অন্য রূপকথা,দ্বিতীয় অধ্যায় – প্রেম পর্ব
মৌপর্ণা
(সাত বছর আগে)
তখন শোভন ২৩, সবে এমএসসি শেষ করে, পিএইচডি শুরু করেছে ডিসক্রিট ম্যাথেমেটিক্সে এবং পাশাপাশি এই নামকরা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টার ফ্যাকাল্টি….
ছাত্র ছাত্রী তো শোভন স্যার বলতে অজ্ঞান…..
অথচ তখন শোভনের অভিজ্ঞতা মাত্র এক বছর!
শোভন স্যারের ক্লাস সারাবছর মন দিয়ে করলে, আর কোনো স্টাডি মেটেরিয়াল, নোটস, সাজেশন কিছুই দরকার হবেনা পরীক্ষার আগে, আর শোভন স্যার শুধু অংক নয়, এস.সি দত্তর ফিজিক্স ক্লাসের সমস্যা গুলোও সমাধান করে দেয় নিমেষে, স্যার অক্লান্ত পরিশ্রম করে সারাদিন, একই পড়া বিশ বার বোঝাতেও ক্লান্ত হয়না স্যার, আর তারপর শোভন স্যার বেশ হ্যান্ডসম, গুড লুকিং, স্ট্রিক্ট পার্সোনালিটি, ফ্রেন্ডলি…..
তাইতো স্যারের ক্লাস সারাবছর হাউসফুল!
কিছু ছাত্র ছাত্রী আসে পড়া বুঝতে, কেউবা শুধু ইন্টারনালে পুরো নম্বর চায় বলে, আবার কেউ কেউ তো শুধু শোভন স্যারকে দেখবে বলে ক্লাসে আসে…
ওরা যে কারণেই আসুকনা কেন, তাতে শোভনের সমস্যা নেই কোনো, কিন্তু স্যারের ক্লাস করতে হলে, মানতে হবে বেশ কিছু শর্ত
১) শোভন ক্লাসে ঢোকার পর, ক্লাসের গেট বন্ধ, অর্থাৎ শোভন আসার আগেই উপস্থিত হতে হবে ক্লাসে….
২) ক্লাসে থাকতে গেলে, বাড়িতে করতে দেওয়া অংক করে আনতে হবে রোজ……
৩) ক্লাসে একদমই অন্যমনস্ক হওয়া যাবেনা…..
শোভনের পড়ানোর দক্ষতা আর এই কড়া শর্তের কারণেই বোধহয় তখন শোভনদের কলেজের অংক ও ফিজিক্স পেপারের রেজাল্ট ছিল শেষ দশ বছরের সর্বোচ্চ…..
*************************************************
ডিসেম্বরের এক ক্লান্ত দুপুর বেলায় শোভন তখন পিএইচডি ইর থিসিস গুলো দেখছিলো উল্টে পাল্টে, রমেশ ঘরে চা আর বিসকুট টা দিতে এসে ঘরের দরজাটা আধখোলা রেখেই বেরিয়ে গিয়েছে ঘর থেকে, অগত্যা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই হলো শোভন কে……..
দরজাটা পুরোপুরি ভেজিয়ে দেওয়ার উদ্যেশে দরজার দিকে এগোতেই, শোভনের কানে ভেসে এলো এক মিষ্টি সুরে ভেজা মহিলা কণ্ঠ …..
……………. তাকে খুঁজি ভেসে ভেসে চলা ওই আকাশের মেঘেদেরই ভেলায়……….
……………. ওকি বুঝি চুপি চুপি এসে শুধু আমাকে লুকিয়ে পালায়…………..
