আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_১৫ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৫
#Esrat_Ety
[শব্দসংখ্যা ৩৮০০+ বড় পর্ব! সবাই সরাসরি মেইন ফেসবুক থেকে পড়বেন]

শায়মী কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। নাবিল বুঝতে পারছে না সে শায়মীর উপর রাগ দেখাবে নাকি ওকে একটা ঠাঁটিয়ে চ’ড় মারবে নাকি ওর কান্না থামাবে।
কেন্দ্রের ভেতরে তাদের দুজনকে ঘিরে ছোটোখাটো জটলা। দুজন পরীক্ষার্থী তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রই নিয়ে আসেনি সাথে করে। দুজন পুলিশ এসে তাদের সাথে কথা বলেছে। এই মুহূর্তে নাবিল একটা কাজই করতে পারে। তার পাপাকে ফোন দেওয়া। সে পুলিশের সাহায্য নিয়ে রাওনাফকে ফোন দেয়।

রাওনাফ ফোন রিসিভ করে।
গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে নাবিল বলে,”পাপা আমি নাবিল বলছি….”

রাওনাফ তাকে কিছু বলতে না দিয়েই বলে ওঠে,”বাবা শোনো। দু ভাইবোন মাথা ঠান্ডা করে বসে থাকো, একেবারে মাথা ঠান্ডা রাখো। পড়া গুলো মনে করার চেষ্টা করো। সামারি গুলো দুজন মিলে আলোচনা করে নাও আবার। হাতে এখনো চল্লিশ মিনিট আছে। কিচ্ছু হবে না বাবা। আমি আসছি! শায়মী কি করছে?”

_কাদছে।
ওকে শান্ত করো। তোমার পাপার উপর বিশ্বাস রাখো। একটা ব্যবস্থা আমি করবোই ‌।
রাওনাফ ফোন রেখে দেয়। নাবিল শায়মীর দিকে তাকায়।
শায়মী বলে,”বিশ্বাস কর নাবিল আমি সত্যিই সব গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আমি কি করে বুঝবো ফাইল দুটো এভাবে অদলবদল হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই এটা আমীরুন খালামনির কাজ। সে আমাদের টেবিল গুছিয়েছে সকালে!”

নাবিলের এবার বোনের উপর খুব মায়া হয়, সে শায়মীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুই থাম। আজ আমি পরিক্ষা দেবোই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুই যা তোর হলে। যা।”

পাঁচ মিনিট ধরে উর্বী জ্যামে আটকে পরেছে। সে সিএনজি নিয়ে শর্টকাট রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। এখানেও জ্যাম। দশটা বাজতে আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি। ছেলে মেয়ে দুটো এখন কেমন করছে কে জানে। রাওনাফ বারবার ফোন দিচ্ছে। উর্বী তার লোকেশন জানিয়েছে। রাওনাফ এদিকেই আসছে।

দুমিনিট অপেক্ষা করে কোনো গতি না পেয়ে উর্বী সিএনজি ড্রাইভারকে বলে,”ভাই আর কতক্ষন লাগবে, তাড়াতাড়ি। একটা ছেলের গোটা একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে।”

_আপা ,আমি তো কিছুই করতে পারবো না। সামনে তাকিয়ে দেখেন কত জ্যাম। অন্তত চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট তো লাগবেই।

_এতক্ষন! অসম্ভব! আচ্ছা হেটে গেলে উত্তরা হাইস্কুল এখান থেকে কতদূর,মানে কতক্ষণ লাগতে পারে বলুন তো!

_বেশি না আপা,আধাঘন্টা,তারও কম।

উর্বী মনে মনে হিসেব করে, আধাঘণ্টা। মানে দ্রুত হেঁটে গেলে পঁচিশ মিনিটের মতো লাগবে। তার ওপর একটা বাইক রাইডার পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। সে ড্রাইভারকে বলে,”ভাইয়া আমি নামবো, আপনার কত হয়েছে?”
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলে,”একশো বিশ টাকা আপা। হেটে যাবেন?”

_না দৌড়ে।

উর্বী টাকাটা দিয়ে নেমে প্রায় ছুটতে থাকে। সে ঘামছে। তৃষ্ণায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে।

***
যুবকটি দেখছে একজন মেয়ে শাড়ি পরে আলুথালু হয়ে দৌড়াচ্ছে, মেয়েটির খোপা আলগা হয়ে এখনই খুলে যাবে। সে অবাক চোখে মেয়েটির মুখমন্ডল অবলোকন করে। গোলগাল মায়াবী মুখশ্রী, রক্তিম হয়ে আছে সৌন্দর্য। ওপাশ থেকে মোটামুটি স্পীড নিয়ে বাইক চালিয়ে আসছিলো যুবকটি। বাম দিক থেকে মেয়েটি হঠাৎ করে তার বাইকের সামনে চলে আসে। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে রাস্তার মাঝখানে আবিষ্কার করে।
মুহূর্ত কেটে যায়। একটু দূরেই রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্টে বসে মেয়েটি তার শাড়ি ঠিক করছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়ে আছে। যুবকটির পরনে সেনাবাহিনী কর্মকর্তার পোশাক দেখে কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

