#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ১১
-“মা, তুলি আমার একমাত্র বোন। ওর জন্য আমি আরো ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আনব। তুমি প্লিজ মুরাদের সাথে বিয়েতে রাজি হইওনা।” মরিয়া হয়ে বলে নাঈম।
-“আগে আমার জানতে হবে কেন মানা করছিস তার আগে আমি তোর কথা শুনবনা।” নাজমা বেগম বলেন।
-“ঠিক আছে শুন। মুরাদ ছোট থেকেই তুলিকে দেখতে পারেনা। সবসময়ই বলে আমার হাতে পড়লে সাইজ হয়ে যাবে। বেয়াদব ছাড়া সে তুলিকে সম্বোধনই করেনা। আমাকে সবসময়ই বকে কেন আমি তুলিকে এতো ভালোবাসি। আমার মনে হয়না মা মুরাদ তুলিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছে। আমার কাছে সবকিছু উল্টোপাল্টা লাগছে মা। আমি চাইনা তুলি বিয়ের পরে কষ্টে থাকুক। অন্য কেউ হলে তুলিকে কষ্ট দিলে আমি দেখে নিতে পারব কিন্তু মুরাদকে আমি কিছু বলতে পারবোনা মা। তুমি প্লিজ রাজি হইওনা।” এক নিশ্বাসে পাগলের মতো বলে যায় নাঈম।
-“তোর যত আজাইরা কথা নাঈম। বিয়ের পরে তুই আসলেই পালটে গেছিস। যে নাঈম তুলির খুশি ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাবতোনা আজ সেই নাঈম তুলির খুশি দেখতে চায়না এটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছেনা। দেখ নাঈম, তুলি বুদ্ধি হবার পর থেকে মুরাদকে ভালোবাসে। ও কতটা খুশি হইছে তুই আন্দাজ করতে পারিস? আর তাছাড়া মুরাদ টাকাপয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে, তুলিকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবে। তুই আর বাগড়া দিস না বাপ। আমি তুলির বিয়ে মুরাদের সাথেই দেব।” নাজমা বেগম বলেন।
নাঈম অসহায়ের মতো ওর বাবার দিকে তাকায়। ওর বাবা হাত নেড়ে বলেন -“আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নাইরে বাপ। তোর মায়ের কথার উপর আমার কথা খাটেনা। এখন শুধু একটাই চাওয়া তুলি যেন সুখী হয়।”
নাঈম কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে ইতি চুল আঁচড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হাতের জন্য পারছে না। নাঈম গিয়ে ওর চুল আঁচড়ে দেয়। ইতি জিজ্ঞেস করে কথা বলার ফলাফল কি? নাঈম মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বলে -“আমি পারলাম না মাকে বুঝাতে।”
ইতি ওর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মুখ রেখে বলে -“দেখ আমাদের সবার নিয়তি আল্লাহ লিখে দিয়েছেন। তাও আমাদের জন্মের বহু আগে। সেটা তো চাইলেই আমরা বদলাতে পারব না। কিন্তু তুলি যাতে ভালো থাকে সেই দুয়া আমরা করতে পারি। আর তাছাড়া কবুল না বলা পর্যন্ত তো এই বিয়ে না হবার চান্স আছে তাইনা? তাহলে অযথা টেনশন না করে ঘুমিয়ে পড়। সকালে অফিস আছে তোমার, আমারও স্কুল।”
ইতির কথায় নাঈম শুয়ে পড়ে ঠিকই কিন্তু ঘুম আসেনা। শুধু ভাবতে থাকে হঠাৎ করে মুরাদের কি হল? কথা নাই বার্তা নাই একেবারে তুলিকে বিয়ে করতে চায়। ইতিও একই কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন স্কুলে গিয়ে ইতি কথা বলে ওর কলিগ ময়নার সাথে। ময়না ওর বেশ সিনিয়র, বয়সে ও চাকুরির দিক থেকে। বড় বোনের মতো আগলে রাখে ইতিকে চাকুরির প্রথম দিন থেকেই। ময়নাকে আগের রাতের সব কথা খুলে বলে ইতি। জিজ্ঞেস করে -“আমার এখন কি করা উচিৎ আপা? নাঈমের মতো আমিও জানি মুরাদ ভাই তুলিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাচ্ছেনা। এখানে অন্য কোন ব্যাপার আছে। এখন যদি এরা অরাজি হয় তাহলে হয়তো মুরাদ ভাইয়ের সাথে নাঈমের সম্পর্ক আগের মতো থাকবেনা, একটু হলেও ভাটা পড়বে। আবার যদি বিয়ের পরে তুলি অসুখী হয় তাহলেও ওদের সম্পর্ক নষ্ট হবে। নাঈম কাল সারারাত ঘুমায়নি, যখনই জাগা পেয়েছি দেখি সে ছটফট করছে। আপা বলেননা আমি কি করব এখন বা আমার কি করা উচিৎ?”
