আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_১৪ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৪
#Esrat_Ety

রওশান আরা একপ্রকার জোর করেই উর্বীকে নিয়ে বিকেলে রওনা দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
লুৎফুন্নাহার কাঁদছেন।
উর্বী তার কাছে গিয়ে বলে,”বিয়ে দেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করতে,এখন মেয়ে শশুরবাড়িতে যাচ্ছে বলে কাঁদছো! এক কাজ করো তারচেয়ে আমাকে ডাক্তারের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলেই পারো। আজীবন আর কাঁদতে হবেনা।”

তহুরা চ’ম’কে উঠে উর্বীর দিকে তাকায়। কি সর্বনেশে কথা ! লুৎফুন্নাহার চোখ মুছে ফেলেন। বলেন,”অনেক কপাল করে এমন শাশুড়ি পেয়েছিস। আর এমন ফালতু মজা করবি না কখনো।”

উর্বী বিড়বিড় করে বলে,
_হ্যা তা ঠিক। কপাল করে শাশুড়িটাই পেয়েছি।
তহুরা ব্যস্ত হয়ে পরে। সে উর্বীর শশুর বাড়ির জন্য নানা রকমের পিঠা প্যাক করে দিতে থাকে। লুৎফুন্নাহারের আদেশে রাওনাফের জন্য আলাদা করে সব দেয়।

উর্বী বলে,”এসব করতে হবে না ভাবী, সে এসব খায় না। শুধু শুধু কষ্ট করবে না।”
_খাবে,তুই শুধু সামনে রাখিস।

উর্বী ভাবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে যায়।

রেডি হয়ে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। উপমা হাতের ফোনের স্ক্রিনের থেকে চোখ সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”অনেক্ষণ ধরে দেখলাম আপু। আমার স্বামীর থেকে তোর স্বামী বেশিই সুন্দর।”

উর্বী হাসতে হাসতে বিছানার একপাশে বসে মজার ছলে বলে,”সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

_মোটেও না। আসিফ মটুর থেকে রাওনাফ ভাইয়া সুন্দর!

উর্বী উপমার বাচ্চাসুলভ কথা শুনে হাসতে থাকে। উপমা বলে ওঠে,”ঐ উচ্ছাসের থেকেও সুন্দর।”
বাক্যটা উচ্চারণ করেই উপমা জিভ কাটে। মুখ ফসকে এটা কি বলে ফেলেছে সে!
উর্বীর চোখে মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে যায়। উপমা বোনের দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,”সরি আপু!”

উর্বী উঠে দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে।

***
নাবিলের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে উর্বী বারবার উঁকি দিচ্ছে। বিষয়টি নাবিল খেয়াল করেছে। সে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। যদি এই মহিলা এখান থেকে না সরে তাহলে সে আজ অনেক কঠিন কথা শোনাবে।
উর্বী বাইরে থেকে বলে,”নাবিল,আমি একটু আসবো?”
_না।
ঠান্ডা ভাবে বলে নাবিল। উর্বীর নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। এভাবে মুখের উপর না করে দিলো? এই ছেলেটি আসলেই ত্যাদোর। এর মা কি এমন ছিলো? রাওনাফকে দেখে তো এমন মনে হয় না। বোধ হয় এই ছেলেটি তার দাদীর মতো হয়েছে।
তার জেদ চেপে গিয়েছে। আজতো এই ছেলেকে পিঠা খাইয়েই যাবে।

সে বলে,” নাবিল মালপোয়া খাবে ?”
_না। আপনি প্লিজ যান এখান থেকে।
উর্বী ভেতরে ঢোকে। তার হাতে এক ট্রে ভর্তি পিঠা।
নাবিল উঠে দাঁড়ায়।

