#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২৩
#Esrat_Ety
[বড় পর্ব। সবাই মেইন ফেসবুক থেকে পড়বেন]
রাত কটা বাজে উর্বী জানে না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে সে। ফোনটাও দূরে কোথাও একটা ফেলে রেখেছে হয়তো।
পাশ ফিরে শোয় উর্বী। বারান্দা থেকে আসা আধো আলোতে দেখতে পায় রাওনাফ এখনও ফেরেনি। দরজা চাপিয়ে রাখা। হাত বাড়িয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে সে।
দরজা ঠেলার শব্দ হতেই উর্বী মাথা তুলে তাকায়। বাইরে থেকে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দেয় শর্মী। ঘুমে জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে,”আন্টি আসবো!”
উর্বী উঠে বসে। বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এসো।”
শর্মী চোখ ডলতে থাকে,ঢুলতে ঢুলতে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বলে,”আন্টি আমি কি তোমার সাথে ঘুমাতে পারি? আপু নেই। আমার খুব ভয় ভয় করছে।”
উর্বী হেসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,”অবশ্যই! এসো।”
শর্মী গিয়ে উর্বীর পাশে শুয়ে পরে। উর্বী শর্মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শর্মী বলে,”কেমন আওয়াজ আসছিলো আন্টি। এজন্যই আমি হরর মুভি দেখতে চাইনা। তখন ভাইয়া বললো “আয় দেখে যা। কতো ইন্টারেস্টিং। দেখে যা।” আমার এখন ভয় করছে। আমি তুলতুলকে রুমে ফেলে এসেছি।”
উর্বী বলে,”তুলতুল কে?”
_তোমার ময়না পাখির নাম রেখেছি তুলতুল।
_কিন্তু ওর নাম তো গুপি।
_গুপি কোনো নাম হলো? ওর নাম তুলতুল।
উর্বী হাসে। শর্মী উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। উর্বী শর্মীর গায়ে একটা হাত রেখে শুয়ে পরে।
কিছুক্ষণ পরে শর্মী বলে,”কয়টা বাজে আন্টি?”
উর্বী হাত বাড়িয়ে অনেক খুজে ফোনটা পেয়ে যায়,ফোনটা নিয়ে দেখে ,রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।
শর্মী বলতে থাকে,”পাপা কেনো আসছে না।”
_দুইটা তিনটা বেজে যাবে আসতে। আজ কিছু ইমার্জেন্সি কেস রয়েছে হাতে।
_জানো আন্টি। আমার পাপাকে খুব ভয় লাগে মাঝে মাঝে।
_কেন কেন?
উর্বী কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে।
শর্মী বলতে থাকে,”পাপা প্রতিদিন কত লোকের পেট কা’টে। বুক চিঁড়ে হার্ট দেখে। আমার খুব ভয় লাগে এসব কথা মনে পরলেই। ভাইয়া-আপু দু’জনেই ডাক্তার হতে চায় পাপার মতো। আমি হবো না। বাপরে বাপ!”
উর্বী হেসে ফেলে,বলে,”তা কি হবে তুমি?”
_আমি কার্টুনিস্ট হবো।
শর্মী বকবক করছে। উর্বীর ঘুম কে’টে গিয়েছে। সে একমনে শুনতে থাকে শর্মী নামের কিশোরী মেয়েটির গল্প। যেন এই গল্পগুলো শর্মী উর্বীর জন্যই জমিয়ে রেখেছিলো।
“এই আন্টি শুনছো?”
“হু শুনছি, বলো।”
_আচ্ছা আন্টি? পাপা এসে গেলে আমাকে কি ঐ রুমে পাঠিয়ে দেবে আজ? আপু তো নেই!
ভয়ে ভয়ে বলে শর্মী।
উর্বী শর্মীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। তারপর হাসতে হাসতে বলে,”না , আজ তোমার পাপাকে গেস্টরুমে পাঠাবো।”
শর্মী হাসছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। হঠাৎ খটখট আওয়াজ হতেই উর্বী আর শর্মী দুজন চুপ হয়ে যায়।
আওয়াজ টা পশ্চিমের কোনো ঘর থেকে আসছে।
শর্মী উর্বীর দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে উর্বীকে শক্ত করে ধরে বলে,”ঐ দেখো আন্টি মিথ্যা বলিনি।”
উর্বী উঠে বসে। একটু থেমে আবারও আওয়াজ হতে থাকে। শর্মী বলে,”কি করবে আন্টি?”
_দেখে আসি। চলো।
_না আন্টি আমার ভয় করছে।
_ঠিকাছে। আমি একাই যাচ্ছি। তুমি থাকো এখানে।
_না। আমি এখানে একা থাকবো না। চলো যাচ্ছি।
শর্মী উঠে বসে। উর্বী শর্মীর হাত ধরে এগিয়ে যায় ধীরপায়ে। আওয়াজ হতেই থাকে। খুব সম্ভবত আওয়াজ টা রওশান আরার ঘর থেকে আসছে। শর্মী ফিসফিসিয়ে বলে উর্বীকে,”আন্টি! কিসের শব্দ ওটা! ভয় করছে তো!”
