#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,১৬,১৭
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#ষোড়শ_পর্ব
২৩.
চন্দ্রা সকাল থেকে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে রাশেদ মুখ কালো করে বসে আছে। তার মুখ কালো করার কারন হচ্ছে চন্দ্রার বাবা সকালে ফোন দিয়ে বলেছে চন্দ্র কালকে নিতে আসবে। চন্দ্রাও হ্যাঁ বলে দিয়েছে। সেখানে যদি রাশেদ বলতো না সে চন্দ্রাকে যেতে দিবে না তাহলে সেটা খারাপ হতো। তাই সেও রাজি হলো। চন্দ্রা কত দিনের জন্য যাচ্ছে সেটাও বলে যাচ্ছে না। রাশেদের সচরাচর রাগ উঠে না কিন্তু আজ রাগ উঠছে। চন্দ্রা টুকটাক গোছানো শুরু করে দিয়েছে। এত্তবড় লাগেজ নামিয়েছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে মিনিমাম ছয় মাসের জন্য যাচ্ছে। এতে রাশেদের রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই সে ঠিক করলো হাসপাতালে চলে যাবে। চন্দ্রা আড়চোখে সব খেয়াল করছে। আর মিটিমিটি হাসছে।
রাশেদ তৈরি হয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চন্দ্রা সমনে এসে বললো,
কোথায় যাচ্ছেন?
হসপিটালে।
এতো তাড়াতাড়ি কেন? এখনো তো সময় হয়নি।
এমনি।
কিছু খেয়ে যান।
থাক এই কয়দিন নিজেই করে সব করতে হবে। আসছি আমি।
আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন। তাই না?
রাগ করার মতো কিছু করেছো তুমি?
মনে হচ্ছে করেছি।
কী করেছো বলে মনে হয়?
আপনাকে জিজ্ঞেস না করে বাবাকে বলে দিয়েছি আমি চলে যাব।
বুঝতেই তো পেরেছো।
সরি। আসলে বাবা এতো করে বললো আমি না করতে পারি নি। আমার ওদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।
ইট’স ওকে।
নো ইট’স নট ওকে। আমি কী বাবাকে মানা করে দিবো?
না না চন্দ্রা এসব কী বলছো? না করবে কেন? দোষ আমারি তোমাকে ছয় মাসের মধ্যে নিয়ে যেতে পারি নি। যাচ্ছো যাও। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
তাড়াতাড়িই আসবো।
তাই? তাহলে এতো বড় লাগেজ নিচ্ছো কেন? দেখে মনে হচ্ছে ছয় মাসের আগে আসবে না।
চন্দ্রা ফিক করে হাসলো। তারপর বললো, আমার ছোট লাগেজ নেই সে জন্য।
ও তাই বলো। আচ্ছা আসার সময় নিয়ে আসবো।
না না দরকার নেই।
রাশেদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, তুমি সব কিছুতে না না করো কেন?
কোথায় সবকিছুতে না না করি?
আমি খেয়াল করেছি যখনই তোমাকে নিজে কিছু দিতে চাই তুমি না করো। আসলে তোমাকে জিজ্ঞেস করাই উচিত হয়নি। একেবারে নিয়ে আসা উচিত ছিলো।
তাহলে নিয়েই আসতেন।
বলছো? ঠিক আছে নিয়ে আসবো।
আচ্ছা খেয়ে নিন। তারপর যান প্লিজ।
রাশেদের রাগ গলে গেছে। সে হেসে বললো, আচ্ছা একটু পরেই যাবো তাহলে। তুমি আস্তে আস্তে করো সব।
ঠিক আছে।
খাবার টেবিলে বসে চন্দ্রা রাশেদকে বললো, রাশেদ টুকুকে কী করবো?
ওর কথা আমার মাথা থেকে বের হয়ে গেছিলো। আসলেই তো কী করবো ওকে নিয়ে?