গানের কথা, সুর ও কণ্ঠ – চুম্বকের মতন টেনে আনলো শোভনকে দুতলা থেকে সোজা বাইরের মাঠে, শোভন যখন মাঠের দিকে এগোলো, তখনও গান গেয়ে চলেছে মেয়েটি মাইক হাতে, মেয়েটির কণ্ঠ ও গানের কথা শুনে শোভন মনে মনে ভেবেছিলো হয়তো গায়িকার পরণে থাকবে হলুদ শাড়ি, কপালে থাকবে লাল টিপ্ ও খোঁপায় থাকবে বেলি ফুলের মালা, কিন্তু একি গায়িকার পরণে ফেডেড জিন্স, লাল টপ ও এলোমেলো খোলা চুল, তবে মেয়েটি যে বিধাতার নিখুঁত সৃষ্টি সেইটা স্টেজের বেশ খানিকটা দূর থেকেই শোভন বুঝতে পেরেছিলো…
মেয়েটি তখনও বিভোর গানের সুরে ও কথায়, গেয়ে চলেছে সে –
……………..তাকে খুঁজি, দুপুরে বয়ে চলা একা একা উদাসী হাওয়ায়
……………..তাকে খুঁজি, বিকেলে আলো ঝরা কোণে দেখা গোধূলি বেলায়
মিনিট দুয়েক হলো, গান শেষ হয়েছে, কিন্তু শোভন তখনও মগ্ন হয়ে চেয়ে রয়েছে মেয়েটির দিকে, শোভনের মগ্নতা ভাঙলো সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট আকাশের ডাকে –
“স্যার, থ্যাংক ইউ! আমরা ভাবিনি তুমি আজকে আসবে আমাদের ফ্রেশেরস ওয়েলকাম পার্টিতে!”
এতক্ষণে শোভনের মনে পড়লো, ঠিক ওরাতো বলেছিলো সেমিস্টারের পর আঠেরোয় ডিসেম্বর ওদের এই আয়োজনের কথাটা…….
আকাশ বলতে থাকে –
“স্যার অন্বেষার গান কেমন লাগলো? ফার্স্ট ইয়ার এর স্টুডেন্ট অন্বেষা কিন্তু দারুন ভোকালিস্ট…….”
“ওঃহহহ এই ভাবে মগ্ন হয়ে এতক্ষণ মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কলেজেই দাঁড়িয়ে! ছিছি, এই ভাবে আমি ওদের সামনেই হাঁ করে মেয়েটার দিকে চেয়ে ছিলাম এতক্ষণ….” কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মনেই ভাবতে থাকে শোভন…..
“স্যার বললেননা তো, কেমন লাগলো, আমরা ভাবলাম একটা অথেন্টিক বাংলা গান…”
“না না, ভালো লাগলো, ইনফ্যাক্ট খুব ভালো লাগলো তোদের অনুষ্ঠান, অন্বেষার গান, কিন্তু এইবার আমি যাই বুঝলি, অনেক কাজ ফেলে এসেছি!”
*************************************************
“আজ সকালে ওভাবে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকাটা মোটেই উচিত হয়নি, তাও আবার নিজের কলেজের স্টুডেন্ট!” কথাটা ভাবতে ভাবতে রাতের খাবার থালায় আঁকিবুকি কেটে চলেছে শোভন….
“শোভন, কতবার বলেছি তোকে থালায় আঁকিবুকি কাটবিনা….এমনি ধার দেনায় জর্জরিত……”
“ওঃ সরি মা! মাথায় অনেক চিন্তা মা……..”
“কেন কি হয়েছে আবার?”
“কই কিছুনা তো! কি আবার হবে মা? পিএইচডি র চাপ চলছে, সঙ্গে সেমিস্টারের খাতা দেখার একটা চাপ, ব্যাস!”
“তবে, এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন? ধার দেনা আর কত বাকি?”
“ওহ মা! ছাড়োনা, এসব কথা, আর খুব বেশি হলে বছর দুয়েকের মধ্যে সব শোধ হয়ে যাবে, তুমি এবারে বসে পর খেতে, আমার তো হয়েই গেল খাওয়া”
*************************************************
মাস ছয়েক পরের ঘটনা – অন্বেষাদের প্রথম ক্লাস শোভন স্যারের সাথে, শোভন সবে মাত্র ক্লাসে ঢুকে ইন্ট্রোডাকশন শুরু করেছেই কি, ক্লাসরুমের গেট থেকে আওয়াজ এলো –
“স্যার আসলাম….”
মেয়েটা আসলাম বলে খানিকটা এগিয়েও গিয়েছে, তবে শোভনের নিয়ম বড্ডো কড়া ও সবার জন্যে সমান, খুব শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় শোভন বললো –
“আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছি ক্লাসে ঢোকার?”
“কিন্তু স্যার, আপনি তো এই মাত্র ঢুকলেন, ইন্ট্রোডাকশন ও শুরু হয়নি, তাই..”
“তাই আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই, তাইতো?”
