আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩২ (শেষ পর্ব)

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩২ (শেষ পর্ব)
#সাহেদা_আক্তার

যে কষ্ট ও একলা সহ্য করেছে সে কষ্ট এখন ভাগ করে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। নিজেকে শক্ত করে পড়া শুরু করলাম।

💔 পর্ষীর জ্বর:
গত দুইদিন ধরে মেয়েটার জ্বর চলছে। আম্মু এসেছে দেখার জন্য। কিন্তু মেয়েটা জ্বরের ঘোরে কেবল তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজ একমাস মেয়েটার খাওয়া দাওয়া নেই ঠিকমতো। স্কুলে বাসায় সব সময় চুপচাপ। তুমি চলে যাওয়ার পর আমুল পরিবর্তন হয়ে গেছে যেন। আগের মতো হাসে না। খেলে না। দৌঁড়াদৌঁড়ি করে না। রুমে বসে থাকে বই খুলে। যেন পড়ছে। কিন্তু আমি জানি বইটা কেবল বাহানা। বই খুলে তাকিয়ে থাকে তোমার ছবির দিকে। হাসতে যেন ভুলে গেছে। রাতে আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি পাশে নেই। রুমের এককোণায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এভাবে করলে আমার মেয়েটাকে বাঁচাবো কিভাবে!

💔 বিদায়:
আজ দুই মাস হয়ে গেছে। আমরা আর পারছি না ছোঁয়া। তোমার স্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমার মেয়েটা আধমরা হয়ে গেছে। সারাদিন তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। স্কুলে যায় না ঠিকমতো। খাওয়া দাওয়া জোর করে করাতে হচ্ছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। লন্ডন চলে যাবো ওকে নিয়ে। আর থাকা সম্ভব না। আমরা চলে গেলে কি তুমি অভিমান করবে? ভালোবাসি খুব। বড্ড বেশি……

তারপর আর কিছু নাই। এরপর ওরা হয়ত লন্ডন চইলা গেসিলো। পর্ষীকে দেখলে মনেই হয় না সে এতটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখন যে লাফালাফি করে! পাকনা থেকেও পাকনা। এটুকু মেয়ের বুদ্ধি কত! আমার মেয়ে কি না। বলতেই ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি পাইলাম। পর্ষী আমার মেয়ে। আর গাজরটা মানে আমার লাল চেরি বরটাও কেবল আমার। উফ! আমি বিছানায় গিয়া ঝাঁপ মারলাম। লজ্জা পাইতে পাইতে কখন মরার মতো ঘুম দিলাম আর খেয়াল নাই।
.
.
.
.
সকালে ঘুম থেকে জেগেও উঠতে ইচ্ছে হইতেসে না। শুয়ে শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকাই রইলাম। কাল রাতে যে কি শুনলাম এগুলা! আল্লাহ! মাথাটা এখনো চক্কর কাটতেসে। গাজরটা, চেরিটা আমার এককালে জামাই ছিল। উফ! ভাবতেই লজ্জা লাগতেসে। আবার মনে পড়ল তার ভাষ্যমতে আমাদের বিচ্ছেদ হইয়া গেসে। এ্যা……

আম্মু ডাক দিলো বাইরে থেকে। উঠবো না উঠবো না করে উইঠা গেলাম। এমনিতেও কালকে না খেয়ে আছিলাম ঢং দেখাইতে গিয়া। এখনো না খাইলে আমার পেটটারে আর খুঁইজ্যা পাওয়া যাইবো না। দরজা খুলতেই আম্মু একটা ম্লান হাসি দিলেন। বললেন, খেতে আয়।

– ফ্রেশ হয়ে আসছি আম্মু।

আম্মু ডাকটা শুনে মুখটা আরো ম্লান হই গেল। আমি বুঝলাম কিন্তু কিছু কইলাম না। তাদেরই সব বলে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হারানোর ভয় বলে তো একটা জিনিস আছে তাই অনেক সত্যি কথা মিথ্যার ভয়ে চাপা পড়ে যায়।

আজকে নাস্তায় দেখলাম মেলা খানা। আমি ইচ্ছে মতো খাইলাম। খাওয়া শেষ হইতেইই মন চাইলো একটা লম্বা ঢেঁকুর দিতে। কিন্তু আব্বা আম্মার সামনে থাকায় দিলাম না। সবাই চুপচাপ খাইতেসে। আমি চইলা যাইতে লাগলেই আব্বু কইলেন, বসো। তোমার সাথে কথা আছে। আব্বুর গলাটা কেমন যেন ধরা। আমি কোনো আপত্তি না কইরা বসলাম।