আমি বলছিলাম কী ওকে কয়দিনের জন্য ওর বাড়ি পাঠিয়ে দেই? আমি আসার পর না হয় চলে আসবে।
আচ্ছা।
আপনি একটু ওর মামাকে কল করে বলে দিয়েন। কাল যেন নিয়ে যায় ওকে।
ঠিক আছে বলে দিবো।
আপনার এই কয়দিনে খাবারের খুব কষ্ট হবে তাই না?
ব্যাপার না আমি সামলে নিবো।
আমি আম্মুকে বলে দিয়েছি প্রতিদিন কাউকে দিয়ে দুপুর আর রাতের খাবার পাঠিয়ে দিবে। সকালটা একটু ম্যানেজ করতে হবে নিজেকে। ঘরে চাপাতা, চিনি, দুধ, বিস্কিট সবকিছু এনে রেখেছি। রান্নাঘরের বামপাশের কেবিনেটে থাকবে। আর রাতে আমি রুটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবো। সময়মতো সেঁকে খেয়ে নিবেন।
এতে কিছু করতে হবে না চন্দ্রা। আই ক্যান ম্যানেজ।
এককাজ করুন কয়দিনের জন্য বাসায় চলে যান। কয়েকদিনের তো ব্যাপার। শুধু কষ্ট করে আসা যাওয়া করতে হবে আর কী।
চন্দ্রা কেন এতো ব্যস্ত হচ্ছো? কিছু হবে না আমার।
রাশেদ একটা ভুল হয়ে গেছে।
কী হয়েছে?
তুমি অসুস্থ এখন আমার যাওয়ার জন্য উচিত হয়নি।
রাশেদ মৃদু হাসলো তারপর ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা চন্দ্রার হাতটা ধরে বললো, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ চন্দ্রা। ওই ঘটনার অনেকদিন তো হলো। সুস্থ না হলেই কী আর হসপিটালে যেতে পারতাম। তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো?
আপনি তো একা খেতে পারেন না। না খেয়েই কাটিয়ে দিবেন তাই না?
এতক্ষণ তুমি বলছিলে সেটাই তো ভালো লাগছিলো। আর রইলো বাকি একা খাওয়ার কথা তুমি প্রতিদিন খাওয়ার সময় ভিডিও কল দিতে পারো। আর হ্যাঁ এই আপনি আপনি করাটা বাদ দাও তো।
চন্দ্রা থতমত খেয়ে বললো, এতক্ষণ তুমি বলছিলাম নাকি?
হ্যাঁ। আর সেটাতেই থাকো।
চেষ্টা করি তো কিন্তু পারি না।
পারবে। এখন আসি। দেরি হয়ে গেছে অলরেডি।
ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।
আচ্ছা।
রাশেদ যাওয়ার পর চন্দ্রা বিরস মুখে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। তারপর মনে পড়লো রাশেদ বলেছিল ব্যাগ নিয়ে আসবে। তাহলে শুধু শুধু এটা গুছানোর মানে কী? তারপর সব আবার নামিয়ে রাখলো। চন্দ্রা মন খারাপ নিয়ে বসে থাকলো। একসময় তার নিজের উপর রাগ হলো। কী দরকার ছিলো রাশেদকে না নিয়ে একা যাওয়ার? তারপর আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলো কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার ঠিক সামলে নিতে পারবে।
পরের দিন রাশেদ গেলো চন্দ্রাকে ট্রেনে তুলে দিতে। চন্দ্রার ভীষন মন খারাপ। সে নিজেকে নিজে গালমন্দ করলো কতক্ষণ। তারপর রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো, সরি রাশেদ।
রাশেদ হেসে বললো, সরি বলার কী হলো?
এইযে একা করে রেখে যাচ্ছি।
তাহলে কী তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে? এটা কী সম্ভব? মন খারাপ করে থেকো না। যাও ঘুরে আসো ভালো লাগবে।
আপনি আমাকে নিতে আসবেন?
তুমি চাও আমি তোমাকে নিতে আসি?