যুবকটি উঠে দাঁড়ায়,তার হাটু ছিলে গিয়েছে। পায়ে ভিষন যন্ত্রনা করছে। সে ধীরপায়ে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উর্বীকে দেখে। উর্বী নিজের শাড়ি ঠিক করছে। যুবক তার দিকে তাকিয়েই থাকে বোকার মতো। ভদ্রমহিলার বয়স আন্দাজ করতে পারছে না। হাত ছিলে গিয়েছে,ঠোট কেটে রক্ত পরছে। কপালেও আঘাতের চিহ্ন। যুবক বলে,”আপনি ঠিক আছেন? দৌড়াচ্ছিলেন কেনো? সু’ই’সা’ই’ড কেস?”

উর্বী ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী একবার তাকে দেখে, একবার তার বাইক।
হঠাৎ বলে,”আপনি তো ভালো স্পীড নিয়েই বাইক চালান, আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে উত্তরা হাইস্কুল পৌছে দেবেন প্লিজ?”
যুবকটি হা হয়ে উর্বীকে দেখে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটি এখনই কেঁদে ফেলবে।

***
কেন্দ্রের সামনে ভিড় জমে গিয়েছে। একজন আহত মহিলা সিকিউরিটি গার্ডের সাথে সমানে তর্ক করছে। সে ভিতরে ঢুকবেই। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড পারমিশন ছাড়া এভাবে কাউকে কেন্দ্রে এলাউ করতে পারে না। আর্মী যুবকটি মহিলার কর্মকাণ্ড কয়েক মূহুর্ত দেখে। কার জন্য এতো মরিয়া হয়ে ছুটে এসেছেন উনি? ভাই-বোন? সে এগিয়ে গিয়ে সি’কিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলে। সিকিউরিটি গার্ড তার এককথায় রাজি হয়ে যায়। উর্বী যুবকটির দিকে একবার তাকিয়ে ভিতরে চলে যায় তাকে ধন্যবাদ না জানিয়েই।

আর মাত্র সাত মিনিট বাকি। যারা ভিড় করে নাবিলদের দেখছিলো তারাও যে যার হলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মাঠে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল,শায়মী আর পুলিশ দুজন। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে ওঠে,”আরে আরে এ কে?”

নাবিল শায়মী গেইটের দিকে তাকায়। সব পরিক্ষার্থী তাকিয়ে দেখে। একটা মেয়ে শাড়ি পরে হাতে একটা ফাইল নিয়ে ছুটে আসছে। মেয়েটা আহত। ঠোঁট,কপাল বেয়ে রক্ত পরছে। মেয়েটি এদিকেই আসছে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেয়েটি হাসছে।
দর্শকরা সবাই অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে, আশ্চর্য মেয়েটি হাসছে কেনো!

নাবিল তাকিয়ে আছে।
কিছু শিক্ষকও কৌতূহলী হয়ে উকি দিচ্ছে।

নাবিলের হঠাৎ করে একটা দৃশ্য মনে পরে যায়। ছোটো বেলায় তার মা তাদের স্কুলের গেইট ঢুকিয়ে দিয়ে যায়, পরে তার মনে পরেছিল সে টিফিন বক্স দেয়নি। সে ঠিক একই ভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে,তার মুখে ছিলো প্রশস্ত হাসি। দু’টো দৃশ্যই প্রায় একইরকম।

***
রাওনাফ গেইটের কাছে গাড়ি থামিয়ে বাইরে নামে। লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখে উর্বী একটা টুলের উপর ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে।
খোলা চুল, শাড়ি আলুথালু হয়ে আছে, আহত উর্বীকে দেখে চ’ম’কে যায় রাওনাফ।
দ্রুত গিয়ে উর্বীর সামনে দাঁড়ায়,কন্ঠে উ’ৎ’ক’ণ্ঠা নিয়ে বলে,”একি হাল তোমার? কি হয়েছে? ওরা কোথায়? তুমি এ’ক্সি’ডেন্ট করেছো?”

_আমি ঠিক আছি, একেবারেই ঠিক আছি। নাবিল শায়মী যে যার হলে ঢুকেছে। আর চিন্তা নেই।
হাঁপাতে হাঁপাতে একনাগাড়ে বলে উর্বী!

রাওনাফ দেখছে উর্বীর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

_তুমি চলো, তুমি ঠিক নেই। তোমার ফার্স্ট এইড দরকার। চলো।

উর্বী বলে,”যাবো। আগে কিছুক্ষণ বসি এখানে। খুব ক্লান্ত আমি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর পাশে বসে পরে।
মুহূর্ত কেটে যায়। উর্বী আশেপাশে তাকায়।

“কাউকে খুজছো?”
রাওনাফ বলে।

_হু, জানেন। আজ এক লোক আমায় সাহায্য করেছিলো এখানে আসতে। আমি তাড়াহুড়োয় তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গিয়েছি।

_ওহহ এই ব্যাপার। তা পরে যদি দেখা হয় দিয়ে দেবে না হয়।

_আবার কিভাবে দেখা হবে?