উর্বীও ফিসফিসিয়ে বলে,”না গেলে তো বুঝতে পারবো না! চলো।”
রওশান আরার ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। দরজার সামনে এসে উর্বী দম নিয়ে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে।
মুহূর্ত কে’টে যায়। শর্মী ভয়ে ভয়ে উর্বীর পেছন থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয় সামনে।
উর্বী হতভম্ব হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। তার সামনেই কয়েক গজ দূরে, রওশান আরার সিন্দুকের কাছে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে একটা শীর্ণকায়,লিকলিকে দেখতে শরীর।
একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
***
রাওনাফকে দেখে সুমনা একটা হাসি দিয়ে বলে,”আমি জানতাম আপনি আসবেন। আমি আর ঝুমুর আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
রাওনাফ ম্লান হাসে, বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”তোমাদের পিকনিক শেষ?”
_হ্যা। খেয়েদেয়ে সবাই যে যার রুমে ঢুকেছে।
_ঠিকাছে, শায়মীকে ডেকে দাও। বলো,পাপা এসেছে।
সুমনা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”আমরা ওর খালামনি দুলাভাই। ওর নিরাপত্তা দিতে কি আমরা জানি না?”
রাওনাফ সুমনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”এই না না! একদম তেমন টা নয় সুমনা।”
_বুঝতে পেরেছি দুলাভাই। আমরা মাইন্ড করিনি।
রাওনাফ বলতে থাকে,”একটু বোঝো আমাকে সুমনা। মেয়ে দু’টো বড় হচ্ছে। ওরা নিজেদের ভালোমন্দ কিছুই বোঝে না। শুধুমাত্র হাতে-পায়েই বড় হয়েছে। এই আজ তোমাদের এই অনুষ্ঠানে রাজ্যের বাইরের লোকজন এসেছে,উঠতি বয়সের ছেলেরা সব। বাবা হিসেবে আমার চিন্তা হয়। মেয়ে দু’টো আমার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও রাতে থাকলেই আমি ভাবি এই বুঝি কোনো বিপদ ঘটে গেলো। রুমার সাথে ছোটবেলায় খুব ভ’য়ংকর একটা ঘটনা ঘটেছিল,তোমরা শুনেছো। কন্যা সন্তান বড় করা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার, চোখ কান খোলা রাখতে হয়। গা ছাড়া ভাব করলেই,কোনো না কোনো শ’কু’ন থাবা বসাতে আসে। তোমার মেয়ে বাচ্চা থাকলে বুঝতে। আজ এখানে এতো ছেলেরা আসবে জানতাম। ওরা না আসলে আমি কখনোই তোমাদের বোনঝিকে তোমাদের থেকে নিয়ে যেতাম না। এইতো কিছুদিন আগে এসে তিনদিন থেকে গিয়েছে। তখন আপত্তি করেছি? করিনি তো! আমিও মানি তোমরা ওদের নিরাপত্তা দেবে। তবে আজ নয়, আমার মন মানছে না আজ। আসবে আরেক সময়। তোমার শশুর বাড়ির দিকের আত্মীয়দের ছেলে গুলোকে আমি পছন্দ করি না। সবকটা স্পয়েল্ড চাইল্ড। এদের সাথে আমার সরল মেয়েটি রাতে এক বাড়িতে থাকবে! আমার ভালো লাগবে না! এতে মাইন্ড করলেও আমি হেল্পলেস সুমনা।”
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে রাওনাফ থামে। সুমনা তার দুলাভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝুমুর এক গ্লাস পানি রাওনাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এই নিন দুলাভাই। পানি খান। ব্যাখ্যা দিতে দিতে আপনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। আরে আমরা কিছুই মনে করিনি। সত্যি বলছি!”