হ্যাঁ। চন্দ্রা অকপটে স্বীকার করলো।
রাশেদ হাসলো। তারপর বললো, আচ্ছা নিতে যেতে পারি কিন্তু কোথায় নিয়ে আমাকে ঘুরতে যাবে বলো?
আমাদের বাগান বাড়িতে। যেখানে ঈদে গিয়েছিলেন সেখানে।
তাহলে তো যেতেই হবে।
রাশেদের কথার ধরনে চন্দ্রা হেসে ফেললো।
এভাবে হাসবে। মুখ ওমন করে রাখো কেন?
আচ্ছা হাসবো।
চন্দ্রা সাবধানে থেকো। ট্রেন ছেড়ে দিবে। গিয়ে আমাকে কল করবে। ঠিক আছে।
আপনিও সাবধানে যাবেন। সময়মতো খাবেন লক্ষীটি অনিয়ম করবেন না। আমি চাই না সেদিনের ঘটনা আর পুনরাবৃত্তি হোক।
আচ্ছা খাবো।
ট্রেন নড়ে উঠলো। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো। রাশেদ ট্রেন থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। হাত নাড়িয়ে হাসলো। চন্দ্রা কিছু বলতে পারলো না। সে চোখ ভর্তি জল নিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের জল সে অন্য কাউকে দেখাতে চায় না। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন তার? মনে হচ্ছে শরীরের একটা অংশ সে রেখে চলে আসছে।
২৩.
চন্দ্রা সিলেট এসেছে আজ তিনদিন। চারদিন তার কাছে চার বছর বলে মনে হচ্ছে। রাশেদের সাথে কথা হয় প্রতিদিন চার পাঁচবার তারপর তার ভালো লাগে না। খেতে বসলে মনে হয় সে কী খাচ্ছে ঠিকমতো? যদিও রাশেদের খাওয়ার সময় সে ভিডিও কল দেয়। রাশেদ খেলেও ওর মনে হয় ঠিক করে খায়নি। মোটকথা সে বিরক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ছুটে চলে যায়। কিন্তু তার বাবা কড়া গলায় বলে দিয়েছে মিনিমাম সাত দিন থাকতে হবে। আজকে মাত্র চারদিন বাকি তিনদিন কীভাবে কাটাবে সেটা ভাবতেই চন্দ্রার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
রাত আটটায় কলিং বেল বাজলো। এতো রাতে কে এলো ভাবছে। সবাই তো ঘরেই আছে। সে তার ঘর থেকে উঁকি দিলো। রাশেদকে ঢুকতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই কী রাশেদ এসেছে নাকি সারাদিন তার কথা ভাবায় তার চোখে ভুল দেখছে? রাশেদ সকলের সাথে কথা বলে ভেতরে এলো। চন্দ্রা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাশেদ মৃদু হাসলো।
সে বললো, চন্দ্রাবতী কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কী আমাকে খুশি হননি?
চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো, আমাকে একটা চিমটি কাটুন তো। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।
বলেই সে হাত বাড়িয়ে দিলো। রাশেদ সেই হাত ধরে টেনে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, এবারও বিশ্বাস হচ্ছে না।
চন্দ্রা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। একটা কথাও সে বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর রাশেদ বললো, তুমি খুশি হওনি?
হয়েছি।
তাহলে কথা বলছো না কেন?
ইচ্ছে করছে না।
তাহলে কী ইচ্ছে করছে? এভাবে জড়িয়ে থাকতে?
চন্দ্রা সরে আসতে চাইলো। রাশেদ ছাড়লো না। রাশেদ বললো, এতো ছটফট করো কেন? এতো দূর মানুষ বিয়ে করে। জার্নি করতে করতে জীবন শেষ। আমার চেনা কেউ থাকলে তাকে বলবো ভাই আর যেখানে বিয়ে কর কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সিলেট করবি না।
সিলেট খারাপ কী?
এইযে এতো দূর আসতে হলো। আট নয় ঘন্টা জার্নি কী কম নাকি? বউকে চাইলেও দেখতে পারি না। আজ যদি কাছে হতো চট করে দেখে চলে আসতাম।
ইসস ঢং!