_পৃথিবীটা গোল। দেখা হতেই পারে।

উর্বী একটু পরপর চিৎকার দিয়ে উঠছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষ’ত। ওষুধ লাগাতেই পুড়ে যেতে চাইছে। রাওনাফ নার্সের থেকে ওষুধ কে’ড়ে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”দেখি আমাকে দাও। সামান্য ওষুধ লাগাতেও এতো হিমসিম খাচ্ছো।”

_স্যার,ম্যাম বারবার নড়ছে।

_আচ্ছা আমি দেখছি।

রাওনাফ এসে উর্বীর সামনে বসে। উর্বী আর্তনাদ করে বলে,”হয়েছে অনেক হয়েছে,আর ওষুধ লাগাতে হবে না। এমনিই সেরে যাবে।”

_চুপ করে বসো, নড়লে আরো বেশি ব্যাথা পাবে।

_আরে আমি বলছি আপনাকে, আমার ক্ষ’ত এমনিতেই সেরে যায়। আগে ব্যাথা পেলে কিংবা ছিলে গেলে আমি একটু বন পাতার রস লাগিয়ে নিতাম। ব্যাস চলে যেতো।

_এটা বন পাতার রস লাগানোর মতো ক্ষত নয়। আর বন পাতা কি?
রাওনাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে।

_আছে একটা জংলি পাতা। দেখাবো আপনাকে।

রাওনাফ উর্বীর ব্যান্ডেজ করে দেয়।

_আজ তোমার স্টামিনা দেখে আমি অবাক হয়েছি! না মানে হুট হাট জ্ঞান হারিয়ে ফেলো কি না!
নিচু স্বরে রাওনাফ বলে।

উর্বী জবাব দেয় না। রাওনাফ বলে,”তোমার এবারের চাকরি টা বোধহয় আমার জন্য চলে যাবে মৃদুলা উর্বী, আমার বাচ্চাদের জন্য!”

উর্বী মাথা নিচু করে ছিলো, সেকথার উত্তর না দিয়ে বলে ওঠে,”আচ্ছা ওদের তো তিনঘন্টা পরিক্ষা। সময় তো হয়ে গিয়েছে। আনতে যাবেন না?”

_হু যাবো, তুমি এখানে শুয়ে রেস্ট নাও। এখন তো হাটতেও পারবে না। কিছুক্ষণ থাকো। আমি ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তোমায় নিয়ে যাবো।

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করতে থাকে। উর্বী তার দিকে তাকায়, বলে ওঠে,”কিছু বলবেন?”

_থ্যাংকস মৃদুলা উর্বী।

বাক্যটা উচ্চারিত হতে যতক্ষন সময় লেগেছে রাওনাফের কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে তত সময় লাগেনি।

উর্বী বসে থাকে চুপচাপ, মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে।

***
রওশান আরার টেনশন হচ্ছে খুব। সেই যে উর্বী বের হলো এখনো আসছে না। ফোন দিলেই বলছে এসে জানাচ্ছি। ফোনে বললে কি অসুবিধে? এদিকে সামিউল বাড়িতে নেই,অন্তরাও কেমন হাসফাস করছে,মেজো বৌও তো চট্টগ্রাম। রওশান আরা খুব একটা বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। তবে আমীরুনকে দিয়ে বারবার খোজ নিচ্ছে। নাবিল শায়মীর পরীক্ষা কেমন হয়েছে কে জানে। টেনশনে সব ভুলে যায়নি তো!

রাওনাফ গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে সবাই এক্সাম দিয়ে বের হচ্ছে। তার ছেলেমেয়ে দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে। হঠাৎ দূরে দেখতে পায় নাবিল শায়মীকে। ওরা এদিক ওদিক দেখছে। তাদের পাপাকেই খুঁজছে সম্ভবত।
রাওনাফ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে থাকে তাদের।
নাবিল শায়মী তাদের পাপাকে দেখতে পায়। দুজনেই প্রায় দৌড়ে আসে।

_কি হয়েছে? কেমন হয়েছে? সবকিছুর আন্সার করেছো তো? ঘাবড়ে যাওনি তো?

_আরে পাপা,একটা একটা করে জিজ্ঞেস করো। আমার এক্সাম খুবই ভালো হয়েছে পাপা। নাবিল তোর কেমন হয়েছে?
শায়মী জিজ্ঞেস করে নাবিলকে।

_এক্সাম কেমন হয়েছে সেটা রেজাল্টেই বুঝবি। ঘ্যান ঘ্যান করিস না।আজ তোকে বাড়ি গিয়ে বুঝাচ্ছি। বেকুব মেয়ে একটা।
দাঁত খিচিয়ে বলে নাবিল।

শায়মী মুখ কালো করে বলে,”একে তো নিজের জিনিস নিজে ক্যারি করতে পারিস না তার উপর আমাকে বকছিস ভুলের জন্য,আমি কি করে বুঝবো ফাইল দুটো অদলবদল হয়ে যাবে?”

