আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৭

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-৭
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

বিভোর অনেকক্ষণ ধরে রুহিকে খুঁজছে। হাতে তুলোর প্যাকেট। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কোথাও দেখতে না পেয়ে নিচতলায় নেমে এলো। কিন্তু কোথাও নেই। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ স্টোররুম থেকে একটা স্টিলের কিছু পড়ার শব্দ কানে এলো। বিভোর কি হয়েছে দেখার জন্য ওখানে গেলো। দরজাটা অল্প খোলা, মনে হচ্ছে যে ভেতরে আছে সে তাড়াহুড়োয় লক করতে ভুলে গিয়েছে। রুহিও হতে পারে ভেবে বিভোর দরজাটা ঠাস করে খুলে দিলো। আর অবাক হয়ে দেখলো একটা লোক রুহির সাথে ধস্তাধস্তি করছে। বিভোরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এগিয়ে গিয়ে ইশতিয়াকের পিঠ বরাবর ঘুসি মারতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো ও। এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি বিভোর এসেছে। ইশতিয়াককে চিৎকার করতে শুনে রুহির হুঁশ এলো। ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিলো ও। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো।

বিভোর রেগে বোম হয়ে আছে। ইশতিয়াককে ফ্লোর থেকে তুলে কলারে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,

‘ তুই কোন সাহসে একটা মেয়ের সাথে এরকম করিস?’

ইশতিয়াক ভয়ে চুপসে গেলো। ওইসময় বড়মুখ করে রুহিকে বললেও এখন বুঝতে পারছে ও কতোটা বিপদে পড়ে গেছে। সবাই জানতে পারলে ওর অবস্থা খারাপ করে দেবে। ও জানে, রুহিকে সবাই কতোটা আগলে রাখে। প্ল্যানটা ফ্লপ হয়েছে বুঝতে পেরে ও বিভোরকে ধাক্কা মেরে পালাতে চাইলো। কিন্তু পেছন থেকে বিভোর ওকে ধরে গলা চেপে ধরলো। হিংস্র গলায় বলল,

‘ তুই যে চোখ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিস, সেই চোখ আমি তুলে নেব!’

উপায় না পেয়ে ইশতিয়াক হিংস্র স্বরে বলল,

‘ ছাড় আমাকে।’

‘ কখনোই না।’

বিভোরের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হলো ইশতিয়াকের। বিভোর ওর পেট বরাবর একটা ঘুসি দিয়ে দু’হাতে ঝাপটে ধরলো পেছন থেকে। ইশতিয়াক নিজেকে ছাড়াতে পারছিলো না, বিভোরের গায়ের শক্তির সাথে কখনোই পেরে উঠবেনা ও। বুঝতে পেরে একটু থেমে আবারও নিজেকে ছাড়াতে বলে উঠলো,

‘ আমাকে ছাড় বলছি, ভালো হবেনা কিন্তু।’

‘ এসব করার আগে মনে ছিলোনা? এখন কেন ছাড়তে বলছিস বাস্টার্ড!’

বিভোরের মুখে গালিগালাজ শুনে কেঁপে উঠলো রুহি। জোরে শব্দ করে কেঁদে দিলো। বিভোর পেছনে ফিরে ওকে দেখার চেষ্টা করতেই ইশতিয়াকের গলা থেকে ওর হাতটা আলগা হয়ে গেলো আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভোরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা খুলে পালিয়ে গেলো ইশতিয়াক।

ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে বিভোর হুমড়ি খেয়ে পড়লো রুহির উপর। আচমকা রুহি গ্রিলের সাথে বারি খেয়ে কঁকিয়ে উঠলো। বিভোর দ্রুত উঠে পড়লো। নিজেকে সামলিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,

‘ লাগেনি তো তোমার? বেশি লেগেছে? দাঁড়াও, আমাকে দেখতে দাও।’

রুহি ঝটকা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ দেখার দরকার নেই।’

বিভোর অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে কী?’

‘ মানে কিছুনা।’

‘ লোকটা এরকম করার চেষ্টা করছিলো কেন তোমার সাথে?’

রাগে, দুঃখে রুহি বলল,

‘ আমি খারাপ মেয়ে তাই।’

‘ এরকম বলছো কেন?’