ময়না একটু ভেবে নিয়ে বলে -“তুমি কি আগে কখনও মুরাদের সাথে আলাদা কথা বলেছ?”
-“হ্যাঁ আপা। মুরাদ ভাইই কল দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে যখন আমি রাগ করে আমাদের বাসায় থেকেছিলাম তখন।”
-“কি কথা হয়েছিল?”
-“উনি কল দিয়েছিলেন যে নাঈমের সাথে কথা বলেছেন। তুলি মাফ না চাওয়া পর্যন্ত আমি যেন নাঈমের সাথে না ফিরি।”
-“হুম তাহলে বোঝা যাচ্ছে উনি আসলেই তুলিকে পছন্দ করেন না। তাহলে কেন বিয়ে করতে চায় এটাই রহস্য। আচ্ছা তুমি এক কাজ কর, তুমি উনাকে ফোন দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস কর কেন উনি তুলিকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন।” বলে ময়না।
-“ঠিক আছে আপা। আমি টিফিন পিরিয়ডে কল দিয়ে জেনে নিচ্ছি। থ্যাঙ্কিউ আপা, আমি আসলে এইসব কাকে জিজ্ঞেস করব কার পরামর্শ নেব বুঝে পাইনা। আপনি আমার বড় বোনের অভাব পূরণ করছেন আসলে।” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে ইতি।
-“ধুর পাগলি বড় বোনের কাছে শ্বশুরবাড়ির এইসব সমস্যা বলা যায় নাকি? উচিৎ না। বাপের বাড়ির কাছে শ্বশুরবাড়ি বড় করতে হয়, শ্বশুরবাড়ির কাছে বাপেরবড়ি বড় করতে হয়। মনে রাখবা কথাটা।” সস্নেহে বলে ময়না। এরপর ঘন্টা বাজলে যে যার ক্লাসে চলে যায়।
টিফিন পিরিয়ডে ইতি কল দেয় মুরাদের কাছে -“মুরাদ ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্য উত্তর দিবেন প্লিজ।”
-“অবশ্যই দেব ভাবি। আফটার অল আপনি আমার হবু সম্বন্ধীর বউ। তুলিকে কেন বিয়ে করতে চাই এটা জানতে চান তো?” হালকা স্বরে বলে মুরাদ।
-“ঠিক ধরেছেন ভাই। আমি আসলে জানতে চাই হঠাৎ কি হল আপনি যাকে দেখতে পারেন না তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন?” জানতে চায় ইতি।
-“সত্যি কথা বলতে কি ভাবি আমি আপনাদের দাওয়াতে যাওয়ার আগেও এমনটা চিন্তা করিনি। কিন্তু আপনাদের ওখানে গিয়ে কিছু জিনিস অবজার্ভ করে আমার এটাই মনে হল আমার বন্ধুকে ভালো রাখার একটাই উপায় হল তার বোনের বিয়ের চাপ তার উপর থেকে সরানো। হ্যাঁ আমি চাইলে পাত্র খুঁজে দিতে পারতাম কিন্তু আমার মনে হল তুলি যে আমাকে ছোট থেকে ভালোবাসে এটা সবাই মুটামুটি জানে। সেখানে অন্য কারো সাথে বিয়ে হলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। আর তুলি কষ্টে থাকলে নাঈম কখনোই ভালো থাকবেনা। তাই ভাবলাম বিয়ে তো করতেই হবে, তুলিকেই নাহয় করি। আমার যেহেতু অন্য কোন পছন্দ নাই, সেহেতু তুলির পছন্দেই নাহয় বিয়েটা হোক। আর কোন কারণ নাই।”