রাওনাফ হেসে ফেলে। সুমনা বলে,”এতো ব্যাখ্যা দিতে জানেন আপনি! সত্যিই আমরা কিছু মনে করিনি।”
রাওনাফ বলে,”আসলে তোমাদের আপার কাছে ব্যাখ্যা, কৈফিয়ত দিতে দিতে আমি এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি এসবে। মানুষটা তো নেই। কিন্তু তার শিখিয়ে দেওয়া অভ্যাস গুলো থেকে গিয়েছে আমার মধ্যে।”
সুমনা হাসে। ঝুমুর চলে যায় শায়মীকে ডেকে দিতে। সুমনা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি পারেনও। হসপিটাল থেকে এখানে ছুটে আসলেন। ফোন করে বললেই ঝুমুরকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম আপনার মেয়েকে। এতো চাপ নিতে পারেন! অয়নের বাবা তো সবসময় বলে,”রাওনাফ ভাই এতো ফিট কিভাবে থাকে বুঝিনা। আমি তো পানি খেলেও আমার ভুড়ি বেড়ে যায়।”, তখন আমি তাকে বলি,”রাওনাফ ভাই প্রতিদিন যা কাজ করে! তুমি বছরেও তা করো না।”
রাওনাফ হাসে। সুমনা বলে,”কাজ একটু কমিয়ে দিন এখন। নতুন বিয়ে করেছেন। কমবয়সী বৌ। তাকে একটু বেশি বেশি সময় দিন।”
সুমনার কথার পিঠে রাওনাফ কোনো কথা বলে না। শায়মী চোখ ডলতে ডলতে সুমনাদের লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায়। তার পাপার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”দিস ইজ নট ফেয়ার পাপা! দিস ইজ ঠু মাচ।”
***
উর্বী ঘামছে। শর্মীকে আগলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে। শর্মী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সামনের রোগাপটকা লোকটাকে। একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরে,খালি গাঁয়ে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। জীর্ণ শীর্ণ শরীর, কৃষ্ণবর্ণের গাত্র, গাঁয়ে কোনো তরল মেখেছে সম্ভবত, চিকচিক করছে পুরো শরীর।
শর্মী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আন্টি এটা কে!”
উর্বী গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”চোর।”
চোরটা একবার উর্বীর দিকে তাকায়, একবার শর্মীর দিকে। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। পালাবার পথ নেই। সে ভাবছে কি করা যায়।
শর্মী ফিসফিসিয়ে বলে,”আন্টি ঐ লোকটা কিভাবে টের পেলো দাদুর সিন্দুকে গয়না আছে!”
উর্বী ফিসফিসিয়ে বলে,”তা আমি কি করে জানবো। ওকে জিজ্ঞাসা করো।”
শর্মী সত্যি সত্যি চোরের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার দাদুর সিন্দুকে গয়না আছে আপনি কিভাবে জানলেন? আমরাও তো জানি না।”
চোরটা হঠাৎ থ্রি-কোয়ার্টারের পকেট থেকে একটা পি’স্তল বের করে উর্বীদের দিকে তাক করে। উর্বী শর্মীকে নিজের পেছনে আড়াল করে নেয়। চোরটা ক্যানক্যানে গলায় ভৌতিক আওয়াজ তুলে বলে,”চিক্কুইর দেবা না। চিক্কুইর দেলে খবর আছে।”
উর্বী ভয়ার্ত কন্ঠে হাত উঠিয়ে বলে,”আচ্ছা আচ্ছা। আপনি আগে ওটা নামান।”
শর্মী উর্বীকে বলে,”চিক্কুইর? আন্টি হোয়্যাট চিক্কুইর? কি বলছে এই লোক!”
উর্বী তাড়াহুড়ো গলায় বলে,”এটা আমাদের বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। এর মানে চিতকার। শর্মী একটু চুপ করো এখন। আমি তোমায় পরে বুঝিয়ে বলবো।”
তারপর চোরের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কি চাই?”
চোর সিন্দুকের দিকে আঙুল তাক করে বলে,”এইডায় যা আছে সব নেতে চাই। খুইল্যা দাও। চাবি কই?”
[এটাতে যা আছে,সব নিতে চাই। খুলে দাও। চাবি কোথায়?]
_চাবি আমার শাশুড়ির কোমরে। সে বাড়িতে নেই।
উর্বী স্বাভাবিক গলায় বলে।
চোর বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”ওহ! তাইলে চুপচাপ মুখ বন্ধ কইরা খারাইয়া থাহো। আমি এইডা ভাঙমু!”
[ওহ! তাহলে মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি এটা ভাঙবো]
নাবিল ঘুম থেকে উঠে পরে। কানে হঠাৎ ঠুকঠুক শব্দ আসছিলো। হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেল। হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে সে সিড়ির দিকে এগিয়ে যায়। শব্দটা দোতলা থেকেই আসছে। সিঁড়ি যত অতিক্রম করছে,শব্দটা তত জোরালো হচ্ছে। একটা উৎকণ্ঠা চেপে বসে নাবিলের চোখে মুখে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে।
চোর এক হাত দিয়ে পি’স্তল তাক করে আরেক হাত দিয়ে রডের সাহায্যে প্রহার করে যাচ্ছে মান্ধাতার আমলের সিন্দুকের তালায়। কিছুক্ষণ পরে হাঁপিয়ে উঠে উর্বীকে বলে,”তুমি ভাইঙ্গা দাও। [তুমি ভেঙে দাও]”
শর্মী বলে ওঠে,”আন্টি কেনো ভাঙবে? আন্টি কি চোর? চোর তো তুমি!”
চোর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এক্কেরে চুপ। বড় লোকের ঢেমশি মাইয়া। পাকনা পাকনা কথা কবা না!”