‘ আমার ইচ্ছা।’

বিভোর রাগী গলায় ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

‘ পালিয়ে গেলো আজকে। ওর কলিজা কেটে নিতাম যদি এখানে থাকতো।’

রুহি ওর কথার জবাব দিলোনা। কাঠ হয়ে বসে রইলো, কাঁদছে। কতবড় সর্বনাশ করতে আসছিলো ইশতিয়াক। বিভোর সময়মতো না এলে কাউকে মুখ দেখানোর উপায় থাকতো না। কিন্তু এসবের জন্য তো বিভোরও একপ্রকার দায়ী। বিয়ে করা বউয়ের প্রতি যার নূন্যতম রেস্পন্সিবিলিটি নেই। রুহি ওর হাত ঘসতে লাগলো, ওই নোংরা লোকটার ছোঁয়া মুছে ফেলতে চাইছে। এই দৃশ্য দেখে বিভোর একপ্রকার জোর করে স্টোররুম থেকে ওকে অন্য একটা রুমে নিয়ে এলো। কিন্তু রুহি উল্টো হেঁটে নিজের ঘরে চলে এলো। দরজা আটকে দিতে চাইলে বিভোর জোর করে ঢুকে পড়লো। রুহির এরকম ব্যবহারে ও প্রচন্ড রেগে গেলেও চুপচাপ রইলো। একটা মেয়ে তার উপর ওর বউ বলে কথা, ওকে ইগনোর করছে সেটা ভয়ংকর ব্যাপার।

রুহি চট করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শাওয়ার ছেড়ে দিতে ভিজতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ রক্তবর্ণ আকার ধারণ করেছে। বিভোরের কথা মনে হতেই বুক থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। দীর্ঘক্ষণ ওয়াশরুমে থাকার পর বাইরে থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো বিভোর।

‘ এক্সকিউজ মি রক্তজবা! কি করছো এতোক্ষণ ওয়াশরুমে? আন্সার মি!’

রুহি উত্তর না দেওয়ায় বিভোর চিন্তিতমুখে আবার ডাকলো। রুহি এবারও জবাব দিলোনা। বিভোর ভাবছে মেয়েটা না আবার এই অপমান না নিতে পেরে খারাপ কিছু একটা করে বসে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই ও ডেস্পারেট হয়ে গেলো। জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলো দরজা। একেবারে ঘেমে-নেয়ে একাকার। কি বিদঘুটে পরিস্থিতি!

‘ এই, তুমি এতোক্ষণ কি করছো? বেরুও বলছি!’

সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার বলল,

‘ আমি কিন্তু এবার দরজা ভাঙতে বাধ্য হবো। শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো, হ্যালো মিস?’

ওয়াশরুমের ভেতর থেকে রুহি বিরক্ত হয়ে গেলো। লোকটা এতো আদিক্ষেতা দেখাচ্ছে কেন আজব! বউ হিসেবে তো মানেই না, এখন দেখ! যেন দরদ, ভালোবাসা উথলে পড়ছে। চুলে টাওয়ালটা ভালো করে প্যাঁচিয়ে দরজা খুললো রুহি। বিভোর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতোক্ষণ ধরে ডাকছে জবাব নেই, এদিকে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। রুহি ওর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো।

বিভোর ছুঁতো খুঁজতে লাগলো কীভাবে ওর সাথে কথা বলবে। রুহি ফিরেও তাকালো না। কিন্তু ঘরের ভেতর একটা পুরুষ মানুষ ওর সাথে কথা বলতে চাইছে এটা ওর জন্য অস্বস্তিকর। বিছানায় ও যেতে পারছেনা, কোনো কাজও নেই।

উপায়ন্তর না পেয়ে রুহি চুপচাপ নিজের ঘর গোছাতে লাগলো৷ সবকিছু পরিপাটি থাকা স্বত্ত্বেও আবার এসব করছে মূলত বিভোরের জন্য । লোকটা জানেনা, রুহি ওর উপর কতোটা রেগে আছে। কতখানি অভিমান করে আছে। যদি জানতো তাহলে বিভোর নামক ব্যক্তিটি কখনো ওর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখার সাহস পেতোনা।

রাত প্রায় দুটোর কাছাকাছি। সব গোছানো কাজ আবার শেষ করে রুহি কাউচে বসে রইলো। এই এতোক্ষণ যাবৎ বিভোর ওর ঘরে বসে ওকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে যেটা ওর জন্য অস্বস্তিকর বিষয়।

‘ শুনো তোমার নাম যেন কী?’

