অসুখের নাম তুমি,১১,১২
সোনালী আহমেদ
পর্ব:- ১১
চুলোয় কড়াই বসানো হয়েছে পিঠা বানানোর জন্য। নিভু নিভু আগুন জ্বলতেই, তাতে একটুখানি ঘি ঢেলে দিলো। চালের গুড়ো দিয়ে বানানো নরম নরম পিঠাগুলো খানিকবাদেই কড়াইয়ে দিয়ে দিলো। এক পৃষ্ঠতল সামান্য লাল হতেই উল্টিয়ে দেয় অপরপৃষ্ঠ। চুলোর গরমের তাপে আধ-সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রমণী। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আবারো নাড়াচড়ায় মন দেয়-পুতুলের সাজে সজ্জিত বাসন্তী রঙের কাপড় পরিধানকৃত রমণী। মুখে ক্লান্তির ছাঁপ না ফুটলেও বিরক্তি স্পষ্ট ফুটে রয়েছে।
দাদী শাশুড়ির বোনের বাড়ীর লোকজন এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। তাদের জন্যই এই নাস্তাপানি বানানো হচ্ছে। বড় জা কাজটি করতে চেয়েছিলো কিন্তু সে দিলো না। পোয়াতি মেয়ে বলে কথা। এই সময়ে সবারই বিশ্রামের প্রয়োজন,তাই সে গুরুদের মতো আদেশ দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে সুমিকে। গত দুইদিন থেকেই সুমিকে কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না রেশমি। তার এক কথা,’ সে যখন সুস্থ হবে তখন যেনো কাজ করে।’ কিন্তু কাজ করতে থাকা অভ্যস্ত অন্য রমণীর মন কি আর কাজ ছাড়া থাকতে চায়! তাই তো বারবার আসে কোনো না কোনো কাজ করতে।
লাঠি হাতে নিয়ে মেঝেতে ঠক ঠক বারি দিতে দিতে উপস্থিত হন জমিলা বেগম। পাকঘরের দিকে মুখ তুলে বলেন,
‘ কি গো হয়েছে! আর কতক্ষণ লাগবে? সামান্য একটু নাস্তা বানানোর গুণ খানা ও নাই কি?’
‘ হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর রহমতে সব গুণ আছে, সময় তো দিবেন নাহলে কীভাবে বানাবো?দাড়ান, চা টা ঢেলে নেই তারপর নিয়ে যান।’
‘ চটাস চটাস কথা কইতে পারো খুব। শুইনা থাকতে পারো না কিচ্ছু! কই দাও,নিয়া যাই। আমার বোন বইসা আছে সেই কখন থেকে।’
‘ এই নেন। নিয়ে উদ্ধার করুন।’
জমিলা বেগম মুখ বাকিয়ে রেশমির হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিলেন। এক কদম যেয়ে, ঘুরে গেলেন। খানিক সন্দেহ নিয়ে রেশমিকে বলে,
‘ কিছু মিশিয়ে টিশিয়ে দাও নাই তো?’
