অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৮

অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৮
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

গাড়ির প্রচন্ড ঝাঁকুনীতে ঘুম ভেগে যায় জয়নবের। বিরক্তি নিয়ে আশে পাশে তাকাতেই মনে পড়ে, সে এখন ডা. আদরের পাশেই অবস্থান করছে। ডা. আদর নির্বিকার ভাবে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। ফ্যাকাশে চোখ জোড়া আজ চশমা দিয়ে ঢাকা নয়। জয়নব নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো তার চোখের দিকে। কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হতেই ডা. আদর তাকালো তার দিকে। জয়নব সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ডা. আদর ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। জয়নব এই মুহূর্তে তাকালে দেখতে পারতো মনচোরা হাসিটি..।

“ঘুম কেমন হলো জান!”

চমকে তাকালো জয়নব। জান ডাকটি কতটা আদর মাখা, স্নেহের চাদরে মুড়ানো। আবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

“কি ডাকলেন আমায়?”

ডা. আদর মনচোরা হাসিটি আবার হেসে ফেললো। জয়নব মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকলো। কথাটুকু এড়িয়ে জয়নবের গ্রীবাদেশে ইশারা করে বলল,

“গলার ক্ষতটা খুব বেশিই। মেডিসিন ইউস করেন নি?”

জয়নব এবার বিস্ময়ে আকাশ চূড়া। রাতের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে সে। ক্ষনিকের জন্য মনে পড়তেই ভেবেছিলো স্বপ্নে তারা করছে সেই লোকটি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়েছে বলে চুল গুলো হাত দিয়ে বেঁধে দৌড় করেছে সে। আয়না দেখার সময় টুকু পায়নি সে। কিন্তু হায়! সব সত্য ছিলো? জয়নব ওরনা দিয়ে গলা ঢাকার চেষ্টা করলো। তখনি শক্ত গলায় বলল ডা. আদর,

” বয়ফ্রেন্ডের দিয়া চিন্হ এভাবে ঢাকবে না। ”

বলেই গাড়ি সাইড করলো। জয়নব ঘাবড়ে গেলো। বাহিরে এক পলক দেখে নিলো। পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারা। যেখানটায় গাড়ি থামিয়েছে আদর একদম জনশূন্য জায়গায়। জয়নব শুঁকনো ঢুক গিললো। ভয়ে তোতলানো শুরু করলো,

“এ..খানে, এখানে থামিয়েছেন কে..ন?”

আদর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো জয়নবের দিক। জয়নব চোখ ফিরিয়ে নিলো। ডা. আদর হালকা ঝুকে ফাস্টেড বক্স বের করলো। জয়নব নড়েচড়ে বসলো। ডা. আদর আরেকটু ঝুকে এলো। ঘাড় থেকে ওরনা নামিয়ে মেডিসিন লাগাতে লাগলো। এদিকে জয়নবের বুকের মাঝে দুরুদুরু করছে। হৃদপিণ্ড হাজারগুন স্প্রিডে ধুকপুক ধুকপুক শব্দ করছে। লোকটি শ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে তার ঘারে। আদর যতবার ঘাড়ে স্পর্শ করছে, জয়নবের শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটি বুঝে আছে। ঠোঁট দুটি কাঁপছে। এক অদ্ভুত অস্থিরতায় গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। মনের ভিতর শিরশিরানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জয়নব যেন নিজের সত্তা ভুলতে বসেছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই লোকটির প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলতে। জয়নব আর পারছিলো না এই অদ্ভুত ভয়ংকর অনুভূতির সাথে। এবার সে খামচে ধরলো নিজের ওরনা। তখনি ডা. আদর স্বরে এলো। জয়নবের এবার প্রান ভরে শ্বাস নিলো। ডা. আদর জয়নবের এ অবস্থা দেখেই ভ্রু কুচকে ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

“আর ইউ ওকে?এমন করছেন কেন আপনি? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?”

জয়নব ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। মাথা নাড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছি!”

ডা. আদর ওকে বলে, আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। জয়নব এবার স্বাভাবিক। বাহিরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। গাড়িতে চলছে পিনপতন নিরবতা। কিছু সময় ব্যয় করে ডা. আদর আবার ডাকলেন,

“জান!”

