#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_২৯
#সাহেদা_আক্তার
গাজর আসছে। তার সাথে রাতুলের কি নিয়ে যেন তর্ক হচ্ছে। আমি দরজা খুইলা রুম থেকে বের হতেই দুজনে আমার দিকে তাকালো।
আমি তাদের দিকে তাকাই আছি। আকাশে গাল দুইটা টকটকে লাল। দেখেই বুঝা যাইতেসে বেশ রেগে আছে। আমি কিসুই বুঝলাম না এত রাগারাগি হইতেসেটা কি! ঝিলিক কাচুমাচু হইয়া একপাশে দাঁড়াই আছে। বাচ্চা মাইয়াটা ভয়ে শেষ। আকাশ আমার কাছে আইসা বলল, ছোঁয়া তুমি এ বিয়েতে রাজি? আমি তার প্রশ্ন শুইনা ভাবলাম সে জানলো কেমনে! সাহেদার কাজ! এজন্য বলসিলো আমাদের! বেদ্দপ মাইয়া, আমারে বললে কি হইতো!? কিন্তু আমার বিয়ে হইলে কি ওর কিছু যায় আসে? যেভাবে রাগে লাল হই আছে। বুঝতেসি না। আমি কাচুমাচু কইরা কইলাম, আসলে…
– হ্যাঁ বা না।
আমি তার দিকে তাকাই কইলাম, না। আমি…। সে আমারে পাত্তা না দিয়া আবার রাতুলের লগে তর্ক জুড়াইলো। কি জ্বালা! তাদের ঝগড়ার আগা মাথা যদিও কিছুই বুঝতেসি না তবে একটা জিনিস বুঝলাম যে তারা আমারে নিয়া ঝগড়া করতেসে। আমি দুইজনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাই ঝগড়া দেখতেসি। আহা! দুই সুদর্শন যুবক আমাকে নিয়া ঝগড়া করতেসে। নিজেরে নায়িকা নায়িকা লাগতেসে। দুই নায়ক নায়িকাকে পাওয়ার জন্য ঝগড়া করতেসে। হঠাৎ মিনার জাদুর চেরাগের দৈত্যের কথা মনে পড়ল। সে আমার কানে কানে কইতেসে, তুমি কি সিনেমার নায়িকা হতে চাও? আমি মনের আনন্দে হ্যাঁ বলবার আগেই হঠাৎ আমার উপর সুনামি বয়ে গেল। কি হইলো!? আমি ভাবনার জাগত থেকে বাস্তবে ফিরে ওদের দিকে তাকাই রইলাম। আকাশ গ্লাস হাতে। আমাকে পানি মারার কারণ কি? আকাশ আমার কাছে এসে ঘাড়ের কাছে কাপড় দিয়ে ঘষতে লাগল। আমি মনে মনে কইলাম, আরে এত ঘষতেসো ক্যান? আল্লাহ! ঝামা দিয়া ঘষে চামড়া তুইলা ফেলতেসে। কিন্তু ঘষতেসে ক্যান!? আকাশ ঘষে বলল, এই দেখো। রাতুল তাকিয়ে দেখলো আমার ঘাড়ে একটা কামড়ের দাগ। আমি লজ্জায় ফাউন্ডেশন দিয়া রাখি। আর গাজরটা সেটা দেখাইতেসে। আকাশ বলল, আমি আমার ছোঁয়াকে চিনতে ভুল করি না রাতুল। আর এই দাগটা আমি ভালো করে চিনি। এটা আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন। ওর শরীরে আমার চিহ্ন। শুইনাই কাঁইপা উঠলাম। এতদিন চিন্তা করতাম এমন রাক্ষসের মতো কামড়টা কে দিসে। এখন দেখি এটা গাজর রাক্ষসের কাম! আমি ভিতরে ভিতরে গাল ফুলাই রাখলাম৷ পঁচা গাজর। আমার এত সুন্দর ঘাড়টারে কামড়াই খাই ফেলসে। ভাবতেই লজ্জায় লাল নীল বাত্তি জ্বলতে লাগলো আমার মুখে। কিন্তু সে! কেমনে কি! কথা হইলো এই কামড়টা সে দিলো কবে!?