উর্বী বলতে থাকে,
_এই নাও। পিঠা খাও। আমার মা তোমার নানু হয় তাই না? তোমার নানু বানিয়েছে। শুনলাম তোমার পিঠা খুব পছন্দ।
_ আচ্ছা আপনি কি কানে শুনতে পাচ্ছেন না? আমি যেতে বলছি আপনাকে। নিজেকে কি আমার মা ভাবতে শুরু করেছেন নাকি।

_মা না হই,সৎ মা তো। মা-ই তো হলাম একদিক থেকে।
উর্বীও দাঁতে দাঁত চেপে বলে। আজ এই জেদী ছেলেটার সাথে সমানে সমান হিসেব হবে।

নাবিল কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে থাকে,

_শোনো আমাদের বাড়িতে কিন্তু পিঠা বানানোর লোক নেই। তুমি প্রায়ই দেখি পিঠার জন্য হা হুতাশ করো তোমার দাদুর কাছে। এই সুযোগ টা মিস করবে না।
নাবিল পিঠার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আগের নাবিল হলে এই পিঠে ভর্তি ট্রে এতক্ষনে ডাস্টবিনে থাকতো। আপনি যান বলছি। প্লিজ‌।”

উর্বীর ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে যায়। সে হাত থেকে পিঠার থালা টেবিলে ধপ করে রেখে চেঁচিয়ে ওঠে,”এই ছেলে! তুমি কি ভাবো কি নিজেকে হ্যা? কিচ্ছু বলিনা বলে যা ইচ্ছে তাই করবে? যা ইচ্ছে তাই বলবে? একটা ঠাটিয়ে চ’ড় মারবো তোমাকে আমি! বড়দের সাথে কথা বলতে জানে না। খালি বইয়ের পড়া মুখস্থ করেই মেধাবী। তোমার চেয়ে শর্মী ঢের বুঝদার। তোমার মাথাভর্তি গোবর। কাচা গোবর। ”

নাবিল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নাবিলের রুমের বাইরে সবাই ভীড় জমায়।

উর্বী নাবিলের হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে বসায়। নাবিল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। উর্বীর এই রুপের সাথে নাবিল পরিচিত নয়। উর্বী পিঠার থালা এনে নাবিলের হাতে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসে। দাত কিড়মিড় করে বলে,

“কসম! সবকটা পিঠা শেষ না করলে আমি এই ঘর থেকে যাবো না।কসম।”
রাগে উর্বীর গলা কাপছে। নাবিল একবার পিঠার দিকে তাকায় একবার উর্বীর দিকে।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভয় পেয়েছে খুব।

***
গটগট করতে করতে সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে উর্বী নাবিলের ঘর থেকে বের হয়। নাবিল বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। তার পাশে রাখা পিঠার ট্রে টা পুরো খালি। উর্বী সবগুলো পিঠা খাইয়ে তবেই দম নিয়েছে।

“কি ভেবেছে সবাই! উর্বী‌ বাজারের সস্তা দরের আলু পটল! সবাই সারাজীবন উর্বীকে কথা শুনিয়েছে, শুনিয়ে যাবে ! ঐ পিচ্চি ছেলেটা পর্যন্ত ধ’ম’ক দিয়ে কথা বলে! এখন থেকে আর চলবে না! এটা তোমার পাপার বাড়ি হলে, এটা আমারও স্বামীর বাড়ি নাবিল, এখন থেকে একেবারে হাংকি পাংকি করলে এভাবেই শাস্তি দেবো আমি…..”

বিড়বিড় করতে করতে উর্বী সিড়ি ভাঙতে থাকে! তার মে’জাজ ভীষণ চটে আছে! কি বলছে সে নিজেও জানে না!

হন্তদন্ত হয় নিজের ঘরের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে পরে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘরের ভেতর দৃষ্টি দিয়ে।

রাওনাফ উর্বীকে দেখতেই খাওয়া থামিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আমি ভেবেছি আমার জন্য রেখেছো এগুলো,এগুলো আমার জন্য ছিলো না?”