[একেবারে চুপ। বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে। পাকা পাকা কথা বলবে না]
উর্বী চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,”খবরদার আমার মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলবেন না।”
চোর ঘুরে উর্বীর দিকে পি’স্তল তাক করে,উর্বী একটা ঢোক গিলে বলে,”আচ্ছা আমি ভাঙছি সিন্দুক। আপনি ওটা নিচে নামান।”
উর্বী সিন্দুক ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। চোর শর্মীর দিকে পি’স্তল তাক করে রাখে। কিছুক্ষণ বাদে শর্মী আবারও বলে ওঠে,”তুমি এটা গায়ে কি মেখেছো?”
-তৈল। খাটি সরিষার তৈল।
_তেল কেন মেখেছো?
_যাতে কেউ জাবরাইয়া ধরলে পিছলা যাইতে পারি। পলাইতে পারি।
[যাতে কেউ জাপটে ধরলে,পিছলে যেতে পারি। পালাতে পারি!]
_হোয়্যাট “জাবরাইয়া” আন্টি?
শর্মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে। উর্বী সিন্দুক ভাঙতে ভাঙতে জবাব দেয়,”জাপ্টে ধরা।”
শর্মী নাক চোখ কুঁচকে বলে,”ছিহহ! এই লোককে কে জাপটে ধরবে। গা থেকে কি দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।”
কথাটায় যেনো চোর খুবই অপমানিত হলো। শর্মীর দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে বলে,”চুপ! এক্কেরে চুপ!”
“এসব কি হচ্ছে এখানে!”
নাবিলের গলার আওয়াজে উর্বী প্র’হার থামিয়ে দেয়। চোর চ’ম’কে উঠে নাবিলের দিকে তাকায়। পাপার মতো লম্বা হয়েছে নাবিল তাই যে কেউই তাকে এখনি সুপুরুষ মনে করতে বাধ্য। সেখানে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির শীর্ণকায় চোর ঘা’ব’ড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
নাবিল হতভম্ব হয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”কেউ আমাকে বলবে হচ্ছে টা কি এখানে!”
উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে,”উনি চোর। চুরি করতে এসেছে। আমরা ওনাকে সাহায্য করছি!”
নাবিল হতভম্ব হয়ে বলে,”সাহায্য করছি মানে!”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”দেখছো না হাতে পি’স্তল। এখন কথা না বলে এসো আমাকে তালাটা ভাঙতে সাহায্য করো।”
নাবিল ক্ষে’পে চোরের দিকে তাকায়। চোর নাবিলের চাহনি দেখে ঘা’বড়ে যায়। নাবিল শার্টের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে,”কোথা থেকে উদয় হলি ছিচকে চোর ব্যাটা! তোর এই খেলনা বন্দুক সরা!”
উর্বী হতভম্ব হয়ে চোরের হাতের দিকে তাকায়। হতভম্ব হয়েই বলে,”এটা খেলনা বন্দুক?”
নাবিল বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”মাথায় তো শর্মীর ব্রেইন নিয়ে ঘোরেন আপনি। বুঝবেন কি করে কোনটা আসল পি’স্তল আর কোনটা নকল!”
চোর ঘা’ব’ড়ে গিয়ে হাত থেকে নকল পি’স্তল টা ফেলে দেয়। নাবিল হাতা গোটাতে গোটাতে এগিয়ে যায়। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি তুলে চোরটাকে সে আ’ছাড় মারবে।
চোর ত’ড়াক করে লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা চাইনিজ চাকু বের করে নাবিলের দিকে তাক করে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব উর্বী নাবিলকে সরিয়ে দেয়।
চোর ওদের দিকে চাকু তাক করে ধরে পৈ’শা’চিক হাসি দিয়ে বলে,”হেহে। এইডা কিন্তু নকল না। মিরপুরের এক মাস্টারের বাড়ি দিয়া চুরি করছি!”
উর্বী আতংকিত গলায় বলে,”তুমি চোর না ডাকাত। আগে নিজের প্রফেশন ক্লিয়ার করো।”
_আগে আল্লাম সার্কাসের বাবুর্চি। মালিক ব্যবসায় লস খাইয়া গেলো। এহন এই ধান্দায় ঢুকছি।
[আগে ছিলাম সার্কাসের বাবুর্চি। মালিক ব্যবসায় লস খেয়ে গেলো। এখন এই কাজ করছি]
_এই ভিআইপি এরিয়ায় তোমার মতো একটা ছিচকে চোর! এতো কিছু কিভাবে জানলে আমাদের বাড়ি সম্পর্কে? আমার শাশুড়ির লকারে গয়না। কিভাবে জানলে?
উর্বীর প্রশ্নে চোর হাসতে হাসতে বলে,”এগুলা মোগো জানতে অয় না। আন্দাজ করতে পারি। আর তোমার হাউরির (শাশুড়ি) ঘরে আন্দাজে ঢুকছি!
[এগুলো আমাদের জানতে হয় না। আন্দাজ করে নিতে পারি। আর তোমার শাশুড়ির ঘরে আন্দাজে ঢুকেছি।]
নাবিল ক্ষে’পে গিয়ে চোরের দিকে দুকদম এগিয়ে যায়। উর্বী পেছন থেকে নাবিলের হাত টেনে ধরে , চেঁ’চি’য়ে উঠে বলে,”চুপ করে দাঁড়াও , ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার!”