জান ডাক শুনেই তরতর করে জয়নবের রাগ বেড়ে গেলো। কাঠ গলায় বলে উঠলো,

“আমাকে আপনি জান ডাকবেন না। জয়নব ঠিক আছে। জান শুধু আপনজনরাই ডাকে!”

আদর মুচকি হাসলো। বলল,

“আমি কি আপনার আপনজন নই জান?”

জয়নব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। রাগ এবার মাথায় উঠে গেলো। কেন রাগ হচ্ছে বুঝলো না জয়নব। তবুও অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে চেয়েও পারলো না। বলল,

“নাহ্ আপনি আমার শিক্ষক, আর আমি আপনার শিক্ষার্থী। এতটুকুই সম্পর্ক আপনার আর আমার!”

ডা. আদর মুখে হাসি উড়ে গেলো মুহূর্তেই। ফ্যাকাসে হয়ে গেলো দাম্ভিক মুখখানা। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“আই ইউল রিমেম্বার! ”

এর পর সব নিস্তব্ধতা। গাড়ির স্প্রীড চলতে শুরু করলো। ডা. আদরের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে গেছে একদম। জয়নব বুঝতে পারলো না এই ক্রোধের কারণ কি?

——————-

অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে বসে হাঁপাচ্ছ জয়নব। মেডিকেল কলেজে নতুন সে। কাঁটা ছেঁড়া ছোট থেকেই ভয় পায়। আর তাদের এ বিষয়ে এখনো ক্লাস হয়নি। মানবদেহের চিড়ে ফেড়ে আবার জোরা লাগানো খুবই ভয়ংকর অনুভূতি। জয়নব ওটির ভিতরেই কাঁপা কাঁপা হাতে ডা. আদরের কথা অনুসরণ করে চলেছে। কঁপাল বয়ে ঘাম ঝরছিল তার। আশেপাশে অন্য ডক্টর গুলো একবার আদরকে বলেই বসল,

“অনভিজ্ঞ কাউকে না নিয়ে আসলেই পারতেন। দেখে মনে হচ্ছে মিস জয়নব নিজেই রোগী হয়ে যাচ্ছেন। পড়ে না উনার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হয়। ”

হাসির রোল পড়লো বন্ধ ঘরটিতে। জয়নব রাগে দুঃখ কান্না পেয়ে গেলো। এভাবে ডক্টর আদর তাকে অপমান না করলেই পারতো। জয়নব এবার যেন কেঁদে দিবে দিবে ভাব তখনি ডক্টর আদর বলে উঠলো,

“আপনি বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। সার্সার্জারি শেষ করে আসছি! ”

জয়নব দৌড়ে বেড়িয়ে এলো যেন সেখান থেকে।

“পানি!”

একজন অপরিচিত একটি মেয়েলি কন্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকালো জয়নব।লাল, খয়েরী জামা গায়ে নাদুসনুদুস গরনের হালকা লম্বাটে মুখে মেয়েটিও তাকে দেখে মুচকি হেসে যাচ্ছে।হাসি টুকু মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো৷ চোখ জোরায় মায়ায় ভর্তি। জয়নবের তখন খেয়াল হতেই ঝাঁপটে ধরে মেয়েটিকে। মেয়েটি পরম যত্ন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,

“কেমন আছিস জান?”

“ভালো আছি শ্যামাপু তুমি কেমন আছো?বড়পু যাওয়ার পর আর তোমাকেও পেলাম না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল শ্যামা,

“আমি ভালো আছি।রুফাইদা চলে যাওয়ার পর আমিও থাকিনি সেই হাসপাতালে ট্রানস্ফার নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি । তা তুই এখানে কেন?”

জয়নব সব খুলে বলল। শ্যামার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো। বলল,

“বোন তুই কেন এসব করছিস? এসব খুব ভয়ংকর। তোর উচিত হয়নি এসব করা!”