‘ হ,দিছি। বিষ দিছি যাতে আপনারা খাইয়া মইরা যান।’
‘ এতো চেত্তো ক্যান? দিলেও তো দিতে পারো।’
‘ কইলাম তো দিছি। দিয়ে দেন এগুলা আপনার খাওয়া লাগবো না। খাইলে মইরা যাইবেন। দেন বলতাছি, দেন।’
জমিলা বেগম রেশমির হাত সরিয়ে জোর করে ট্রে নিয়ে চলে গেলেন। বোন এসেছে, জরুরী কথা আছে। তাদের ভালোমতো বুঝাইতে হইবে। সূচনা আবার যদি সৌহার্দের বিয়ের কথা জানিয়ে দেয় তাহলে বড় কান্ড বেঁধে যাবে। দূর সম্পর্কের এই এক বোনের সাথেই যোগাযোগ রয়েছে তার। হুট করেই বোনের আগমনে বিপাকে পড়ে যান তিনি।
ঠ্যাকায় পড়েই রেশমির সাথে কথা বলেছেন, নাহলে তো চোখ দিয়ে তাকিয়েও দেখে না। সঙ্গে খুব করে বুঝিয়ে বলেছেন যে, ‘সে যেনো তার বোনের সামনে না যায়। ‘
রেশমি বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না। তার এত শখ নেই বুড়ির চৌদ্দ গুষ্ঠির সামনে যাওয়ার। বুড়ির বারবার বলার ধরন দেখে মনে হচ্ছিলো, সে বোধ হয় মরেই যাচ্ছে তাদের সামনে যাওয়ার জন্য।
কোনোদিন শাড়ি না পরা রেশমি এখন একসাথে রান্না আর শাড়ী দুটোই সামলাচ্ছে। নারী রা বিয়ের আগে যতই অবুঝ থাকে না কেনো বিয়ের পর তার দ্বিগুণ বুঝদার হয়ে যায়। হুট করেই জ্ঞানী হয়ে যায়। এক হাতে স্বামী-সংসার সব চালাতে সক্ষম হয়ে যায়। একে এক ধরনের মিরাক্কেল বা ম্যাজিক বলা যেতে পারে। কিছুদিন আগেও এখানে-ওখানে, উঠোনে,মাঠেঘাটে খেলাধুলা করা মেয়েটি আজ রান্নার ময়দানে নিপুণভাবে রান্না করছে। অদ্ভুত! সত্যিই খুব অদ্ভুত।
জমিলার রুমে আলোচনা চলছে সৌহার্দ আর সূচনার বিয়ের। সূচনার ছোট বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে বেশ কয়েক টা স্থান থেকে। তাই তারা দ্রুতই বিয়ে করিয়ে নিতে চান। যাতে ছোট টার বিয়ে দিতে পারে। জমিলা পড়েছে বে-কায়দায়। সে কিছু বলতেও পারছে না,সইতেও পারছে না। কথার মাঝেই সূচনার মা বলে ওঠে,
‘ আজ বুধবার। সামনের শুক্রবারেই না হয় আকদ করিয়ে ফেলি। কি বলো বুবু।’
‘ হ্যা,হ্যা। তুই যা বলিস। ‘
‘ কিন্তু তোর নাতি কই?তাকে তো দেখছি না। সে কি শরম পাচ্ছে নাকি? ডাকো তো তাকে।’
সূচনা নিরব হয়ে সবার মাঝে বসে আছে। তার মুখে নেই কোনো হাসি।
‘নিলা,নিলা। তোর সৌহার্দ দাভাইকে ডেকে নিয়ে আয়।’
নিলা, সুমির প্রেগন্যান্টের কথা শুনে পরের দিনেই চলে এসেছে। কিন্তু এসেই যখন রেশমির ব্যাপার শুনলো সে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলো। দুইদিন থেকেই রেগে রয়েছে সে,কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। সবাই কীভাবে পারলো তাকে রেখে সৌহার্দের বিয়ে দিয়ে দিতে। সে কত আশা করেছিলে সৌহার্দের বিয়ে খাবে,নাচবে,গাইবে। সবাই কীভাবে পারলো তার সাথে এমন করতে? সে তো জীবনেও এমন করতো না। কেউ তাকে ভালোবাসে না,কেউ না। সবাই অনেক বুঝিয়েছে যে এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়েছে, সে মানে না। তার জবাব,’বিয়ে তো হয়েছে,তাই না?’
নিলা বিরক্তি নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে সৌহার্দকে খুঁজে বের করলো পুকুরপাড়ে। উদাস হয়ে বসে আছে সৌহার্দ। দৃষ্টি পুকুরের পানিতে নিবদ্ধ। চোখে নোনাজল। বলা বাহুল্য মন খারাপের সময় সৌহার্দ সবসময় এখানে এসে বসে থাকতো। ছোট থেকেই সে এ অভ্যাসের দাস । দাদী, চাচী বা চাচা যেই বকুক সে এখানে এসেই বসে বসে নিরবে কাঁদতো। নিশ্চই প্রশ্ন জেগেছে,আজ সৌহার্দের মন কেনো খারাপ, তাই না?