– তুমি তো সব জেনেই গেছো। রাতুলের কাছে যখন শুনেছিলাম তোমার বাবা মা কেউ নেই তখন আর লোভ সামলাতে পারিনি। আমাদের মেয়েটা মারা গেছে একেবারে ছোট থাকতে। কয়েক মাস বয়স তখন। ডাক্তার আগেই বলেছিল আমরা এখন বাচ্চা না নিলে আর নিতে পারবো না। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করে যখন বাচ্চা নিতে পারলাম না তখন বুঝলাম আমাদের সন্তানের আশা ত্যাগ করতে হবে। সেভাবেই কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু তোমাকে পেয়ে আমাদের সব অভাব পূরণ হয়ে গেছে। এজন্য আমি রাতুলের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। আমাদের ক্ষমা করে দিও।

আব্বু কান্না করে দিলেন। আম্মুও নীরবে কাঁদতেসে। আমি আব্বুর সামনে গিয়া বললাম, কে বলেছে আমার আব্বু আম্মু নেই? এই যে আমার সাথে বসে আছে। খাচ্ছে, কথা বলছে।

– ছোঁয়া…

– হতে পারে তোমরা আমার আসল আব্বু আম্মু না। কিন্তু তোমরা তাদের থেকে কি কম করেছো? আমি অসুস্থ থাকাকালে কি না করেছো। আমার সব সময় খেয়াল রেখেছো। আমার আসল আব্বু আম্মুর কথা মনে নেই। কিন্তু যা মনে আছে তা তোমাদের স্মৃতি। তোমরাই আমার বাবা মা।

এতক্ষণ পর আব্বু আম্মুর মুখে হাসি দেখতে পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রাতুল কোথায়? ঝিলিক কইলো, ছাদে গেসে সকালে। এখনো আসে নাই।

– আচ্ছা।

– তুমি কি বিয়ে করবা?

– তুই চুপচাপ খা। কারবারি একটা৷

আমি বাসা থেকে বের হয়ে ছাদে চইলা আসলাম। চারতালা বাইতে বাইতে হাত ঠ্যাং সব গেল। উঠে হাঁপাইতে হাঁপাইতে চারদিকে তাকাইলাম। রাতুল ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে তাকাই আছে নিচের দিকে। আমি গিয়া পাশে দাঁড়াইলাম। ও কিছু কইলো না। আমিই শুরু করলাম।

– পাখিটা দেখো। কি সুন্দর লাগছে আকাশে দেখতে।

– হুম।

– বলতো পাখিদের কোথায় দেখতে ভালো লাগে? আকাশে বেড়িয়ে গান গাইতে না খাঁচায় বন্দি রাখতে?

– ছোঁয়া, আমি…

– উ হু। যা বলছি তার উত্তর চাই।

– আকাশে।

– তাহলে বাঁধতে চাইলে কেন?

– ছোঁয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি সেই স্কুল লাইফ থেকে। তোমার সাথে হওয়া সেই ক্রিকেট ম্যাচটা আমি আজও ভুলতে পারি না।

– ক্রিকেট ম্যাচ!?

– হ্যাঁ, ও তোমার তো মনে নেই। আমার সাথে তোমার বাজি হয়েছিল। যদি তুমি তিনটা বলের একটায় ছক্কা মারতে পারো তবে আমি একজনকে খেলতে নিবো। প্রথম দুই বলে পারোনি। কিন্তু শেষ বলে…

– কি?

– চেরি বলে একটা ছক্কা মারলে।

– তাহলে তোমার আগেই আমি আকাশকে ভালোবাসতাম।

রাতুল চুপ কইরা গেল। আমি কইলাম, ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা জোর করে পাওয়া যায় না। আবার এমনও হয় যে দুইজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবেসেও ভাগ্যে না থাকায় হারিয়ে ফেলে। আমি সব ভুলে গেলেও আমার ভেতরটা আকাশের ভালোবাসা ভোলেনি। হাজারের মাঝেও তাকে খুঁজে নিয়েছে। রাতুল, এক তরফা ভালোবাসাটা খুবই কষ্টের। তুমি আমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছো এতদিন। আমি সেজন্য অনেক কৃতজ্ঞ কিন্তু নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।

– আমি এই ভয়ে প্রতি মুহূর্তে ছিলাম। যদি আকাশ ফিরে আসে। তাও নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু এত কিছু করেও তোমার মন জিততে পারিনি। তবে…

– তবে?

– বিয়েটা হবে।

আমি আর রাতুল দুজনে বাসায় আসলাম। আব্বু আম্মু বসার রুমে বসে আছেন চিন্তিত অবস্থায়। ঝিলিক দরজা খুইলা দিলো। আমরা দুইজন তাদের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। কেমনে কমু সেই চিন্তায় আর লজ্জায় মুখে চেইন টানসি। হাতে দুইটা কচলাইতেসি, কাচুমাচু করতেসি। যত সহজে বিয়েতে মানা করা যায় তত সহজে বিয়ের কথা বলা যায় না। রাতুল বলল, ফুফা ফুফু বিয়ের আয়োজন করো। আগামী শুক্রবার বিয়ে। আম্মু আব্বু একে অপরের দিকে তাকাই কইলো, ছোঁয়া বিয়েতে রাজি?

