আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩০ (বোনাস পর্ব)

#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩০ (বোনাস পর্ব)
#সাহেদা_আক্তার

– আপনার স্ত্রীর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আইডি কার্ড দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। আপনি এখুনি হাসপাতালে আসুন। অবস্থা খুবই খারাপ।

শুনেই আকাশ দৌঁড়ে হাসপাতালে চলে আসলো। রেদোয়ান, আয়ানও ওর পেছন ধরল। আশে পাশে রোগীতে গিজ গিজ করছে। কাছেই একটা বাস এক্সিডেন্ট হয়েছে। চারদিকে সবাই ছোটাছুটি করছে। লাশের সারি করিডোরে। আকাশ পাগলের মতো আমাকে খুঁজে চলছে আহতদের মধ্যে। একবারও মনে হয়নি যে এদের মধ্যে নাও থাকতে পারে। নিহতের কাতারেও মানুষ থাকে। আয়ান রিসেপশনে গিয়ে আমার খোঁজ করল। রিসেপশনিস্ট বলল, সাতশ তিন নং কেবিন। পেশেন্টের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। কিছুক্ষণ আগে তাকে মৃত বলে জানিয়ে গেছে। আমরা খুবই দুঃখিত স্যার।

এই কথা শোনার সাথে সাথে আকাশের যেন দুই পায়ের শক্তি চলে গেল। বসে পড়ল ফ্লোরে। আয়ান ওর কাছে এসে বলল, ভাই, ভাবিকে দেখতে যাবি না? ওর মুখে কথা নেই। পাথর হয়ে বসে আছে ফ্লোরে। রেদোয়ান জড়িয়ে ধরতেই ওর শরীর কাঁপুনি দিয়ে কান্না এল। বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল, আমার ছোঁয়াকে এনে দে। আমার পৃথিবী না দেখা সন্তানটা! আমার পর্ষীকে কি জবাব দেবো? মেয়েটা এখনো মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। না হলে তার ঘুমাতে চায় না। আমি কি করব!? সামনের দিনগুলো কিভাবে বাঁচবো!?

সবাই খবর পেয়ে ছুটে চলে আসল। কেবিনে ভীড় করে আছে। ঢেকে রাখা সাদা কাপড়টা তুলতেই সবার বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। চেহারা বিভৎস হয়ে আছে। চেনার উপায় নেই। সারা শরীরে রক্ত শুকিয়ে আছে। কেবিনের ভেতরে চলছে কান্নার রোল। আকাশ ঠায় বসে আছে পাথরের মতো কেবিনের বাইরে। পর্ষী এখনো জানে না তার আম্মু আর ফেরত আসবে না ওর কাছে। ওকে বাংলোয় রেখে আসা হয়েছে বাকি বাচ্চাদের সাথে।

রাত দশটার আগেই লাশটাকে কবর দেওয়া হয় আমার আব্বু আম্মুর কবরের সাথে। চারদিকে সবাই কাঁদছে। পর্ষীর কপালে তার আম্মুকে শেষ বারের মতো দেখা হলো না। বরং সেই বিভৎস চেহারার ভয়ঙ্কর স্মৃতির নিয়ে ঘুরতো সারাজীবন। একটার দিকে সবাই বাংলোয় ফিরলো। বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে গেছে। সবাই যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেল তাদের রুমে। কেবল আকাশের ঘুমহীন চোখ দুটো খোলা। পাশে পর্ষী ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা জানেও না।

আকাশের চোখটা লেগে এসেছিল। পর্ষীর ঠেলায় জেগে উঠে বলল, কি হয়েছে আম্মু? পর্ষী ঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, আম্মু কোথায়? আকাশ কি বলবে বুঝতে পারল না। বোবার মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। পর্ষী বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল। শেষে ওকে শান্ত করার জন্য বলল, আসবে আম্মু, তুমি ঘুমাও। ঠিক আসবে। পর্ষী আবার শুয়ে পড়ল আকাশকে জড়িয়ে ধরে। আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের নোনা জল বালিশ ভিজছে। কিন্তু অন্তরের ক্ষত কবে শুকাবে!