মন খারাপের কারণ টা খুব বড়। সেটা হলো পরশুদিন তাকে বাংলাদেশ নামক মাতৃভূমি ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাতে হবে। এজন্যই মনটা ভীষণ খারাপ। সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এটাই যে তার নিয়তি। কিছু লোকেদের কাছে বিদেশ যাওয়া মানেই বিলাসিতা। বস্তুত, বিষয়টা একদম ই তেমন নয়। বিদেশে থাকা কোনো সহজ ব্যাপার না।
পরিবার-পরিজন,বন্ধু-বান্ধব,মা-বাবা,বউ পরিচিত জায়গা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা অজানা স্থানে গিয়ে থাকতে হয়। সৌহার্দ আগে ভাবতো,’মানুষ কীভাবে অন্যদেশে থাকে? যার এক বিন্দু জিনিস ও তাদের চেনা বা পরিচিত নয়। কেউ মেরে গুম করে ফেললেও তো জানার উপায় নেই।’ নিয়তি দেখো আজ তাদের অবস্থানেই সৌহার্দ দাড়ানো।
‘ দাভাই, তোমাকে দাদী ডাকে।’
নিলার উপস্থিতিতে সম্মতি ফিরে সৌহার্দের। পলকেই চোখে মুখ মুছে,স্বাভাবিক হয়ে গেলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো,
‘কেনো?’
‘ দাদীর কে এসেছেন। তারা আপনাকে দেখতে চায়।’
সৌহার্দ খানিকক্ষণ থম মেরে বসে তারপর উঠে গেলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় সে উপস্থিত হয় জমিলার রুমে। জমিলা বেগম হাত কচলাচ্ছেন। কোনো ঝামেলা না হলেই তিনি বাঁচেন। বড় আশা দিয়ে রেখেছেন বোনকে। কথা বার্তাও পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু রেশমিকে নিয়েই সব ঝামেলা। আর কয়টা দিন হলেই রেশমি নামক উটকো ঝামেলাকে সরিয়ে ফেলতেন তিনি। এখন কীভাবে সামলাবেন,ভেবেই কূল পাচ্ছেন না তিনি।
চলবে…..
‘অসুখের নাম তুমি’
সোনালী আহমেদ
পর্ব:-১২
সৌহার্দের উপস্থিতিতে খুশিতে গদগদ হয়ে যায় সূচনার পরিবার। সূচনার ভাবী আর দাদী সৌহার্দকে নিয়ে টিটকারি করতে লাগলো। যার আগা গোড়া কিছুই সৌহার্দের মাথায় ডুকছিলো না। সে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
‘আপনি এসব কি বলছেন দাদী,আমি তো কিছুই বুঝতেছি না।’
‘আহা,কচি খোকা। কিচ্ছু বুঝে না। আজ বিয়ে দিলে কাল বাচ্চা হবে এখন বুঝে না।’
‘ মানে?’
‘ এত ঢং করতে হবে না। এতদিন ননদিনীকে পেয়ে যে আপনার মন বদলে গিয়েছে তা কানে এসেছে। তাই আপনার সব রংঢং ছুটাতে আমার ননদিনীকে এবার একবারেই তুলে দিয়ে যাবো।’
সূচনার ভাবীর কথা মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। কি বলছেন উনি? একবারে দিয়ে যাবে মানে? সে মনে মনে চক কষতেই তার হিসাব মিলে গেলো।
সৌহার্দ বিস্ফোরিত চোখে জমিলার দিকে তাকালো। তিনি তখনও নিজের হাত কচলাচ্ছেন। মুহূর্তেই সে রেগে গেলো। তবুও কোনোরকম রাগ সংযত করে স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,
‘আমি বিবাহিত। বউ থাকা স্বত্তেও কীভাবে আরেকটা বিয়ে করবো?’
