অন্তর্দহন প্রণয়,পর্ব-৭
লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
হতাশ হয়ে চাইলে এবার কুয়াশার দিকে। কুয়ার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। নিরাশ হয়ে তারা ফিরে এলো হলে। কিন্তু হলে পা রাখতেই যা দেখলো, চোখ ছানাবড়া….।
সবাই জড় হয়েছে এক সাথে। ঠিক তাদের মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডা.আদর। হাত নাড়িয়ে খুব সুন্দর ভঙ্গিমায় কিছু বলছেন। দূর থেকে তেমন কিছু শুনতে পাচ্ছে না বলে এগিয়ে এলো ওরা। জয়নব এই প্রথম ডা. আদরকে মাস্ক ছাড়া দেখলো। লাল সাদা রং এর শরীর আর চশমার আড়ালে ফ্যাকাশে চোখের মালিক প্রচন্ড সুদর্শন। শরীরে তার যেন আভিজাত্য চুয়ে চুয়ে পড়ছে। শক্ত চোয়াল জুড়ে সুন্দর করে কাঁটা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। গায়ে ঝুলছে নেভি ক্যাজুয়াল শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট। সাদা চামড়ার হাতে উপর চুপটি করে বসে আছে ব্ল্যাক ওয়াচ। হালকা বাদামি চুল গুলো ঠেলে পিছনে রেখেছেন। অহংকারের সাথে যেন মাথা উঁচু করে আছে ছোট ছোট দুটো তীল গ্রীবাদেশে। জয়নব যেন ঘোরে চলে যেতে লাগলো। শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিটির উপর তার মন যেন ধীরে ধীরে গলে পড়তে লাগলো।
” সামনের শুক্রবার নবীন বরণ হতে চলেছে। প্রতিবারের মতো আপনাদেরকেও বরণ করে নিয়া হবে। তবে আপনারা চাইলে কবিতা, নাচ, গান, মডেলিং আরো অনেক কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তার জন্য দায়িত্বতে আপনাদের সিনিয়র ভাই আয়ান আর যুথি। ”
কানের মাঝে ঝনঝন করে উঠলো আয়ান নামটি। চকিতে মুখ তুললো জয়নব। চোখ দুটিতে চমকের ছাফ। আয়ান যখন এসে দাঁড়ালো ডা. আদরের পাশে, জয়নব যেন ১৮০ বোল্ডের শক্ড খেলো। শুকনো ঢুক গিলে কুয়াশার দিক তাকালো। কুয়াশা ভ্রু কুচকে আছে আয়ানকে দেখে। জয়নবের দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে তাকালো আবার। এর মাঝে ডা.আদরের ঘোষণা সবাই হাততালি দিতেই জয়নব অসহায় ভাবে তাকালো কুয়াশার দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে ডা. আদর তাকালো অসহায় মুখশ্রী জয়নবের দিকে। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। জয়নবের পাশ ঘেষে এবার চলে গিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে এলেন তিনি। জয়নব তখন তাকিয়ে কুয়াশার দিকে। কুয়াশাও তাকিয়ে জয়নবের দিকে। যেন চোখে চোখে হাজার কথা চলছে তাদের মাঝে!
ডা. আদর সব কিছু লক্ষ করলেন। দুজনের সামনে এক চুটকি বাজিয়ে বললেন,
“কোথায় হারিয়ে গেলেন মিস?”
জয়নব চমকে তাকালো। বুকের মাঝে থুতু দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। বলল,
“কোথাও না স্যার!”
সন্ধিহান দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইলো ডা. আদর। জয়নবের আগাগোড়া দেখে নিলো। কচুঁ পাতা রঙ্গের জামা পড়া, উষ্কখুষ্ক চুল, ক্লান্ত মুখ আর চোখ। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ তাদের। ডা. আদর ঠান্ডা আর থমথমে কন্ঠে বললেন,
“ইউ বোথ কাম টু মাই কেবিন! কুইক লি? ”
জয়নবের ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো। কেন জানি লোকটিকে দেখলে তার ভয় লাগে। লোকটি ফ্যাকেশে ধারালো চোখ যেন তাকে আরো শিথিল হয়ে পরে…।আবার ডাকচ্ছে তাদের??
