#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ১২
-“ভাবি আপনার বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত আপনি নাঈমকে কতটা ভালো করে খেয়াল করেছেন বলুনতো?” জিজ্ঞেস করে মুরাদ।
-“ভালোভাবেই তো খেয়াল করেছি।” উত্তরে বলে ইতি।
-“ওর ডান হাঁটুর উপরে থাইয়ে অনেক খানি মাংস নাই খেয়াল করেছেন?
-“হ্যাঁ, খেয়াল করেছি। কিন্তু কিসের জন্য অমন হইছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেনি।”
-“আজ আমি বলি শুনেন। এটা হয়েছে আমার জীবন বাঁচানোর জন্য। আমার আব্বার প্রফেশন কি আপনি জানেন?”
-“না সেটা জানিনা।”
-“ব্যাপার না ভাবি। আপনার বিয়ে হইছে অল্পদিন। এখন নিজেদের বাদ দিয়ে অন্যদের সম্পর্কে না জানাই ভালো। যাই হোক আমার আব্বা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশ। একবার আব্বা গোপনে খবর পেয়ে মোটর সাইকেলের বড় একটা চালান আটক করে। সেই সময় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে তার বাজার মূল্য ছিল কোটি টাকার মতো। সেই চালান ছুটিয়ে নেয়ার জন্য আব্বাকে বড় এমাউন্টের একটা ঘুষ অফার করা হয়। আব্বা ফিরিয়ে দেন। তারা নানাভাবে আব্বাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে সফল না হয়ে আমাকে স্কুল থেকে উঠিয়ে নেয়। আমাকে যখন মাইক্রোবাসে তুলে তখন নাঈম দেখে ফেলে। দৌড়ে এসে মাইক্রোবাসের পিছনে কোনমতে ঝুলে থেকে ওদের সাথে একটা গ্রামে নামে। ওরা যখন আমাকে বেঁধে রেখে আব্বার কাছে ফোন করে বিনিময় চাইবে সেই সময় নাঈম পা টিপে টিপে এসে আমার বাঁধন খুলে দেয়। ওরা টের পেয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে কোপ দিতে যায়, নাঈম হ্যাচকা টানে আমাকে সরিয়ে দিতেই রামদায়ের কোপ পড়ে ওর থাইয়ে। এক খাবলা মাংস উঠিয়ে নেয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমাদের দুজনের মধ্যে কি এক শক্তি এসে ভর করে আমরা এক দৌড়ে অনেকটা দূরে চলে যাই। কিন্তু নাঈমের পা থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়ায় ও নিস্তেজ হয়ে আসে। ওকে নিয়ে একটা খড়ের গাদার পাশে বসিয়ে পাশের নালা থেকে পানি দিয়ে কিছুদূর রক্তের দাগ মুছে দেই। আমি নাঈমের কাছে ফিরে আসতেই হৈ হৈ আওয়াজ শুনে ওকে নিয়ে আমি গাদার আরো ভিতরে সেঁধিয়ে যাই। ওরা ধরধর করতে করতে আরো সামনে চলে যায়। আমি আরো প্রায় আধঘন্টার মতো অপেক্ষা করে কারো কোন আওয়াজ না পেয়ে নাঈমকে ভালো করে খড় দিয়ে ঢেকে চলে যাই লোকালয়ের দিকে একজন মানুষের দেখা পেয়ে উনাকে আমাদের অবস্থা বুঝিয়ে নিয়ে আসি। উনি এসে নাঈমকে কোলে তুলে এক দৌড়ে উনার বাসায় নিয়ে গিয়ে গ্রামের ডাক্তারকে ডেকে আনেন। ডাক্তার সব শুনে নাঈমকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বাজারে গিয়ে আব্বার অফিসে ফোন দিয়ে লোকেশন সহ সব জানান। আব্বা থানা থেকে ফোর্স নিয়ে এসে ওদের আস্তানা চিনে নেন আর আমাদের দুজনকে নিয়ে আসেন। নাঈমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রচুর রক্ত পড়ায় নাঈম শকে চলে যায়। আম্মা আর খালাম্মা টানা দুইদিন