সৌহার্দের সামান্য কথা সেকেন্ডেই মজলিসে বিস্ফোরণ ঘটালো। জমিলা বেগম চোখ বন্ধ করে ফেললেন। যা ভেবেছিলেন তা হয়েই গেলো। এ ছেলেকে ইশারায় এতবার বললাম না বলতে তবুও বলে দিলো। তার জায়গায় সিয়াম হলে জমিলার কথার এক চুল ও নড়তো না যেভাবে বলেছে ওভাবেই করতো। নাতির উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন তিনি।
সূচনার দাদী জমিলাকে চেপে ধরতেই তিনি সব কথা বলে দেন। তবে সেটা নিজের মতো। তার বলা কথার সাথে বাস্তবিক ঘটনার আকাশ পাতাল ব্যবধান।
সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করা হলো। সৌহার্দের বিয়ে টা ইলেকট্রিক শকের মতো ছিলো তাদের জন্য। বেশ খানেক সময় ভেবে চিন্তে নির্মলা অর্থাৎ সূচনার দাদী মুখ খুললেন,
‘মেয়েটাকে ছেড়ে দাও,তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’
নির্মলার কথা সৌহার্দের কানে গোচর হতেই শরীরে জ্বলা ধরে ওঠলো। কি বললো,’ছেড়ে দাও’। হোয়াট দ্যা হেল -ছেড়ে দাও। এটা কি ধরনের কথা? বিয়ে করেছে কি বউ ছেড়ে দিতে?তার ইচ্ছা হলো কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। এবং সে তার ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ প্রাধান্য ও দিলো। বেশ চড়া গলায় হাকি দিয়ে বলে ওঠলো,
‘ বউ কি খেলনা জিনিস যে যখন ইচ্ছা খেলবো যখন ইচ্ছা হবে না ফেলে দিবো! যদি আপনাদের কাছে এমন মনে হয় তাহলে আমি দুঃখিত আমি একদম আপনাদের মতো নই। আর না হতেও চাই। আমি স্বামী, যেখানে আমার সমস্যা নেই সেখানে আপনারা আপনাদের সমস্যা দেখাচ্ছেন। এটা কতটুকু যৌক্তিক?’
‘ বাহিরের নোংরা মেয়েটার জন্য আমাদেরকে এসব কী উল্টাপল্টা বলছো সৌহার্দ?’
‘ভাষা সংযত করে কথা বলুন । আমি খুব ভালো ভাবেই কথা বলছি। যাকে আপনি বাহিরের নোংরা মেয়ে বলছেন সে আমার বউ। আর আমার বউকে বিনা কারণে বাজে কথা বলার কোনো অধিকার আপনার নেই। আমার বউকে ছাড়বো কি ছাড়বো না সেটা আমার ব্যাপার। অপরিচিত মানুষ নাগ না গলালে ভালো হবে।’
‘ জমিলা শুনেছিস তুই? তোর নাতি কীভাবে কথা বলছে আমার সাথে। তুই কি চুপ করেই থাকবি? তার সাহস দেখ, সে কী বলছে আমাদের। এ মেয়ে তাবিজ করেছে তোর নাতিকে রে। তোর সংসার শেষ রে। আজ আমার সাথে এভাবে বলছে,মিলিয়ে নিস কাল তোর সাথেও এভাবে কথা বলবে।’
জমিলা বেগম কিছু বলার আগেই সৌহার্দ হনহন করে বেরিয়ে গেলো। মেজাজ টাই খারাপ করে দিলো। এমনিতেই সে টেনশনে আছে,আর তার উপর সবাই পড়ে আছে তার বিচ্ছেদ নিয়ে। সে কি একবারও বলেছে সে এ বিয়েতে খুশি নয়,বউকে ছেড়ে দিতে চায়? তাহলে সবাই তার বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে পড়েছে কেনো?