রাওনাফ তার ছেলেমেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ব্যস ব্যস ব্যস।এনাফ! এখন বাড়ি চলো। নিজেদের আরো স্মার্ট এবং স্মার্ট বানাতে হবে বুঝলে। ওঠো গাড়িতে। আব্দুল তোমাদের নিয়ে যাবে।

_কেনো পাপা,তুমি যাচ্ছো না?
জিজ্ঞেস করে নাবিল।

_না তোমার আন্টিকে হসপিটাল থেকে পিক করতে হবে। ওখানে তার ড্রেসিং হয়েছে।

_বেশ তো আমরাও যাই চলো।
শায়মী বলে ওঠে।

রাওনাফ শায়মীর দিকে অবাক চোখে তাকায়।
শায়মী বলে,”চলো পাপা। আন্টি দেখলাম খুব আ’ঘাত পেয়েছে। তাড়াহুড়োতে কিছু জানতেই পারলাম না। কি হয়েছিলো পাপা?’
_বাইকের সাথে এ’ক্সি’ডেন্ট করেছে দৌড়াতে গিয়ে।

নাবিল তার পাপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যস্ত রাস্তায় কেউ শাড়ি পরে দৌড়ায় ! এই মহিলাকে নাবিলের কখনোই স্বাভাবিক মনে হয়নি। এই মহিলা সত্যিই অস্বাভাবিক।

***
সবাই উর্বীর দিকেই তাকিয়ে আছে। এদিকে যে দুজন পরিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কারো হুশ নেই।

রওশান আরা চেঁ’চি’য়ে বলে,”একি! একি হাল! কি হয়েছে বৌমার?”

_মা কিছু হয়নি,ছোট্টো একটা এক্সিডেন্ট,আমি ঠিক আছি।
উত্তর দেয় উর্বী।

_ এটা ছোটো এক্সিডেন্ট? কখন হলো? কিভাবে হলো?

_মা এটা কিন্তু ঠিক না। দেখছেন দুজন পরিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আর আপনি আমায় নিয়ে পরে আছেন!

রওশান আরা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে,বলে,” ওদের পরিক্ষা কেমন হয়েছে তা আমি জানি। ওরা রাওনাফ করিমের ছেলে মেয়ে।”

উর্বীকে রাওনাফ বলে,”এখন তুমি রেস্ট নাও”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ তার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে,

_শায়মী, নাবিল তোমরাও ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো। আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি। তারপর কোয়েশ্চন পেপার দেখবো তোমাদের!

নাবিল ওর নিজের রুমে চলে যায়। উর্বী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চায় কিন্তু পায়ে খুব ব্যাথা। শায়মী এসে তাকে ধরে,”দেখি আন্টি।আপনি আমার সাথে আসুন।”

উর্বী শায়মীর মুখের দিকে তাকায়। এই মেয়েটা তাকে ধরেছে।

রওশান আরা তাকিয়ে আছে সেদিকে তার কাছে সে দৃশ্য ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে।

শর্মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

_এই মেয়ে তুমি হাসছো কেনো?
উর্বী শর্মীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে।

_কিছু না,এমনিই।

_বলতে বলেছি আমি!
ধমকের সুরে বলে উর্বী।

_জানো আন্টি। তোমাকে একেবারে মিশরের মমিদের মতো লাগছে। পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা। দ্যা মাম্মি রিটার্নস!

খিকখিক করে হাসতে থাকে শর্মী।

উর্বী হেসে ফেলে। এই বাচ্চা মেয়েটা এত্তো কথা জানে। অথচ প্রথম প্রথম কেমন গম্ভীর সাজার ভান ধরে থাকতো‌।

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উর্বী হাত বাড়িয়ে শর্মীকে কাছে টেনে নেয়। নিজের কোলের উপর মাথা টা রেখে চুলে হাত বোলাতে থাকে।
শর্মীর সে আদরে কেমন শান্তি শান্তি লাগে। সে চোখ বন্ধ করে নেয়। কিশোরী অবুঝ মন কল্পনায় দেখে সে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। কি নরম হাত! কি সুন্দর গন্ধ। যে হাতটা তার মাথায় বিলি কাটছে সেটা কি চমৎকার আরাম দিচ্ছে।

বিছানার উপরে সেই দৃশ্যটা দেখে রাওনাফ দাঁড়িয়ে পরে। তারপর নিশ্চুপ হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিরক্ত করে না উর্বী আর শর্মীকে।

***
আক্তারুজ্জামান উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”গত রবিবার আসার কথা ছিলো আপনার!”

_আসলে এতো ব্যস্ত!
উর্বী নিচুস্বরে জবাব দেয়।

_গুড! ব্যস্ত থাকা ভালো, নিজেকে ব্যস্ত রাখা ভালো। এমন ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন যাতে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসার প্রয়োজনই না পরে। অবশ্য তাতে আমার ইনকাম কমে যাবে।