উর্বী কিছুক্ষণ অনর্থক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। সে এতক্ষন রাওনাফকে পিঠে খেতে দেখছিলো। হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,

_এগুলো আপনার জন্যই ছিলো। আপনি খান‌। আমিতো শুধু দেখছিলাম একজন অতি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কিভাবে আরাম করে এই তেল মিষ্টি পিঠা খাচ্ছে। ভালোই লাগছিলো দেখতে। ভাবিনি খাবেন। আমি তো আনতেই চাইনি,ভাবী জোর করে দিয়েছে।

রাওনাফ মুচকি হেসে বলে,”তোমার মা দারুন পিঠা বানায়। এরকম পিঠা অনেক বছর হয় খাইনি। নাবিলের মাম্মাও ঠিক এরকম মজাদার পিঠা বানাতো। তার মতো পিঠা কেউ বানাতে পারতো না। শুধু পিঠা না,যেকোনো রান্না।”

উর্বী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় আমীরুন এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”সুমনা আর ঝুমুর আপায় আসছে বড় ভাইজান।”

***
“দুলাভাইকে যতটা ভদ্রলোক মনে হয় দুলাভাই কিন্তু ততটা ভদ্রলোক নয় উর্বী।”

সুমনার কথায় উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। রাওনাফ স্তব্ধ হয়ে সুমনার দিকে তাকিয়ে আছে। সুমনা রাওনাফকে বলতে থাকে,”কি? এভাবে কি দেখছেন!”

রাওনাফ কিছু না বলে কফির মগে চুমুক বসায়। সুমনা আর ঝুমুরকে সে খুব ভালো করে চেনে। এরা একবার যখন রাওনাফকে নিয়ে পরেছে,সহজে ছাড়বে না। তার চেয়ে এখান থেকে উঠে পরা যাক!

রাওনাফ হাতঘড়ির দিকে তাকায়। সুমনা আর ঝুমুর হঠাৎ করে এসেছে রাওনাফের সাথে দেখা করতে, রাওনাফের স্ত্রীকে দেখতে। উর্বী বিনয়ের সাথে হেসে সুমনাকে বলে,”আপনারা বসুন! আমি, চা নিয়ে আসছি!”

ঝুমুর উর্বীর হাত টেনে ধরে। হেসে বলে,”আরে বসুন। চা পরে হবে!”

উর্বী বসে পরে। সুমনা বলতে থাকে,”সত্যি কথাই বললাম। ওনাকে দেখতে শান্তশিষ্ট দেখাতে পারে কিন্তু মোটেও তেমনটি নয়। আপাকে সবসময় ডমিনেট করে রাখতো।‌ খুব পজেসিভ,বলতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত পজেসিভ ছিলো। ইনফ্যাক্ট আপাকে দুলাভাই দুলাভাইয়ের কোনো ছেলে বন্ধুদের সাথেও কথা বলতে দিতো না।”

রাওনাফ অবাক হয়ে সুমনার ফাজলামি টাইপের কথাগুলো শুনছে! সে আদৌ এমন ছিলো না!

উর্বী হাসি চেপে রেখে সুমনাকে বলে,”ঠিকাছে। পরে শুনবো। বসুন আপনারা। আমি চা নিয়ে আসছি।”

উর্বী চলে যেতেই রাওনাফ সুমনাকে কিছু বলতে যাবে, সুমনা বলে ওঠে,”একটু ভাঙচি দিচ্ছিলাম আপনার নামে দুলাভাই আপনার বৌয়ের কাছে!”

ঝুমুর বলতে থাকে,”আপনার স্ত্রী খুবই খুবই খুবই চাঁপা স্বভাবের মনে হচ্ছে দুলাভাই। বড় আপা ছিলো চঞ্চল। দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রের মানুষের সাথে সংসার করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি একটু বলতেন!”

রাওনাফ মুখ চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”থামবে তুমি! হাউ চাইল্ডিশ!”

সুমনা আর ঝুমুর উচ্চশব্দে হাসতে থাকে।

রাওনাফ শুকনো হাসি হেসে বলে,”হঠাৎ করে এলে যে! এতো করে বলি তখন সারা দাও না!”