এদিকে কুয়াশা টুপ করে মাটটিতে বসে পড়লো।
“বইন আমি জামু না। তুই যা। এই বেটটা অভিনব স্যারের থেকে বেশি রাগী। ”
জয়নব তার পাশে বসলো। ফিসফিস করে বলল,
“তুই না গেলে আমিও জামু না। তার আগে আয়ান ভাইয়ার কাছে যাই চল!”
কুয়াশা এবার খেপে গেলো,
“তুই যা। মাফ কর আমায়। আয়ান মইরা, মইরা গেছে কইয়া মাথায় তুলছোস? ব্যাটা সমনে হাজির তোর সাথে নেই আমি যা ভাগ!”
জয়নব বাচ্চাদের মকো মুখ করে মানাতে চাইলো,
“প্লীজ!”
কুয়াশা রাগ করেও থেকেও পারলো। খিল খিল করে হেসে দিলো। তারপর পা বাড়ালো দুজন আয়ানের কাছে।
———-
“আর ইউ ম্যাড জয়নব?”
“আমি সত্যি বলছি ভাইয়া, আমি সেদিন আপনাতে দেখেছি। ”
একে একে সব খুলে বলল জয়নব! আয়ান হো হো করে হেসে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে হাসি থামাবার চেষ্টা করলো। করিডোরের এক পাশে বসার জন্য চেয়ার দিয়া। সেখা বসে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,
“আই থিঙ্ক তোমার একটা ভালো সাইক্রেটিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার। ”
জয়নব আর কিছু বলতে পারলো না। এদিকে কুয়াশাো একটি কথা বারবার ঘ্যানঘ্যান করে চলছে। জয়নব রাগে চেঁচিয়ে উঠলো এবার,
” তোর আমার কথা বিশ্বাস না হলে আসিস না আমার সাথে।আমি অসুস্থ নেই। সেদিন যা দেখেছি ভুল দেখিনি। আমার কাজো আর তোর হেল্প করতে হবে না। যা করার আমি করবো। ”
কুয়াশা হতাশ হলো।জয়নবকে বোঝানো তার কাম্য নয়।এরেই মাঝে একজন ওয়ার্ড বয় এসে হাজির। লোকটি এসেই ধমকের মতো বলল,
“তোমাদের আদর স্যার ডাছেন!”
লোকটি কথায় দুজনেই কেমন সিটিয়ে গেলো। মিন মিন করে বলল,
“যাচ্ছি ভাইয়া!”
——————–
“আপনার কোথায় গিয়েছিলেন? আপনার কি জানেন না? ক্লাস চলা কালীন সময় গুলোতে কোথাও যাওয়া নিষেধ আপনারা কি জানেন না?”
মাথা নত করেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন। ডা. আদরের শক্ত কথাতেই যে কেঁপে উঠলো তারা। দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,
“সরি স্যার।”
ডা. আদর এবার দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,
“নিয়ম যখন ভেঙেছেন শাস্তিতো পেতেই হবে!”
দুজনেই চোখ তুলে তাকালো। মুখখানা এমন যেন এখনেই মেরে বালি চাপা দিয়ে দিবে যেন ডাক্তার আদর। চুপসে গেছে একেবারে। আদরের তা দেখেই হেসে ফেলতে চাইলো হো হো বাট চেপে গেলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“মিস কুয়াশা আজ আপনি ডিউটি করবেন শিশু ওযার্ডে। আপনি যেতে পারেন এখন।”
কুয়াশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে চলে গেলো। বাচ্চাদের ওয়া ওয়া শুনতে মোটেও তার ইচ্ছে করছিলো না। সারা দিন জার্নি করে এই প্যারা নিয়ার কোনো মানেই হয় না।
কুয়াশা যেতেই জয়নবের পানে তাকালো আদর। জয়নবের মনে হলো, তার ধারালো দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে। জয়নব বার বার ঢুক গিলতে লাগলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার হাত পা। ডা. আদর টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখে যেন অদ্ভুত কিছু তার। কিন্তু কি? বুঝতে পারছে না জয়নব। ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে সুক্ষ্ম ভাবে মুখস্থ করতে ব্যস্ত জয়নবের লতানো শরীরের দিক।জয়নবের অস্বস্তি লাগছে খুব। সে বলল,
“স্যার আ..মি কি করবো??”
ডা. অাদর অকপটে বলল,
“ভালোবাসো!”
