আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৮

আঠারো_বছর_বয়স পর্ব-২৮
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

ভালোবাসা একদিকে যেমন পৃথিবীর সব সুখ বয়ে আনে, এক নিমিষে সে সুখ কেড়ে নিয়ে মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। পৃথিবী নামক গ্রহটিতে “ভালোবাসা” জিনিসটি না থাকলে কী এমন হতো? মানুষ বোধহয় পশুর চেয়েও অধম হয়ে যেতো। তবুও সে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যেতোনা। আত্মার বন্ধন জড়িয়ে আছে ভালোবাসায়। এক আত্মার কষ্টতে অন্য আত্মাকেও জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে হয়।

কিন্তু ডাক্তার হওয়া স্বত্তেও যদি নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে সামান্যতম সাহায্য না করতে পারে, তাহলে কী দাম সেই ভালোবাসার। কলঙ্কিত হয়ে যায়না সেই ভালোবাসা? এতে কি “ভালোবাসা” শব্দটার অপমান হয়না! বিভোরের চোখ রক্তবর্ণ, মুখ শুকিয়ে গিয়েছে দু’দিনেই। হসপিটালের বেডে নিথর দেহটিকে পড়ে থাকতে দেখে আবারও তার বুকটা ভার হয়ে এলো। গলা শুকিয়ে যেন লেগে গেলো৷ কন্ঠনালীতে কোনো শব্দ আসছেনা, মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছেনা।

রুহির গায়ে হসপিটালের আকাশী রঙের পোশাক। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ক্যানোলা। সেদিনের পর আর জ্ঞান ফেরেনি রুহির। পাশে বসে আছে বিভোর। ঘাড়ে ঝুলানো স্টেথোস্কোপটা ডেস্কে রাখলো, তারপর রুহির হাত ধরে বসলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

‘একটাবার চোখ খুলোনা তুমি। একবার দেখবো তোমায়।’

চোখবোজা মানুষটা তার কথা শুনলোনা। বিভোর একটু রেগেই উঠলো।

‘ঢং করছো তাইনা? আমাকে কষ্ট পেতে দেখে খুব আনন্দ লাগছে তোমার? এতোদিন দূরে রাখার প্রতিশোধ নিচ্ছো?’

কথা বলেনা মেয়েটা। বিভোরের রাগের সাথে সাথে খুব অভিমানও হয়। সে কেন খেয়াল রাখতে পারলোনা ওর জবাফুলটার?

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সায়েম আসেন। তিনিই রুহির চিকিৎসা করছেন৷ বিভোরকে আশ্বস্ত করলো যে খুব দ্রুতই রুহির জ্ঞান ফিরবে। মাথা ফেটে রক্ত বের হওয়ায়
একটু বেশিই সমস্যা হয়েছে। তিনি চলে গেলে বিভোর রুহির পাশে বসে রইলো। নাসিমা বাসা থেকে রাতের খাবার নিয়ে এসেছেন। জোর করে কয়েক লোকমা ভাত তুলে খাইয়ে দিয়েছেন বিভোরকে। মা কেন বুঝতে পারছেনা জবাটাকে ছাড়া ওর গলা দিয়ে খাবার নামছেনা? কেন? বিভোর কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। সিস্টার কিয়ারা ওর সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা বললেন। নাদিরা রুহির সাথে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু শরীর ততোটা ভালো নয় বলে বিভোর জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ইভার সাতমাস বয়সী একটা মেয়েবাচ্চা আছে, তাই চাইলেও ও থাকতে পারেনা। তবে সর্বক্ষণ ফোন দিয়ে ওর খোঁজখবর নেয়।