আকাশ রাতুলের কলার চেপে ধরে বলল, এত স্বার্থপর কি করে হলে? কি করে? ছোঁয়া প্রেগনেন্ট ছিল। বুঝতে পারো ছোঁয়া আর আমার সন্তানকে হারিয়ে আমি কতটা কষ্টে ছিলাম? পর্ষীর মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। না খেয়ে মেয়েটা শুকিয়ে শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। তুমি জানতে, তাই না? মিথ্যে চোখের জল দেখাতে এসেছিলে। সব জেনে শুনে চাদনির সাথে মিলে ছোঁয়াকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলে আমার থেকে। ওর স্মৃতি নেই জেনে নিজেকে ওর মনে বসাতে চেয়েছিলে। আমাকে আর আমার মেয়ে চিরতরে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলে।
আকাশের কথা শুইনা আমি আকাশ থেকে পড়লাম! এসব কি বলতেসে!? আমি নিজের পেটে হাত দিলাম। আমার সন্তান ছিল এক্সিডেন্টের সময়! আর পর্ষী আসলো কোথায় থেকে! পর্ষী সব সময় আমাকে আম্মু আম্মু ডাকতো কিন্তু আমি পাত্তা দেই নাই। কিন্তু তাকে আশেপাশে দেখলে খুব ভালো লাগতো। সে জড়াই ধরলে অন্য রকম শান্তি পাইতাম। আর ঐ পিচ্চি শাঁকচুন্নির সাথে আকাশের কি সম্পর্ক! রাতুল চুপ কইরা দাঁড়াই আছে। আকাশ আবার বলল, আর কত লুকাবে ওর থেকে সত্যি? আমার ভয় হতো ওকে পুরানো স্মৃতি মনে করাতে। ওর লাইফ রিস্ক হতে পারে ভেবে কিছু বলিনি। তাও চেষ্টা কম করিনি। ওর সামনে এসেছি, বার্থডেতে একইভাবে উইশ করেছি, ওর মতো লবণ দিয়ে গাজরের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছি, পর্ষী এসেছে, ওর সবচেয়ে প্রিয় শাড়িটা দিয়েছি। তাও কিছুই মনে করাতে পারিনি। তার মানে এই নয় যে সে আমাদের ভুলে গেছে। আমার ভালোবাসা ভুলে গেছে। সুযোগ দিয়েছি বলে ভেবেছিলে নিজের করে নেবে?
আমি রাতুলের দিকে তাকাই আছি। হঠাৎ নিজের গাল বেয়ে কিছু পড়ার অনুভূতি হইতেই হাত দিলাম। আমার চোখ থেকে পানি পড়তেসে। বুঝতে পারতেসি না এসব কি বলছে আকাশ! আমি রাতুলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি বলছে এগুলো বন্ধু? আমাকে বলো। আমি কি ভুলে গেছি? আমি কেন আমার ছোটবেলার ছবি পাই না? তোমাদের জিজ্ঞেস করলে কথা ঘুরিয়ে ফেলতে। আব্বু আম্মু সবাই কি লুকাচ্ছো? আমাকে বলো। কি হল?
রাতুল সোফায় বইসা পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি তোমাকে আবার হারাতে চাই না ছোঁয়া। আমি রাতুলের কাছে গিয়া বললাম, প্লিজ তোমরা আমাকে বলো সবটা। প্লিজ…। আকাশ আমাকে এক বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা বলা শুরু করল।
.
.
.
.
(একবছর আগে)
– পর্ষী…, আরে দাঁড়াও। এমন দুষ্টামি করে না। ভালো মেয়ের মতো খেয়ে নাও।
– না। আমি খাবো না। তোমার জামাইর হাতে খাবো।
বইলাই মাইয়াটা দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে লাগল। এই মেয়েটা এত চটপটে হইসে না! পাকনা পাকনা কথা। অল্প বয়সে পাইকা টসটস করতেসে। বাপেও সমান তাল দেয়৷ আরেকটু বড় হোক একেবারে বিয়ে দিয়া বিদায় কইরা একটু শান্তি হবো। তখন জামাইরে বলব, বাবা এই পাগলকে তুমি সামলাও। আমি আর দুইটা পাগলকে সামলাইতে পারবো না।
আমি মেয়েটার পেছনে পেছনে খাবার নিয়া ছুটতেসি। এদিকে মহাশয়ের ডাক। আকাশ ওয়াশরুম থেকে ডাইকা উঠলো, ছোঁয়া…, এই ছোঁয়া………। কি কুক্ষণে এই পাগলাটার প্রেমে পড়সিলাম! বাপ মাইয়া একসাথে আমার ত্যানা জীবনে আগুন লাগাইয়া কয়লা কইরা দিলো।
– কি হয়েছে?