চোর চাকুটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,”তালা পরে ভাঙমু । খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দাও আগে। আর খবর দার তিড়িং বিড়িং করবা না। এক পোচ দিয়া মাথা আলাদা করমু কিন্তু!”
উর্বী ঘামছে। মনে মনে বলছে,”আপনি এখনও কেনো আসছেন না শর্মীর পাপা!”
***
শায়মী মুখ ভার করে গাড়িতে বসে আছে। রাওনাফ হেসে ড্রাইভ করতে করতে এক হাত দিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শায়মী বলে,”একদম আমার সাথে কথা বলবে না তুমি পাপা।”
রাওনাফ হাসে। নরম গলায় বলে,”সরি মামনি! আরেকদিন খালামনির বাড়িতে রাতে থেকো। আজ নয়।”
_আজ কি সমস্যা? পাপা আমি কি ছোট? তুমি এমন কেন করো! ওরা সবাই হাসাহাসি করছে।
_না তুমি ছোট নও, তুমি বড়। ইয়াং প্রিটি লেডি! সেজন্যই তো ভয়। কোন ড্রাকুলা এসে রাওনাফ করিমের প্রিন্সেস টাকে নিয়ে যায় আবার!
শায়মী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”নেক্সট উইক সিনেপ্লেক্সে নিয়ে যাবো। আমি নিজে। এখন প্লিজ মুড ঠিক করো।”
একহাতে চাকু ওদের তিনজনের দিকে তাক করে আরেক হাত দিয়ে গপাগপ ভাতের লোকমা মুখে ঠুশছে।
উর্বী, নাবিল,শর্মী তিনজন সামনে চুপচাপ বসে আছে। যতবার উর্বী চাকুটার দিকে তাকাচ্ছে ততবার একটা করে ঢোক গিলছে সে। কি ভয়ংকর চাকু!
চোর খেতে খেতে ওদের দিকে তাকায়। শর্মী বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আপনি এভাবে বিশ্রী ভাবে খাচ্ছেন কেন? ঠিক ভাবে খান। কোনো টেবিল ম্যানার জানেন না নাকি? পাপা এভাবে খেতে দেখলে আপনাকে বকতো।”
চোর বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”এই মাইয়া এতো কথা কয় ক্যা?”
উর্বী ফিসফিসিয়ে শর্মীকে বলে,”চুপ করো না!”
নাবিল বলে,”তোর বয়স কতো?”
চোর মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায় , ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”তুই তোকারি করবা না! মোর বয়স ছাব্বিশ বছর।”
_নাম কি তোমার?
নাবিল বলে ওঠে।
_পল্টু।
_তোমার শরীর এতো টিঙটিঙে কেন? খেতে পাও না নাকি? এতো চুরি করো,সেসব দিয়ে কি করো?
পল্টু খাওয়া থামিয়ে হাসে, বলে,”আমরা ইচ্ছা কইরাই গতর এই রহমের বানাই। এতে দৌড়াইতে সুবিধা হয়। ধরা পরি না সহজে।”
[আমরা ইচ্ছে করেই শরীর এরকমের বানাই। এতে দৌড়াতে সুবিধা হয়।]
সবাই চুপচাপ। নাবিল সুযোগ খুঁজছে কখন চোর একটু অন্যমনষ্ক হবে আর সে চাকুটা কে’ড়ে নেবে।
পল্টু বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”এইসব কে রানছে?”
উর্বী বলে,”আমি রেধেছি। কেনো?”
_তোমাগো দ্যাশের বাড়ি কোনহানে?
[তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়]
_বরিশাল।
_এই রান্ধন তো বরিশালের না। এক ড্যাগ ঝোল দিয়া থুইছো। এইয়া তো উত্তরবঙ্গের মাইনষে খায়। আইজ খিদা আছিলো বইলা খাইলাম। নয়তো পল্টু এইসব থার্ড কেলাস রান্ধন ছুইয়াও দ্যাহে না। সময় থাকলে তোমারে আইজ রান্ধা শিখাইয়া যাইতাম। আমি সার্কাস দলে আট বছর বাবুর্চির কাম করছি।
[এই রান্না তো বরিশালের না। এক কড়াই ঝোল দিয়ে রেখেছো। এসব তো উত্তরবঙ্গের মানুষ খায়। আজ খিদে ছিলো বলে খেলাম। নয়তো পল্টু এসব থার্ডক্লাস রান্না ছুঁয়েও দেখে না।]
নাবিল পল্টুর অন্যমনষ্ক ভাব দেখে এগিয়ে যায় দু’পা। পল্টু মাথা তুইলা বলে,”মোরে গোঙ্গা মনে হরনের দরকার নাই? ঐ হানে চুপচাপ খাড়াইয়া থাহো।”
নাবিল দাঁড়িয়ে যায়। শর্মী নীরবতা ভেঙে উর্বীকে বলে,”হোয়্যাট “গোঙ্গা” আন্টি?
উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শর্মীর সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”গোঙ্গা মানে বোকা।”
পল্টু বলে,”তোমাগো আমার খুব পছন্দ হইছে। তোমাগো একটা কথা কই। দাড়োয়ানডারে পাল্টাইবা। আসার সময় দ্যাখলাম চেয়ারে বইসা বইসা ঘুমাইতেছে। ওরে বেতন দাও কতো?”
নাবিল বলে,”পাপা জানে।”
_পাপা পাপা করবা না। যত্তোসব। আব্বা বলবা। মুসলমানের বাচ্চা আব্বারে পাপা ডাডি কইলে পাপ অয়।
সবাই চুপ। পল্টু আবারও উর্বীকে বলে ওঠে,”তুমি এই পোলাপান দুইটার কি হও?”
উর্বী কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে নাবিল বলে ওঠে,”উনি আমার পাপার ওয়াইফ।”
_ওয়াইফ কি?
_বৌ।
_তোমার আব্বার বৌ মানে? তোমাগো আম্মা?
উর্বী চুপ করে থাকে, নাবিল মাথা নাড়ায়, বলে,”আমার মা মারা গেছে।”
পল্টু অবাক হয়ে বলে,”ওও তোমগো হোতি মা?”
শর্মী উর্বীকে বলে,”আন্টি হোতি মা কি?”
উর্বী বিব্রত হয়ে নিচুস্বরে বলে,”সৎ মা।”
শর্মী চুপ হয়ে যায়। সৎ মা শব্দটা তার পছন্দ না মোটেই। সে চোরকে বলে,”উনি আমার পাপার ওয়াইফ আর আমার আন্টি। কোনো হোতি মা না। আর আপনি প্লিজ আপনার ভাষা ঠিক করুন। অর্ধেক কথা বুঝতেই পারছি না। বুঝতে না পারলে উত্তর দেবো কি?”
পল্টু শর্মীর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,”হোতি মা সবসময় খারাপ হয়না। তোমগো এই হোতি মারে ভালো মনে হইতেছে আমার। দ্যাখো ক্যামনে তোমগো আগলাইয়া রাখতে আছে। হোতি মা তো আছিলো আমার। ডেইলি মাইর খাইতাম। পাছার উপরে ঠাস ঠাস মারতো। আব্বারে দিয়া মাইর খাওয়াইতো। দশবছর বয়সে রাগে দুঃখে বাড়ি ছাড়লাম।”
কথাগুলো বলতে বলতে পলটু খুবই ইমোশনাল হয়ে পরলো। নাবিল বিরাট সুযোগ হাতে পেলো। অন্যমনষ্ক ভাব দেখে চোখের পলকে একটান মেরে পল্টুর হাতের চাকু টা কে’ড়ে নেয়। পল্টু ত’ড়াক করে লাফিয়ে ওঠে।
উর্বী সাহস পেয়ে ছুটে যায় পল্টুর কাছে। পল্টুর হাত শক্ত করে ধরে শর্মীর দিকে তাকিয়ে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”শর্মী দড়ি আনো, দড়ি আনো। এটাকে বাঁধতে হবে।”
নাবিল চাকু টা দূরে ছুড়ে মেরে পল্টুর দিকে এগিয়ে যায়। অন্যহাত শক্ত করে ধরে। পল্টু ক্যানক্যানে গলায় বলতে থাকে,”ছারো কইলাম! মোরে ছাইরা দ্যাও কইলাম।”
শর্মী ঘুরছে। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। উর্বী চেঁচাতে থাকে,”দড়ি কিচেনে তিন নাম্বার কেবিনেটে। গো গার্ল! গো।”
পল্টু এর মাঝে এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। নাবিলের হাতে কা’মড় বসিয়ে এক দৌড় লাগায় সিঁড়ির দিকে। কিন্তু তার আগেই উর্বী গিয়ে তাকে আটকে ফেলে।
***
বৃদ্ধ দাড়োয়ান মজিদ মিয়া চেয়ারে বসে ঝি’মুচ্ছে। রাওনাফ গেইটের কাছে গাড়ি থামিয়ে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে। কিছুসময় পরে মজিদ মিয়া ঘুম থেকে উঠে গেইট খুলে দেয়।
রাওনাফ গাড়ি পার্ক করে। শায়মীকে নিয়ে রওশান মঞ্জিলের সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সদর দরজার কাছে এসেই থমকে যায় রাওনাফ। শায়মী আর রাওনাফ একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বাড়ির ভেতর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছে সম্ভবত। রাওনাফ কলিং বেল টিপতে গিয়েও টেপে না। ওয়ালেট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খোলে।
দরজা খুলে রাওনাফ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। শায়মী পেছন থেকে তার পাপার শার্ট খামচে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ধীরে ধীরে মাথা বের করে সামনে উঁকি দিতেই সেও স্তব্ধ হয়ে যায়।
পল্টুকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। নাবিল আর শর্মী তার পেছনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে। উর্বী পাশেই কপালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। তার কপাল পুনরায় কে’টে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পল্টু যখন নাবিলের হাতে কামড় দিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। তখন উর্বী গিয়ে পল্টুর সামনে দাঁড়ায়। নাবিল নিজেকে সামলে নিয়ে একটা গ্লাস উঠিয়ে ছুড়ে মারে পল্টুর দিকে। কিন্তু সেটা ভুলবশত লেগে যায় উর্বীর কপালে।
পুরো বাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে আছে। লিভিং রুমের সোফা উল্টিয়ে পরে আছে। মেঝেতে স্থানে স্থানে কাঁচের টুকরো। অনেক ধস্তাধস্তির পরে পল্টুকে বাগে আনতে পেরেছে আহত উর্বী আর রাওনাফ করিমের দুই ছানা।
রাওনাফ সবাইকে অবলোকন করে হতভম্ব গলায় বলে,”হোয়্যাটস গোয়িং অন!!!!”