তোমার কাছে তো এমনই মনে হবে। জানো কত মিস করছিলাম? তাইতো না বলে চলে এসেছি।
চন্দ্রা এবার হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, রাশেদ সাহেব আপনি প্রেমে পড়েছেন কঠিন প্রেমে। আমার চোখ ফাঁকি দেয়া এতো সহজ নয় ডাক্তার সাহেব।
তাই?
জ্বি।
বলো তো কার প্রেমে?
বলবো না।
রাশেদ চন্দ্রার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। তারপর কানে কানে বললো, আমি বলবো?
চন্দ্রার কান ঝিনঝিন করে উঠলো। সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না।
রাশেদ কানে কানে বললো, চন্দ্রা গান শুনবে?
চন্দ্রা চট করে উত্তর দিলো, না।
কেন?
এতো বাজে গলা! বলেই চন্দ্রা হেসে ফেললো।
তাই? এই বাজে গলা আর আমাকে যে সারাজীবন সহ্য করতে হবে। আমাকে যে এভাবে জ্বালাচ্ছো তার শোধ নিব।খুব তাড়াতাড়ি। রেডি থাকো। এখানে আসলে তো ভূলেই যাও। কালকেই ফিরছি সকাল সকাল আর এক বছরের আগে আসতে দিবো না।
বললেই যেন মানছি। আমি ঘুম থেকেই উঠবো দুপুরে।
মানতে হবে। না হলে কোলে করে নিয়ে যাবো।
ইসস দেখা যাবে।
চ্যালেন্জ করছো?
চুপ আর একটাও কথা না। ফ্রেশ হয়ে আসুন একটু পরেই খেতে ডাকবে।
আচ্ছা শেষ একটা কথা?
কী?
তুমি এতো সুন্দর কেন?
কারন আপনার দেখার চোখটা সুন্দর তাই।
সর্বনাশ করে দিলে চন্দ্রাবতী। এর প্রতিশোধ যে নিবো। তৈরি থেকো।
চন্দ্রা হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাশেদের মন খুব হালকা লাগছে। সে জানতে প্রেমে পড়েছে তবে এতো কঠিন প্রেমে পড়েছে বুঝতে পারে নি। এই মেয়েকে ছাড়া চারদিন চার বছর মনে হচ্ছে। দূরে থেকেও কী সাংঘাতিক মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে আমাকে! ওই বাড়িতে ডুকলেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে আসলে কেউ হাতে হাতে জিনিস এগিয়ে দেয় না। বকার পরও না খেয়ে বসে থাকে না। রাতে খাবারের পর চা নিয়ে আসে না। বিছানায় যাওয়ার পর খালি খালি লাগে। কী যেন একটা প্রচন্ড মিস করে? হ্যাঁ চন্দ্রার গায়ের গন্ধ। চারপাশে চন্দ্রা চন্দ্রা গন্ধ সে প্রচন্ড মিস করে।
চলবে………
#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#সপ্তদশ_পর্ব
২৪.
পরের দিন ঠিক হলো রাশেদ আরো দুইদিন থেকে তারপর চন্দ্রাকে নিয়ে ফিরবে। রাশেদের মানা কেউ শুনলো না। চন্দ্রাকে সকালের খাবারের পর রাশেদ বললো, চন্দ্রা তুমি আমাকে কী কথা দিয়েছিলে মনে আছে?
কী কথা দিয়েছিলাম?
বলেছিলে আমি তোমাকে নিতে আসলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।
ও সেটা। ঠিক আছে নিয়ে যাবো। কোথায় যাবেন?
আমি কী চিনি নাকি তোমাদের এলাকা? তুমি নিয়ে চলো।
চা বাগানে যাবেন?
আশেপাশে আছে নাকি?
আশেপাশে বলতে একটু দূরে যেতে হবে। অটো বা টমটম দিয়ে যাওয়া যায়। বিশ মিনিটের মতো লাগবে।
তাহলে চলো।
নাকি আমাদের বাগান বাড়িতে যাবেন?
