#অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_১
#নাজমুন_বৃষ্টি
একই কাগজে এক বছর পর আবারো স্বাক্ষর দিচ্ছে নীলাদ্রি। পার্থক্য শুধু এটুকুই, একবছর আগে নিজের সব অনুভূতি দিয়ে বিয়ের স্বাক্ষর আর এখন ডিভোর্স। কিন্তু তার কোনো মায়া বা আফসোস হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে সে অবশেষে মুক্তি পেতে চলেছে। নীলাদ্রি সাইন করার আগে বিপরীত দিকের লোকটার দিকে এক পলক তাকালো। চার চোখের দৃষ্টি একত্রে হতেই নীলাদ্রি মাথা নিচু করে খুব দ্রুতই সাইনটা করে দিল। হ্যাঁ, এখন থেকে সে ডিভোর্সি। আজ থেকে তাকে সমাজে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েই চলতে হবে।
নীলাদ্রি সাইন করা শেষ হতেই কাগজটি বিপরীত দিকে বসা লোকটিকে বাড়িয়ে দিতেই সে সাইন করতে নিলো।
আরিয়ান কাগজে কলম বসানোর আগে একবার নীলাদ্রির দিকে তাকালো। নীলাদ্রি তার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে ফেলল। তার এই মানুষটার চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। এই চোখের দিকে তাকালে তার মন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
এরপর লোকটিও খুব তাড়াহুড়োর সহিত সাইনটা করে দিল।
নীলাদ্রি একটা মলিন শ্বাস ফেলল। এতদিনে লোকটির প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল তবে পাশাপাশি স্বস্তির শ্বাস’ও ফেলল। অবশেষে সে এই তিক্ততা-পূর্ণ জীবনটা থেকে মুক্তি পেল কিন্তু তবুও এই মানুষটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ভুলতে কী পারবে মানুষটাকে! নীলাদ্রির বুক চিরে এক তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এল।
কোর্ট থেকে বেরিয়ে বাবার হাত ধরে গাড়িতে উঠার উদ্দেশ্যে দরজা খুলতেই পেছন থেকে সেই অতি চিরচেনা ডাকটা শেষ বারের মতো কানে বাজতেই নীলাদ্রি এক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে পেছনে তাকালো।
আরিয়ান একটু এগিয়ে নীলাদ্রি’র কাছ থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
-‘ভালো থেকো। এই এক বছর অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়। পারলে মাফ করে দিও।’
নীলাদ্রি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। কেন জানি, এই মানুষটার এমন নরম কণ্ঠ শুনলে সে এই মানুষটার করা পাষবিক অত্যাচার সব ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।
নীলাদ্রির হুশ ফিরলো যখন তার বাবা রেগে আরিয়ানকে থা’প্প’ড় মারলো।
-‘তোমার লজ্জা করে না। আমার মেয়ের জীবন শেষ করে আবার ভালো থাকতে বলছো? আমারই ভুল ছিল, বেশি ভালো মনে করে তোমার হাতে মেয়ে দিয়ে। আজ থেকে আমার মেয়ের সাথে তোমার সব সম্পর্ক শেষ। আমার মেয়ের আশেপাশেও যেন তোমাকে আর না দেখি। মনে থাকে যেন!’
আরিয়ান নেহাল আহমেদের কথা শুনে আর কোনো জবাব দেওয়ার সাহস পেল না।
নেহাল আহমেদ হনহন করে গাড়ির পাশে এসে দরজা খুলে নীলাদ্রির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-‘যা মা। গাড়িতে উঠ।’
নীলাদ্রি বিনা বাক্য ব্যয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই অন্যপাশে তিনিও উঠে পড়ার পর গাড়ি ছেড়ে দিল।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে কোর্টের গেট পেরিয়ে আসতেই নীলাদ্রি জানালা দিয়ে পার্কিং প্লেসে আরিয়ানের গাড়িটির দিকে তাকালো। আরিয়ান ড্রাইভিং সিটে বসে নীলাদ্রিদের গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আছে।
নীলাদ্রিদের গাড়ি গেট পেরিয়ে চলে আসতেই সে শেষবারের মতো পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আরিয়ানকে দেখে নিলো। আরিয়ানও ততক্ষনে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
দুইটা গাড়ি একে অপরের বিপরীত দিকের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই গাড়ির মতোই আজ থেকে নীলাদ্রি-আরিয়ানের গন্তব্য ভিন্ন। আর কোনো সম্পর্কের বাধা নেই।
নীলাদ্রি পেছন ফিরে চোখ মুছে নিলো। সে তো মানুষটাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল! তবুও কেন মানুষটা তাকে আপন করে নিতে পারলো না! হয়ত তারই নিয়তি খারাপ।
নেহাল আহমেদ মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। নীলাদ্রি বাবার বুকে গুটিসুটি মেরে বসে রইল। সে বুঝতে পারছে, হয়ত বাবার’ও ভীষণ মন খারাপ কারণ তিনিই যে জোর করে নীলাদ্রিকে বিয়ে দিয়েছিল নিজেরই বন্ধুর ছেলের সাথে।
———-
তখন সবেমাত্র উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছে নীলাদ্রি। তার ইচ্ছে, সে অনেক পড়বে। একদিন বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে কিন্তু বাবা তার এক বন্ধুকে কথা দিয়ে রেখেছিল যে তার একমাত্র মেয়েকে বন্ধুর ছেলের হাতে তুলে দিবে।