জায়নামাজ ছেড়ে উঠেন না। খালু পাগলের মতো হয়ে যান। আব্বা নানান জায়গা থেকে রক্ত যোগাড়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে অল্প কিছু রক্ত যোগাড় করেন। নাঈমের রক্তের গ্রুপ রেয়ার হওয়ায় রক্ত পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। ডাক্তাররা একসময় হাল ছেড়ে দেন। আব্বা সব থানায় জানিয়ে আশেপাশের কয়েক জেলা খুঁজে ডোনার এনে নাঈমকে রক্ত দেয়ান। আমরা নাঈমকে হারিয়েই ফেলেছিলাম প্রায় ভাবি। কিন্তু আমাদের দুই মায়ের দুয়ার জোরে আল্লাহ ওকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তখন যদি নাঈম আমাকে বাঁচাতে স্বেচ্ছায় ঝাঁপিয়ে না পড়ত আজ আমি থাকতাম না, সেখানেই আমার গ/লা/কা/টা লা/শ পড়ে থাকত।”
-“কি বলেন ভাই। আমিতো এসবের কিছুই জানিনা।” উদ্বিগ্ন গলায় বলে ইতি।
-“জানবেন কিভাবে? আপনাদের বিয়ের পরে এতো সময় কি পেয়েছেন যে একে অপরের এতো কথা শেয়ার করবেন? আমার বন্ধু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাধার মতো খাটে। বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তারমধ্যে ননস্টপ চলে ওর মা বোনের নাটক। শান্তিমতো বউয়ের সাথে দুদন্ড বসার উপায় নাই ওর। ভেবেছিলাম অন্তত বিয়ের পরে ও শান্তি পাবে। কিন্তু এখন দেখছি অশান্তি আরো বেড়ে গেছে। ভাবি আমি নাঈমের শুকনো মুখ দেখতে পারিনা। মনে হয় আমার সব দিয়ে হলেও ওর মুখে হাসি ফুটাই। তাই আমার কাছে এখন এটাই সহজ সমাধান মনে হচ্ছে।” মুরাদ বলে।
-“ভাই তাই বলে আপনি জেনেশুনে তুলির মতো রাগী, বদমেজাজি, উচ্ছৃংখল মেয়েকে বিয়ে করবেন এটা একটা কথা হল? আপনার তো একটা জীবন আছে।” ইতি বলে।
-“ভাবি এই জীবনটা আজ হয়তো থাকতোনা যদি নাঈম তখন না আসত। দেখেন ভাবি, আমাকে বিয়ে তো করতেই হবে। আর যেহেতু আমার কোন আলাদা পছন্দ নাই সেহেতু তুলিকে বিয়ে করতে অসুবিধা নাই। তাছাড়া তুলি আমাকে ভালোবাসে ছোট থেকেই। সুতরাং আমাকে পাওয়ার জন্য হলেও ও নিজেকে পরিবর্তন করবে বলে আমার মনে হয় ভাবি। আপনি প্লিজ আমাকে সাপোর্ট করেন। আপনার আর আমার ভালোবাসার মানুষ তো একজনই ভাবি। তাকে ভালো রাখা তো আমাদেরই দায়িত্ব। আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, নাঈমের দিকে ফোকাস করেন প্লিজ। ওকে কখনো একা ছাড়বেন না ভাবি, এটা আপনার কাছে অনুরোধ। ভালো থাকবেন, রাখছি।” বলে মুরাদ ফোন কেটে দেয়।
ইতি স্কুল শেষে বাসায় ফিরে দেখে মুরাদের মা বাবা, মুরাদ, নাঈম, ওর বাবা মা সবাই ড্রইংরুমে। তুলিকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। ইতি সবাইকে সালাম দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ওর পিছনে নাঈমও উঠে আসে। ইতি নাঈমের কাছে জানতে চায় সে কখন এসেছে আর বাসায় গেস্ট তাও ওকে কল দেয়নি কেন? নাঈম জানায় উনারা সরাসরি নাঈমের অফিসে গিয়ে নাঈমকে নিয়ে এসেছে অল্প কিছুক্ষণ আগেই। নাস্তাও উনারা সাথেই নিয়ে এসেছেন। ইতিকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে নাঈম আবারও ড্রইংরুমে যেতে উদ্যত হতেই ইতি ডেকে বলে -“তোমার বোনের বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন উনারা, উনাদের আনা নাস্তা খাইয়েই বিদায় দিবা নাকি? এটা কেমন কথা? যাও তুমিও কিছু নাস্তা কিনে আনো আর আমি দেখি শর্টকাটে কি বানানো যায়।”