– হুম। বিয়েটা হবে তবে আমার সাথে না।

– তাহলে কার সাথে?

– ওর আগের স্বামী আকাশ আয়মানের সাথে।

আমি এক দৌঁড়ে রুমে দৌঁড় দিলাম। ইস্ নামটা শুনলেই এখন লজ্জা লাগে। আমি নাকি এক বাচ্চার মা!
.
.
.
.
দুইবছর পরে,

– দেখো না পরশ কাঁদছে।

– তো আমি কি করব?

– যাও না। কোলে নাও।

আকাশ বেশ বিরক্ত হইয়া গেল। পরশ হওয়ার পর থেকে কাম করাই জ্বালাই মারতেসি। এত ভালোবাসে আর একটু বাবু সামলাবে না? এখন বাচ্চাটা কানতেসে। বাচ্চাদের দুইটা কাজ। খাওয়া আর বাথরুম। একটু আগেই আকাশের গায়ে বাথরুম করসে। বেচারা ওকে চেঞ্জ করে, ঘুম পাড়িয়ে, গোসল করে এসে আমাদের সাথে টিভি দেখতে বসছিল। এখন খাওয়ার দরকার। সে আমার কাছে আইসা কইল, ওর খাওয়ার সময় হইসে। আমি টিভির দিকে তাকাই কইলাম, তো খাওয়াও। পর্ষী ঝিলিককে বলতো আমাকে আরেকটু পপকর্ণ ভেজে দিতে।

– আমি খাওয়াবো!?

– হুম।

আকাশ আমার দিকে ভেটকাই তাকাই রইসে। আমি ওর দিকে তাকাই কইলাম, কি হল? আকাশ আমাকে হঠাৎ কোলে তুলে রুমে নিয়া গেল। আমি চার হাত ঠ্যাং নাচাইতে নাচাইতে কইলাম, আরে ছাড়ো। মেয়েটার সামনে কি শুরু করসো? ও আমারে নামাই কইলো, করবো না? দুই মাসের দুধের শিশু আর আমি নাকি তাকে খাওয়াইতাম। আমি হাসি চাপতে চাপতে কইলাম, ও সরি সরি।

আকাশ বসার ঘরে পর্ষীর পাশে গিয়া বসে বলল, তোর মায়ের মাথাটা গেছে বুঝলি? পর্ষী মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হঠাৎ কলিংবেল বাইজা উঠল। মুন রেদোয়ান লাবিবকে নিয়া তাদের দাদার বাড়ি গেসে। আব্বু আম্মুদের আসার চান্স আছে। আকাশ দরজা খুইলা দেখেলো রাতুল আসছে।

– তুমি? এসো ভেতরে।

রাতুল ভেতরে আসলো। সোফায় বসতে বসতে বলল, ছোঁয়া কোথায়? আকাশ বলল, আছে ভেতরে।

– বাচ্চারা কেমন আছে?

– ভালো।

– হুম, এটা বাচ্চার জন্য। জন্মের সময় তো আসতে পারিনি। তাই ছোট একটা উপহার আনলাম।

আকাশ উপহারটা নিল। পর্ষী এসে জিগাইলো, কেমন আছো আঙ্কেল? রাতুল হেসে বলল, ভালো। তবে আজ আমি একটা জিনিস দিতে এসেছিলাম।

– কি?

ও একটা বিয়ের কার্ড দিয়ে বলল, আমার বিয়ে। সামনের শুক্রবার। বাচ্চাদের নিয়ে অবশ্যই এসো। আমি তখন পরশকে ঘুম পাড়িয়ে বসার রুমে আসলাম। রাতুলকে দেখে হাসলাম। সেও একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল, উঠি। আমি বললাম, একটু নাস্তা করে যাও। সে বলল, নতুন বউকে নিয়ে একদিন আসবো না হয় তোমার হাতের গাজরের হালুয়া খেতে। বলে রাতুল চলে গেল।

আকাশ বলল, ওর উপর যতটা রাগ ছিল তার থেকে বেশি আমি কৃতজ্ঞ। ও না থাকলে হয়ত আমি তোমাকে ফিরে পেতাম না। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমার ভালোবাসার টানেই আমি আজ ফিরে এসেছি। ও আমার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলো। পর্ষীও আমাদের জড়িয়ে ধরল। এমন মুহুর্তে পরশের আবার কান ফাটা চিৎকার। আমি মুচকি হেসে বললাম, তোমার ডাক পড়েছে। আকাশ হতাশ ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, বাচ্চাগুলা তোমার কাছে দুদন্ড থাকতে দেবে না। আমি পেছন থেকে হাসি চাইপা রেখে কইলাম, সাবধানে পরষ্কার কোরো। আগের মতো জামা কাপড়ে ভরিয়ে ফেলো না।

সমাপ্তি……… 🥰

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here