রাতুল কবর দেওয়ার সময় গিয়েছিল। কেঁদেছিল। কিন্তু ঐ চোখের জল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই মুছে ফেলল। যে মারা যায়নি তার জন্য কেঁদে কি হবে? রাতুল সোজা হসপিটালে চলে গেল। যেখানে আমি শুয়ে আছি। দুই হাতে ক্যানোলা লাগানো। মাথায় কাচও ঢুকে গিয়েছিল। তাই মাথা নেড়া করে ফেলা হয়েছে অপারেশনের আগে। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। গলায় সার্ভিক্যাল কলার বেল্ট লাগানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। হার্টরেট দেখা যাচ্ছে মেশিনে। মরার মতো শুয়ে আছি।

কালকে লম্বা সময় ধরে অপারেশন হয়েছে। বাসে থাকায় সামনের সিটের সাথে প্রচন্ড জোরে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারা ছিলাম। রাতুল বেড়াতে গিয়েছিল। সেদিনই ওর কাজিনের সাথে কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলো। পথিমধ্যে জানতে পারলো রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই জ্যাম বেঁধেছে। সে এক্সিডেন্ট স্পটটা দেখতে গিয়েই আমার দিকে ওর নজর পড়ে। স্ট্রেচারে করে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিলো। তখন থেকেই রাতুল আমার সাথে। সিটি স্ক্যান করে ডাক্তার ইমিডিয়েট অপারেশন করার পরামর্শ দেয় এবং বলে আমার ফ্রন্টাল লোবের অনেক ড্যামেজ হয়েছে। এতে স্মৃতি শক্তি হারানোর সম্ভাবনা ৮০%। বলে ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে চলে যায়।

রাতুল বাইরে বসে আছে। অপারেশন শুরু হয়েছে আধা ঘন্টা। হঠাৎ চাদনি এসে বলল, তুমি রাতুল না?

– জ্বি। আপনি?

– আমি আকাশের ফ্রেন্ড। এখানেই ডক্টর হিসেবে আছি। তোমাকে আমি দেখেছিলাম কয়েকবার ছোঁয়ার সাথে।

– জ্বি, আমি ওর স্কুল ক্লাসমেট ছিলাম।

– এখানে? কেউ অসুস্থ?

রাতুল সব খুলে বলল চাদনিকে। সে বলল, সো স্যাড! আচ্ছা আপনাকে একটা ব্যাক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করব? রাতুলের সব বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। চোখ মুছতে মুছতে বলল, বলুন।

– আপনি ছোঁয়াকে ভালোবাসেন?

– হঠাৎ এ প্রশ্ন?

– আপনার কান্না দেখেই বুঝতে পারছি। আমিও একজনকে ভালোবাসি। জানেন কাকে? আকাশকে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনি আপনার ছোঁয়াকে পেয়ে যাবেন আর আমি আমার আকাশকে। এমনিতেও ছোঁয়ার কিছু মনে থাকবে না। ৮০% মানে অনেক। ইউ ক্যান ট্রাই ইট।

– কি প্ল্যান?

চাদনি তার প্ল্যান বলার পর বলল, যদি আপনি আপনার ভালোবাসাকে পেতে চান তাহলে এটাই সুযোগ। তবে হ্যাঁ খেয়াল রাখবেন যাতে ছোঁয়া আকাশের সামনে না আসে। এটা আমার কার্ড। রেখে দিন। প্ল্যানে রাজি থাকলে জানাবেন। ছোঁয়াও আকাশকে ভুলে যাবে আর আমিও আমার আকাশকে আপন করে নিতে পারব। পর্ষীও মা পেয়ে যাবে। বলেই চাদনি হেঁটে চলে গেল। রাতুল অনেক ভাবার পর মনে হল এতে কারোরই ক্ষতি হবে না। সে তার ছোঁয়াকে পাবে আর চাদনি আকাশকে। পর্ষীরও মায়ের অভাব হবে না। সে রাজি হয়ে ফোন দিয়ে চাদনিকে জানিয়ে দিল।

