অনুভূতির_সংঘাত_৫

অনুভূতির_সংঘাত_৫
ছামিনা_বেগম

খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে সেই অনেক আগে । ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুই ছুই করছে , তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্ধকার রাতের গভীরতা । পুতুলের রোজ রাত জেগে পড়ার অভ‍্যাস । গভীর , নিশুতি রাতে নাকি পড়ায় মনোযোগ আসে তার । তাই রোজদিনের নিয়মমাফিক সে পড়তে বসেছে । বাইরে মেঘের তর্জন গর্জন শোনা যাচ্ছে , মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে আকাশে । হঠাৎ ঠাস করে একটা শব্দ হওয়ায় পুতুল কানখাড়া করে বোঝার চেষ্টা করল কিসের শব্দ এটা ? কিন্তু বুঝতে পারল না । ভাবলো হয়তো আশেপাশে কোথাও গাছ ভেঙে পড়েছে । পড়ায় আবার মনোনিবেশ করতে গিয়ে শব্দটা আবার হলো । কৌতুহল দমন করতে না পেরে সে বেরিয়ে এলো বাইরে । পুতুল অবাক হয়ে দেখল সদর দরজাটা হাঁট করে খোলা । হাওয়ার দাপটে সেটি বারবার বন্ধ হচ্ছে আবার খুলে যাচ্ছে । সেই সাথে শুকনো পাতা , বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে পাপোশ আর মেঝে । শব্দ শুনে বকুলও বেরিয়ে এসেছে। এই দৃশ্য দেখে সেও বিস্মিত !শেফালী বেগমকে রোজ ঘুমের ওষুধ খেতে হয় ।তাই তিনি শব্দ পাননি । বকুল বেশ বিরক্ত হল । আশ্চর্য , দরজাটা এমন হাঁট করে খুলে রেখেছে কে ? সে দরজা লাগিয়ে পুতুলকে বলল নিজের ঘরে যেতে । পুতুল নিজের ঘরে প্রবেশের আগে শিমুলের ঘরে আলো জ্বলতে খানিকটা অবাক হয়েই উকি দিল । হাওয়া লেগে পর্দা বারবার সরে যাচ্ছে । দরজা খোলা কেন ? এতক্ষণে তো ভাবির ঘুমিয়ে পড়ার কথা ! এক পা দু পা করে পুতুল এগিয়ে গেল সেদিকে । পুতুল দুবার ডাকল ‘ ভাবি ,ভাবি ‘ বলে । কিন্তু কারো আওয়াজ শুনতে না পেয়ে দরজা আলতো করে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটি । ভেতরে ঢুকে আরো বিস্মিত হল সে । ঘর একদম ফাঁকা ! বাথরুমে দুবার নক করে দেখল কেউ আছে কিনা ? কিন্তু দরজার নব ধরে একটু ঘুরাতেই খুলে গেল সেটি । পুতুল আরো বেশি অবাক হল যখন রান্নাঘর , ড্রয়িং রুমের কোথাও খুঁজে পেল না অহনাকে ।অজানা আতঙ্কে হাত পা কাপতে লাগল ওর । ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পুতুল বকুলের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে শুধাল ,

-মেজ দা , ঘুমিয়ে পড়েছিস ? একটু বাইরে আয় না ।

ভেতর থেকে বকুলের বিরক্তিমাখা কন্ঠস্বর শোনা গেল ,

– কি শুরু করেছিস বল তো পুতুল ? ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে । আর এদিকে কেউ দরজা লাগাতে ভুলে যায় এখন আবার তুই এসে প‍্যানপ‍্যান করছিস ! ধুর ,ভালো লাগে না আর !

মুখে একথা বললেও বকুল দরজা খুঁলে দাড়াল । ঘুম ঘুম চোখে আবার প্রশ্ন করল ,

-কি হয়েছে ?

-ভাবি ঘরে নেই মেজ দা ।

– ঘরে না থেকে কোথায় যাবে ! আছে হয়তো বাথরুমে ! তোর এত রাতে ভাবির সাথে কি দরকার ?