সেটা হলে তো আরো ভালো হয় আর সেখানেই তো যাওয়ার কথা ছিল।
তাহলে বাবাকে বলে দিচ্ছি। ব্যবস্থা করে রাখবে আমরা দুজন দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যাবো।
বাড়ির কেউ যাবে না?
না কেউ যাবে না। ভাইয়া বাসায় নেই, ভাইয়াকে ছাড়া ভাবী যাবে না আর ভাবীকে রেখে মা, বাবা যাবে না।
আচ্ছা।
পরশু ফিরবো। ঠিক আছে।
না না তাহলে দেরি হয়ে যাবে। ঢাকা ফিরতে হবে।
তাহলে কাল বিকালে ফিরবো। রাতে অথবা সকালে রওনা হবো ঢাকায়।
আচ্ছা।
যেই বলা সেই কাজ। দুপুরে খেয়ে বিকেলের দিকে চন্দ্রা রাশেদ বেরিয়ে পড়লো। চন্দ্রার পড়নে জিন্স আর কুর্তি। রাশেদের খুব ইচ্ছে ছিলো চন্দ্রাকে শাড়িতে দেখার। সে সিএনজিতে উঠে চন্দ্রাকে বললো, চন্দ্রা তুমি শাড়ি পড়তে পারতে।
কেন?
চা বাগানে শাড়ি পড়া ছবি সুন্দর হতো।
চন্দ্রা বুঝতে পারলো রাশেদের ইচ্ছে ছিলো চন্দ্রাকে শাড়িতে দেখার। চন্দ্রা মৃদু হেসে বললো, শাড়িতে ছবি তোলার জন্য কী হাত পা ভাঙবো নাকি?
রাশেদ অবাক হয়ে বললো, কেন?
সাহেব এটা সিনেমা নয়। শাড়ি পড়ে টিলায় উঠবো কীভাবে? আপনি কী ভেবেছেন এই সিএনজি সোজা বাগান বাড়ির গেটে নামবে?
হ্যাঁ। তা নয়তো কী?
এই আপনি দেশে ঘুরে বেড়াতেন?
খোঁচা দিচ্ছো?
অবশ্যই। বুঝতে পারছেন না এখনো?
এতো মিষ্টি মেয়েটা করলার মতো তেতো কথা বলে কেন?
চন্দ্রা হাসলো। তারপর বললো, রাশেদ এইটা দিয়ে আমরা নদীর ঘাটে নামবো। তারপর নৌকা করে নদী পার হয়ে হেঁটে যেতে হবে।
আগের বার তো এমন ছিলো না। আমরা তো গাড়িতে গিয়েছিলাম।
আগেরবার আপনারা অন্য রাস্তা দিয়েই এসেছিলেন। তারপরও মনে করে দেখুন আপনারা গাড়ি না পাহাড়ি জীপে করে এসেছিলেন।
আরে হ্যাঁ মনে ছিলো না। কী জীপ ছিলো সেটা? মা বলেছিলো উনার কোমড়ের আয়ু দুই বছর কমে গেছে এতো ঝাঁকুনি খেয়েছিল।
চন্দ্রা হাসলো তারপর বললো, এই জীপ গুলো এমনই। নেক্সট আসলে আর কখনোই জীপে আসবেন না। দরকার হলে হেঁটে আসবেন। এই যে আজকে যেমন যাচ্ছি।
এখান থেকে কীভাবে যাবো?
সিএনজি থেকে নেমে একটু হাঁটতে হবে তারপর ঘাটের মতো আছে সেখান থেকে নৌকা করে নদী পার হবো। নদী পার হবার পর একজন থাকবে উনি নিয়ে যাবেন। হেঁটে হেঁটে যাবো।
কে আসবে তোমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার?