ঝুমুর বলে ওঠে,”আপনার বৌকে দেখতে এলাম। তাছাড়া আপনার সাথে কথা ছিলো!”

রাওনাফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়, ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বলে,” কি কথা?”

_বাবার প্রোপার্টি ভাগ হয়েছে। আপার অংশ খুব শিগগিরই তার ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দিতে একটা পারিবারিক বৈঠক বসাতে চাইছি। আপনি যদি একটু সময় দিতেন!”

চায়ের ট্রে নিয়ে উর্বী ভেতরে ঢোকে। সবাই চুপ হয়ে যায়। উর্বী সবার মুখের দিকে তাকায়। তার একটুও এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সুমনা আর ঝুমুরের কত ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে তাদের আপার স্বামীর সাথে! উর্বীর তৃতীয় পক্ষ হয়ে থাকার ইচ্ছে নেই।
ঝুমুর উঠে দাঁড়িয়ে উর্বীর হাত থেকে ট্রে নামিয়ে বলে,”বসুন আপনি। আজ আপনার সাথে অনেক আড্ডা দেবো!”

বিনয়ী হাসি হেসে ঝুমুর আর সুমনার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে উর্বী বলে,”আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি!”

ঘর থেকে বেরিয়ে উর্বী সরাসরি নিচে চলে যায়। আজ যেহেতু একটু সময় পেয়েছে রান্নাটা বরং সে নিজের হাতে করবে।

***
অন্তরা বসে বসে টিভি দেখছিলো। উর্বী দরজার বাইরে এসে বলে,”আসবো।”

_আসুন ভাবি।
অন্তরা উঠে বসে।

উর্বীর হাতে এক বাটি কদবেল ভর্তা।

বিছানার এক পাশে বসতে বসতে সে বলে,
_নাও এটা খাও।

অন্তরা কদবেল মাখা দেখে খুশি হয়। তার আসলেই টক কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো।
সে বাটি থেকে ভর্তা তুলে মুখে দিতে দিতে বলে,”আপনিও খান না ভাবি।”

-না,এটা তোমার জন্য তোমার শাশুড়ি বানিয়েছে। এটা শুধু তুমিই খাবে।

অন্তরা উর্বীর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। উর্বীর মুখ হাসি হাসি। বলে ওঠে,”কি একটা ম্যাজিক দেখো অন্তরা! নাতি নাতনি আসার খবর শুনলেই বাঙালি জাঁদরেল শাশুড়ি গুলো গলে যায় পুরো।”

অন্তরা লাজুক হাসি হাসে।

_আজ থেকে রান্না বান্নার ঝামেলা করবে না। মা আমাদের সাথে খেতে বলেছেন।

অন্তরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মানে কি তার শাশুড়ি তাকে মেনে নিয়েছেন!

উর্বী বলে,”যদিও মা বলেছেন বাবু হবার পরে তোমাদের আবার আলাদা থাকতে হবে তবে আমি জানি মা নাতী নাতনির মুখ দেখলে আর তোমাদের দূরে সরিয়ে রাখবে না।”

উর্বী অন্তরার পাশ থেকে একটা নকশি কাথা উঠিয়ে বলে,”এটা কি! বাবুর জন্য করছিলে? তোমার ফোড় টা তো হয়নি। দাড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি।”
অন্তরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের জন্য যে মেয়েটার এতবড় ক্ষতি হলো সেই মেয়েটা তাদের প্রতি কতটা আন্তরিক !

অন্তরা উর্বীকে বলে,”একটা কথা বলবো ভাবি যদি কিছু মনে না করেন।”
-হ্যা। বলো।
-ভাইয়াকে আপনি মেনে নিয়েছেন নিজের স্বামী হিসেবে?