মেয়েটি মাথা নীচু করে সরি বলে এগিয়ে যাচ্ছিলো ক্লাসরুমের ভেতর দিকে, এরইমধ্যে শোভন আবার শুরু করলো, এবার বেশ একটু জোর গলায় বললো –
“কি ব্যাপার ! আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছি কি? আজ বেরিয়ে যাও, কাল এস ঠিক সাড়ে- নটায়, নটা বত্তিরিশে নয়……
এখন দাঁড়িয়ে থেকে নিজের, আমার আর ক্লাসের সময় নষ্ট করো না”
একটু থেমে শোভন আবার শুরু করলো –
“এন্ড ক্লাস, আমার ক্লাসে থাকতে হলে মানতে হবে এরম অনেক ছোট বড় নিয়ম – ১) ……………………..,………………………….
………………….,…………………………………,………
………………………………………….,………………….
*************************************************
আরো মাস তিনেক কেটে গিয়েছে এর মধ্যে, প্রথম দিনের ঘটনার পর, অন্বেষা আর আসেনি শোভনের ক্লাসে…..
অন্বেষা মিত্র একমাত্র স্টুডেন্ট যে একদিনও শোভনের ক্লাসে উপস্থিত হয়নি গত তিন মাসে!
আজ ইন্টারনাল পরীক্ষার খাতাটা সবাই কে বাড়ি নিয়ে গিয়ে, খুঁটিয়ে নিজের ভুল গুলো দেখতে বলেছে শোভন, অন্বেষা মিত্রর খাতাটা দিয়ে গিয়েছে ওদের ক্লাসের সোমা বলে একটি মেয়ের হাতে….
*************************************************
ব্যাগ থেকে সবে টিফিনটা বের করেছে শোভন…
এরই মধ্যে দেখতে পেলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সেকেন্ড ইয়ার কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা …
“কিরে প্রিয়াঙ্কা, বাইরে কেন? ভেতরে আয়, বল ইন্টারনাল খাতায় কোনো অসুবিধে নাকি অন্য কোনো অঙ্কতে ……”
প্রিয়াঙ্কা কোনোরকমে আটকে আটকে বললো –
“স্যার, অন্বেষা বলছিলো, অন্বেষার একটু দরকার ছিল আপনার সাথে….”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো শোভন প্রিয়াঙ্কার দিকে তারপর বললো –
“আচ্ছা বুঝলাম, তবে অন্বেষা কই?”
“এইতো স্যার, আপনার ঘরের বাইরে, আমি গিয়ে বলছি ওকে ভেতরে আসতে!”
কথাটা শেষ হতেনা হতেই, প্রিয়াঙ্কা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো আর কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে ঢুকলো অন্বেষা….
অন্বেষা ঘরে ঢুকতেই বেশ চিৎকার করেই বলতে থাকে –
“আপনার ক্লাস না করলে, আপনি এরকম ভুলভাল নম্বর কাটবেন আর ইচ্ছে করে কম নম্বর পাঠাবেন বোর্ডে, তাইতো?”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাটা শেষ করে অন্বেষা, দুহাত দিয়ে মুছে নেয় চোখের তলাটা….
শোভন খুব শান্ত গলায় বলে –
“কোথায় ভুল নম্বর কেটেছি দেখা?”
অন্বেষা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলে –
“না আপনি আগে বলুন, আপনি এই নম্বর টাই পাঠাবেন বোর্ডে? আমি কোনোদিনও এতো কম নম্বর পাইনি!”
“অন্বেষা, চেয়ার টা টেনে বস…………….
কি হলো? বসতে বললাম তো! ………………..
গুড! বল এবারে, কাঁদার মতন কি হলো?
বোর্ডে কোনো স্টুডেন্টের নম্বর আমি আজ অবধি কম পাঠাইনি! তোর ক্ষেত্রেও..”
“সেটা বড় কথা নয়, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা ! অক্টোবরের মিড্ উইক চলছে, আর দেড় মাসে পরীক্ষা, এতো বাজে প্রিপারেশন এবারে! ডানলপে একজন স্যারের কাছে, টিউশন পড়ছিলাম, কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা, উপরন্ত ওখানে….”
“ব্যস এই জন্যে, ফ্রেশার্স ওয়েলকাম এর স্টার পারফরমার এভাবে কাঁদবে?”
