#আমার হৃদয়ে সে
#সূচনা পর্ব
#রোকসানা আক্তার
১.
ঘুমানোর জন্যে মাত্র পাশ থেকে বালিশটা টানলাম এমন সময় ফনক কোথা থেকে এসে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয়।আমি গালে হাত টেনে অবাক চোখে ফনকের দিকে তাকাই।ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ নড়ে উঠার আগেই ফনক আমার মুখের উপর বলে উঠে,
“তোমার সাহস হলো কীভাবে?মাকে দিয়ে আজ রান্না করাতে!তোমাকে না বললাম মাকে দিয়ে রান্না না করাতে!মা প্রেশারের রোগী!তাপের কাছে যেতে অসুবিধে হয়? তারপরও তুমি কেন শুনলে না? মার প্রেশার বেড়েছে যাও এবার গিয়ে সেবা করো।সারারাত বসে বসে সেবা করবে।আজ আর তোমার ঘুম নেই।গো ফার্স্ট! ”
গালে হাত রেখে তাকিয়ে রইলাম ফনকের দিকে।
“কী হলো,যাও?”
ফনকের কথা মতন সটান বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শাশুড়ী মার রুমে এলাম।এসে দেখি মা গাঁয়ে পাতলা চাদর এঁটে সোঁজা হয়ে শুয়ে আছেন।আমি মার বিছানার কাছে গেলাম।কপাল এবং গলায় আলতো হাত বুলিয়ে বললাম,
“মা,আপনার নাকি প্রেশার বেড়েছে?”
শাশুড়ী মা চোখজোড়া তীব্র সংকুচিত করে বলেন,
“নাহ ত।কে বললো, তোমাকে?”
“ফনক।”
“ওহ।আরেহ ছেলেটাও না দেখছো কি পাগল!অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বললাম যে আমি আজ ওর জন্যে নিজহাতে সরষে ইলিশ রান্না করেছি। তুমি এবং ও ভাত খেয়ে নিতে।আমি রুটি খেয়েছি।ভাত আর খাবো না।এটা বলে রুমে চলে এলাম।আর ও ভেবেছে হয়তো আমার প্রেশার বেড়ে গেছে।তুমি গিয়ে বলো যে মার প্রেশার বাড়ে নি।মা এমনি ই শুয়ে আছে।”
“জ্বী,আচ্ছা।”
শ্বাশুড়ি মার কথায় মাথা নেড়ে পেছন ঘুরতেই চোখের কোল বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।অশ্রুটুকু সযত্নে মুছে আবার নিজেকে স্বাভাবিক করি।রুমে আসি।ফনক খাটের উপর আধশোয়া বসে বামহাতটা পেছনের দিকে তুলে ডানহাতে ফোন স্ক্রলিং করছে।আমাকে ভেতরে আসতে দেখে সে ফোন থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়।আমি বললাম,
“মার প্রেশার নেই!”
“কীভাবে বুঝা হলো?মাপা হয়েছে নাকি?”
“নাহ।মা ই বললেন।মার প্রেশার নেই।মা এমনিই শুয়ে আছেন।”
ফনক আমার কথায় কয়েক সেকেন্ডস চুপ করে থাকলো।তার পরমুহূর্তে চোখের মধ্য মণিতে একরাশ চাঞ্চলতা ফুঁটিয়ে আবার ফোনে তাঁকাতে তাঁকাতে বললো,
“ওকে।
ব্যস্ শেষ কথা ফনকের। আমার সাথে আর কোনো কথা বাড়তি কথা বলবে না।ফনক কখনো প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে দুই একটি কথাও বলবে না।যেটা বলা প্রয়োজন তা একবারই বলবে।দ্বিতীয় বার বলার প্রয়োজন বোধ করবে না।বাসায় আসলে সবসময় গম্ভীর মুডে থাকবে!আমি এটাসেটা নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলে শুধু হু,হা উত্তর ছাড়া তার আর কোনো উত্তরই আসে না।এসব আমাদের বিয়ের রাত থেকেই।বিয়ের রাতেই বুঝতে পারি ও আমাকে পেয়ে আসলে ওতটা খুশি হয়নি।কেন হয় নি?কি কারণে?আর না হলেও আমাকে বিয়েটা কেন করেছে সে?এসব প্রশ্নের দ্বার আমার মস্তিষ্কে বার কয়েক ঠুকরে উঠলেও বলার মতন সাহস হয়নি কখনো।আমার বাবার বন্ধুর ছেলে সে।খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা।বন্ধুত্বের আসনটাকে তারা আরো খুব শক্ত করতে দুজনে আমাকে এবং ফনককে বিয়ে দেন।বিয়ে হবার সময় ফনকের সম্পর্কে আমার ওত ধারণা ছিল না।তবে হ্যাঁ সে বিয়ের আগে বার কয়েক আমাদের বাসায় এসেছিল তার আব্বুর সাথে। তখন ফনকের সাথে আমার ওতটা ফ্রিলি কথা হত না। রিলেটিভ হিসেবে সামাজিক মতন যতটুকু বলার ততটুকুই বলতাম। এছাড়া আর কিছু না।