– টাওয়ালটা দাও না।
– ওয়াশরুমে ঢুকার সময় নিয়ে নিতে পারো না?
– কি করব? মনে থাকে না। দাও না।
আমি একটা লাঠিতে টাওয়ালটা নিয়া কইলাম, ধরো, দরজা খুলো। সে দরজা খুলতেই আমি টাওয়াল আগাই দিলাম। সে টাওয়ালটা শক্ত কইরা ধইরা এমন টান মারলো যে লাঠিটা শুদ্ধ নিয়া গেল। সে ওয়াশরুম থেকে বলল, এটা কি!? আমি তখন বাইরে হাসতে হাসতে শেষ।
– কি আবার? তোমার ধান্দা আমি বুঝি না? আজকে তো টাওয়াল ভেতরেই রেখে এসেছিলাম। এটা বাইরে আসলো কেমনে?
– নিয়ে বের হয়েছিলাম আর কি। ভুলে গিয়েছি নিতে।
– হ্যাঁ, তোমার সাথে এতদিন সংসার করছি আর আমাকে তো বোকা পেয়েছো। মেয়েটা এত বড় হয়েছে তাও লজ্জা সরমের বালাই নেই।
– এমন করো কেন?
– মেয়েটা বড়ো হচ্ছে তো নাকি? তোমাকে দেখে দেখেই পেঁকে গেছে কাঁচা বয়সে।
আকাশ ওয়াশরুম থেকে বের হইতে দেখি মাথা না মুইছা বের হই গেসে। আইসাই আমাকে জড়াই ধইরা কইলো, হইলে হইসে। দেখবা আমার মেয়ে তার জামাইকে অনেক ভালোবাসবে আমার মতো। আমি তাকে ছাড়াই কইলাম, হ, তোমার মতো ভালোবাসলে আমার মেয়ে না খেতে পেয়ে মরবে।
– কেন!? কেন!?
– তোমার মেয়ে ভালোবাসার ঠেলায় তাকে যে সারাদিন ঘরে বসাই রাখবে। তখন জামাই তোমার মেয়েকে খাওয়াবে কেমনে?
সে আমার হাতে টাওয়াল ধরাই দিয়া বলল, সেটা তারা বুঝবে। আমি আমার বউকে ভালোবাসবো৷ এটাই ফাইনাল। এখন আমার মাথার চুল মুছে দাও। সে গিয়া বিছানায় বসলো বাচ্চা ছেলের মতো। আসছে ঢং করতে, বইলা ওর মাথার মুছতে শুরু করলাম। ও আমারে জড়াই ধইরা পেটে মুখ ডুবাই দিলো।
– আরে করছোটা কি! ছাড়ো। মেয়েটা বসার রুমে।
– না তো। নো ছাড়াছাড়ি। তোমার শাস্তি আছে। আমাকে বলো নাই কেন?
মাথার চুল মুছা শেষ। এখন চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বললাম, বলার আগেই তো জেনে ফেললে। ভেবেছিলাম তোমার উজ্জ্বল মুখটা দেখবো খবরটা দিয়ে। সে আমার পেট থেকে মুখ সরিয়ে বলল, দেখলি বাবা? তোর কথা তোর মা আমাকে না জানিয়ে সবাইকে জানিয়ে বেড়িয়েছে।
– আরে! সবাইকে কই জানালাম!? কেবল মুন জানে। ও… মুন তো আবার তোমার স্পাইগিরির চাকরি নিয়েছে। ভুলে গিয়েছিলাম। ওকে দিয়ে ক্লাস এইট থেকে বিয়ের আগে পর্যন্ত স্পাইগিরি করিয়ে শান্তি হয়নি। আমাকে এত জ্বালিয়েছো তোমরা!