সে কত আলাদা করে শান্তভাবে তার দাদীকে বুঝিয়েছে যে সে এ বিয়েতে খুশি, সে বউকে ছাড়তে পারবে না। তার দ্বিতীয় বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নেই। তারপরেও তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলো? হাউ?
জমিলা বেগম তার পেছন আসতেই সে দাড়িয়ে বলে,
‘ দাদী আরেকবার যদি তুমি আমাকে, রেশমিকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলেছো বা জোর করেছে তাহলে আমি এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো আর কোনোদিন ফিরে আসবো না। এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বললাম। ‘
জমিলা স্তব্ধ হয়ে গেলো। সৌহার্দ তার মাথা ছুঁয়ে কসম করেছে যে সে আর এ বাড়ীতে থাকবে না! তাও ওই ছোটলোক মেয়েটার জন্য। যে নাতি তার সব আবদার ইচ্ছা,আদেশ সবকিছু নির্দ্বিধায় পালন করতো সে আজ তাকেই কসম দিয়েছে। তার বোন ঠিকই বলেছে, ওই জাদুকরি মেয়ে তাবিজ করেছে।
তিনি কিছু বলবার আগেই সৌহার্দ তার সীমানার বাহিরে চলে গিয়েছে। অগত্যা ব্যর্থ হৃদয় নিয়ে বোনের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে চলে গেলেন। কিন্তু বিষয়টা সোজা ছিলো না, তার বোন চিরদিনের জন্য ইতি টেনে গিয়েছে। একদফা রেষারেষি আর ঝগড়া-বিবাদ ও সাথে করেছিলেন।
সূচনারা চলে যেতেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো জমিলা। তার মাথায় এত পরিমান রাগ চওড়া দিলো যে সে কন্ট্রোল করতে পারছিলো না। মাথা নিচু করে ফোঁপাতে লাগলেন।
প্লেট বাটিগুলো নেওয়ার জন্য রুমে এসে জমিলার এমন অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায় রেশমি। কৌতুহল নিয়ে জমিলার কাছে গেলো। তার মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করে বসলো,
‘দাদী কি হয়েছে?’
রেশমির মুখ টা চোখের সামনে দেখতে পেয়েই জ্বলে ওঠলো জমিলা। দূর্বল হাত দিয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন রেশমির গালে। হাত দূর্বল হলেও চড় টা বলিষ্ঠ ছিলো। বেশ লাগলো তার গালে।
বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,
‘ অভাগী,মুখপুড়ি আমার সংসার শেষ করে দিলি। বাপের সংসার শেষ করে এখন জামাইর সংসার শেষ করতে লেগেছিস? কি মনে করোস আমি কিছু জানি না? বাপকে খেয়ে, মামার ঘাড়ে চাঁপতেই তো মামার দূর্দশা করে দিয়েছিস। এখন আমার সংসারে এসে তা ধ্বংস করতে নেমেছিস? আজ আমার নাতিকে বিপক্ষে কথা বলিয়েছিস কাল তাকে আলাদাও করে ফেলবি। সেসব কি আমার জানা নেই! তোদের কারণেই সাজানো গোছানো সংসার নষ্ট হয়ে যায়।’
খানিক খানিক দম নিয়ে সম্পূ্র্ণ কথাগুলো বলেন জমিলা। এই বয়সেও তার কত তেজ। রেশমি জমিলার পাশ থেকে প্লেট টা হাতে নিয়ে বলে,
‘ কথা দিলাম দাদী, আমার কারণে আপনার সংসারের বিচ্ছেদ আমি কোনোদিন হতে দিবো না।’
খুবই শান্তস্বরে কথা টা বলে ওঠে যায় রেশমি। এ একটা জায়গায় দূর্বল সে। বাবা নামক কোনো কথা আসলেই তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এত চঞ্চল স্বভাব টাও হারিয়ে যায়। সবাই বলে সে নাকি তার বাবাকে খেয়ে ফেলেছে। আচ্ছা এটা কি আসলেই সত্যি? দাদীর কথাতেও সে ভুল দেখছে না। তার মামার বাড়ীতে যবে থেকে উঠেছিলো তবে থেকেই তাদের অবস্থার অবনতি দেখা দিয়েছিলো। সে কি তাহলে আসলেই অপায়া!