অন্বেষা হাঁ করে চেয়ে থাকে শোভনের দিকে….
শোভনের মুখে হালকা হাসির রেখা, গলাটা পরিষ্কার করে বলে –
“পুজোর কি প্ল্যান?”
“হ্যাঁ স্যার? সরি মানে …..”
“মানে পুজোতে কলেজ চারদিন ছুটি, বাকিদিন ম্যানেজ করে আসতে পারবি?”
“হ্যাঁ স্যার! পারবো! ”
“বেশ! ক্লাস পেয়ে যাবি! ওই দশদিন নতুন কিছু পড়াব না…
আজ রাতে বাড়ি গিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ভাব কোন চ্যাপ্টার গুলোতে সব চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে, কাল ঠিক এইসময় এসে লিস্টটা দিয়ে যাস, সব হয়ে যাবে!”
“ফিজিক্স এও একটু সমস্যা হচ্ছে…..”
“তাহলে ফিজিক্সের ডাউট গুলোও দিয়ে যাস কাল! এখন আয়, আরো পনেরো মিনিটে ক্লাস আছে, আর আমার লাঞ্চ হয়নি এখনো!”
থ্যাংক ইউ আর সরি দুটো একসাথে বলে হাসি মুখ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো অন্বেষা!
*************************************************
এই ঘটনার পর, অন্বেষা আর বাদ দেয়নি শোভনের একটাও ক্লাস, এমনকি পুজোর চারটে দিন বাদে, প্রতিদিন শোভন সকাল বিকেল সাহায্য করতে থাকে অন্বেষাকে সব ছোট বড় সমস্যায়….
অন্বেষাও যতটা সম্ভব খেটেছিলো পরীক্ষার শেষ দিন পর্যন্ত…..
তারপর ফলাফল আসার পর, নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলোনা যে নিজের সব বিষয়ের মধ্যে ও ক্লাসের সবার মধ্যে সর্বোচ অংকের নম্বর অন্বেষারই!
*************************************************
সময়ের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে কেটে যায় আরো দুটো বছর………………….
শোভন ও অন্বেষার মধ্যে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল এই দু বছরে, সে অদ্ভুত এক মনের মিল…..
তখনও মুখে কেউ কাউকে কিছু বলেনি, তবে অন্বেষা ক্লাসে না এলে শোভন চেয়ে থাকতো গেটের দিকে, দেরি করে এলেও এখন ক্লাসে প্রবেশ মেলে সহজেই, অন্বেষার ছোট বড় সব সমস্যা হলেই ছুটে যেত শোভনের কাছে, শোভন ও প্রানপন চেষ্টা করে যায় অন্বেষার সব সমস্যা সমাধান করার জন্যে, অন্বেষাও প্রায় জোর করে শোভন কে গাড়িতে ছেড়ে আসে শোভনের বাড়ির নিকটতম বাস স্ট্যান্ডে, বেশ কয়েকবার ক্লাসের সবাইকে গাজরের হালুয়া খাওয়ানোর নাম করে, সেই টিফিন পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে শোভনের বসার ঘরেও ………….
এখন অন্বেষারা ফাইনাল ইয়ারে, অংকর সাবজেক্ট বাতিল হয়েছে সিলেবাস থেকে, কিন্তু অন্বেষাদের ক্লাসের প্রায় সবাই অনুরোধ করেছিল শোভন কে – ওদের ক্যাম্পাসিং এর আগে, চাকরির পরীক্ষার অংকের চটজলদি উপায় শেখানোর জন্যে, এর জন্যে ওরা সবাই অবশ্য শোভনের বাড়ি গিয়ে আলাদা করে টিউশন পড়ার কথাই বলেছিলো শোভন কে, তবে শোভন বিনা পয়সায় কলেজেই ফাঁকা সময়ে ওদের সাহায্য করার প্রস্তাবটা দেয়…..
*************************************************
আর পাঁচটা দিনের মতো, এক সোমবার – কলেজের দেওয়া বরাদ্দ ঘরে ঢুকতেই শোভনের হৃদস্পন্দন হয়ে যায় দ্বিগুন……..
শোভনের টেবিলের ওপর রাখা – ভালোবাসার বার্তা লেখা জন্মদিনের গ্রিটিংস কার্ড ও এক গোছা লাল গোলাপ!