না। উনি কেয়ারটেকার না। সবসময় থাকেন না। ওখানকার চা ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন মাঝে মাঝে বাড়ি পরিস্কার করে আসে।
ও আচ্ছা।
নেমে পড়ুন চলে এসেছি।
পাহাড়ি টিলা বেয়ে উঠতে রাশেদের খুব কষ্ট হলো। সে এবার বুঝলো চন্দ্রা শাড়ি পড়ে নি কেন? শাড়ি নিয়ে এখানে আসা যেত না। হাঁটতেই পারতো না।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর কিছু বাড়িঘর দেখা গেল। রাশেদ চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললো, এসে পড়েছি?
না। আরেকটু ভেতরে। এখানে চা ফ্যাক্টরীতে যারা কাজ করে তাদের কোয়াটার এটা। আমাদের বাড়িটার কাছে অন্য কোন বাড়ি নেই।
এতো দুরে কেন?
বেশি ক্লান্ত লাগছে?
হ্যাঁ। তোমার লাগছে না।
না আমি এভাবে আগেও এসেছি।
আরো মিনিট দশেক হাঁটার পর চন্দ্রাদের বাগান বাড়ির সামনে দাড়ালো ওরা। রাশেদ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। চন্দ্রারা ঘরে ঢোকার পর এই বাড়ির ভেতরে চন্দ্রাদের ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল। এতো বড়ো বাড়িতে চন্দ্রা আর রাশেদ একা। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব! রাশেদ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। সে খুবই ক্লান্ত। চন্দ্রা ড্রয়ার থেকে থেকে ব্যাথার স্প্রে বের করে রাশেদের পাশে বসলো।
পা ব্যাথা করছে বেশি?
হ্যাঁ।
এটা লাগিয়ে নিন।
থ্যাংক গড তুমি এটা এনেছো? খুব দরকার ছিলো।
এগুলো এখানে থাকে। আমি দিয়ে দেই।
রাশেদ হেসে বললো, বউ সেবা করতে চাইছে না করবো কেন? দাও।
বউয়ের সেবা পেতে সব পুরুষ মানুষেরই ভালো লাগে তাই না?
অন্য সবার কথা জানি না। আমার ভালো লাগে।
আপনি শুয়ে থাকুন আমি খাবারগুলো গরম করে রেখে আসি। আসার সময় মা দিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা যাও।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর চন্দ্রা আর রাশেদ ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ বললো, চন্দ্রা আজ কী পূর্নিমা?
না কাল পূর্ণিমা।
আচ্ছা এখানে এতো দূরে জায়গা কে রাখলো?
বাবা।
বাবা কী করে খবর পেল?
সেটা তো জানি না। তবে বাবার খুব ইচ্ছে ছিল একটা চা বাগান কেনার৷ আর এটার খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথে ঠিক করলো কিনে ফেলবে আর খুব কমে পেয়েছিল তাই কিনে নিয়েছে।
তোমরা কী প্রায়ই আসতে?
হ্যাঁ। আমি প্রতিবার ঢাকা থেকে এলে এখানে চলে আসতাম। আগে সবাইকে সাথে করে নিয়ে আসতাম। এই প্রথম একা আসা হলো। শুধু আপনার সাথে।
একটু পর পর ঘন্টা বাড়ি দিচ্ছে কেন?
সময় জানাচ্ছে।
এখনকার যুগে ফোন থাকতে ঘন্টা বাড়ি দিয়ে জানাতে হয় কেন?
সেটা তো বলতে পারবো না।
থাক বলতে হবে না। চলো বাইরে গিয়ে বসি?
না। এখন বাইরে যাওয়া যাবে না।
কেন?
ডাক্তার সাহেব এইটা শহর না বাগান। এখানে রিস্ক আছে।
কেন? পাহারাদার নেই?
আছে। তারপরও বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। বিপদ বলেকয়ে আসে না।
আচ্ছা। যাবো না।
চন্দ্রা হেসে বললো, আপনি তো খুব বাধ্য বর। কোন কিছু মানা করলে খুব শোনেন।
অবশ্যই। কোন সন্দেহ আছে?
না নেই।
চন্দ্রা আমরা পরশু যাবো এখান থেকে।
সকালে না বললেন ঢাকায় ফিরবেন?