উর্বী হাসে। কিছুক্ষণ হেসে অন্তরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে আমাকে একটা কাথা দাও। আমিও বাবুর জন্য নকশি কাথা বানাবো।

***
ঘুম ভাঙতেই গাঁয়ের ওপর ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পায় উর্বী। তার গাঁয়ের ওপর দু’টো কম্ফোর্টার চাপানো। কাল রাতে হারকাপানো শীতে উর্বী বড্ড ভুগেছিলো, একটা কম্ফোর্টারে মানছিলোই না যেন। কিন্তু অলসতার কারণে গুটিসুটি মেরেই ঘুমিয়েছিলো।
এটা রাওনাফ করিম খানের কাজ। উর্বী জানে। কম্ফোর্টার দু’টো সরিয়ে উর্বী আনমনে হাসে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে সেদিকে চোখ যায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে উর্বী চমকায়। বুকের মধ্যে সেই চিরচেনা আতঙ্ক এসে ভর করে। একবার রিং হয়ে কে’টে যায়। উর্বী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বার আবারও ফোন বেজে উঠতেই কাঁপা কাঁপা হাতে উর্বী ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠে,”আসসালামুয়ালাইকুম মৃদুলা আপা। আমি লিটন বলছিলাম।”

উর্বী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অস্ফুট স্বরে বলে,”ওয়ালাইকুমুস সালাম, বলুন।”

_আপা, মনির ভাই মিটিং ফিক্সড করেছে আপনি জানেন?

_জি, জানি। আমি ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে যাবো।

_ঠিকাছে আপা,রাখছি।

ফোনটা হুট করে সুইচ অফ করে হাত থেকে ফেলে চুপচাপ বসে থাকে উর্বী। বুকটা ক্রমশ ভার হয়ে উঠছে হঠাৎ। যেভাবে বসা ছিলো সেভাবেই হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকে। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের অস্তিত্ব টের পেতেই উর্বী মাথা তুলে তাকায়। রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”মাথা ঘুরাচ্ছে নাকি বৌমা? আজ তবে অফিস যেও না!”

উর্বী ম্লান হেসে বলে,”মা, ওটা আমার অফিস। এভাবে হুটহাট ছুটি নেওয়া যায় না। আমি ঠিক আছি।”

রওশান আরা হাতের ফোনটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”রাওনাফ ফোন করেছে। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে নাকি। নাও ধরো।”

উর্বী খানিকটা অবাক হয়। ফোনটা হাতে নিতেই রওশান আরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

উর্বী একপলক ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা কানে ধরে।

ওপাশ থেকে রাওনাফের গলার আওয়াজ শোনা যায়, সে নিচুস্বরে উর্বীকে বলে,”তুমি কি অসুস্থ নাকি?”

_না তো।

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”উর্বী তুমি কি বিকেলে ফ্রি আছো, অফিস টাইমের পরে?”

_আমার আবার কি কাজ? আমি তো বাড়িতেই থাকি। কেনো বলুনতো?

_না মানে,আমার কলিগরা অনেকদিন থেকেই বলছে গেট টুগেদারের কথা ‌। আজ হুট করে আমায় না জানিয়েই একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছে “রিভানায়”। খুব জোরাজুরি করছে। কি করবো বুঝতে পারছি না।

_আমাকে আসতে হবে?
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

_হ্যা,তবে তুমি না চাইলে দরকার নেই। পুরোটাই তোমার ইচ্ছে।

_আচ্ছা আমি আসবো।

_উর্বী।

_হ্যা বলুন। ব্যাপারটা কি জটিল হয়ে যাচ্ছে তোমার মনে হয়?

_না। আর কেউ যাবে না এ বাড়ি থেকে?

