অনুভূতিরা শীর্ষে 💗,পর্ব_১০
লেখনিতে_সুমাইয়া ইসলাম মিম
আমি আয়নায় তাকাতেই দেখি সেই লোকটা দাঁড়ানো যাকে সাদিয়া আপুর পাশের দেখেছিলাম। কেমন করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বেশ ভয়ই পেলাম। একেতো এখানে আমি একা আর কেউই নেই। সবাই নিচে, এই আওয়াজে কেউ আমার চিৎকার শুনতেও পারবে না। তাও সাহস করে বললাম,
–আপনি কে? এখানে কি করেন?
লোকটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল,
-আমি! আমি আসিফ! এখানে তোমার কাছেই এসেছি।
আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আমার কাছে এসেছে কেন?
–আপনি আমার কাছে এসেছেন মানে কি? বের হন এখান থেকে। এক্ষুনি বেরিয়ে যান। নয়তো আমি চিৎকার করবো।
লোকটা ভয়ংকর হাসি দিয়ে বলল,
-তোমার চিৎকার শুনতে কেউ আসবে না। আরে তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই!
আমি বিষ্ফোরিত চোখে তাকালাম। কত অসভ্য লোক। চেনা নেই জানা নেই বিয়ে করতে চায়! আমি বেশ শক্ত গলায় বললাম,
–একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আমি আপনাকে চিনিও না! আর আপনি আমাকে কি করে চিনেন? আপনি এক্ষুনি বের হন এখান থেকে!
লোকটা আমার কাছে এগিয়ে আসছে। এর মতলব ভালো ঠেকছে না। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দৌড় দিবো তখনই আমার হাত ধরে ফেলল লোকটা। আমার সারা শরীর ঘিনঘিন করছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। কি শক্ত ভাবে হাতটা ধরেছে লাল লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
–হাত ছাড়ুন! আপনার সাহস তো কম না, আপনি আমার হাত ধরেছেন? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমার হাত!
লোকটা ভয়ংকর ভাবে বলল,
-কেন? এখন এমন কেন করছো? যখন সাদ ভাই তোমার হাত টেনে ধরেছিলো তখন তো কিছু বলো নি! কেন? তখন কি বেশি সুখ অনুভূত হচ্ছিলো?
ছিঃ! লোকটার কথা শুনে নাকমুখ কুঁচকে এলো আমার। সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছে আমার! চোখের কোনে পানির কণা এসে ভীর জমিয়েছে! যেকোন সময় পড়ে যেতে পারে! এর যা বলল তাতে মনে হলো আমার সামনে সবচেয়ে ঘৃণীয় একটা নর্দমার কীট দাঁড়িয়ে আছে।
-ইশ! জানো তো সুবহা রানী! সাদ ভাই যখন তোমার ওই সেক্সি কোমড়টা ধরলো না! ইচ্ছে হচ্ছিলো সাদ ভাইকে সরিয়ে তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও যেয়ে তোমার সর্বাঙ্গ…….
আমি সহ্য করতে না পেরে মুক্ত হাত দিয়ে জোরে সর্বশক্তি দিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম জানোয়ারটার গালে। চিৎকার করে বললাম,
–অসভ্য! জানোয়ার! তোকে তো…..
কিছু বলার আগেই সাদাদ ভাই এসে জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন,
–সুবহা! তোমার এতোটা অধঃপতন ঘটেছে? ছোট হয়ে বড়দের গায়ে কি করে হাত তুলো তুমি? এই তোমার শিক্ষা?
আমি পুরো অবাক হয়ে গেছি! এই লোকের কথা শুনে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি ইনি পুরো বিষয়টা না জেনেই চিৎকার করছেন! সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম এই আসিফ নামের কীট সাদাদ এর সামনে একদম ভিজে বিড়াল। একে দেখে মনেই হবে না ভিতরে এক জানোয়ারের সত্তা বসবাস করে। কি ভাবে ভদ্র হয়ে বলল,
-থাক আর বকা দিও না। বাচ্চা একটা মেয়ে! আমি কিছু মনে করি নি!