সে আবার আমার পেটে মুখ ডুবিয়ে বলল, যাকে ভালোবাসি তাকে না জ্বালালে শান্তি আছে? মেয়েটাকে বসার ঘরে টম এন্ড জেরি ছেরে দিয়ে এসেছি৷ দরজাও খোলা। হঠাৎ এসে গেলে কি হবে! আমি তাকে জোর কইরা সরাই দিয়া বললাম, আরে ছাড়ো। কটা বাজে? নয়টা তো বেজেই গেল। যাবে না আজ চেম্বারে? আসো আমি নাস্তা দিচ্ছি। আমি আসার সময় তার দিকে এক পলক তাকাইলাম। ওর রোমান্সে পানি ঢাইলা যে মজা পাই সেই মজা হাসির গল্প পইড়াও পাই না। ওর গোবেচারা মুখ দেইখা হাসতে হাসতে রান্নাঘরে গেলাম।
নাস্তা দিলাম টেবিলে। রুটি আর গরুর ঝোল। প্লেটে দিচ্ছি মেয়েটা বায়না ধরল চিনি দিয়ে খাবে। পর্ষীটা আমার মতো মিষ্টি পাগল হইসে। আমি চিনি আইনা দিলাম। আকাশটা ওরে খাওয়াই দিতে লাগল। পর্ষী হঠাৎ কইলো, আব্বু, আম্মুকে খাওয়াই দিবা না?
– আসছে পাকনা বুড়ি। নিজে খেয়ে শেষ করো।
– আহা, বকছো কেন? আসো খাইয়ে দেই।
– আমি খেতে পারবো। তোমরা খেয়ে বের হও তাড়াতাড়ি। দেরি হচ্ছে।
– আরে, বসো তো। পর্ষী মামুনির ছোট ভাই বোনটা আব্বুর হাতে খেলে তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে চলে আসবে।
পর্ষী শুইনাই চেয়ার থেকে উইঠা লাফাতে লাগল আর আনন্দে তালি দিয়ে বলতে লাগল, আমার ভাই হবে। আমার বোন হবে। কি মজা! আমি ওকে চুপ করাই বসাই বললাম, হয়েছে। এখন খেয়ে নাও। দশটায় স্কুল এখনই সাড়ে নয়টা বাজিয়ে ফেলছে।
খাওয়া শেষে ওর এপ্রোন আর স্ট্যাথোস্কোপটা এনে দিলাম। বের হওয়ার সময় আকাশ জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু লাগবে? আমি অনেক ভেবে বললাম, আলুবোখারার চাটনি পেলে এনো। এখন খেতে ভালো লাগবে।
– আচ্ছা, সাবধানে থেকো।
– টাটা আম্মু।
দুইজনে বেরিয়ে যেতেই আমি আরাম কইরা সোফায় বসলাম। শরীরটা কেন যেন ছেড়ে দিতেসে। দুইদিন পরই আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারি। দেয়ালে টাঙানো ছবিটাগুলোর দিকে তাকাইলাম। আব্বু আম্মুর ছবিটা দেখে মনে মনে বললাম, আম্মু তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে। অথচ মনে মনে এখনো তোমাদের খুঁজি। কতদিন হয়ে গেল!
.
.
.
.
সবাই অপেক্ষা করতেসে রেদোয়ানদের বাংলোয়। আজকে আমাদের ম্যারেজ এনিভার্সারি। বাংলোয় সেলিব্রিট করার কথা মুনই বলল। তাই সবাই ওখানে একসাথে হবে আজ। আর আজকেই আমরা আমাদের বাবুর কথা জানাবো সবাইকে। আমি একটু বের হইসিলাম। একটা দরকার ছিল। দুপুর দেড়টা বাজে আমার কোনো খবর নাই। তারপর একটা ফোন আসলো আকাশের ফোনে।
– হ্যালো কে বলছেন?
– আপনি আকাশ আয়মান?
– জ্বি।
– আপনার স্ত্রীর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আইডি কার্ড দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। আপনি এখুনি হাসপাতালে আসুন। অবস্থা খুবই খারাপ।
চলবে…