কার্ডে কোনো নাম লেখা না থাকলেও এটা যে অন্বেষার দেওয়া সেটা বুঝতে সময় লাগলোনা শোভনের……..
কার্ড আর ফুল দুটোই ব্যাগে ঢুকিয়ে, শোভন দৈনিক দিনের মতন, সময়তালিকার নিয়মে পৌঁছলো সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে….
তবে আজ বারেবারেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিলো শোভন, বারেবারেই মনে হচ্ছিলো এবারে কি করবে, অন্বেষার সাথে কোনভাবেই কোনোরকম সম্পর্কে জড়ানোর মতন পরিস্থিতি নেই একেবারে, নিবারণ বাবু মানে শোভনের বাবা মারা যাবার পর থেকেই সংসারের সব ভার শোভনের কাঁধে, সাড়ে তিনশো স্কোয়ার ফিটের জীর্ণ ভাড়া বাড়ির ঘুপচি দুটো ঘরে দেওয়াল বেয়ে জল পরে বর্ষা কালে, নিজের ঘরে একটা বিছানাও নেই, শুধু আছে একটা চৌকি!
“স্যার….উত্তর কি টোয়েন্টি ফোর?”
*************************************************
দুপুর তিনটেই যখন অন্বেষাদের ক্লাসে ঢুকলো, ওরা সবাই শোভন কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো, তবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়েও শোভনের মুখের হাসিটা কেমন ফেকাসে দেখালো….
আজ অন্বেষা একবারও আসেনি শোভনের ঘরে, সম্ভত অন্বেষা আশা করেছিল শোভন নিজেই ক্লাসের শেষে অন্বেষাকে ডেকে পাঠাবে আর হলোও ঠিক তাই, তবে ক্লাসের শেষে নয়, ক্লাসের শুরুতেই শোভন অন্বেষা কে বললো ক্লাসের শেষে শোভনের ঘরে আসতে…..
অন্বেষার ইচ্ছে পূরণ হলেও, খটকা লাগলো মনে – শোভনের কপালের ভাঁজ আর ফেকাসে হাসিটা দেখে, তারপর অন্য দিনের তুলনায় শোভনকে আজ অনেকটাই বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছিল, তারপর কেউ একজন জিজ্ঞেসও করলো –
“স্যার, কিছু সমস্যা হয়েছে?”
কিন্তু শোভন ছোট্ট একটা উত্তর ‘কই কিছুনা তো’
বলেই এড়িয়ে গেলো…..
খুব অদ্ভুত ভাবে, অন্বেষার সাথে কথা বলাতো দূর, অন্বেষার চোখে চোখও রাখলো না পুরো ক্লাসের সময়টা তে একবারও!
*************************************************
ক্লাসের শেষে অন্বেষা শোভনের পিছু পিছু ঢুকলো শোভনের বসার ঘরে, দুজনে বসলো মুখোমুখি, শোভন ব্যাগ থেকে গ্রিটিংস কার্ড ও গোলাপের গোছাটা টেবিলে রেখে অন্বেষার দিকে তাকিয়ে বললো
“হমম, এটার মানে কি?”
অন্বেষা ফেকাসে মুখে, এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শোভনের দিকে, চোখ দুটো ভোরে এলো, ভারী কাঁপা কাঁপা গলায় কোন মতে বললো –
“আমি পছন্দ করি তোমাকে, তাই…….”
অন্বেষার কথাটা শেষ না হতেই শোভন বেশ কড়া ভাবে বলে উঠলো –
“মাথার ঠিক আছে তোর? সামনে ক্যাম্পাসিং অন্বেষা! আর দশটা দিন বাকি মাত্র, আর এখন তুই আমাকে নিয়ে…
চাকরিটা পেয়ে গেলে, দেখবি ওখানে কত ভালো ছেলে….”
“আমার অন্য কোনো ভালো ছেলে চাইনা”
“পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই! এগুলো খুব ছোট্ট একটা ব্যাপার, দু তিন বছরে তোর আজকের কথাটা ভেবে হাসি পাবে, আর কতটা চিনিস তুই আমাকে, কতটা জানিস আমার সম্পর্কে………..
…………………………………………………………..