এখন ইচ্ছে করছে না। আমার তো ইচ্ছে করছে সারাজীবন থাকতে।
ডাক্তারি ছাড়া আর কী পারেন করতে? এখানে থাকতে হলে কাজ জানতে হবে।
কেন? চা পাতা তুলবো।
তাই?
হ্যাঁ।
বলুন তো চা গাছের কোন পাতাগুলো তুলতে হয়?
এক জায়গা থেকে তুললেই হয়।
আপনার এই কথা শুনলে কেউ চাকরি দিবে না।
কেন?
চা গাছের কচি পাতা দিয়ে চা-পাতা তৈরি হয়। বুড়ো পাতা কোন কাজে লাগে না।
তাই নাকি? জানতাম না তো। তাহলে চা তোলা বাদ।
আচ্ছা।
চন্দ্রা আসার সময় ফ্যাক্টরী দেখে এলাম। কাল সকালে যাবো ঠিক আছে?
আচ্ছা।
চন্দ্রা?
হুম।
আমি কিন্তু সিরিয়াস।
কোন ব্যাপারে?
এখানে থাকার ব্যাপারে। সত্যি আমার ইচ্ছে হচ্ছে না যেতে। আচ্ছা এখানে কোন ক্লিনিক নেই?
কেন?
ধরো এখানের ক্লিনিকে ডক্টর হিসেবে জয়েন করলাম।
তারপর?
তারপর তুমি এখানের বাগানের বাচ্চাদের স্কুলে চিচার হয়ে জয়েন দিলে। সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে দুজন একসাথে সময় কাটাবো। তারপর সারাজীবন এভাবেই থাকবো।
একেবারে ফিউচার প্লান করে ফেললেন দেখছি।
অবশ্যই।
ডাক্তার সাহেব জীবন এতোটা সহজ নয়। বাগানের জীবন খুব কষ্টের। এখন মনে হচ্ছে ফ্যান্টাসীতে ভরপুর। যখন সত্যি সত্যি চলে আসবেন তখন প্রথম প্রথম ভালো লাগবে তারপর যখন দেখবেন খাবারের জন্য পর্যাপ্ত পরিষ্কার পানি নেই, রান্না করতে হবে মাটির চুলাতে, ফোনে নেটওয়ার্ক নেই, ফেসবুক বা অন্যান্য সোস্যাল মিডিয়া চালাতে পারবেন না, বাজার অনেক দূরে তখন মনে হবে আগের জীবন ঢেড় ভালো ছিলো। পারবেন এই সবকিছু মেনে নিতে?
তোমার ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই পারবো।
ইসসস! নিজের বুঝি কোন ইচ্ছে নেই?
আছে তো। তোমার পাশাপাশি থাকা, একদম কাছাকাছি থাকা।
২৫.
পরের দিন সকালে চন্দ্রা রাশেদকে নিয়ে বের হলো। প্রথম নিয়ে গেল চা ফ্যাক্টরীতে। চায়ের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। চা পাতা পেষ্ট করা থেকে শুরু করে একদম শেষ পর্যন্ত দেখেছে। একদম লাষ্ট প্রসেসের সময় রাশেদ দেখলো একটা বেগুনি রঙের আলোর উপর দিয়ে চা পাতা যাচ্ছে। সে একমনে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্রা চা ফ্যাক্টরীর ম্যানেজারের সাথে কথা বলছিল। সে রাশেদকে খেয়াল করে বললো, রাশেদ ওদিকে তাকিয়ে থেকো না। চোখে সমস্যা হবে।
কেন? ওটা কী?
ওটা সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি। তাকিয়ে থাকবেন না।
তুমি এতো কিছু জানো?
হ্যাঁ।
তাহলে আমি জানি না কেন?
কারন আপনি প্রথম দেখছেন। আর আমি যতবার এসেছি দেখেছি। এখন আরেকটা জায়গায় যাবো চলুন।
কোথায়?
রাবার ফ্যাক্টরী।
চন্দ্রা আমি চা পাতা নেব। কোথা থেকে কিনতে হয়?