চাদনি একজন লোককে দিয়ে ফোন দিয়ে আকাশকে আমার কথা জানিয়ে দিল। তারপর সদ্য মৃত একজন মেয়ের পরিচয় আমার নামে দিয়ে রিসেপশনে জানিয়ে দিল সে কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে। আকাশও এসে জানতে পারল ছোঁয়া নামে যে ছিল সে মৃত। মেয়েটির শরীর আমার মতো হওয়ায় আর চেহারা দেখতে না পাওয়ায় সবাই ধরেই নিয়েছিল আমি মারা গেছি। সবাই সেই মৃত লাশ দাফনে ব্যস্ত হয়ে গেল। অন্যদিকে রাতুল অপারেশনের পর তার ফুফা ফুফুকে হাসপাতালে আসতে বলল। তারা আসতেই রাতুল বলল আমি অনাথ। সে আমাকে চিনে। এখন তারা যদি চায় তবে আমাকে এডাপ্ট নিতে পারে।

ফুফা ফুফু নিঃসন্তান ছিল। একটা মেয়ে ছিল কিন্তু অনেকদিন আগে মারা গেছে। তাই সন্তানহীন জীবনে একটা ছেলে বা মেয়ের খুবই অভাব ছিল তাদের। তাই তারা কোনোকিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যায় এবং ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকে। জ্ঞান ফেরার পর জানা গেল সত্যিই আমার পুরানো কিছু মনে নেই। রাতুল তার ফুফা ফুফুকে আমার বাবা মা হিসেবে পরিচয় করে দিল। তারা আমাকে অনেক যত্ন করে সুস্থ করে তোলে। আমাকে ভার্সিটি ভর্তি করায়। আমি ওদের সব কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নেই। সব স্বাভাবিক থাকলেও রাতের বেলা কি যেন দেখে ভয়ে জেগে উঠতাম। আবছা কাদের যেন দেখতাম। মাঝে মধ্যে শরীর খারাপ হয়ে বমি হতো। মাথা ব্যাথাটা নিত্য সঙ্গীর মতো হয়ে গেল।

এদিকে পর্ষী যখন জানতে পারল আমি আর নেই তার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চাদনি বহু চেষ্টা করে আকাশের মনটা নরম করতে পারলেও পর্ষীকে বাঘে আনতে পারলো না। তাই অন্য প্ল্যান করল। দুই মাসের মাথায় পর্ষীর দোহাই দিয়ে চাদনি আকাশকে লন্ডন চলে যাওয়ার প্রস্তাব করল। আকাশও তাতে রাজি হয়ে যায় কারণ এখানে আমার স্মৃতি তাকে আর পর্ষীকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে যাওয়ার আগে কৌশল করে আকাশ থেকে একটা ডিভোর্স পেপারে সাইন নিয়ে নেয়। রাতুলও আমাকে এটা ওটা বুঝিয়ে সাইন নিয়ে নিল। ফলে আমার সাথে আকাশের আর কোনো সম্পর্ক রইলো না।
.
.
.
.
একবছর পর আকাশ পর্ষীকে নিয়ে দেশে ফিরল। বাসায় যাওয়ার আগে একবার দেখতে এল আমার কবর। আসার সময় জ্যামে পড়ল ওরা। গাড়িতে থেকে হঠাৎ পর্ষী চেঁচিয়ে ওঠে, আম্মু আম্মু। আমি সেদিন সাহেদাকে নিয়ে নাচের ক্লাসে যাচ্ছিলাম। ও আমাকে ঠিকই দেখেছিল। আকাশ দেখার আগেই আমি ভবনে ঢুকে গেলাম৷ তাই ও কাউকে দেখতে না পেয়ে পর্ষীকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে, তোমার আম্মু নেই সোনা। সে গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু আকাশের জন্য বের হতে পারল না। এদিকে জ্যাম ছেড়ে দিল।

পর্ষী বের হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু নাচের স্কুলের নামটা ঠিকই মুখস্ত করে নিল। বাসায় আসতেই মুন দরজা খুলল। আকাশের অনুরোধেই মুন আর রেদোয়ান ওদের বাসায় থাকে এখন। ও চায় না ছোঁয়া জিনিসগুলো অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাক। পর্ষী মুনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মুন জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে পর্ষী সোনা? কাঁদছো কেন? আম্মুকে মনে পড়ছে?