জয়নব সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাতেই আদর বলে উঠলো,
“কাল সকালেই আমি চিটাগং যাচ্ছি সেখানে একটি সার্জারি আছে, আমি আমাকে অ্যাসিস্ট করবেন। সো রেডি থাকবেন সকাল সাতটায় বের হবো আমরা!”
জয়নব আর মাথা ঘামালো না মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলো সে। তার মাথা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আয়ানের ব্যাপারটা….।
———-
রাত প্রায় দুটো বাজে, চোখে ঘুম নেই জয়নবের। নিশাচর পাখিদের মতো সেও বেড়িয়ে পড়লো হোস্টেল থেকে। ঠিক একই জায়গায় এসে দাঁড়ালো জয়নব। সেদিন রাতের কথা প্রতি স্পষ্ট মনে আছে এখন, তাহলে? কেন আয়ান অস্বীকার করছে সব? এসব ভেবেই সে আকাশের দিকে তাকালো। তারা ভরা আকাশ। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধকের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝলো। ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,
“বড়পু! আমি তোমার জন্য কিছুই কি করতে পারবো না? যেখানেই হাত দিচ্ছি? সব ধোয়াশা লাগচ্ছে কি করবো আমি বলতো!”
কোনো প্রশ্নের উত্তর ফিরে এলো না। এলো শুধু প্রবল বেগে স্ব স্ব বাতাস। জয়নব চোখ খুলো। বিজে যাওয়া ছল ছল চোখে ভেসে উঠলো সেই কালো আবরণের মানবের প্রতিছবি। জয়নব স্তম্বিত হলো। লোকটি তার খুব কাছে, বিন্দু পরিমাণ ফাঁকা নেই যেন। জয়নব যখন পিছিয়ে যেতে নিলো। তখনি লোকটির বলিষ্ঠ হাত জোরা চেপে ধরলো জয়নবের বাহু। জয়নবের কথা যেন গলার মাঝ বরাবর আটকে গেছে। কালো কুচকুচে চোখের মনির লোকটি তার হাত দুটি একবারে পিছনে নিয়ে পিঠের সাথে চেঁপে ধরলো। হিসহিস করে বলল,
“মেয়ে রাতবিরাতে হচ্ছে পশুদের রাজ কি করছো এই রাজ্যে প্রানের ভয় আছে তো?”
জয়নব চোখ বড় বড় করে চাইলো। অস্পষ্ট ভাবে বলল,
“প..শু”
লোকটি আরো ঘনিষ্ঠ হলো। জয়নবে শরীরের ঘান শুকে নিয়ে বলল,
“হে, পশু মানুষ খেকো পশু। ডোবা তেলে ভেজে খেতে খুব টেষ্ট। সব থেকে সুস্বাদু হয় মেয়েদের দেহের কিছু অংশ!”
জয়নবের পিলে চমকে উঠলো। লোকটির কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রবল চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। এদিকে সে চিৎকার করতে-ও পারছে না যেন গলার মাঝে কেউ কিছু একটা চাপা মেরে দিয়েছে।
“শোনো মেয়ে, প্রকৃতির মাঝে অনেক কিছু ঘটে যার উত্তর খুঁজতে হয় না। আজ ছেঁড়ে দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর দয়া ময়া নাও হতে পারে আমার। হতেও পারে আমার পেটে গিয়ে তুমি হজম হয়ে আছো!”
লোকটির হাসির শব্দ পেলে জয়নব। লোকটি কথা হীম হয়ে যাচ্ছে শরীর। জয়নবের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। লোকটি এবার অপ্রতাশিত কাজ করে বসলো। প্রথম দিনের মতো দাঁতের দাগ বসিয়ে দিলো জয়নবের গ্রীবাদেশে। জয়নব ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো একেবারে। ক্ষত স্থান থেকে বেড়িয়ে আশা রক্ততে জিব্বা বসলো। শরীরের শিড়া উপশিরায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো যেন। ধীরে ধীরে জয়নব নেতিয়ে পড়তে লাগলো। লোকটি এবার কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়লোন হোস্টেলের দিকে। জয়নব তখন তাকিয়ে। লোকটি বিছানায় শুয়ে দিলো জয়নবকে। আধো খোলা চোখ জোড়ায় হাত বুলিয়ে চুম্বন করলো ললাটে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো সে,
” ঘুমিয়ে পরো আমার রাজ্যের রাণী। ”
চলবে,