এখানে তো প্যাকেজিং হয় না রাশেদ।
তাহলে?
শুধু তৈরি করা হয়। এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে প্যাকেজিং করা হয়। সমস্যা নেই আমি বাবাকে বলে দিবো আমাদের জন্য চা পাতা আনিয়ে রাখতে।
ঠিক আছে।
রাবার ফ্যাক্টরীতে গিয়ে রাশেদের দম বন্ধ হয়ে আসলো। চারপাশ খোলা মাঝখানে কী একটা মেশিনের মতো। এটাকে ফ্যাক্টরী কেন বলা হয় সেটা বুঝতে পারলো না। ছোট একটা জায়গা। এতো বিশ্রী গন্ধ।
রাশেদ নাক-মুখ চেপে বললো, এতো গন্ধ কেন চন্দ্রা?
রাবারের গন্ধ এটা।
এতো বিশ্রী কেনো? বের হও। আমি আর থাকতে পারছি না।
আচ্ছা চলুন।
চন্দ্রা রাশেদকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। রাশেদ বাইরে এসে দম ছাড়লো। প্রান ভরে শ্বাস নিলো। তারপর চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এখন কোথায় যাবো?
আপাদত ঘরে ফিরবো। সকালে খাওয়া হয়নি। সেই খেয়াল আছে?
কী খাবো? বাজার করতে হবে না?
না আমাকে মা বাসা থেকে সব দিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই রান্না করবো।
চন্দ্রা?
হুম।
মনিপুরী কোন মানুষ দেখলাম না কেন?
এতো মানুষ থাকতে মনিপুরীদের কথা কেন?
ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছি সিলেট অঞ্চলে ওরা থাকে।
হ্যাঁ থাকে তবে ওদের আলাদা পল্লী আছে। মনিপুরী পল্লী। সেখানে জনসাধারণ যেতে পারে নি। তবে সেটা এখান থেকে বেশ দূরে। আপনি চাইলে নিয়ে যেতে পারি।
তুমি না বললে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
হ্যাঁ। তবে আমরা যেতে পারবো। যাবেন? আজ হয়তো জনসাধারণ প্রবেশ করতে পারবে।
কেন?
কারন আজ দোল পূর্নিমা। মনিপুরীদের মন্দিরে তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য হবে। সেটা দেখতে অনেক মানুষ আসে। তবে সবথেকে বেশি মানুষ আসে রাস পূর্ণিমাতে। রাস দেখেছেন কখনো?
না।
রাস পূর্ণিমাতে আসবো। ঠিক আছে।
আচ্ছা। তবে একটা জিনিস বুঝলাম।
কী?
তোমাকে এখানে সবাই চেনে তাই না?
আসলে আমাকে চেনে আমার বাবার পরিচয়ে। আর ছোট থেকেই আসি তাই এলাকা, মানুষ চেনা হয়ে গেছে।
আর যাই বলো এখানে আসার পর তোমার হাঁটাচলা, কথাবলা বদলে গেছে।
চন্দ্রা হেসে বললো, বদলেছে কীভাবে?
তোমার হাঁটাচলা, কথাবার্তায় একটা আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে।
সেটা তো হবেই। নিজের এলাকা বলে কথা।
ঠিক ধরতে পেরেছি।
জানেন চাচার বিয়ের পর আমরা এসেছিলাম এখানে নতুন বউ নিয়ে ঘুরতে। আমার ছোট চাচা আমার ছোট চাচীকে ইমপ্রেস করতে এই কচি চা পাতা কচকচ করে খেয়েছে।
তাই নাকি? ছোট চাচি ইমপ্রেস হয়েছিলো?
হ্যাঁ।
তাহলে আমিও খাই। দেখি তুমি ইমপ্রেস হও কিনা?
চন্দ্রা হাসলো। রাশেদ কী জানে না সে অলরেডি ইমপ্রেস। আলাদা করে ইমপ্রেস করার দরকার নেই।
চলবে….