– তুই বুঝতে পারছিস না কেন ? আমি বাথরুম , ড্রয়িং রুম , কিচেন সব জায়গায় খুঁজেছি । ভাবি কোথাও নেই !

-কোথাও নেই ? তো গেল কোথায় ? সর দেখি ….

বকুল ছুটল শিমুলের ঘরের দিকে । ওকে পেছন পেছন অনুসরণ করতে গিয়ে মনে পড়ল পুতুলের শিমুল দার ঘরে বিছানায় খোলা ডায়েরিটা সে দেখেছিল একটু আগে । বিকেলে এই ডায়েরিটাই তো ভাবি নিয়ে এসেছিল স্টাডি রুম থেকে । পাশেই পড়েছিল সাদা মতো একটা কাগজ । তখন গুরুত্ব না দিলেও এখন হন্তদন্ত হয়ে ছুটল সেটার খোঁজে । বিছানার ওপর থেকে খোলা ডায়েরির পাতা উলটে ঝড়ের বেগে পড়ে গেল প্রতিটি বাক‍্য । এক একটা শব্দ পড়তে গিয়ে অসাড় হয়ে গেল হাত পা । নিজের স্নেহভাজন বড়ো ভাইয়ের প্রতি ঘৃণার রি রি করে উঠল সারা দেহ । এতটা নির্লজ্জ মানুষ কি করে হতে পারে কেউ ! অহনার কথা চিন্তা করেই ওর সারা দেহ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল । নিশ্চয়ই মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে !কষ্ট পাবারই তো কথা । নিজের সবথেকে আপন মানুষটার কাছ থেকে এত বড়ো প্রতারণা কেউ কল্পনাও করতে পারে না । এত রাতে কোথায় গেল কে জানে ? পাশে পড়ে থাকা সাদা মোটা কাগজটা তুলে সবুজ শাড়ি পরিহিতা মেয়েটিকে দেখে রাগ , ঘৃণা বহুগুণে বেড়ে গেল পুতুলের । কঠিন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক । বিরবির করে স্বগতক্তি করল ,

-” আমার দাদার জীবনটা তো তুমি তছনছ করে দিয়েছিলে , আবার কেন ফিরে এসেছ তুমি ? একবার দাদাকে সর্বশান্ত করে তোমার শান্তি হয়নি ? আবার কি চাও তুমি , হ‍্যাঁ ? ”

– “কিছু বুঝতে পারছিস ? কোথায় গেছে ভাবি ? দাদা তো এখনো ফেরেনি । চল মাকে ডাকি ?

-কিন্তু মেজ দা , মায়ের শরীর…..

-কিন্তু এ ছাড়া উপায় কি ? …আমরা কেউই কারণ জানি না । ভাবি এমন হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেল ? ভাইয়ার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে না কি ?

পুতুল অসহায় হয়ে তাকাল বকুলের দিকে । ডায়েরির কথাটা লুকিয়ে গেল সন্তপর্ণে । বলল ,

-জানি না ।

*****

-জামাল চাচা , স্পিড বাড়িয়ে দিন । আবার ঝড় আসবে মনে হচ্ছে !

– জি , মামনি ।

কথা মতো জামাল মিঞা স্পিড বাড়িয়ে দিল । দশ মিনিটের মতো হয়েছে বৃষ্টি থেমেছে । এখনো মেঘ গুর গুর আওয়াজ করছে । বৃষ্টি আজ বিকেলে তার নানু মনিকে দেখতে গিয়েছিল । বৃদ্ধা এতদিন পর প্রিয় নাতনিকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন । কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলেন না । কিন্তু বৃষ্টির থাকা সম্ভব হয়নি । রাত পোহালেই তাকে ফিরতে হবে বেঙ্গালুরুতে । সকাল সাতটায় ফ্লাইট ওর । নানুবাড়িতে থেকে গেলে সমস্যা হয়ে যেত । ওর নানুমনি কেঁদেকেটে হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলেছিলেন তবুও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল ও ছাড় দেয়নি বৃষ্টি । ঝড় কমলে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ড্রাইভার ওরফে হক বাড়ির কেয়ারটেকার জামাল মিঞাকে গাড়ি বের করতে বলেছে ।গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির তান্ডবলীলা দেখতে দেখতে নানুমনির কথাই ভাবছিল বৃষ্টি । ঘোর ভাঙল গাড়ি থামতে দেখে । কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল ,
-কি হল চাচা ? গাড়ি থামালেন কেন ?
-মামনি , সামনে এক্সিডেন্ট করেছে একটা গাড়ি ।