বাহ! বিভোর ওর নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে? ভালোই তো। রুহি না চাইতেও বলল,

‘ রুহানি।’

‘ মনে পড়েছে, রুহি!’

‘ তোমার সাথে ওই লোকটার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
আই মিন বয়ফ্রেন্ড হয় তোমার?’

রুহি কিছু বলল না৷ রাগ হচ্ছে প্রচন্ড।

‘ যদি ওটা তোমার বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকে তাহলে ইমিডিয়েট ওকে রিজেক্ট করো। চরিত্র ভালোনা।’

‘ ওটা আমার কেউ হয়না।’

‘ সেটাই ভালো।’

এরপর দীর্ঘক্ষণ নীরবতা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। রুহির নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছিলো। কিভাবে জানাবে যে এই লোকটাকে সে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে মানে। এতোবছর এই লোকটার জন্য শুধু অপেক্ষা করে এসেছে। ভালোবেসে ফেলেছে লোকটাকে। কিভাবে বললে বুঝবে বিভোর? এতদিন কোনো খোঁজখবর না নিয়ে হঠাৎ আজ এসে বলছে ওকে নাকি ডিভোর্স দেবে। রুহি তো এমনটা কখনো চায়নি। তাহলে কেন দেবে? ওর উল্টাপাল্টা জীবনটাকে সহজ না করে কেন এতো কঠিন করে তুলছে বিভোর। ভীষণ রাগে কেঁপে উঠলো রুহি৷ চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। মাথা নিচু করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে বিভোরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে,

” আমার শুধু আপনাকে চাই৷ আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেন না আপনি!”

কিন্তু চাইলেই তো সবকিছু বলা যায়না। কেমন আন ইজি ফিল করে রুহি৷ তার চেয়ে বড় কথা বিভোর ওকে ফিরিয়ে দিলে রুহি এবার মরেই যাবে। সামনে বসে থাকা লোকটাকে ও হারাতে চায়না। এতদিন দূরে ছিলো, কাছে পেয়ে হারানোটা কতোটা যন্ত্রণার সেটা রুহির চেয়ে ভালো আর কে জানবে!

বিভোর শুধু ওর কাগজের বউটিকে পরখ করে যাচ্ছিলো। মেয়েটির সাথে কতোটা বিশ্রি ঘটনা ঘটতে নিচ্ছিলো, ছিঃ! এমন হলে বিভোর নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতোনা। নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলো মেয়েটিকে। কিন্তু একজনের কাছে দায়িত্ব শিফট করে আর কোনো খোঁজ রাখেনি মেয়েটার। এই অপরাধবোধ কাজ করছে ওর মনে।

রুহির কপালের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে গেলো। কিন্তু ও চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে গুম হয়ে বসে আছে। টু শব্দটিও করছেনা। বিভোর এরকম দেখে তাড়াহুড়ো করে ফ্রিজ খুলে বরফ নিয়ে এলো। একটা আইস ব্যাগে সেগুলো রেখে রুহির কপালে ছোঁয়াতেই রুহি প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো৷ এসব আদিক্ষেতা দেখানোর মানেটা কী? কেন এরকম কেয়ার দেখাচ্ছে! ওর পিছু লেগে আছে কেন! সহ্য হচ্ছেনা ওর, রুহি একদম সহ্য করতে পারছেনা বিভোরকে।

যদি ওকে মেনে নিতো, স্ত্রী’র অধিকার দিতো তাহলে রুহি ওর এসব কেয়ারনেস মেনে নিতো। কিন্তু এখন, কোনোভাবেই না। নো নেভার!

রুহি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলল,

‘ আপনার জন্য সব হচ্ছে। আপনি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছেন। আপনার এসব সো কল্ড কেয়ার আমাকে দেখাবেন না। আমার বিরক্ত লাগছে আপনাকে। আমি কখনো আপনাকে ক্ষমা করবো না।’

ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here