ইতির কথায় সম্বিৎ ফিরে নাঈমের। কিন্তু ও তো চায়না মুরাদের সাথে তুলির বিয়ে হোক। সেটা ইতিকে মনে করিয়ে দেয় আবারও। ইতি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে বলে -“দেখ নাঈম, সংসার করবে তুলি আর মুরাদভাই। ওরা রাজি, মা রাজি, মুরাদ ভাইয়ের পরিবার রাজি। আমরা কেন মানা করতে যাব বল? দেখ মুরাদ ভাই তোমার বাল্যবন্ধু, তুমি উনাকে ভালো করে চেন। উনার সাথে বিয়ে না দিয়ে যদি বাইরের অচেনা কারো হাতে বোনকে তুলে দাও আর সে তোমার বোনকে কষ্ট দিল তখন তুমি কি করবা? আমি সারারাত ভেবে দেখলাম এটাই ভালো হয়। তুমি প্লিজ আর মানা করিওনা।”
ইতির কথায় নাঈম আর কিছু না বলে বাইরে চলে যায়। খানিক পরে কিছু মিষ্টি ও ফল নিয়ে আসে। ততক্ষণে ইতি চট করে নুডলস পাকোড়া বানিয়ে ফেলে চা বসিয়ে দিয়েছে। নাঈম ফিরলে ওকে বলে সব ট্রেতে সাজিয়ে দিচ্ছি, তুমি তুলিকে ডেকে আনো। ও এগুলো নিয়ে যাক ড্রইংরুমে। নাঈম তুলির রুমে গিয়ে দেখে তুলি নাই, ওয়াশরুমের দরজা বাহির থেকে লাগানো। এটা দেখে সে ড্রইংরুমে গিয়ে তার মা কে ডাক দেয়। নাজমা বেগম বাইরে এসে জানান যে তুলি ওর বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গেছে। নাঈম একটু রেগে যায় ওর মায়ের উপর। নাজমা বেগম বলেন -“আমার উপর রাগিস কেন? আমি কি জানতাম উনারা আসবে?” গজগজ করতে করতে উনি ড্রইংরুমে যান।
নাঈম নাস্তা নিয়ে ইতিকে যেতে বলে। ইতি বলে -“দেখ তোমাদের পারিবারিক আলাপের মধ্যে আমি গেলে মা অযথা রাগ করবে। দরকার নাই। তুমিই নিয়ে যাও। আমি স্কুল করে এলাম, একটু রেস্ট নেই।”
নাঈম ড্রইংরুমে টেবিলে নাস্তা নামিয়ে রাখতেই মুরাদের মা বলে উঠেন -“নাঈম তোমার বউ কই? সালাম দিয়ে গিয়ে কই লুকালো? ডাকো ওকে, আমি কিছু জরুরি কথা বলতে এসেছি। ইতিরও থাকা দরকার। সেও এই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডাকো ওকে।”
নাঈম খুশি হয়েই ইতিকে ডাকতে যায়। ইতি বাইরে থেকে সবই শুনেছে তাই ও নাঈমের সাথে ঘরে ঢুকে সবাইকে আবারও সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মুরাদের মা ওকে টেনে পাশে বসিয়ে দেয়। শাশুড়ির দৃষ্টি দেখে ইতি কুঁকড়ে যায়। উনি মুরাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে তেলতেলে হাসি দিয়ে বলেন -“আসলে তুলির বান্ধবীরা সকাল থেকে এসে এমন জোর করল ওকে নিয়ে বাইরে যাবে আমি আর মানা করতে পারিনি। আপনারা আসবেন জানলে কিছুতেই ওকে যেতে দিতাম না।”
-“আপা আমরা তুলির কাছে আসিনি। তুলিকে বাইরে দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নেই আপনাদের এখানে আসার। আমার কথা আছে আপনাদের সাথে, তুলির সাথে না।” মুরাদের মা বলেন।
উনার কথার ধরনে মনে মনে ঘাবড়ে যান নাজমা বেগম। বুঝতে পারেন না কি বলতে উনি।
আপনারা কি বুঝতে পারছেন কি বলতে চান মুরাদের মা?
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