আক্তারুজ্জামান হো হো করে হাসতে থাকে কথাটি বলে। উর্বী চুপ করে বসে থাকে। আক্তারুজ্জামান নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে,”চলুন তবে শুরু করি। আজ আপনাকে কিছু টাস্ক দেবো।”

***
উর্বীর কাছে মনে হচ্ছে এই ব্যস্ত নগরীর সবথেকে সুন্দর স্থান হচ্ছে নীলক্ষেত। চারিদিকে শুধু বই আর বই। তার ইচ্ছে করছে বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।

শর্মীর জন্য সে জাফর ইকবালের দুটো সাইন্স ফিকশন নিয়েছে। শায়মীর জন্য কি কিছু নিয়ে যাবে? পরীক্ষা শেষ দুজনের। ওদের পরীক্ষার সময় সবাই ওদের কিছু না কিছু দিয়েছে,শুধু উর্বীই দেয়নি।

আচ্ছা হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা বই নেওয়া যায়। উর্বী কিছুক্ষণ ভেবে মনে মনে বলে, না বাবা থাক, ওই লোকের বই দিয়ে কাজ নেই। কিশোরী বয়সে ওই লোকের বই পড়লে মেয়েদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
উর্বী ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে কিছু না পেয়ে সে বই বাদ দিয়ে অন্য কিছু দেবে বলে ভাবে। কিন্তু কি দেবে?

উর্বী আড়ং-এ যাবে বলে ঠিক করে। সব বড়লোকের ছেলেমেয়ে,আড়ং থেকে কিনলে নিশ্চই পছন্দ হবে।

উর্বী ঘুরেঘুরে সব দেখতে থাকে। প্রত্যেকটা জিনিসের প্রাইজ ট্যাগে চোখ বুলিয়েই সে সেটা যথাস্থানে রেখে দেয়।
ঘুরতে ঘুরতে উর্বীর চোখ আটকে যায় একটা ড্রেসে। অসম্ভব সুন্দর একটা ড্রেস। একেবারেই শায়মীকে মানিয়ে যাবে।

শায়মীর জন্য ড্রেসটা কিনে উর্বী জেন্টস পয়েন্টের পাশ দিয়ে হাটতে থাকে। তার চোখ খোঁজাখুঁজি করছে। নাবিলের জন্য কি নেওয়া যায় ! হঠাৎ-ই একটা পাঞ্জাবি দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে হাত বুলিয়ে দেখে পাঞ্জাবিটা, একেবারে মসৃণ আর আরামদায়ক। উর্বীর ইচ্ছা করছে এটাই নিয়ে নিতে। দেখে তো মনে হচ্ছে সাইজ ঠিকই হবে। কিন্তু প্রাইজ টা আগে দেখে নিতে হবে। উর্বী উল্টে পাল্টে প্রাইজ ট্যাগ খুঁজতে থাকে।
একজন স্টাফ এসে বলে,”এনি প্রবলেম ম্যাম?”

_আসলে এটার দাম টা জানতে চাই। কোনো প্রাইজ ট্যাগ খুজে পাচ্ছি না।

_ম্যাম,এটার প্রাইজ জেনেও কোনো লাভ নেই,এটা অলরেডি সোল্ড আউট। সরি।

উর্বী বিষন্ন ভঙ্গিতে পাঞ্জাবীটার দিকে তাকায়।

“আপনি চাইলে নিতে পারেন। এটা আমি নিচ্ছি না।”

ভারি এবং হাস্কি পুরুষালি কন্ঠস্বর। উর্বী ঘার ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কন্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগলো। ভদ্রলোক মুখে মাস্ক পরে আছেন।

উর্বী বলে,”সরি আমি বুঝতে পারছি না। আপনি আমায় বললেন?”

_জ্বি আপনাকে, এটা আপনি নিতে পারেন। আমি অর্ডার ক্যান্সেল করে ফেলেছি।

লোকটা উর্বীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। উর্বীর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। পাশ থেকে স্টাফ লোকটি বলে,”তাহলে তো ভালোই হলো ম্যাম। এটার দাম মাত্র ২৯০০ টাকা।”
উর্বী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ২৯০০ টাকা মাত্র !

লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে। উর্বী মিনমিন করে স্টাফকে বলে,”ঠিকাছে আপনি এটা প্যাক করে দিন।”

স্টাফ লোকটি চলে যায়। উর্বী তার সামনে মাস্ক পরে থাকা লোকটিকে বলে,”আমি কি আপনাকে চিনি?”
লোকটি হেসে ফেলে। বলে,
“চিনলেও চিনতে পারেন,যদি আপনার মেমোরি ভালো হয়।”

এরপর সে মাস্ক টি খুলে ফেলে। উর্বী তাকিয়ে আছে। এ তো সে,যার বাইকে তার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।