“আমি কি করতাম শ্যামাপু বলো? যেখানে আমার বোনের এভাবে খুন হয়ে গেলে, কেন হলো, কি করে হলো? তাদের কেন শাস্তি দিতে পারলো না পুলিশ আমি জানতে চাই। তুমি কিছু জেনে থাকলে প্লিজ সাহায্য করো! আমি যেখানেই হাত দিচ্ছি সব ধোঁয়াশা। আমি চাই আমার বোনের খুনিদের নিজ হাতে শাস্তি দিতে।”

শ্যাম কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো। রুফাইদার মতোই হয়েছে জয়নব। দুবোনের কত মিল। কিন্তু রুফাইদাকে যারা মেরেছে, তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না ঠিকি। কিন্তু জয়নবকে সে সাহায্য করতেই পারে। এসব ভেবেই কিছু বলবে তার আগেই অপারেশন থিয়েটারের বাতি নিভে গেল। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে শ্যামা হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেল সেখান থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেলো। তার কথা কাউকে না বলতে, আর আধঘন্টার মাঝে ওয়াশরুমে দেখা করতে। জয়নব মাথা নাড়লো। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পাড়লো না, এভাবে চলে করন গেলো তার শ্যামপু?

—————-

চট্টগ্রামের কাজ শেষ ফিরে যাবার পালা। ঠিক সেই মুহূর্তে জানা গেলো, শহরে মারামারি লেগেছে রাজনৈতিক দুই দল। সেদিকে যে গাড়িই যাচ্ছে আগুন ধরিয়ে দিয়া হচ্ছে। এসব শোনার পর হাসপাতালের দায়িত্বরত ডাক্তার হাশেম বললেন আজ রাত রাত বাসাতেই থেকে যেতে। কিন্তু ডক্টর আদর রাজি হলেন না। তারা কোনো গেস্ট হাউজেই উঠতে চায়। ডক্টর হাশেম মাথা নাড়লেন। পাশেই একটি বাংলো বাড়ির মতো রেসর্টে বুকিং করে দিলেন রুম। ডা. আদর আর জয়নব বের হওয়ার আগেই জয়নব বলল,

“আপনি চলুন আমি আসছি। ”

ডক্টর আদর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকাতেই জয়নব বলল,

“ওয়াশরুমে যাবো।”

“রেসর্ট তো কাছেই। সেখানে গিয়েই না হয়…”

মাঝ পথেই কথা থামিয়ে বলল জয়নব,

“ইটস আর্জেন্ট! প্লিজ!”

কাঁধ বাকিয়ে ডা. আদর বলল,

“ওকে!”

জয়নব হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমে দিক ছুটলো। সেখাই পায়চারি করছে শ্যামা। চোখে মুখে আতঙ্ক। জয়নবকে দেখেই এগিয়ে এলো সে। কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেট এগিয়ে দিল তার দিকে। যেতে যেতে বলে গেলো,

” ওই হসপিটালের কাউকে বিশ্বাস করবে না। কাউকে মিনস কাউকে না..! কে কখন কোন দিক দিয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা করে বসবে জানা নেই। আর হে আমার সাথেও কোনো যোগাযোগ করা চেষ্টা করো না! ভালো থেকো জান!”

জয়নবের ললাটে চুম্বন করে বেড়িয়ে গেল শ্যামা। তার চোখে ছলছল করছে পানি। কত বছরের আত্মগোপনে থাকতে পারবে জানা নেই তার। মন থেকে শুধু চায়। এসব ক্রাইম শেষ হোক। আর কোনো মানুষ না মারা যাক। জয়নব তাকিয়ে রইলো শ্যামার যাওয়ার দিক। ঠিক তখনি ভেসে এলো ডা. আদরের কন্ঠ। চট জলদি প্যাকেটটি ভরে নিলো ব্যাগে। আর বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ডক্টর আদর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলল,

“চলুন এবার?”

জয়নব চাপা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“হে চলুন।

—————–

সবুজে সবুজে চারিপাশ ঘেরা রেসর্টের। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নিরিবিলি সময় কাঁটাবার জন্য পার্ফেক্ট। চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো জয়নব।চারিদিকে যেন চোখ ধাঁধানো সুন্দর। জয়নব হা করে দেখছে সব। সময়টা শেষ বিকেল হওয়াতে মনোরম পরিবেশ আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে যুগলদের। জয়নব চোখ ফিরালো আদরের কন্ঠ পেয়ে। তার ভিতরে ঢুকতেই আকাশ ভেঙ্গে পড়লো জয়নবের মাথা। অস্পষ্ট স্বরে বলল শুধু,

” অসম্ভব! ”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here