শর্মী উচ্ছসিত কন্ঠে বলে,”আমরা চোর ধরেছি পাপা। এই দেখো চোর।”
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কপাল কে’টেছে কিভাবে আবার!”
শর্মী বলে,”ভাইয়া গ্লাস ছুড়ে মে’রেছে।”
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকায়। নাবিল বলে,”পাপা আমি চোরকে মা’রতে যাচ্ছিলাম। ভুলে ওনার কপালে গিয়েছে। এক্সট্রিমলি সরি!”
শায়মী তার পাপার পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। উত্তেজিত গলায় বলে,”এটা চোর? তোরা তিনজন ধরেছিস?”
শর্মী বুক ফুলিয়ে বলে,”ইয়েস! আমরা তিনজন। ইট ওয়াজ সো এক্সাইটিং! তুই মিস করে গেলি আপু!”
উর্বী যন্ত্রনা ভুলে রাওনাফ করিমের অবুঝ দুই কন্যার কথোপকথন শোনে।
শায়মী বলে,”ধূর আমি আজ কেনো গেলাম খালামনির বাড়িতে! তোরা কত মজা করলি!”
শায়মীর কথায় উর্বী হাসবে না কাঁদবে কিছু বুঝতে পারছে না!
শায়মী বলতে থাকে,”এই চোর এতো বিশ্রী কেন দেখতে! ঠু ডার্ক এ্যান্ড ডার্টি। ইয়াক!”
নাবিল বলে ওঠে,”তো তুই কি আশা করেছিলি? চোর রিত্তিক রওশানের মতো দেখতে?”
শর্মী হাসতে হাসতে বলে,”না। আপু ভেবেছিলো চোর বিটিএস-এর জাংকুকের মতো দেখতে।”
শর্মীর কথায় হেসে ফেলে নাবিল,হেসে ফেলে উর্বীও। রাওনাফ অবাক হয়ে সবার বাচ্চামো দেখতে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”চুপ! চুপ করো এখন সবাই! আই শ্যুড কল দ্যা পুলিশ। আর শায়মী, এভাবে কারো বডি শেমিং করতে হয়? এসব শিখিয়েছি তোমাকে আমি? ওকেও আল্লাহ বানিয়েছেন।”
উর্বী এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভোলাভালা তিন ছানার ভোলাভালা বাপের কথা শুনে কপাল থেকে হাত সরিয়ে পেট চেপে ধরে হাসতে থাকে সে।
রাওনাফ তার দিকে তাকায়। উর্বী চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে মেঝের দিকে তাকিয়ে সে হাসতে থাকে।
চেয়ারে বসে চোর পল্টু তখনও বিড়বিড় করতে থাকে,”ছাড়ো কইলাম! মোরে ছাড়ো কইলাম!”
***
রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ টহল পুলিশ আসে । রাওনাফের সাথে কথা বলে চোর পল্টুকে নিয়ে চলে যায়।
পুলিশ চলে গেলে রাওনাফ তার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন যার যার রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। সকালে এ নিয়ে কথা হবে। যাও সবাই।”
উর্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফের তিন পুত্র কন্যাও দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ নিচুস্বরে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার ড্রেসিং দরকার। চলো।”
উর্বী ধীরপায়ে এগিয়ে আসতে নিলে দুর্ঘটনাবশত পা রেখে দেয় ভাঙা গ্লাসের টুকরোতে।
ঘটনাটা ঘটতে সময় নিয়েছে চার সেকেন্ড। কিন্তু সবাই হতভম্ব হয়ে মিনিট খানেক উর্বীর দিকে তাকিয়েই রইলো। রাওনাফ হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিড়বিড় করে মুখ থেকে তার একটা শব্দই বের হয়,”আনবিলিভেবল!”