উর্বী বলে,”আপনিই সেই লোক না?”
ছেলেটি বলে,”এইতোহ। আপনার মেমোরি তো দেখছি খুব ভালো। এভাবে একজন পথচারীর কথা মনে আছে।”
উর্বী হেসে বলে,”আপনাকে সেদিন তাড়াহুড়োয় ধন্যবাদ দিতে পারিনি। আমার ছেলেমেয়ের পরিক্ষা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো আসলে।”

ছেলেটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আপনার ছেলে মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে? ”
উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়। যুবকটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েই থাকে।

***
উচ্ছাস রাগে ফুঁসছে। উর্বীর আগের নাম্বার টা বন্ধ। বেয়াদব টা নাম্বার বন্ধ করে রেখেছে ! নাম্বার বন্ধ করেই ভেবেছে তার থেকে পালাবে। এত্তো সোজা? বোকা মেয়ে! আজীবন বোকাই থেকে যাবে।

***
সামনে জাহাঙ্গীর। উর্বীর ইচ্ছা করছে কোথাও পালিয়ে থাকতে। এই লোকটা তাকে পেলেই রাজ্যের মশকরা শুরু করে দেয়। উর্বীর অসহ্য লাগে সেসব। সেদিন বাড়িতে গিয়ে সবার সামনে দাঁত বের করে বলে,”ভাবি নকশী কাঁথা কার জন্য বানাচ্ছেন? নতুন অতিথি আসছে নাকি!”
তারপর রাওনাফের কানে ফিসফিস করে কি যেনো বললো।

অসহ্য! সে কি জানে না এ বাড়িতে অন্তরার বাচ্চা হবে !

উর্বী পালাতে পারে না। জাহাঙ্গীর তাকে দেখেই চিতকার দিয়ে ওঠে।
“ভাবি! এদিকে আসুন। এদিকে।”
উর্বী আশ্চর্য হয়ে যায়, এটা তো হসপিটাল। এভাবে কেউ চেঁচায়?

সে দাঁড়িয়ে পরে, জাহাঙ্গীরের পেছন থেকে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা উঁকি দেয়, বলে,”আরেহ ভাবি যে। রাওনাফ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি”
উর্বী মনে মনে বলে,”ব্যাস হয়ে গেলো। এক রামে রক্ষে নেই,লক্ষন তার দোসর।”
উর্বীর কাছে জাহাঙ্গীরের থেকে তার বৌকে বেশি ভয় হচ্ছে। এই মহিলা চোখ টিপি দিয়ে এমন এমন সব মজা করে উর্বীর হাড় ঠান্ডা হয়ে যায় পুরো।

সে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলে,”কেমন আছেন আপনারা? সব ভালো?”
_আমরা তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার খবর কি? রাওনাফের কাছে এসেছেন কেনো? দুজনে ঘুরতে টুরতে যাবেন না কি?
উর্বী বিব্রত হয়ে বলে,”না মানে কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। হসপিটাল কাছেই ছিলো তাই ভাবলাম আসি। উনিই বলেছিলো,আমার কিছু টেস্ট করাতে হবে।”

_কেনো কেনো? কি টেস্ট ভাবি? কি ব্যাপার?
দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী।

উর্বী মিতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়, সামান্য এই ব্যাপারটাকে নিয়েও এদের ডাবল মিনিং বের করতে হবে!

সে বলে,”কিছু না,কদিন থেকে জ্বর আসছে আর চলে যাচ্ছে। তাই আর কি।”

মিতা কনুই দিয়ে জাহাঙ্গীর কে খোঁচা দিয়ে বলে,”কি হলো। আসল কথা বলো।”

জাহাঙ্গীর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,
_ওহহ হ্যা। ভাবি আমরা এসেছিলাম একটা কাজে। রাওনাফকে তো বলেছিলাম,ও হয়তো আপনাকে এখনো বলেনি। আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাচ্ছি। সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। মোট ছয় ফ্যামিলি যাচ্ছি। উইদাউট বাচ্চা কাচ্চা। রাওনাফকে অনেক জোর করেও রাজি করাতে পারিনি। এখন যাচ্ছি চাচী আম্মার কাছে। সেই পারবে।

***
নিজের ঘরে এসেই নাবিলের চোখে পরে তার বিছানার উপর একটি সুন্দর পাঞ্জাবী। সে হাত বুলিয়ে দেখে। ভীষণ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি।কে কিনেছে? তার পাপা? পাপাই হয়তো। পাপা তো প্রায়ই কিছু না কিছু কিনে এভাবে রেখে যায়। নাবিলের বেশ পছন্দ হয়। সে পাঞ্জাবী টা সাথে সাথে পরে নেয়। একেবারেই মসৃন। সত্যিই পাপার পছন্দ আছে!

রাওনাফ নাবিলকে দেখে বলে,”লুকিং গ্রেট বেটা।”

_থ্যাংকস পাপা।

_কখন নিলে? আড়ং এর মনে হচ্ছে।

নাবিল অবাক হয়। খাবার টেবিলে সবাই চুপচাপ। নাবিল বলতে থাকে, “কখন নিলে মানে? এটা তুমি আমায় দাওনি?”

_না তো,আমি দিইনি।

_তবে!