রোজ ঠান্ডা গাড়িতে করে কলেজে আসিস, সাড়ে তিনশো স্কয়ার ফিটের জীর্ণ ভাঙা ভাড়া বাড়িতে এডজাস্ট করতে পারবি? পারবিনা তুই…অন্বেষা জীবনটা অনেক বড়”
“এতো কিছু শুনে এখনই কি লাভ বলো! তুমি শুধু বলো তুমি আমাকে নিয়ে কিচ্ছু ভাবনা? আমায় পছন্দ করোনা? আমায় নিয়ে না ভাবলে কেন দিন রাত জেগে আমাকে কম্পিউটার সাইন্সের প্রজেক্টে সাহায্য করেছিল, ওটাতো তোমার সাবজেক্ট নয়, আমার জন্যে লাইব্রেরি থেকে বই এনে তুমি নিজে নতুন একটা সাবজেক্ট পড়া শুরু করলে আর তারপর নিজের সব কাজ ফেলে আমার প্রতিটা বিষয়ে তোমার সাহায্যটা, আমার ক্যাম্পাসিং এর জন্যে আমার জন্যে আলাদা করে ইংলিশ স্যাম্পল গুলো জোগাড় করে দেওয়াটা! ওটাতো তুমি বাকিদের দাওনি…
…”
“আমি সবাইকেই সাহায্য করি অন্বেষা, একটা দুটো জিনিস তোর কাছে বেশি না থাকলে তুই এগবি কি করে! হাজার জনের পুল ক্যাম্পাসিং হবে, সিলেক্টেড হবে মাত্র দেড়শো! এসব কথা এখন থাক, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে বাদ দে, কেমন? এখন শুধু তুই চাকরির জন্যে….”
“না, আজকে তোমাকে বলতেই হবে, এতো স্টুডেন্টের মধ্যে তুমি আমাকেই কেন এগিয়ে দিতে চাও? কেন তুমি আমার ব্যাপারে এতো সিরিয়াস?”
” অফেকশন এন্ড লাভ – আর নট দি …..”
” অফেকশন – রিয়েলি?
বাড়ি ফেরার সময়, রোজ গাড়ির কাঁচে আমাকে দেখা – অফেকশন!
ভালো কম্পানির ক্যাম্পাসিং না হওয়ার দাবিতে কলেজের গেট বন্ধ রাখলো সারারাত, বেরোতে দেওয়া হলোনা ফ্যাকাল্টি দেরও………….
ক্যান্টিনে খাবার শেষ, কলেজের ডিন তোমাদের জন্যে খাবার আনালো কোনও এক রেস্তোরা থেকে! সেই খাবারের চার ভাগের তিন ভাগ আমার হাতে দিয়ে, আমায় ফিসফিস করে বললে – নিজে খেয়ে বাকিদের দিস – অফেকশন!
আমার ঘরে ঢুকতে গেলে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই ! ফর্মালিটির কি আছে? – অফেকশন!
আমাকে আর শুভময় কে একসাথে চা খেতে দেখে একটা অনর্থক রাগ – অফেকশন!”
“অন্বেষা আসতে কথা বল! এতো চিৎকার করে ….”
“না, আমি চিৎকার করেই বলবো! ওকে?
সত্যি বলতো, কলেজ ফেস্টে আমি যখন তোমার দিকে তাকিয়ে গান গেয়েছি, তখন তুমি কিচ্ছু …”
“অন্বেষা, আমরা আর এই বিষয়ে কোনো কথা বলবোনা, কমপক্ষে তুই চাকরিটা না পাওয়া অব্দি! এখন তুই প্লিজ যা…..” – বেশ গলা চড়িয়ে কথাটা বললো শোভন….”
“না আমি কিছুতেই যাবোনা…আগে তুমি বলো সরস্বতী পুজোর দিন……………………………..
………………………………………………………..”
এভাবেই অন্বেষা আর শোভনের তর্ক বিতর্ক চলছিল….অন্বেষার যুক্তির সামনে, শোভনের কোনো কথাই যুক্তিসম্মত লাগছিলোনা, তবে শোভন বারেবারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো এই বিষয়টাকে শেষ করার, কিন্তু বুঝিয়ে, ধমকে যত অন্বেষাকে শান্ত করার চেষ্টা করে চলেছে সে, অন্বেষা ততোধিক বেশি উত্তেজিত হয়ে চলেছে,
এই সবের মধ্যে, শোভনের ঘরের বাইরে যে কখন লোক জমায়েত হয়েছে, সেইটা লক্ষ্যই করেনি ওদের মধ্যে কেউ!
