর যখন তৃতীয় ও চতুর্থ শর্তের কথা শুনে তখন ফোঁস করে উঠে। নাজমা বেগম বুঝান, বিয়েটা হোক। তারপর উঠিয়ে নিবে অবশ্যই। বিয়ে পর্যন্ত চুপ থাক তুই।
পরদিন মঙ্গলবার, শুক্রবারের বেশি দেরি নাই। ইতি স্কুলে থাকতেই খাদিজা বেগম উনাকে কল দেন। বলেন -“মা, আমার তো মেয়ে নাই তাই তোমাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে। আমার এখন ঘুরে ঘুরে শপিং করার এনার্জি নাই। তাই আমার হয়ে তুমি একটু তুলিকে নিয়ে শপিংএ যাও প্লিজ। আমার কার্ড পাঠিয়ে দিচ্ছি মুরাদের হাতে, পিন কোড মুরাদ বলে দিবে। তুলির যা যা মন চায় শপিং করে দিও। আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ের দিন তুলিকে পার্লার থেকে সাজানোর। ফাইভ স্টারে ওদের জন্য রুম বুক করেছি। রাতে ওরা সেখানেই থাকবে।”
-“ঠিক আছে আন্টি।” বলে ফোন রাখতেই দেখে পিয়ন ডাকতে এসেছে -“ম্যাডাম আপনার গেস্ট এসেছে।”
ইতি গেস্টরুমে গিয়ে দেখে মুরাদ বসে। ইতিকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়। একটা খাম এগিয়ে দেয় ইতির দিকে, বলে -“ভাবি, মা এখানে উনার কার্ড পাঠিয়েছেন। শপিং লিমিট ১ লাখ টাকা। আর আমি আপনার বিকাশে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিচ্ছি। তুলির সাথে আপনিও শপিং করবেন প্লিজ। আপনার একমাত্র ননদের বিয়ে। সবচেয়ে ভালো হত আমি বা মা সাথে থাকতে পারলে। কিন্তু আমার আবার বাইরে যাওয়ার কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াতে হবে।”
মুরাদ চলে যাওয়ার পরে ইতি খাম খুলে দেখে একটা ডেবিট কার্ড ও একটা চিঠি। চিঠিটা খুলে পড়তে লাগে –
মা ইতি,
দুয়া দিয়ে শুরু করছি। আমি নিজে গিয়ে শপিং করিয়ে দিতে পারলামনা তারজন্য ক্ষমা চাইছি। কার কার জন্য কি কি কিনতে হবে আমি বলে দিচ্ছি। আমার হয়ে কিনবা প্লিজ। তোমার শাশুড়ির জন্য একটা জামদানি শাড়ি নিবা, তোমার শ্বশুরের জন্য হাতের কাজ করা পাঞ্জাবি, তোমার জন্য ল্যাহেংগা আর নাঈমের জন্য ম্যাচিং শেরওয়ানি। তোমার ল্যাহেংগার সাথে ম্যাচিং ব্যাগ, জুতা, কসমেটিকস সব নিবা। তুলির যা যা লাগে সব কিনবা। টাকা কম পড়লে জানাবা, আমি বিকাশ করে দেব। আমি চাইনা আমার একমাত্র ছেলের বউয়ের বিয়ের ব্যাপারে কোন শখ যেন অপূর্ণ না থাকে।
খাদিজা আন্টি
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইতি ভাবে মানুষে মানুষে কত তফাৎ। ওর শাশুড়ী ওর জন্য সব কমদামি শপিং করছে, শাড়ি এক ধোয়া দিতেই রঙ শেষ আর তুলির শাশুড়ী পুরো কার্ড দিয়ে দিছে নিজের মতো শপিং করতে। ভাবতে ভাবতেই দেখে ফোনে লেখা – Sasuma calling……
কি বলবে ইতির শাশুড়ী?
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