শর্মী পাশ থেকে বলে,”এটা আন্টি কিনেছে তোমার জন্য ভাইয়া। আপুকেও একটা ড্রেস দিয়েছে। ভীষণ সুন্দর! আমাকে দিয়েছে অনেকগুলো বই।”
নাবিল উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী চুপচাপ খাচ্ছে। নাবিল কিছু বলে না। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই উর্বীকে ভিষন সমঝে চলে সে। তবুও উর্বীর দেয়া পাঞ্জাবিটা পরে থাকতে তার ইচ্ছে করছে না। তার ধারণা উর্বীর দেওয়া পাঞ্জাবি পরে থাকা মানে উর্বীকে মাম্মার যায়গা দিয়ে দেওয়া। নাবিল তা করবে না।

কিছু না বলে নাবিল উঠে নিজের ঘরে চলে যায়।

উর্বী চুপচাপ খেতে থাকে। তার চোখ মুখ স্বাভাবিক। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে। খেতে খেতে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একি আপনারা বসে আছেন কেনো? খাচ্ছেন না কেনো সবাই? শর্মী খাও!”

***
উর্বীকে রুমে কোথাও না পেয়ে রাওনাফ বারান্দায় চলে আসে। উর্বী অন্ধকারে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

“উর্বী”
রাওনাফের ডাক শুনেই উর্বী চমকে ওঠে।

“ভয় পেয়েছো? আ’ম সরি। তুমি এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

_এমনিই।

রাওনাফ কিছু বলার আগেই উর্বী বলে ওঠে,” মিতা ভাবি ফোন দিয়েছে অনেকবার। ”

_আর বোলো না,আমাকে পাগল করে ছাড়বে। এখন আবার মাকে ধরেছে। মা ওদের কেনো লাই দিচ্ছে বুঝি না। পাঁচ মিনিট আগে ফোন দিয়ে সব কনফার্ম করে ফেলেছে।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”সে হয়তো চাচ্ছে তার ছেলে আর ছেলের বৌ একে অপরের প্রেমে পড়ুক। তাই একটু নিড়িবিলিতে পাঠাতে চাচ্ছে।”

উর্বীর মুখে এমন কথা শুনে রাওনাফ বিব্রত হয়। কেশে বলে,
“আচ্ছা আমি যাই হ্যা।”

রাওনাফ রুমের ভেতর চলে যায়।
উর্বী মুখে আঁচল দিয়ে হাসতে থাকে। এতো সামান্য কথায় এতো লজ্জা কিভাবে পায় একজন পুরুষ? সে কি রাওনাফকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে নাকি! আজব লোক!

হাসতে থাকে উর্বী। হাসতে হাসতেই তার মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে একদৃষ্টে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নাবিল চোখ বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। রওশান আরা এসে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। নাবিল উঠে বসে, রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”ওও দাদু তুমি ! এসো। কিছু বলবে?”

_না তোকে দেখতে এলাম। তোর সাথে একটু গল্প করতে এলাম।

রওশান আরা বসে পরে। নাবিল চুপ করে আছে।

_তোর কি রাগ পরেছে?

_রাগ? আমি কেনো রাগ করবো? দাদু প্লিজ। ওনার গল্প করতে আসলে তুমি যেতে পারো।

রওশান আরা বলে,”দাদুভাই একটা কথা বলতো!”

_কি!

_উর্বীকে এতদিন ধরে দেখছিস। তোর কেনো ওর উপরে এতো রাগ?

নাবিল কোনো উত্তর দেয়না।
রওশান আরা বলতে থাকে,
_তুই ভয় পাচ্ছিস যে ও রাওনাফকে তোদের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তোদের মায়ের জায়গা নিয়ে নেবে। কেউ কি কারো যায়গা কখনো নিতে পারে দাদু?

নাবিল ধীরে ধীরে বলে,”তুমি কেনো এমন টা করলে দাদু। পাপার সাথে ওনার বিয়ে দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিলো?”

_না দরকার ছিলো না। পুরোটাই হয়েছে আমার খেয়াল খুশির জন্য। আমি মানি। কিন্তু আমি পরে অনেক ভেবেছি, উর্বীর সাথে তোমার পাপার বিয়ে দেওয়াটা ছিলো আমার সঠিক সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি।
তোমার পাপা খুবই ভালো মানুষ। আর উর্বীও একটি চমৎকার মেয়ে। ভালোয় ভালোয় মিলেমিশে গেলে কি হয় জানো তো দাদু? সবকিছু ভালো হয়ে যায়। এই সংসারটা কখনোই আর ছন্নছাড়া হবে না। আমি নিশ্চিত। উর্বী হতে দেবে না।

_তুমি ওই মেয়েটির নামে অন্ধ হয়ে গিয়েছো দাদু।

রওশান আরা হাসে,”অন্ধ ঠিক না দাদু। উর্বীর মধ্যে আমি আরেকটা রওশান আরা দেখি।”