রুহির সাথে নাসিমা চৌধুরী আর বিভোর থাকেন। ছেলের বউয়ের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার যেন তাঁরই। এই মেয়েটাকে তিনি আগে থেকেই খুব পছন্দ করতেন। কখনো ভাবেননি এই মিষ্টি মেয়েটাই তাঁর পুত্রবধূ হবে। কিন্তু পুত্রবধূ হলেও তিনি সেই নজরে রুহিকে দেখেন না। নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখছেন। রুহির এই অবস্থায় তিনি খুবই ব্যথিত। যেদিন হসপিটালে নিয়ে আসে সেদিন বাবর চৌধুরী বিভোরকে আচ্ছামতো ঝাড়েন। কেন সে খেয়াল রাখেনি, ওর জন্য আজ ওর এই অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। রাগে-দুঃখে বিভোর সেদিন কেঁদেই ফেলে। নিজের হাসপাতালে থাকার দরুন সবাই দাঁড়িয়ে ওর কান্না দেখছিলো আর অবাক হচ্ছিলো। সবাই ওকে সান্ত্বনামূলক বাণী শোনাচ্ছিলো। বিভোরের এতোটাই রাগ হয় যে করিডোরের ফুলের টবটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ভেতরে তখন রুহির চিকিৎসা চলছে, রক্ত দেওয়া হচ্ছে। ওর সাথে বিভীরের ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করেনা বলে রক্তটুকুও দিতে পারেনি। ক্ষোভে ওর বুক ফেটে যায়। কীসের প্রেমিক, কীসের স্বামী সে? যেখানে মৃতপ্রায় স্ত্রীকে সে সামান্য রক্তও দিতে পারছেনা তখন সে কীসের স্বামী! নাদিরা, ইভা সবাই ওকে দেখে ঘাবড়ে যায়। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিলোনা। ছেলের মেন্টাল কন্ডিশনের কথা চিন্তা করে বাবর চৌধুরীর মনটা নরম হয়।

তিনি ছেলেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে চোখ রাঙিয়ে গমগমে স্বরে বলেন,

‘তুই আমার গাছ থেকে ফুল খেয়েছিস? আজকাল গরু থেকে ছাগলে আপডেট হলি? তোর এই সাহস কীভাবে হলো যে তুই আমার মেয়েকে সেই খাওয়া ফুল গিফট করিস, আমাকে বললে আমি কি দিতাম না?’

এই ভয়ংকর সিচুয়েশনেও বিভোর বাবার কথা শুনে অবাক। ইভা তো হেসেই দিলো। ছেলেকে এভাবে তাকাতে দেখে তিনি বড়বড় চোখ করে বললেন,

‘এভাবে তাকাবিনা। নজর নিচে রাখ। তুই কি ভাবছিস আমি জানলাম কীভাবে? আসলে আমার মেয়েটার হাতে আমার গাছের সেই কালোগোলাপটি ছিলো। আমার গাছের ফুল আর আমি চিনবোনা? দেখ আমি ওর হাত থেকে নিয়ে এসেছি।’

বাবর চৌধুরী পাঞ্জাবীর পকেট থেকে শুকিয়ে যাওয়া কালোগোলাপটা বের করে দেখালেন। রুহি যখন সিঁড়ি থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখন ওর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছিলো ফুলটি। বাবর চৌধুরীর চোখে পানি এসে পড়ে এই দৃশ্য দেখে। তিনি ফুলটা নিয়ে নেন, নচেৎ কেউ ফেলে দিতো। রুহিকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও পুত্রবধূ ভাবতে পারছেন না। নিজের সন্তান বলে মনে হচ্ছে। ওনার অনেক শখ ছিলো একটা মেয়ের। কিন্তু আল্লাহ পাক তা দান করে আবার নিয়েও গেছেন। জন্মের এক সপ্তাহ পরেই মারা যায় তাঁদের মেয়েটি। নাসিমা তো আজও সেই মেয়ের কথা ভেবে কাঁদেন, তাঁদের প্রথম সন্তান ছিলো মেয়েটি। রুহিকে তিনি “মা” বলেই ডাকেন।

বিভোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন কেঁদে দিয়েছিলো। তিনি পুত্রকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন কারণ ও একজন ডাক্তার। এর থেকে ভয়ংকর সিচুয়েশন ওকে পার করতে হয়েছে। কত মানুষের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে। তাহলে আজ এমন করছে কেন! ওকে তো শক্ত থাকতে হবে। হায়! ভালোবাসাকে হারানোর ভয় যদি কেমন হয়, কেউ যদি বুঝতো তাহলে কেউ কাউকে
সান্ত্বনা দিতোনা। বাবর চৌধুরী তাও বললেন,

‘এমন করছিস কেন? তুই না ডাক্তার। দেখ, এটা তোর হসপিটাল। তোর কাজের জায়গা। সবাই তোর উপর ভরসা করে, এখন তুই-ই যদি নিজের আপনজনের জন্য এভাবে ভেঙে পড়িস তাহলে তাঁদের কী হাল হবে ভেবে দেখতো। ওদের মনোবল ভেঙে টুকরো হয়ে যাবেনা? তুই কি এটাই চাস যে পেশেন্টরা চিন্তায় চিন্তায় মরে যাক? বল!’

