আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_২৫
সাহেদা_আক্তার
দরজার দিকে তাকাইতেই মনে হইলো কে যেন দরজার বাইরে দাঁড়াই আছে।
আমি সাবধানে গিয়া দরজা খুলতেই ধড়াম কইরা সাহেদার রুমের ফ্লোর ফাইটা গেল। আমি নিজেও ভয় পাইয়া গেলাম। তারপর তাড়াতাড়ি কইলাম, আপনি ঠিক আছেন? চাচি কোকাইতে কোকাইতে গলা ফাটা চিৎকার কইরা কইল, মা গো, বাবা গো, মাজাটা গেল গো। গেল গেল, আমার মাজা আর নাই। গেল…। সাহেদা দৌঁড়ে এসে বলল, কিরে!? কি করে হলো?
– দরজাটা খুলতেই আর কি…
আমি আর সাহেদা উঠানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাদের দুইজনের ঘাম ছুটে গেল তাকে এক ইঞ্চি নড়াইতে৷ এত বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দেখতে সবাই দৌঁড়াইয়া আসলো। সবাই মিলে ঠেইলা তুললাম তারে। মনে হইতেসিলো এই বুঝে তলায় পইড়া প্রাণ পাখি উইড়া যাইবো৷ সাথে কানে তালা লাগানো বাবা গো মা গো চিৎকার। তারে কোনোমতে ধইরা রুমে নিয়া গেল সবাই।
– সে কান পেতে কি শুনতে আসছিল আল্লাহই জানেন।
– জানতে আসছিল তার হবু বউ মা কতটা চিনা বুদ্ধির টাইটানিক জাহাজ।
– হুর। কিসের হবু বউ? ঐ পোলারে বিয়ে করা আর জেনেশুনে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া একই জিনিস।
– তুমি তিনজনের যে হাল করসো।
– তিনজন কোত্থেকে আসলো?
– এই যে মাজা ভেঙে বিছানায় শোয়াই দিলি।
– এটা তো এক্সিডেন্ট। তাও ভালো হইসে। কান পাতার শাস্তি। করবে না বউমা? করুক। বুঝবে মজা। আর বাকি দুজন তো ওদের অপরাধের শাস্তি পাইসে। বেশ হইসে।
– হায়রে! এখন কি অবস্থা কে জানে!
– বন্ধু অলরেডি কালকে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলসিলো ওয়াশরুমে যাওয়ার। পরে টনে টনে স্যালাইন খাওয়াই হুঁশ আসছে।
– এমন খারাপ অবস্থা! তাহলে আকাশ ভাইয়ের কি অবস্থা!
– আমি কেমনে জানি। বাসায় নাই। তালা দেখসি। সর তো। আমি ঘুমাবো। কি যে ঘুম পাইতেসে। পরে ডাক দিস দরকার হইলে।
আমি বিছানায় ল্যাটকাই (শুয়ে) গেলাম। আরাম কইরা সকালে না ঘুমাইলে সারাদিন ঘুমে পাগল হয়ে পাবনা যামু।
কথার কিচিরমিচিরে ঘুমটা ভাইঙা গেল। তাকাই দেখি মানুষে গিজগিজ করতেসে রুমের মধ্যে। পাশে সাহেদাও মরার মতো ঘুমাইতেসে। আমি গুতাই গুতাই কইলাম, ওই বেডি, উঠ। বিয়া তোর আর তুই পড়ি পড়ি ঘুমাস।
– ছোঁয়া আরেকটু।
ওর ফোন বাজতেই কইলাম, ওই আয়ান ভাই কল দিসে। সে লাফাই উইঠা বলল, ফোন কই? ফোনটা ঠ্যাংয়ের তলে বাজতেসে৷ সে খুঁইজ্যা নিয়া কইলো, ধুর, আর সময় পাইলো না সিম কম্পানির লোকগুলা।
– একেবারে ঠিক টাইমে ফোন দিসে। যা ফ্রেশ হয়ে নে।
– আর তুই আরো ঘুমা।
আমি দাঁত কেলাইলাম। ঘুম কি আর সে যাইতে দিবে? সে যাওয়ার আগে আমারে ঠিকই টাইনা উঠাইলো। আমি হামি দিতে দিতে দেখলাম কত মানুষ! বাচ্চা কাচ্চা সব এদিক ওদিক ছুটতেসে, খেলতেসে। ফোনটা দেখে বেকুব হই গেলাম। সাড়ে দশটা বাজে! ফ্রেশ হয়ে বের হইতেই পেটটা ষাঁড়ের মতো ডাক দিলো। খুদা লাগসে। খাবারের সন্ধানে রান্নাঘরে যেতেই আন্টি বলল, উঠেছো? সাহেদা উঠেছে?