_রওশান আরা খুব ভালো কোনো মহিলাও নন। সবাইকে সবসময় জোরজবরদস্তি করে রওশান আরা।

রওশান আরা নাতীর কথায় হাসে, বলে,”তোমরা একদিন যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে,এ বাড়ি খালি হবে। আমি মরে যাবো। তখন তোমার পাপার অবস্থা কি হবে তুমি ভেবেছো কখনো? জীবন এভাবে কাটতে পারে না দাদু। একজন কাছের মানুষ খুবই দরকার,নিজের মানুষ। একদিন তুমি বুঝবে দাদু। এখন তুমি সেটা বোঝার পরিস্থিতি তে নেই।

_হ্যা সেজন্য বুড়ো বয়সে এসে বিয়ে করতে হবে। তা তুমি বসে আছো কেনো? তুমিও একটা বিয়ে করে নাও। নিজের লোক বানাও‌ একটা।
রওশান আরা হেসে বলে,
_আমার জন্য তো তুমি আছোই দাদু। নিজের লোক।
নাবিল হেসে ফেলে।
_ভাত খাবে না দাদু? তোমার নতুন মা তোমার জন্য টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছে।
নাবিল আড়চোখে তাকায়। রওশান আরা হাঁসি চাপিয়ে আছে।
নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”আমি কি আজ ওনার সাথে বেশি বাজে ব্যাবহার করেছি দাদু? ওনাকে কি ভালো করে থ্যাংকস বলা উচিত ছিলো?”
_মিথ্যে কথা বলবো না দাদু। তবে তুমি এমনটা না করলেও পারতে।
হুট করে তোমার ওভাবে চলে আসি উচিত হয়নি।

_আমার কি তাকে সরি বলা উচিৎ দাদু?

রওশান আরা তাকিয়ে আছে নাবিলের দিকে। নাবিল নরম হয়ে জানতে চাইছে।

রওশান আরা নাতীর দিকে চুপ করে তাকিয়েই থাকে। নাবিল বলতে থাকে,”কিন্তু আমি কখনোই আমার মাম্মার জায়গা অন্য কাউকে দেবো না দাদু। আমি শর্মী আর শায়মী নই।”

***
“ভাবি এদিকে আসেন এদিকে! আপনি ভাইয়ের পাশে বসেন। পেছনে বসছেন কেনো?”

উর্বী মিতার দিকে তাকায়, তারপর রোবটের মতো এসে রাওনাফের পাশে বসে। তারা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

গাড়িতে মিউজিক চলছে। সবাই হৈ হৈ করছে। চুপ করে আছে শুধু রাওনাফ এবং উর্বী।
উর্বী মনে মনে ভাবে,”কে বলবে এদের বয়স হয়েছে। এখনই এত ফুর্তিবাজ। না জানি কলেজ জীবনে কি করেছে।”
আড়চোখে একপলক রাওনাফের দিকে তাকায় সে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা পড়ছে সে। উর্বী মনে মনে হাসে। এই ডাক্তারদের পড়াশোনা কখনোই শেষ হয় না!

উচ্ছাস হাসছে।
“ভাই হাসছেন কেনো?”
সজীব অবাক হয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে আছে।

_ব্যাপারটা কেমন সিনেমেটিক হয়ে গেলো। আমার প্রেমিকা সামনের গাড়িতে তার স্বামীর পাশে বসে আছে। আর আমি হন্য হয়ে তাদের ফলো করছি। আমায় আবার ফলো করছে আমার শত্রু। এরকম একটা সিনেমা মনে হচ্ছে যেন দেখেছি।

সজীব চুপ করে আছে। তার ভীষণ ভয় লাগছে। এতবার করে বলেছে এতো রি’স্ক নিয়ে লাভ নেই। কে শোনে কার কথা! এই শু’য়ো’রের বাচ্চা মামুন আবার তাদের ফলো করছে কেনো! ভাই নিজের জন্য কোন বিপদ ডাকতে চলেছে কে জানে!

রাত ন’টা নাগাদ তারা সেন্টমার্টিন পৌঁছে যায়। তারা সবাই উঠেছে সেন্টমার্টিনের সুপরিচিত ব্লু-প্যারাডাইজ রিসোর্টে।
সবাই খুব ক্লান্ত। সবাই মিলে ঠিক করেছিলো রিসোর্টে পৌছেই আগে রেস্ট নেবে,তারপর খাওয়া-দাওয়া।
উর্বীদের জন্য ঠিক হয়েছে ৪০৪ নাম্বার রুম। সবাই সবার লাগেজ নিয়ে সবার রুমে যাচ্ছে। রাওনাফ রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে এসেছে। তারা রুম বয়কে অনুসরণ করে নিজেদের রুমের দিকে এগোচ্ছে। উর্বী তার স্বামীর পিছু পিছু হাটছে। সে ধারনাও করতে পারছে না এই রিসোর্টেই রুম নাম্বার ৪১২-তে তার জন্য অপেক্ষা করছে কেউ।

চলমান…..

#আপনাদের গঠন মূলক মন্তব্য একান্ত কাম্য। আমি লিখতে অনুপ্রেরণা পাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here