উর্বী মুখ তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়। নাবিল,শর্মী,শায়মী তিনজনই এগিয়ে আসে। নাবিল একটা উল্টানো সোফা ঠিক করে দেয়। শায়মী ধরে ধরে উর্বীকে বসিয়ে দেয়।
রাওনাফ বলতে থাকে,”এটাই বাকি ছিলো! তবে এটা কম হয়ে গেলো মৃদুলা উর্বী! তোমার হাত দু’টো এখনও অক্ষত!”
রাওনাফের কথায় ব্যাথাতুর শরীরেও উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে চায়। রাওনাফ বলে,”দেখেছো মেঝেতে এতো কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে! তবুও আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটো।”
নাবিল তার পাপার দিকে তাকায়। তার পাপার কন্ঠে ঐ মেয়েটার জন্য উৎকণ্ঠা!
যন্ত্রনায় উর্বীর চোখ থেকে পানি বের হয়ে যায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে শার্টের হাতা ফোল্ড করে নেয়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে তার পদক্ষেপ বোঝার চেষ্টা করছে।
রাওনাফ কোনো সংকোচ ছাড়াই, অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীকে কোলে তুলে নেয়।
শর্মী পাপার দিকে হা করে একপলক তাকিয়ে সাথে সাথে নিজের চোখ চেপে ধরে। শায়মীও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিটিমিটি হাসছে। শুধুমাত্র নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে তাকিয়ে আছে।
বিব্রত, অবাক, লাজুক উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না, খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিড়ি ভা’ঙতে থাকে।
শায়মী এবার মাথা ঘুরিয়ে তার পাপাকে দেখে। শর্মী চোখ চেপে ধরলেও হাতের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ ঠিকই দেখেছে পাপা আর আন্টিকে। সে ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত নামিয়ে নেয়। শায়মী এসে আবারও শর্মীর চোখ চেপে ধরে।
নাবিল কপাল কুঁ’চ’কে ছিলো এতক্ষণ। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কপালের ভাঁজের রেখা বিলীন হয়। কোনো এক অজানা কারণে তারও একটু একটু হাসি পাচ্ছে।
***
একটু পর পর উর্বী মৃদু আর্তনাদ করে উঠছে। রাওনাফ তার পা থেকে কাঁচের টুকরো টা বের করে তার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়। তারপর পা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। রাওনাফ বলতে থাকে,”আনবিলিভেবল, তুমি নাকি ওম্যান অব থার্টি! তোমার থেকে শর্মীও বেশ স্মার্ট!”
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলে,”ব্যাথা করছে খুব?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। রাওনাফ বলে,”পেইন কিলার দিয়ে দেবো।”
উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”পা থেকে হাত সরান।”
রাওনাফ অবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বীর পা থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় তার পাশে বসে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই উর্বী বলে ওঠে,”আবার কি!”
রাওনাফ বিরক্ত হয়ে বলে,”তোমার কপালের ড্রেসিং করতে হবে। পরপর তিনবার কপালে আঘাত পেলে। একবারে কপালটাকে ফাটিয়ে কেনো বসে থাকো না?”
উর্বী বিড়বিড় করে বলে,”ওটা তো এমনিই ফাটা!”
রাওনাফ উর্বীর কথায় পাত্তা না দিয়ে মেডিসিনে চোবানো তুলো উর্বীর কপালে চেপে ধরতেই উর্বী চোখ মুখ খিচিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে রাওনাফের বাম হাত খামচে ধরে।
রাওনাফ চ’ম’কে উঠে নিজের হাতের দিকে তাকায়। উর্বীর আর্তনাদ থেমে গেলেই রাওনাফ একটানে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উল্টে পাল্টে নিজের হাতটাকে দেখে। নখের দাগ বসে লাল হয়ে গিয়েছে পুরো। উর্বী ধীরে ধীরে চোখ মেলে নিজের কীর্তি উপলব্ধি করতে পেরে লজ্জায় মিইয়ে যায়। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী দ্বিধা কাটিয়ে রাওনাফের হাত আগলে নিয়ে অপরাধী গলায় বলে,”সরি।”
চলমান…..
#নোটবার্তা: এটা পুরোটাই কাল্পনিক। যাই হোক, আমার অনেক পাঠক আছে যারা ইন্ডিয়া থেকে আমার গল্প পড়ে। তাদের বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা বোঝার কথা না। তাদের জন্য পল্টুর সংলাপের নিচে ব্যাখ্যা করে দিয়েছি।
কাল গল্প আসবে কি না নিশ্চিত না। পারলে এভাবে অবশ্যই দেবো।
আর হ্যা আমার পাঠক-পাঠিকারা যারা রাওনাফ উর্বীর রোমান্স দেখবেন বলে হাপিত্যেশ করছেন তাদের বলি,
“আপনারা এতো অধৈর্য কেনো বাপু? একটু সময় দিন না!”
আরে আরে! রাগ করে কমেন্ট না করে কই যান? একটা কমেন্ট করে যান! সুন্দর সুন্দর বড় বড় কমেন্ট!