এই টুকু সম্পর্কের মাঝেই অন্য আরেকটা সম্পর্ক বাবা জুড়িয়ে দিবে সত্যি তা ভাবলে আমার এখনো কান্না আসে।বিয়েতে আমিও ওতটা রাজি ছিলাম না।শুধুমাত্র বাবার জেদের কাছে হেরে বিয়েতে রাজি হয়ে যাই।বাবা ফনক বলতে অন্ধ একদম।ফনকের মতন ভালো ছেলে আর পৃথিবীতে দ্বিতীয় টি নেই।এমন ছেলের সাথে বিয়ে হলে জীবন ত একদম ফুলের মতন!আজ হয়েছে।ফুলের গন্ধের পরিবর্তে ফুলের কাঁটার আঘাত পেতে হচ্ছে! বাবাকে ভাবলাম বলবো ফনকের ব্যাপারে।কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না।বললে বাবা বিশ্বাস করবে না।দোষ আমাকেই দিবে।আমি খারাপ।আমি বেশি এক্সকিউজ দেখাচ্ছি হ্যানত্যান!সো লাভ নেই।এছাড়া মাকে বললেও লাভ নেই।বাবা যা বলে মাও তাই।তাই মনের কষ্টটা নিজের মনেই চেপে রাখার চেষ্টা করি!তবে আজ একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছি।তা হলো ফনক আমার গাঁয়ে আজ এই প্রথম হাত তুললো।অথচ এর আগে আমার কিছু তার কাছে ভুল মনে হলে কয়েকটা কটু কথা শুনাতো!কিন্তু..ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ জোড়া আবারো বসে আসলো।ফনক বোধহয় এবার আমার দিকে তাকালো।
“এভাবে সং এর মতন দাঁড়িয়ে থাকলে বাতি অফ করবো কীভাবে? ”
বুঝলাম ফনক এবার ঘুমাবে।আমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে বাতি অফ করতে পারবে না।আর বাতি অন থাকলে চোখে ঘুম আসবে না।সরে এলাম।তার থেকে অনেকটা দূরত্বে বজায় রেখে তার পাশের রাখা আমার বর্ধিত জায়গাটুকুতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে গেলাম।বাতি অফ হয়েছে।ফনক হয়তো ঘুমিয়ে যাবে শীঘ্রই!আর আমার আজ ঘুম কি হবে? আর!
২.
মধরাতে বহু কষ্টে চোখপাতার বুজলেও ভোরবেলায় আবার উঠে যাই।কারণ ভোরে ফনক বেরুবে।তার অফিসে আঁটটায় যেতে হয়।কিচেনে এসে প্যানে চায়ের কেটলি বসাই।কেটলি চুলোর আঁচে রেখে তারপর আবার সুঁজি নিই।পায়েস বানাবো।মোটামুটি তিন ধরনের নাস্তা বানানো শেষ হলে তা ডাইনিং এ গিয়ে রাখতেই দেখি ফনক সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেছে।সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখমুখ তার।বেশ ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে।ফোলা মুখের উপর সিল্কি কালো চুলের কিছুটা গোছা কপালে উপর এসে আবার পড়েছে।তারসাথে অফিসে যাওয়ার ফর্মাল ড্রেস সেই সাদা টি-শার্ট,শার্টের উপর কালো টাই এবং কালো প্যান্ট অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে ।আচ্ছা আমি কি তার সুন্দরের থেকে অনেকটা কম? তাই এতটা রিজেক্টেড তার কাছে?কথাটা প্রায়ই আমি ভাবি।আমার ভাবনার মাঝে ফনক চেয়ারে টেনে বসে।আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে হুড়মুড় ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে যাই।খাবার গুলো একে একে টেবিলে সার্ভ করি।ফনক খুব গম্ভীর মুখে খাবার গুলো খেতে থাকে।খাবার এই যে মুখে নিচ্ছে আর আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে একটিবারও আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।ফনকের খাবার মধ্য সময়ে আমার শাশুড়ী মা ডাইনিং এ আসেন।উনার হাতে থাকা ফোনটার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে ফনককে বলেন,
“ফনক?রিমি আজ দুপুরেই বাসায় বেড়াতে আসতেছে।”
এতক্ষণ পর ফনক এবার মুখ খুললো।
“গ্রেটস!কে কে আসবে সাথে?”