– জ্বি আন্টি।
– ধরো এগুলা খেয়ে নাও দুজনে।
আমারে চা বিস্কিট ধরাই দিয়া আবার কাজে লাইগা গেলেন। আমিও ভালো মেয়ের মতো চইলা আসলাম। সাহেদারে ডাইকা বসতে বসতে কইলাম, মানুষে তো এখনই গিজগিজ করতেসে৷ বাকিরা আসলে কই বসাবে? ও বিস্কিট চুবাইতে চুবাইতে কইলো, ছাদে স্টেজ করবে।
– বেয়ে বেয়ে পাঁচ তলা উঠবো!?
– কি করা? ছাদে করলেই সুবিধা হবে। একপাশে স্টেজ অন্য পাশে খাবারের আয়োজন।
– হুম। বুঝলাম।
আমি তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতেই জিগাইলো, কই যাস? আমি কইলাম, তোর স্টেজ দেখতে যাই। সে কিছু বলার আগেই কয়েকজন আত্মীয় আইসা ওর লগে গল্প জুইড়া দিলো। আমি রুম থেকে বের হইয়া কাপ পিরিচ রাইখা ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়া দিলাম।
ছাদে কাজ চলছে। বাঁশ লাগানো হইতেসে এক পাশে। আরেক পাশে স্টেজ সাজানো শুরু হই গেসে। কাপড় দিয়ে স্টেজ বানাই ফেলসে। এখনো অনেক কাজ বাকি। আঙ্কেল তদারকি করতেসেন। আমি এক চক্কর দিয়া নিচে চইলা আসলাম। সোজা বাসায়৷ এখন সাহেদার আত্মীয়রা আসবে। ব্যস্ত থাকবে। সন্ধ্যার দিকে সাইজা যামু নে। কলিংবেল টিপতেই রাতুল দরজা খুলল। তারে দেইখা ঢোক গিললাম। সাবধানে এক পাশ কইরা ঢুইকা রুমে চইলা গেলাম। আম্মার সকালে ডিউটি, তাই সে সকাল সকাল চইলা যাওয়ার কথা। আব্বাও কাজে গেসে গা। ঝিলিক রান্নাঘরে খুটখাট করতেসে। আমি চুপচাপ বিছানার এক কোণায় বইসা আছি। খিদা লাগসে আবার খুব।
বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। বলতে তো পারি না আমারে খাওন দেন। খিদায় আমার পেট ব্ল্যাকহোলে পরিণত হইয়া গেসে। এখন যা সামনে পামু তাই গিইলা ফেলমু। বাসায় হাঁটাহাঁটি করতেও ভয় লাগতেসে। কখন বন্ধু ঘপাৎ কইরা টুটি চাইপা ধরে বলে, আমারে জোলাপ খাওয়াইসো ক্যান!? আমি এসব ভাবতেসি এদিকে বসার ঘর থেকে টম এন্ড জেরির শব্দ আসতেসে। ঝিলিক টিভি ছাড়সে। আমিও গিয়া খাবার নিয়া বসলাম। পাশের সোফায় রাতুল বসা। আমি নিঃশব্দে খাবার গিলতেসি আর মনে হইতেসে সে আমার দিকে তাকাই আছে। আমার খাওয়ার মাঝে সে দুইবার ওয়াশরুম গেল৷ তার মানে এখনো এফেক্ট যায় নাই!
আমি খাওয়া দাওয়া শেষ কইরা রুমে ঢুইকা বিশাল ঢেকুর দিলাম। যাক এতক্ষণে পেটটা শান্তি হইসে। আমি পিছন ফিইরা দরজা মারবো এমন সময় দেখি পাহাড়ের মতো রাতুল আমার পিছনে দাঁড়াই আছে। আমি মেকি হাসি দিয়া কইলাম, কিছু বলবে?
– কাল হালুয়ায় কি ছিল?
– কই কি ছিল?
– বাটির হালুয়ায় কি ছিল?
– যাই থাকুক তুমি চুরি করে খেয়েছো কেন?
– খেয়েছি বেশ করেছি। বাসার মানুষকে না দিয়ে বাইরের মানুষকে কেন দেবে?
– আমি তো সবার জন্যই বানিয়েছিলাম। ফাঁকে তুমি ওগুলো খেয়ে অসুস্থ হলে।
– কি ছিল বাটির গুলোয় যে কেবল আমিই অসুস্থ হলাম!?
– সেটা তোমার শাস্তি। চুরি করেছো কেন? এখন যাও তো। আমার কাজ আছে। রেডি হতে হবে।
আমি তারে ঠেইলা দরজা লাগাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বেশ হইসে অসুস্থ হইসো। খাইবা আর অন্যের জিনিস?