ইতিমধ্যে, সিনিয়র প্রফেসর মিস্টার মল্লিক এসে সবাইকে ধমকে দিয়ে ঘরের সামনে থেকে যখন সরাচ্ছে, শোভনের নজর পরে ঘরের বাইরে, অন্বেষা তখনও নিজের মেজাজেই স্পষ্ট কথা গুলো বলে চলেছে চিৎকার করে……
মিস্টার মল্লিক ঘরে ঢুকেই, জোর গলায় ধমক দিয়ে চললো অন্বেষাকে বেশ খানিক্ষণ, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললো অন্বেষা কে …………
………..
*************************************************
গত চারদিনে শোভনের নেওয়া চাকরির প্রস্তুতির বিশেষ ক্লাসে উপস্থিত ছিলোনা অন্বেষা! তারপরের দুদিন ছিল শনি ও রবিবার…..
মোটমাট শেষ ছদিন শোভনের সাথে একবারও কথা হলোনা অন্বেষার….
আজ আরো একটা সোমবার, দুপুর তিনটেই ক্লাস নিতে গিয়ে শোভন দেখলো অন্বেষা আজও উপস্থিত নেই ক্লাসে, অথচ আজ সকালেই অন্বেষাকে একবার দেখেছে সে………
..মনের মধ্যে বিভৎস্য এক অস্থিরতা, শেষ সাতটা রাত অপরাধবোধে ঘুমোতে পারেনি সেরকম, আর ধৈর্য না রাখতে পেরে –
একবার ভাবলো শরীরটা ভালো লাগছেনা বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবে সে, তবু জোর করে শেষ বছরের কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলো ক্লাসে, তবে এই প্রচেষ্টাও মনের কাছে পেরে উঠলোনা কিছুতেই!
দ্রুত গতিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে, আর তারপর ফোন করলো অন্বেষার নম্বরে, দুটো রিং পুরো হওয়ার আগেই ফোনটা ধরে নিলো অন্বেষা –
“হ্যালো….”
“কোথায় আছিস? দেখ অনেক হয়ে গিয়েছে, ঠিক আড়াই দিন বাদে ক্যাম্পাসিং আর তুই….”
“আমি বসছিনা ক্যাম্পাসিংএ………”
“সব কিছুর একটা সীমা আছে অন্বেষা……
আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবিনা…”
“আমার বাড়ির লোক কিছু বলছেনা আমার ডিসিশনে …..তুমি বলার কে?”
“ক্লাসে আয় ……
……..আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইনা……..
…………আমি কিচ্ছু শুনছিনা ……….
আমি রাখছি অন্বেশা, তুই আসলে আয়, না আসলে আসিসনা!”
ফোনটা রেখেই হনহন করে ক্লাসে ঢুকে আবার অংকে ফিরে আসে শোভন….
শোভনের অস্থিরতা কাটে অন্বেষার গলার স্বরে –
“আসবো?”
মাথাটা আলতো ঝাকিয়ে সম্মতি জানায় শোভন…..
ক্লাসের শেষে শোভন এগিয়ে যায় অন্বেষার সিটের দিকে ও নীচু গলায় বলে
“কথা ছিল, ফাঁকা হয়ে ওপরে – আমার বসার ঘরে….”
“সরি, আমি ওপরে যেতে পারবোনা! তোমার যদি সত্যি কিছু বলার থাকে তবে আমার গাড়িতে ফিরতে পারো আজ..”
শোভন কথা না বাড়িয়ে, বেরিয়ে যায় ক্লাস ছেড়ে আর তারপর ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অপেক্ষা করে ওদের পুরোনো চেনা জায়গায় যেখানে, অন্বেষার ড্রাইভার গাড়িটা পার্ক করে রাখে…..
*************************************************
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অন্বেষা এসে দাঁড়ালো পার্কিং স্পেসে, অন্বেষা কে দেখতেই ড্রাইভার, গাড়ির দরজা খুলে দিলো চাবি দিয়ে, শোভন ও অন্বেষা দুজনেই উঠে পড়লো পেছনের সিটে…..