———————-
ঘরের কাজ নিপ্টিয়ে বেশ রাতের দিকেই রুমে যায় রেশমি। বিছানা থেকে বালিশ টা নিয়ে নিচে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলো। আজ তার মন খারাপ। নিচে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে নিদ্রা যাপন করার প্ল্যান করেছে সে। মন খারাপ থাকলে তার ঘুম আসে না তখন ঠিক এইভাবে শুলেই ঘুম চলে আসে। সৌহার্দ চুপচাপ রেশমির কান্ড দেখছিলো। এতক্ষণের জমিয়ে থাকা রাগ টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
‘তুমি নিচে শুয়েছো কেনো?’
‘ ইচ্ছা হয়েছে।’
‘নাটক দেখাচ্ছো? নাটক?’
রেশমি জবাব না দিয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে রইলো।
‘ উপরে ওঠে আসো।’
কয়েক মিনিটেও রেশমি হেলদোল দেখালো না। ব্যাস হয়ে গেলো। সৌহার্দ উল্কার মতো ছুটে এসে রেশমিকে ছেপে ধরলো।
‘কি সমস্যা? ‘
‘ছাড়ুন। ব্যাথ্যা লাগছে।’
‘ লাগুক। আরো বেশি লাগুক।’
রেশমি ধ্বস্তা-ধ্বস্তি করে পেরে না ওঠে ছেড়ে দিলো। সৌহার্দ আরো চেপে ধরলো। যেনো নিঙ্গড়িয়ে ফেলবে সে।
অনেক্ষণ পর রেশমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বললো,
‘কাল যে আপনি চলে যাবেন আমাকে বলেছেন?’
ওহ,তাহলে মেডাম এজন্য এমন করছে।সে তো ভেবেছিলো সূচনার বিষয়গুলো নিয়ে রাগ করেছে। সৌহার্দের রাগ উবে গেলো। হাতের চাপ হালকা করে দিলো।
বেশ খানেক্ষণ সময় পর সৌহার্দ রেশমির গালে গাল ঘষে জবাব দেয়,
‘বললে কি হতো শুনি?’
রেশমির কথার সাউন্ড সিস্টেম অফ হয়ে গেলো। বারবার কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছিলো না। চোখটা বন্ধ করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।
সৌহার্দ আবারো আগের মতো করে বললো,
‘কি হলো বলছো না কেনো?’
রেশমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘স্ সরুন।’
‘কেনো? সারাদিন তো আমার কাছে আসতে চাও। দাদীর সাথে চাচীর সাথে ঝগড়া করো। এখন সরে বলছো কেনো?’
রেশমি মাটিতে বিছানো চাদর খামছে ধরলো। সৌহার্দকে ঠেলেও সরাতে পারলো না।
সৌহার্দ গালে ঠোঁট ছুয়ে বলে,
‘কি হলে বলছো না কেনো?’
‘আপনি কথা কাটাতে এসব করছেন। কোনো লাভ নেই। আমি রেগে আছি।তাই আপনার সাথে কথা নেই।’
সৌহার্দ কিছু বললো না। হঠাৎ মনের ভেতরে উঁকি দেওয়া প্রশ্ন টা করে বসলো,
‘এই তোমার বয়স কত?’
রেশমি ছোট্ট করে জবাব দিলো,
‘পনেরো।’
এক ঝটকায় রেশমিকে ছেড়ে উঠে বসলো সৌহার্দ। এত ছোট তার বউ! বিষ্ময়ে ভাব টা কাটাতেই পারছে না সে। রেশমির বয়স কম সে ভেবেছিলো কিন্তু এত ছোট সে ভাবেই নি। অন্তত তার থেকে এত ছোট এটা তো কখনোই ভাবেই নি।
চলবে!
সোনালী আহমেদ