সাদাদ ভাই অগ্নিচোখে বললেন,
–কিভাবে বাদ দিবো আসিফ ভাই! আপনার গালে আঙুলের দাগ পড়ে গেছে। দি দেখলে খুব কষ্ট পাবে। আর আমি আমার বোনের কোন কষ্ট সহ্য করবো না।
তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–সুবহা! সে সরি! তুমি ভুল করেছো সরি বলো! আর আসিফ ভাই আপনি এখানে এসেছেন কেন?
আসিফ আমতাআমতা করে বলল,
-আসলে ওয়াশরুম খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছি। ওকে দেখে ভাবলাম একটু পরিচিত হই তাই আর কি!
সাদাদ ভাই রাগী চোখে আমার দিকে তাকালেন। এবার আমার দুঃখে কান্না পাচ্ছে। মানে উনি সবটা না জেনে শুনে কেন আমাকে বকবেন? কিসের অধিকারে? সাদাদ ভাই আবার আমাকে বললেন,
–সুবহা! আমি তোমাকে কিছু বলেছি। এক্ষুনি ক্ষমা চাও!
এবার রাগে আমার গা রিরি করে উঠলো। শক্তভাবে বললাম,
–যেখানে আমার কোন দোষ নেই সেখানে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওনাকে বলবেন আমার থেকে দূরে থাকতে নয়তো এর ফলাফল ভালো হবে না।
বলেই চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু সাদাদ ভাই বললেন,
–দাঁড়াও সুবহা! এভাবে বেয়াদবি করে তুমি যেতে পারো না। আগে সরি বলো দেন যাও।
আমি এবার চিৎকার করে বললাম,
–আমি মোটেই ক্ষমা চাইবো না। এমন কোন কাজ করিয়েন না যার জন্য পরবর্তীতে আফসোস করতে হয়! এই লোকটা একটা জঘন্য লোক! এ আপনার বোনের জীবনটাও ধ্বংস করে ছাড়বে!
এবার উনি বেশ জোরে সুবহা বলে আমার দিকে হাত তুলল! কিন্তু আমাকে মারতে পারে নি! আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম! এবার আমি আর আমার চোখের পানি আটকাতে পারি নি। গাল বেয়ে নেমে এলো। শুধু একটা কথাই বললাম উনাকে,
–বিশ্বাস ভালো! তবে অন্ধ বিশ্বাস সবকিছু তছনছ করে দেয়!
বলেই ওখান থেকে দৌড়ে চলে এলাম। আপুর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো আমাদের বাসার কাছেই একটা বিশাল জায়গায়! তাই বাসায় আসতে তেমন একটা কষ্ট হয় নি। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। আজ কান্নারা কিছুতেই বাধা মানছে না। ফ্লোরে বসেই চুড়ি খুলে খুলে এদিক ওদিক ছুড়ে মারার ফলে সবগুলো চুড়ি ভেঙে চূড় চূড় হয়ে গেছে। আজ মনটাও ভীষণ কাঁদছে!
.
তখন থেকে সাদাদ দেয়ালে একের পর এক আঘাত করছে। এখন তো রীতিমত হাত ফেটে রক্ত পড়ছে কিন্তু তবুও যেন মনকে শান্ত করতে পারছে না। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সে কি করে তার সুবহা কে মারতে হাত উঠিয়েছিলো? ভাবতেই তার গা শিউড়ে উঠছে। সাদিয়া কয়েকবার এসে তার ভাইকে ডাক দিয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। বন্ধ দরজায় কড়াঘাত করেও কোন লাভ হয় নি। হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। সাদাদ নিজেকে বন্ধী করে লাইট নিভিয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে গেলো হাত পা ছড়িয়ে! বিছানায় শুতেই তার চোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। সে কি করবে? এক দিকে নিজের ভালোবাসা আর অন্যদিকে বোনের ভালোবাসা! আজ তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সুবহার চোখের পানি তার হৃদয়ে এক বিষাক্ত মেডিসিনের ন্যায় কাজ করেছে যা ক্রমাগত তাতে ক্ষত করেই চলেছে। আজ সুবহার ব্যবহারে সে খুব কষ্ট পেয়েছে সাথে সাথে নিজের প্রতি চরম বিরক্ত সে।
.