বিভোর রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘আমিতো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি, পারছিনা।’

‘তেমন কিছুই হয়নি। ঠিক হয়ে যাবে আমার মেয়েটা। তুই শুধু দোয়া কর আর শক্ত রাখ মনটাকে। দ্যাটস ওকে!’

বাবার কথায় যেনো মনোবল ফিরে এলো বিভোরের। সত্যিই কিছু হবেনা তার জবাফুলটার। সে দেখে রাখবে। এভাবেই নিজেকে সামলিয়েছিলো বিভোর। বাবা-মা যদি সবকিছুতে সন্তানের পাশে থাকে তাহলে যেকোনো কঠিন মুহূর্ত পার করা অতোটাও যন্ত্রণাদায়ক
নয়।

______

চারদিকে কেমন শীত শীত আমেজ। কুয়াশাজড়ানো ভোর। দূর দিগন্তের কোনোকিছুই প্রায় চোখে পড়েনা। আবাসিক এলাকায় অতিথি পাখিদের আগমন ঘটেছে। কিচিরমিচির শব্দ অনেকদূর অবধি পৌঁছায়। দূরের লেকটার পানি শান্ত, স্থির। পানির উপরে ফুটে আছে পদ্মফুলের কয়েকটি কলি। তারও উপর মেঘের মতোন ভাসছে কুয়াশারা। পদ্মপাতার উপর জমেছে শিশিরকণা। অতিথি পাখিদের সেই কলরব আর অসাধারণ শীতের আগমনে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে বিভোর। আশ্চর্য! চারটা দিন আগেই না কাঠপোড়া রোদ তার তেজ দিয়ে পৃথিবী ঝলসে দিচ্ছিলো! এই পৃথিবী আর প্রকৃতির নিয়ম বড়ই অদ্ভুত!

বিভোরের চোখ রক্তলাল। চারদিনের মধ্যে সে কয়েক মিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক কর‍তে পারেনি।
কাল রাতেও জেগে ছিলো, রুহিকে একব্যাগ রক্ত নিতে হয়েছে। তবে জ্ঞান এখনো ফিরেনি। দীর্ঘ একটা রাত ছিলো, শেষ হতেই চাইছিলোনা। জোৎস্নামোড়ানো সেই রাতটাতে ওর জবাফুলটাকেই চাঁদ মনে হচ্ছিলো। বিভোরের বুকের কান্নারা সেই জোৎস্নার আলোর রঙ ধারণ করেছিলো! একা থাকায় কত কষ্ট তা বুঝতে পারে বিভোর। এই গল্পগুলো বলবে সে জবাফুলটাকে। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে নিশ্চয়ই শুনবে রুহি। বিভোরের মনে পড়ে সেই গান,

‘আমি তোমাকেই বলে দেব
কি-যে একা দীর্ঘ রাত,
আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে।

আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প।
কড়া নেড়ে গেছি, ভুল দরজায়!
ছুঁয়ে কান্নার রঙ, ছুঁয়ে জোৎস্নার ছায়া…(২)

আমি কাউকে বলিনি সে-নাম
কেউ জানেনা, না জানেনা আড়াল…(২)
জানে কান্নার রঙ, জানে জোৎস্নার ছায়া।’

মন হারানো এক সুগন্ধি’তে হঠাৎ পুরো ঘরটা ভরে যায়৷ বিভোর এক পলক রুহিকে দেখে আবার বাইরে দৃষ্টি মেললো। তারপরই প্রচন্ড শব্দ করে কিছু একটা নিচে পড়ার আওয়াজ হলো। চমকে উঠলো বিভোর। পেছন ফিরে দেখলো রুহির পা নড়ছে। কাচের গ্লাসটা ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে ফেটে গিয়েছে। বিভোর দ্রুত এলো তার জবাফুলটার কাছে। আশা, তাঁর রুহির জ্ঞান ফিরেছে। তবে সে কেমন যেন করছে। ইশারায় বিভোরকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মুখ ফুটে সেই কথাটা বলতে পারছেনা। রুহির চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। ওর মনে হচ্ছে বিভোরকে আর দেখতে পারবেনা। ডাক্তারবাবুর চেহারাটা ঘোলাটে দেখছে সে। অনেকক্ষণ পরে বিভোর বুঝতে পারলো তাঁর জবাফুলটির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here