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ, অন্যদিনের মতন শোভন লুকিং গ্লাসে আর অন্বেষার মুখটা দেখার চেষ্টা করছেনা, চেয়ে রয়েছে বাইরের আকাশটার দিকে………
বাইরের আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢাকা, রাস্তার ধারে লাগানো গাছ পালা দুলছে ঝোড়ো হাওয়ায়, ধুলো বালি উড়ছে চারিপাশে, তবুও এক ফোটা বৃষ্টি নেই! গাড়ির ভেতরেও এক অদ্ভুত নিস্তব্দতা, আজকে FM টাও বন্ধ করতে বলেছিলো অন্বেষা কিছুক্ষণ আগে….
“….উত্তম দা! ডানদিকের রাস্তায় চায়ের দোকানের সামনে গাড়িটা লাগিয়ে তুমি একটু চা খেয়ে এসো, মিনিট পনেরো পর আমি তোমায় ডেকে নিচ্ছি, এমনিও খুব ঝড় উঠেছে”
কথাটা বলেই একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো অন্বেষা ড্রাইভারের দিকে……
ড্রাইভারও মুহূর্তের মধ্যে, টাকাটা হাতে নিয়ে গাড়িটা সাইড করে রাখে চায়ের দোকানের সামনে…..
*************************************************
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে যেতেই অন্বেষা শোভনের দিকে তাকিয়ে বলে –
“বলো কি কথা ছিল?”
“ছেলেমানুষি কেন করছিস? ক্যাম্পাসিং এ বসবিনা মানেটা কি? মানে হঠাৎ কি হলো …..”
“ইচ্ছে করছেনা তাই বোসবোনা…”
“শোন্ অন্বেষা পাগলামি টা বন্ধ কর, ঠিক আছে? নিজের ক্যারিয়ার টা নিয়ে এভাবে ছেলেমানুষি করিসনা প্লিজ! আমি সত্যি আর পারছিনা বিশ্বাস কর, আমার মনের ভেতর এতকিছু চলছে তুই বিশ্বাস করতে পারবিনা…..”
“ভালোবাসো আমাকে? ” অন্বেষার চোখ দুটো আবারো জলে ভোরে এলো…
“এতো সহজেই চোখে জল আসে তোর? ……
জানিস অন্বেষা আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে, বাবার জুতোর ব্যবসাটা তে মারাত্মক লস হলো, মানে ওই একজন বাবাকে ঠকিয়ে……….
অনেক ধারদেনাও করেছিল বাবা ব্যবসাটা দাঁড় করানোর জন্যে, কিন্তু সে ব্যবসা দাঁড়ালো না!
সব মিলিয়ে এই ঘটনার পর, বাবা একদিন ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন! সুখী মানুষ…….!
তারপর সেই ধার শোধ করতে, আসতে আসতে আমাদের বাড়ি ঘর সব খোয়া গেলো…তার সাথে হারিয়ে গেলো আমার জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসার স্বপ্নটা! আমার আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হলোনা, কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই পাওনাদারের আনা গোনা শুরু হলো….”
“কিন্তু কেউ মারা গেলে তো তার ধার নেওয়া….”
“জানি, তবে কিছু জায়গায় টাকা পয়সার লেনদেন টা ভরসায় চলে! আমি ওদেরকে ঠকাতে পারবোনা রে!……..
……….,…সেই কলেজের সময় থেকে টিউশন পড়াই, তারপর এখানে! ……….
……সব মিলিয়ে সব ঘেঁটে আছে জানিস…..
খুব শক্ত রে আমার জীবনের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা……
……এবারে তোর প্রশ্নোর উত্তরে আসি – হ্যাঁ ভালোবাসি তোকে!
কিন্তু এই সম্পর্কের পরিণাম কি? আমার কাছে তোকে দেওয়ার মতন কিচ্ছু নেই, এমনকি সময়ও নেই! ………
ভালোবাসা আর ভালোবাসার সম্পর্কে থাকা – মানে রিলেশনশিপে থাকাটা পুরো আলাদা!
ভালোবাসার জানিস তো কোনো শর্ত নেই, রিলেশনশিপের আছে!…………”
” কতটা সময় চায় তোমার? দু বছর, চার বছর, আট বছর……..
আমি অপেক্ষা করবো …………
ততদিন ……..যতদিন না তুমি এই সম্পর্কটার জন্যে তৈরী হও……..আমি অপেক্ষা করবো !
চলবে