জামাল মিঞার কথা মতো বৃষ্টি গাড়ির হেড লাইটের জমকালো আলোয় সামনে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল । শুনশান রাস্তায় দুমড়েমুচড়ে একপাশে উলটো হয়ে পড়ে আছে একটি সাদা গাড়ি । ভেজা পিচ ঢালা রাস্তায় রক্তের বন‍্যা বইছে । বৃষ্টি আতঙ্কিত হয়ে বলল ,

– ইয়া আল্লাহ ! চাচা, তাড়াতাড়ি অ্যম্বুলেন্স কল করুন । কেউ ভিতরে আটকে পড়েছে মনে হচ্ছে ।

-হ‍্যাঁ , হ‍্যাঁ করছি ।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল তখনো । বৃষ্টি হুড়মুড়িয়ে নেমে দৌড়ে গেল গাড়ির দিকে । অ্যাম্বুলেন্সকে ঠিকানা বলে পেছন পেছন দৌড়ে এলো জামাল মিঞাও । বৃষ্টি টানাহেঁচড়া করে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করল কিন্তু সেটা তো খুললই না বরং গাড়ির ভাঙা কাঁচ বিঁধে হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল । জামাল বৃষ্টিকে সরতে বলে নিজেই কয়েকবারের চেষ্টায় দরজা খুলতে সম্মত হল । বৃষ্টিদের গাড়ির হেড লাইটের আলোতেই গাড়ির ভেতরের যাত্রীকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল ওরা । বৃষ্টি একরাশ আতঙ্ক নিয়ে তাকাল জামালের দিকে । একজন গর্ভবতী মহিলা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে । তার একখানা হাত পেটের ওপর রাখা । বাচ্চাটা ঠিক আছে তো ! বৃষ্টি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শুধাল মহিলাকে উদ্দেশ্য করে ,

– এই যে আপা ? আপনি শুনতে পাচ্ছেন ? আপা , চোখ মেলুন প্লিজ । চাচা, উনি তো সেন্সে নেই মনে হচ্ছে ? ওনাকে বের করা উচিত ! ধরুন । অ্যাম্বুলেন্স এখনো এলো না কেন ?

– মামনি , চিন্তা করো না । ওরা আসছে …. ধরো , চেষ্টা করি বের করার ।

বৃষ্টি ও জামাল দুজনে মিলে খুব সন্তপর্ণে ধীরে ধীরে বের করল অহনাকে । অহনাকে কোলের ওপর নিয়ে বৃষ্টি আবার ডাকল ,

-আপা , আপনি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন ? প্লিজ, চোখ খুলুন । তাকান এদিকে ….আপা.….

মুখের ওপর জলের ফোঁটা এবং একটি উদ্বিগ্ন মেয়েলি কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই অহনা ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল । ঝাপসা চোখে দেখল একটি চেনা চেনা মুখ । কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না । কিন্তু শরীরের যাতনা যত বৃদ্ধি পেল ততই বাস্তবজ্ঞান ফিরে এলো ওর । পেটের ওপর হাত রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল সে , কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠল ,
– আপা, আমার বাচ্চাটা ?
– ও হয়তো ঠিক আছে আপা ! আপনি চোখ বন্ধ করবেন না । অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছি , এসে পড়বে এক্ষুনি । আপনি প্লিজ একটু শক্ত থাকুন । আপনার বাচ্চার জন্য হলেও আপনাকে জেগে থাকতে হবে । প্লিজ আপা , কোনোক্রমেই চোখ বন্ধ করবেন না । জেগে থাকার চেষ্টা করুন ….। চাচা , আর কতক্ষণ লাগবে ?
জামিল মিঞা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ।