– আমি আম্মুকে দেখেছি। আমি যাবো আম্মুর কাছে।

– ও কি বলছে আকাশ ভাইয়া?

– রাস্তায় কাকে দেখে ছোঁয়া ভেবেছে। তখন থেকে কেঁদেই চলেছে। কি করব বলো?

– না, আমি আম্মুকেই দেখেছি। এ্যাঁ……

– আচ্ছা আগে ফ্রেশ হয়ে নাও, অনেক জার্নি করেছো। তারপর সব শুনবো।

মুন পর্ষীকে নিয়ে রুমে চলে গেল। রেদোয়ান বলল, মেয়েটা এখনো ছোঁয়ার মায়া থেকে বের হতে পারেনি। আকাশ দরজা মারতে মারতে বলল, আমিই পারিনি আর ও তো বাচ্চা। মেয়েটার জন্যই ভয় হয়। দেখ কেমন শুকিয়ে গেছে এক বছরে। দুইজনই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

দুইদিন পর লন্ডন ফেরার কথা ছিল। কিন্তু পর্ষী রাজি নয়। সে বাংলাদেশে থাকবে বলে জেদ ধরল। মেয়েটার এমনিতেও মন খারাপ থাকে প্রায়ই। তাই আর জোর করল না। ভর্তি করিয়ে দিল একটা কিন্টারগার্ডেনে। আমরা এর মধ্যে একদিন ফুসকা খেতে গিয়ে পর্ষী দেখে ফেলল। আমাদের পিছে হেঁটে চলেও এল। আমি যখন পৌঁছে দিলাম আবার কিন্ডারগার্ডেনে তখন মুন এসে ওকে নিয়ে গেল। মুন আমাকে পিছন থেকে দেখে চিনতে পারল না। বাসায় যাওয়ার পর গলা ফাটিয়ে কান্না করতে লাগল পর্ষী। কেউই ওকে শান্ত করতে পারল না। আকাশ হসপিটাল থেকে আসার পর শান্ত হলো।

আকাশকে বলে ভর্তি হয়েছিল নাচের স্কুলে শুধু আমাকে খুঁজে পাওয়ার আশায়। যতবার যেতো ততবার চারদিকে তাকিয়ে কেবল আমাকে খুঁজতো। আমি যেদিন গেলাম সেদিন পর্ষীর মন খারাপ ছিল। মনে মনে বলছিল, আজ যদি আম্মু আসতো! ঠিক তখনই আমি তাকে দেখতে পেয়ে কথা বলতে গেলাম। আর সে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করল। তাকে বুঝিয়ে নাচ শেখার জন্য নিয়ে এলাম। একটু পর পর আমাকে দেখতে লাগল যদি আবার হারিয়ে যাই।

মুন যখন এলো আমি ভয়ে সরে গেলাম। পর্ষী অনেক বলেও বোঝাতে পারল না যে আমি বেঁচে আছি। বাসায় গিয়ে আকাশকেও বার বার বলল আমাকে দেখার কথা। কিন্তু তারা কি করে বিশ্বাস করবে যে আমি বেঁচে আছি যেখানে নিজ হাতে আমাকে দাফন করে এসেছে।

কদিন পর আয়ান ভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন করল। আর সেদিনই আমি লেট করে গেলাম। আমাকে দেখে ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে প্রকাশ করল না। ক্লাস শেষ হতেই বাইরে এসেই আকাশকে কল দিল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here