নেহাল আহমেদের বন্ধুর হঠাৎ করে ক্যান্সার ধরা পড়লো। এরপর আস্তে আস্তে শরীরের অবনতি হচ্ছিলো ঠিক তখনই তিনি বুঝতে পারলেন তার আর এই দুনিয়ায় বেশিদিন থাকা হবে না। সে মারা গেলে তার এতিম ছেলেকে কেউ দেখে রাখবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন,তার দু’চোখ বন্ধ হওয়ার আগেই একমাত্র আদরের ছেলেটাকে বিশ্বস্ত কারো হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। তার একমাত্র কাছের বন্ধু নেহাল আহমেদের একমাত্র মেয়ে নীলাদ্রিকে সে দেখেছিল। অনেক ভদ্র একটা মেয়ে। একটু বেশি অসুস্ততা অনুভব হতেই তিনি বন্ধুকে বলে বিয়ের তোড়জোড় চালালেন যে তার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিবে।
আরিয়ান সবসময় থাকতো ঢাকায়। সে পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই একটা ব্যবসা খুলে ওখানেই থাকতো। বাবার মৃত্যু-শয্যায় দেখতে এসেই বাবার শেষ কথা অনুযায়ী ইচ্ছের বিরুদ্ধে নীলাদ্রির সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে হলো। ঠিক একই ভাবে নীলাদ্রিও সেই বিয়েতে রাজি ছিল না। তার সবচেয়ে বড়ো ইচ্ছেটাই যে অপূর্ন রয়ে যাবে, তার উচ্চশিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছে আর তার চেয়ে বড়ো কথা একজন অচেনা-অজানা মানুষের সাথে হুট্ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সে চায়নি। কিন্তু আঙ্কেলের এই অবস্থায় রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তাই এক রকম ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ঘরোয়াভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিয়ের পর দিনই আরিয়ান যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছিল তখন তার বাবা রেগে গিয়ে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধেই থেকে গেল আরও কয়েকদিন সে কিন্তু নীলাদ্রি-আরিয়ানের মধ্যে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি, আরিয়ান নীলাদ্রির সাথে কথাও বলেনি। আরিয়ানের বাবা এটা বুঝতে পেরে তার ছেলেকে ওয়াদাবদ্ধ করালেন যে তিনি যদি না থাকেন তখন মেয়েটিকে কোনোরকম যেন কষ্ট না দেয় আর ঢাকায় তার সাথেই যেন মেয়েটিকে রাখে। আরিয়ানও আর উপায় না পেয়ে মাথা নাড়লো।
এরপর কয়েকদিনের ভেতরই আরিয়ানের বাবা মারা যান। তখন আরিয়ান না চাইতেও নীলাদ্রিকে সহ ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়।
ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। নীলাদ্রি মনে করলো, হয়ত মানতে কষ্ট হচ্ছে। আস্তে আস্তে মেনে নিবে। সে সবকিছু ভুলে মানুষটার সেবা-যত্নের দিকে সম্পূর্ণ ধ্যন দিল। কিন্তু মানুষটা নীলাদ্রির সাথে একটা কথাও বলার প্রয়োজনবোধ করতো না। আস্তে আস্তে ব্যাড আলাদা হলো এরপর ঢাকায় যাওয়ার পর পুরোপুরি রুমও আলাদা হয়ে গেল। উল্টো ঢাকায় গিয়ে মানুষটার মুখোশ খুলে গেল।
সারাটাদিন নীলাদ্রি একা বাসায় পড়ে থাকে, তার কোনো খোঁজ নেয় না। মাঝরাতে আরিয়ান নেশা করে এসে নীলাদ্রি কিছু বললে গায়ে হাত তুলতো। নীলাদ্রি বিয়ে হয়েছে তাই ভালোবাসা দিয়ে মানুষটাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু না, তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। মানুষটা তাকে চায়ই না। যদি হুশে থাকে, নীলাদ্রিকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য একটি মেয়ের সাথে কথা বলতো। নীলাদ্রি সব চুপচাপ সহ্য করলেও এভাবে অন্য একটি মেয়ের সাথে কথা বলা দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। সে রেগে গিয়ে একদিন মোবাইল নিয়ে ফেলায় সেদিন রাতটা নীলাদ্রির জন্য কালরাত মনে হয়েছিল। এতদিন হুশে না থেকেই মারতো, সেদিন হুশে থেকেও বেধড়ক মেরেছে নীলাদ্রিকে।
সকালে উঠেই সারা দেহ ব্যথায় ছটপট করে উঠল। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে নীলাদ্রির সকাল সকাল উঠে যেতে হয়েছিল আরিয়ানের নাস্তার ব্যবস্থা করার জন্য। নীলাদ্রি তবুও টু শব্দ না করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত সফল হয়নি।
——–
হঠাৎ কারো অনবরত ডাকার ফলে নীলাদ্রির হুশ ফিরতেই দেখলো বাবা তার পাশের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।
নীলাদ্রি আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো গাড়ি অনেক আগেই তাদের বাড়ির সামনে থেমে আছে। গাড়ি থেকে ব্যাগ আর জিনিস-পত্র সব নামানো শেষ।
নীলাদ্রি কাল-বিলম্ব না করে গাড়ি থেকে নামতেই নেহাল আহমেদ বলে উঠলেন,
-‘আস্তে ধীরে নাম মা।’
নীলাদ্রি বাবার দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
সে গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে তাকালো। কতদিন পর এই বাড়িটাতে এসেছে। ঢাকায় যাওয়ার পর আরিয়ান আর নীলাদ্রিকে এই বাড়িতে আসতে দেয়নি। বাবা-মায়ের জোরাজোরিতে একবার এসেছিল আসলেও নিজে সহ এসে দিনের ভেতর রওনা দিয়েছিল আবার। নীলাদ্রি নিজের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে প্রানভরে শ্বাস নিল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