_না, শুধু শর্মী আসবে। ওকে নিয়ে এসো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

***
শর্মী দূরে দাঁড়িয়ে তার পরিচিত বন্ধুদের সাথে গল্প করছে।

উর্বীর মনে হচ্ছে উর্বী একটা ল্যাম্পোস্ট। সে ঠিক ল্যাম্পোস্টের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
রাওনাফ তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
পার্টিতে যে মহিলারা এসেছে তাদের একটিকেও উর্বীর পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে রাওনাফের বন্ধুদের স্ত্রীদের। যারা কোনো স্বাভাবিক মজাই করতে পারে না।
মধ্যবয়সী মহিলা হিসেবে তাদের আচরণ বেমানান।

এতক্ষণ সবাই উর্বীকে ঘিরে ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। পাঁচ মিনিট হলো উর্বীকে ছাড় দিয়েছে।

লামিয়া উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। উর্বীর কাছে এই মহিলাকে ভালো লেগেছে।

“কি ব্যাপার উর্বী? এখানে দাড়িয়ে কেনো?
_না এমনিই।

_তোমার বুঝি বিরক্তি লাগছে এই পরিবেশে? রাওনাফকে পাঠিয়ে দেবো?
_না না। তার দরকার নেই।

রাওনাফ উর্বীদের দিকেই আসছে। লামিয়া বলে,”আচ্ছা তোমার বর এদিকেই আসছে। আমি যাই হ্যা?”

উর্বী লামিয়াকে যেতে দেয় না। লামিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ এসে উর্বীকে বলে,”শরীর ঠিক আছে তোমার?”

_হ্যা,কেনো বলুন তো?

_না, চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছো।

_এতো আলো সব চোখে লাগছে আমার। আর কিছু না।

_কিছু খেয়েছো?

_না,এখানের কিছুই আমার পছন্দ হচ্ছে না।

_কোনো পানীয় খেলে খেতে পারো। ভালো লাগবে।

উর্বী চুপচাপ একটা গ্লাস উঠিয়ে নিতেই রাওনাফ বলে ওঠে,”ওটা যেখানে ছিলো সেখানেই রাখো। ওটা খেও না।”

উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রাওনাফ সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”ব্লাডি মেরি!”

উর্বী হতভম্ব হয়ে তার হাতের গ্লাসের দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ গ্লাসটা রেখে দিয়ে ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনারা খান?”

রাওনাফ থতমত খেয়ে যায়। পরমুহূর্তেই বলে ওঠে,
_আরে না না। এগুলো তো আমার কয়েকজন কলিগরা এনেছে । ওরা খ্রীষ্টান।

উর্বী সরু চোখে রাওনাফকে দেখছে।
রাওনাফ মিনমিন করে বলে,” ডোন্ট জাজ মি! আমি জীবনে একটা সিগারেট খেয়ে দেখিনি।”

পাশ থেকে লামিয়া উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। রাওনাফ আর উর্বী তার দিকে তাকায়। লামিয়া বলতে থাকে,”সিরিয়াসলি রাওনাফ তোমাদের দুজনের এই সিনটা কতটা কিউট বলে বোঝাতে পারবো না! মনে হচ্ছে কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছে!”

রাওনাফ আর উর্বী চ’মকে ওঠে তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকায়। উর্বী মাথা নিচু করে অন্যদিকে চলে যায়। লামিয়া উচ্চশব্দে হাসতেই থাকে। রাওনাফ দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো, সে কি আসলেই কৈফিয়ত দিচ্ছিলো উর্বীর কাছে! কিন্তু কেন!”

অনুষ্ঠান শেষে উর্বীরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাওনাফ গাড়ি চালাচ্ছে। উর্বী আর শর্মী পেছনে বসে গল্প করছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। শর্মী বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়,সে উর্বীকেও বলে ছুঁতে। উর্বী ধমক দিয়ে শর্মীর হাত ভেতরে টেনে আনে এবং গাড়ির জানালার কাচ উঠিয়ে দেয়।
রাওনাফ মিররে তাদের দেখে। শর্মী হাতের পানি উর্বীর মুখে ছিটিয়ে দিয়ে খিকখিক করে হাসে। উর্বী টিস্যু দিয়ে শর্মীর হাত মুছিয়ে দেয়।