বৃষ্টির কথা গুলো অহনা কতটুকু বুঝলো কে জানে ? ওর মনে পড়ল সেই প্রথম দিনের কথা যেদিন অহনা প্রথম জানতে পারলো তার ভেতর একটা ছোট্ট প্রান ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে । শিমুলকে জানালে সে ছোট্ট শিশুর মতো অহনার পেটে মুখ ডুবিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল । তারপর যেদিন প্রথমবার চেকআপ করতে গিয়ে বাচ্চার হৃৎস্পন্দন শুনলো সেদিন আনন্দের আতিশয্যে আরেক দফা কেঁদে ভাসিয়েছিল সে । সেদিনই বিকেলে পথশিশুদের ডেকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাইয়েছিল শিমুল । তারপর যেদিন রেশমি আপা বলল তার মেয়ে হতে চলেছে সেদিন সেকি খুশি তার ! গরীব দুঃখিদের ডেকে বস্ত্র বিতরণ থেকে খাওয়া দাওয়া কত কিছুই না করেছিল শিমুল । সব কি মিথ‍্যা ছিল ? অহনার মন মানতে চায় না । মেয়েরা বোকা হোক আর যাই হোক , আর কি বুঝুক আর না বুঝুক ভালোবাসা , স্নেহের ভাষা তারা বোঝে । কিন্তু ওই লেখা গুলো ? ওগুলো তো শিমুলের হাতেরই লেখা । এ তে তো কোনো সন্দেহ নেই । কোনটা সত্যি কোনো মিথ্যা বিচার করতে গিয়ে অহনার মাথা ব‍্যাথা করতে লাগল । বুঝতে পারল শরীর টা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে তার । নাহ , বড়ো ভুল হয়ে গেছে । এভাবে বেরিয়ে আসা ঠিক হয়নি । এই হটকারিতা কিভাবে করল সে । নিজের সাথে সাথে মাম্মামের জীবনটাও হুমকির মুখে ফেলে দিল । শিমুল আর ও মিলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন টা দেখেছিল ওরা , হোক তা মিথ‍্যের জালে বোনা তবুও তো তাতে কোনো কমতি চোখে পড়েনি অহনার । যে মানুষটার মিথ‍্যে ভালোবাসা এত প্রেমময় হয় , এত শান্তির হয় তাতে তো অনায়াসেই একটা জনম পার করে দেওয়া যেত । ওই ডায়েরিটাকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যেত অহনা । অথবা এটার জের ধরে মাঝে মাঝে ঝগড়া করত শিমুলের সাথে । তাতে কি খুব ক্ষতি হতো ? অহনা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল । শিমুল না হয় ওকে ভালোবাসেনি কিন্তু ওদের বাচ্চাটা কি দোষ করল ? অহনা শিমুলকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের অনাগত সন্তানের ওপর অবিচার করে বসল । মা হয়ে কিভাবে তা পারল সে ? সে না হয় শিমুলের কাছ থেকে জবাবদিহি চাইতে পারত । কিন্তু নাহ । সেটা না করে আবেগের বশে যে ভুল করে ফেলেছে মনে হতেই শারিরীক পীড়ায় সাথে সাথে মানসিক পীড়ায় পিষ্ট হতে লাগল । চোখ দুটো বুজে আসার আগে দেখতে পেল দুটি বড়ো বড়ো আলো এসে থামল কাছেই । বৃষ্টির মাঝেই স্ট্রেচার হাতে দৌড়ে এলো দুজন মেল নার্স । এরপর আর কিছু দেখা হলো না অহনার ।

(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here