“রিমি এবং টিপি।বললাম তুশারকেও সাথে নিয়ে আসতে।তুশারের নাকি অফিসে আবার কি কাজ পড়ে গেছে তাই সে আর আসতে পারবে না।রিমি এবং টিপা বেড়ানো বেশ হলে তাদের নিতে তারপর তখন সে আসবে।”
“বুঝলাম।এখন কি ড্রাইভার নিয়ে আসবে?”
“হ্যাঁ।”
“যাক ভালো হলো।এবার খেয়ে নাও।”
“খাবো একটু পর।তুই কি এখনই চলে যাবি?”
“হ্যাঁ,মা।”
“আচ্ছা তুই অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু।রিমি এবং টিপির জন্যে বাজার করতে হবে।”
“আজ কখন আসবো তা বলতে পারছি না মা।তুমি একটা কাজ করো দারোয়ান কাকাকে দিয়ে বাজারটা করিয়ে নিও।আমি টাকাটা দিয়ে যাচ্ছি।”
বলে ফনক তার মানিব্যাগ থেকে ছয় হাজারের মতন টাকা বের করে তা টেবিলের উপর রাখে।শাশুড়ী মা তা হাতে নেন।বলেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
ফনক উঠে দাঁড়ালো।ঘড়ির দিকে একফোঁড় তাকিয়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো।আমিও তার পেছন পেছন হাঁটা ধরলাম।উদ্দেশ্য দরজা লক করা।ফনক সদর পার হয়।আমি দরজা লক করবো হাতলে হাত রাখি। এমন সময় ফনক কিছু একটা ভেবে সে তার আগের সেই গুরুগম্ভীর মুখখানা নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়।ভাবলাম আমাকে এই বুঝি কিছু বলবে।কিন্তু না! আমার ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে আমাকে পাশ কেঁটে ভেতরে চলে গেল।শাশুড়ী মাকে বললো,
“মা আমার গাড়ির চাবিটা রুমে রেখে এসেছি।”
“বউ মা যাও ফনকের চাবিটা নিয়ে আসো।”
আমি মার কথায় মাথা নেড়ে দুই কদম পা এগুতেই ফনক বলে উঠে,
“তার আনতে হবে না।আমি নিজেই নিয়ে আসতে পারবো মা।”
“বউমা আনলে কী সমস্যা আবার..!”
ফনক তার মার কথাটা শুনেও শুনলো না যেন!সে তরহর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।দুই মিনিট পর চাবি হাতে নিয়ে আবার ফিরলো।বেরুনোর সময়,
“মা গেলাম।”
বলে টুপ করে বেরিয়ে গেল! তারপর আমি দরজা লক করলাম।ডাইনিং এসে শাশুড়ী মাকে খাবার সার্ভ করতে থাকলাম।সার্ভ করার মাঝেই শাশুড়ী মা বলে উঠলেন,
“বউ মা,তুমি বাচ্চাকাচ্চা নিবে না?”
শাশুড়ী মায়ের কথায় আমি কিছুটা দমে যাই।বুকটা ফাঁক ফাঁক করে উঠে।পায়েশের থালাটা খুব শক্ত করে ধরে তা নিচে নামিয়ে শাশুড়ী মার দিকে তাকাই।হাসার চেষ্টা করি।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলি,
“মা নিব।আসলে এখনো ওই ব্যাপারে ডিসিশন নিই নি।আর কিছু সময় যাক..তারপর..।”
“ডিসিশন আর কবে নিবে,হ্যাঁ?তোমাদের বিয়ে হয়েছে আটমাস!আটমাস কি কম?আমার কি দাদী হতে শখ জাগে না?ছাদে উঠলে দেখি মাঠে কত দাদীরা তাদের কি ফুটফুটে নাতিদের নিয়ে মাঠে খেলতে নিয়ে আসে।বাহ কি চমৎকার সেই দৃশ্য!আমার দেখলে খুব হিংসে লাগে।”
শাশুড়ী মার কথা শুনে আমার হাসি চলে এলো।হাসিটা মুখে রেখেই বললাম,
“আচ্ছা মা,বসুন।আপনার চা টা নিয়ে আসতেছি!”
বলে কিচেনে আসি।কিচেনে আসতেই এতক্ষণের ফুটন্ত হাসিটা এবার বিষাদে রূপ নিল।খুব কেঁদে উঠি।মুখ চেপে কেঁদে উঠি।তাও নৈঃশব্দ্যে।জোরেই কাঁন্না পেয়েছে।জোরে কাঁদলে শাশুড়ী মা আবার শুনে ফেলবেন।শুনে ফেলবেন তার ছেলের সাথে আমার দূরত্বের কথা।আরো শুনে ফেলবেন তার দাদী না হওয়ার অপূর্ণতার কথা!