রাওনাফের কাছে শর্মীর সে হাঁসি শুনতে বড্ড ভালো লাগে। তার চোখে হঠাৎ শর্মীর প্রতি উর্বীর অদৃশ্য একটা অধিকাবোধ ধরা পরে।

***
রাওনাফ তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দিয়েছে। দশটায় পরিক্ষা শুরু হবে। এখন আটটা বেজে গিয়েছে, হাতে মাত্র দুঘন্টা বাকি। সে তার ছেলেমেয়েকে তাড়া দিচ্ছে,”কি তোমাদের হয়নি এখনো? আরে তাড়াতাড়ি করো,রাস্তায় জ্যাম থাকতে পারে। কুইক।”

আজ নাবিল আর শায়মীর মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। নাবিল শায়মী তাদের দাদুর ঘরে, দাদুর থেকে দোয়া চাইতে এসেছে।
রওশান আরা তার নাতী নাতনির কপালে চুমু একে দেন।

রাওনাফ নিচতলায় দাঁড়িয়ে চেঁচায়,”কি তোমাদের হলো? আরে জ্যামে পরে গেলে কিন্তু বিপদে পরবে, তাড়াতাড়ি।”

নাবিল শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”চল,এই লোক মনে হচ্ছে এখন থামবে না। ”
দু’জনে নিচে নেমে আসে, নাবিল বলে,”সব নিয়েছিস তো গুছিয়ে? হু নিয়েছি। এই নে তোর ফাইল। চেক করে নে। নিজের টা তো নিজে গুছিয়ে নিতে পারিস না !

নাবিল আর শায়মী নিচে নেমে সবার থেকে দোয়া নেয়। উর্বী দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শায়মী এসে উর্বীর কাছে দোয়া চাইলেও নাবিল মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকে এককোণে।

ওরা গাড়িতে উঠলে উর্বী ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। সব আমীরুনকে নিয়ে গোছাতে হবে আজ।

কেন্দ্রে যাওয়ার পথে রাস্তায় মোটামুটি জ্যাম ছিলো। নাবিল শায়মীকে কেন্দ্রের গেইটে ছেড়ে দিয়ে রাওনাফ বাড়ির পথে রওনা দেয়। হাতে এখনো পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি আছে। সে আগেই চলে এসেছে। তাকে চেম্বারে বসতে হবে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম লেগে যায়। রাওনাফ মেজাজ খারাপ করে গাড়িতে বসে আছে।

হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। উর্বী এখন তাকে ফোন দিচ্ছে কেনো!
সে ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই উর্বীর গলা শোনা যায়,”আপনি কোথায়? আপনি শিগগির বাসায় আসুন নয়তো অঘটন ঘটে যাবে।”

_কি হয়েছে,ধীরে সুস্থে বলো।

_নাবিলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড আর এডমিট কার্ড বাড়িতেই রেখে গিয়েছে।

_হোয়্যাট!!!!
রাওনাফের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। এখন কি করবে সে? কি হবে তার ছেলের!

রাওনাফ নিজেকে যথাসাধ্য ঠান্ডা রেখে বলে,”বাড়িতে সামিউল আছে? ”
_না তো। উনি সেই কখন বেড়িয়েছে। এখন কি করবো?

_আমি বুঝতে পারছি না,আমি মাঝ রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উর্বী একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে,”শুনুন। আপনি শান্ত থাকুন। আমি বাড়ি থেকে এখনই বের হচ্ছি। আমি আপনাকে জানাবো।”

রাওনাফ কিছু বলার আগেই উর্বী ফোন কেটে দেয়। তার হাতে সময় নেই। সে দৌড়াতে দৌড়াতে সিড়ি ভেঙে নিচে নামছে। আজ সময়ের সাথে তাকে পাল্লা দিতে হবে।

চলমান…..

#নোটবার্তা: আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করে আপনাদের অনূভুতি জানান। আমি পড়তে চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here