সকালের রোদ চোখে পড়তেই মাথা তুলে দেখি এখনো এলোমেলো ভাবেই ফ্লোরে বসে আছি। চোখের পানি শুকিয়ে চেহারায় টান লাগছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ৮ টা বেজে গেছে প্রায়। আজ আপুর বিয়ে আর আমি এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিলাম! মনটা ভীষণ খারাপ। কোনমতে ফ্রেশ হয়ে রুমটা গোছগাছ করে নিলাম। বাইরে বের হতেই দেখি সবাই কাজে ব্যস্ত। আমাকে দেখে আম্মু বলল,
-কিরে চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? ঘুম হয়নি ঠিকমতো?
আমি মলিন মুখে বললাম,
–না আম্মু এমন কিছু না। ওই মাথা ব্যাথা করছিলো এর জন্য হয়তো!
আম্মু এসে কপালে হাত দিয়ে বলল,
-সেকি কথা! জ্বরও তো নেই। আয় নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিবি। আজ যে রুবাইয়ার বিয়ে ভুলে গেলি?
আমি হালকা হেসে বললাম,
–না আম্মু! ভুলবো কেন? কোথায় বিয়ের কনে?
বলতে বলতেই আপু চলে এলো। এসে বলল,
-এই যে এখানে!
আমি আপুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
–এই আপু! আমাকে খাইয়ে দেবে না আজ? আজ তোমার হাতে শেষ বারের মতো খাবো। এর পর তো তুমি অন্যের বাড়ি চলে যাবে! তখন কে খাইয়ে দেবে আমায়?
বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। আপুও কান্না করে দিয়েছে। এর মধ্যে ভাইয়া এসে বলল,
-কেন? আমার সুবহামনি কি আমার হাতে খাবে না?
খেয়াল করলাম ভাইয়ার মনটাও খারাপ। যতই হোক আদরের বোনকে বিদায় দিতে হবে। আমি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললাম,
–কেননা? অবশ্যই আমি তোমার হাতে খাবো! কিন্তু আপুর থেকে তো মা মা গন্ধ আসে।
আপু এবার আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আমিও আর নিজেকে থামাতে পারলাম না। ভাইয়াও মনটা খারাপ করে আমাদের ধরে আছে। আম্মু বারবার ওড়না দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিচ্ছে। তারপর এসে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আপু আমাকে খাইয়ে দিলো।
.
আজ আপুর বিয়ে। কত্ত কাজ। আজ আর আমি কোন রেস্ট পাচ্ছি না। এটা সেটা করতেই হচ্ছে। বলতে গেলে কেউই বসে নেই। আপুকে পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার কাজিনরা আর মামাতো চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরাও সাথে গিয়েছে সাজতে। আমাকে আম্মু বারংবার বলেছে।কিন্তু আমিই যাই নি। একে তো মন ভালো নেই। আর বাকি কাজ গুলোও দেখতে হতো। তাই আর যাই নি। ঘরে বসেই লাল লেহেঙ্গাটা পড়ে হালকা সেজে নিলাম। আপু তার বিয়ের জন্য পিয়াজ কালারের একটা লেহেঙ্গা চুজ করেছে তাই আমি লাল রঙের লেহেঙ্গা চুজ করেছি। হাতে চুড়ি পড়তে গিয়ে দেখলাম হাতটা জখম হয়ে আছে। কাল জানোয়ারটা এতো শক্ত করে ধরেছিল যে দাগ এখনো রয়েছে আর চুড়ি খুলতে গিয়ে কিছু ভেঙে হাতে ঢুকেছিল! এর জন্যই হাত ধুতে গিয়ে এতোটা জ্বালা করেছে হাতে। হাতে চুড়ি পড়ে একে একে কানের দুল, টিকলি পড়ে নিলাম। আর মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আজ সাদাদ ভাইয়ের সামনেই যাবো না। উনাকে আজ একদমই পাত্তা দিবো না। অনেক বেশি হার্ট করেছে আমায়। শুধু এই বিয়েটা পর্যন্ত। এর পর থেকে আর কখনও উনার সামনে যাবো না। মনে মনে সব ডিসিশন নিয়ে আস্তে আস্তে রুম থেকে বের হলাম। আপুরা অনেক আগেই সেন্টারে পৌছে গেছে। আম্মু বাবাও ওখানে। শুধু ভাইয়া আর আমি এখন যাবো।
,
,
,
চলবে…………….❤️