আমি মনের আনন্দে আলমারি খুইলা বসলাম। কিছুতেই কিছু পছন্দ হয় না। একটা একটা কইরা শাড়ি খুইলা দেখতে লাগলাম৷ একটাও মানানসই মনে হইতেসে না। মনে মনে আফসোস করতেসি ঐ লেহেঙ্গাটার জন্য। কি যে সুন্দর ছিল! আমি শাড়ি দিয়া পুরা বিছানার বারোটা বাজাই দিলাম। দুই ঘন্টা পরে ঝিলিক দরজা নক করলো। আমি উঁকি মাইরা কইলাম, কি রে?
-তোমাকে খুঁজতেসে।
– কে?
– একটা লোক। পাসেল না কি যেন…
– পার্সেল হাবা। কি হয়েছে? পার্সেল এসেছে?
– হ্যাঁ।
আমি গিয়া দেখলাম এক ছোকড়া দাঁড়াই আছে। আমাকে একটা বর্গাকার বাক্স ধরাই দিয়া একটা কাগজে সাইন করতে বলল। আমি সাইন কইরা দরজা মারলাম। ঝিলিক উৎসাহিত হইয়া বলল, কি গো ছোঁয়াপু?
– খুললে তো জানবো৷ দেখি দাঁড়া।
রুমে আইসা দেখলাম পুরা বিছানা শাড়িতে ভর্তি কইরা রাখসি। এবার শাড়িগুলা গুছানো লাগবে। আমি আর ঝিলিক মিইলা গুছাই ফেললাম। তারপর বাক্সটা নিয়া বসলাম। উপরের প্যাকিং খুইলা বাক্সটা খুলতেই কয়েকটা বাক্স বের হইলো। বড়ো বাক্সটা খুইলা আমি খুশিতে আত্মহারা হই গেলাম। সেই সাদা লেহেঙ্গাটা। তার উপর একটা চিরকুট। সেখানে লেখা, তোমাকে দেখার অপেক্ষায় থাকবো আগের মতো। পরের বাক্সটা ঝিলিক খুলল। একটা চকার সেট। সাদা পাথরের সুক্ষ্ম নকশা করা। তার সাথে হাতের চুড়ি আর টিকলি। সেখানেও একটা চিরকুট। সে কইলো, ছোঁয়াপু দেখো একখান কাগজ। আমি চিরকুটটা নিলাম। লেখা, তোমাকে এটায় দারুণ মানাবে। আরেকটা বাক্সে একটা রজনীগন্ধার থোকা আর তিনটা হলুদ গোলাপ। চিরকুটে লেখা, ভালোবাসি ভালোবাসি শুধু যে তাকে, ভালোবেসে ভালোবাসায় বেঁধে যে রাখে। ভালোবাসি।
আমি চিরকুটটা নিয়া বইসা আছি। ঝিলিক বলল, কি লেখা গো ছোঁয়াপু? আমি চিরকুটটা লুকাই কইলাম তেমন কিছু না।
– কে দিসে?
– আমার একজন পরিচিত। ঝিল, যা তৈরী হয়ে নে। আমাকে হতে দে।
– এত তাড়াতাড়ি!
– আরে, ঠিক কর কোনটা পরবি। যা যা…
আমি ওরে বাইর কইরা দিলাম। তারপর জিনিসগুলা আবার দেখতে লাগলাম৷ কে হইতে পারে!? মাথায় আসতেসে না। বন্ধু? না, সে কেমনে হবে? সে তো জানেই না আমি এটা পছন্দ করসি। কে জানে, কে জানে!? পর্ষী ছাড়া তো আর কেউ জানে বলে মনে হয় না। তাহলে কি পর্ষীর কাজ! কিন্তু এত ছোট পুচকি কি করে এত কিছু করবে। আর চিরকুটগুলা দেখে তো মনে হচ্ছে অন্য কেউ। কে হইতে পারে? ধুর।
সাহেদা চিন্তার মাঝে ফোন দিল। আমি রিসিভ করতেই কইলো, কি রে? সেই যে গেলি আসার নাম নাই। আসিস না কেন? আমি কইলাম, সন্ধ্যায় আসমু রেডি হয়ে।
– না তুই এখুনি আয়৷
– কিন্তু …
– কোনো কথা নাই। এখন আসবি মানে। এখুনি।
– আচ্ছা আচ্ছা। আসছি।
সে ফোনটা কাইটা দিল। মাইয়াটা বিয়ার আগেও শান্তি দিল না গো। আমি সব গুছাই বাক্সটা নিয়া রওনা দিলাম উপরে। এত মানুষের মাঝে বাক্স নিয়া কোনোমতে আস্তো ওর রুমে পৌঁছাইলাম। ও আমারে কইলো, এটা কি? আমি কানে ফিসফিস কইরা কইলাম, সিক্রেট।আমার কথা শুইনা ও সবাইরে বের কইরা দিয়া দরজা মাইরা বলল, এবার বল কি। আমি সব খুইলা দেখিয়ে সব কইয়া বললাম, কে হতে পারে বলতো?
– তোর জামাই।
চলবে…