-“শুধু এটাই কারণ হলে আপনি আরো আগেই তুলিকে বিয়ে করতে চাইতেন, এখন বলতেন না। কারণ নাঈম আজ নতুন করে টিউশনি আর দোকানের হিসাব লিখছে না। ভাই সত্যিটা বলবেন প্লিজ।”
-“আপনি অনেক বুদ্ধিমতী ভাবি। আমি আপনাকে আর নাঈমকে আগেও একসাথে দেখেছি কিন্তু গতকাল রাতে আপনার হাতের অবস্থা দেখে নাঈমের যে এক্সপ্রেশন দেখেছি সেটা নতুন। ওর এই এক্সপ্রেশন দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নেই তুলিকে বিয়ে করার।”
-“কি দেখেছিলেন নাঈমের এক্সপ্রেশনে?”
-“ভাবি নাঈমকে আমি সেই সময় থেকে চিনি যখন আমরা দুজনেই কথা বলতে পারতাম না। বরং আমিতো বলব ওর মা-বাবার চেয়েও আমি ওকে ভালো পড়তে পারি, আপনার চেয়েও। কারণ আপনি নতুন এসেছেন এখনো নাঈমের সাথে ততটা সময় কাটাতে পারেননি যাতে ওকে চিনতে পারেন। আপনি কি খেয়াল করেছিলেন আপনার হাতের অবস্থা দেখে নাঈমের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল? সেটা কিসের জানেন? সে খুব ভালো করেই জানে এসব কেন হচ্ছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছেনা। তাকে প্রায় সারা দিনরাত বাইরে থাকতে হচ্ছে, আপনাকে আগলে রাখতে পারছেনা এটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে ভাবি। ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে ভাবি। ওর তিরিশ বছরের জীবনের সব ভালোবাসা জমা ছিল, আপনাকে উজাড় করে দিচ্ছে কিন্তু আপনাকে আগলে রাখতে পারছেনা। এখন আমি যদি তুলিকে বিয়ে করি তাহলে দুইটা ব্যাপার ঘটবে। জানতে চান?”
-“হ্যাঁ, জানতে চাই। বলুন প্লিজ।”
-“এইযে তুলির বিয়ের টাকা জমানোর জন্য অফিসের পরে যে অমানুষিক পরিশ্রম করে টিউশনি আর দোকানের হিসাব লিখছে এটা বন্ধ হবে, আপনাকে বেশি সময় দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত তুলি যেহেতু আমাকে ভালোবাসে সেহেতু আমি শক্ত করে বললে সে আর আপনাকে জ্বালাবে না। আপনি ভালো থাকলে ভালো থাকবে নাঈম। আমি শুধু নাঈমকে ভালো দেখতে চাই, আর কিছু না।” বলে মুরাদ।
-“ভাই তাই বলে জেনেশুনে তুলির মতো রাগী, জেদি, বেয়াদব মেয়েকে বিয়ে করবেন? এটা আপনার সারাজীবনের ব্যাপার।”
-“ভাবি যদি নাঈম আমার জীবন না বাঁচাতো তাহলে কই পেতাম এই জীবন? নাঈমের উপহার দেয়া জীবন নাহয় ওর জন্যই উৎসর্গ করলাম।” হেসে বলে মুরাদ।
-“কি বলছেন ভাই? নাঈম কবে আপনার জীবন বাঁচালো?” সবিস্ময়ে বলে ইতি।
-“শুনেন তাহলে ভাবি………..
চলবে
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