#অনুভবে তুমি (প্রথম পর্ব )
#সুস্মিতা রায়চৌধুরী
“ময়না, এই ময়না, শুনছিস! কিছু পুড়েছে মনে হয়। এখানেও গন্ধ আসছে।”
“ও .. হ্যাঁ বৌদি, গ্যাসটা বাড়ানো আছে, প্রেসারে ডাল সেদ্ধ করতে দিয়েছিলাম। একদম খেয়াল করি নি।”
“তোর আজকাল মনটা যে কোথায় থাকে ময়না! কাল মাছের ঝোলে নুন দিস নি।”
“ও.. তাই! ভুল হয়ে গেছে বৌদি আর হবে না।”
“ও মোর ময়না গো
কার কারণে তুমি একেলা
কার বিহনে দিবানিশি যে উতলা
সে তো আসবে না….”
“থামলে কেন গো বৌদি গাও না! কত ভালো গলা তোমার! অবশ্য তোমার সবকিছুই তো ভালো। কত সুন্দর দেখতে তুমি,কত ভালো লেখ তুমি! ভগবান তোমাকে সুখী হওয়ার, জন্য সবকিছু দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। আর আমাদের কপালে শুধুই কষ্ট লিখে পাঠিয়েছে। তা তুমি এখন রান্না ঘরে কেন এলে বৌদি? তোমার লেখা নেই?”
ময়নার কথা শুনে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্বেষা। কি করে বোঝায় এই ছোট মেয়েটাকে যে সুখটা বড়ই আপেক্ষিক। সুখের অনুভূতি একেক জনের কাছে এক এক রকম।
অন্বেষা হেসে বলল, “আসলে ময়না রানী তোমাকে এই বার্তা দিতে এলাম যে রান্নাঘরের সেলফ- এর কাজগুলো করতে সঞ্জয় আসবে, তুই রান্নাটা তাড়াতাড়ি সেরে নে।”
সঞ্জয়ের নামটা শুনেই হাতের খুন্তিটা রেখে ঘুরে দাঁড়ালো ময়না। বিষন্ন,আনমনা মুখটায় হঠাৎ খুশির প্লাবন।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চোখ দুটো মেলে ময়না জিজ্ঞাসা করলো, “কখন আসবে গো বৌদি?”
“এইতো ঘন্টা খানেকের মধ্যে। মাঝে পনেরো দিন কোথায় যে ডুব দিয়েছিল! কত দেরি হয়ে গেল কাজের।” কথাগুলো বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল অন্বেষা।
রান্নাঘরের বাইরে এসে সে লক্ষ্য করলো ময়না নিজের চুরিদারের দিকে বারবার দেখছে, চুলগুলো ঠিক করে নিল,মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে পরিষ্কার করল। মুখের মধ্যে এক খুশির ছোঁয়া,মানে অনুরাগের ছোঁয়া। ময়নার মুখের এই অভিব্যক্তিটুকু দেখার জন্যই তো সে রান্নাঘরে এসেছিল।
আসলে অন্বেষা পেশাগতভাবে একজন ফ্রিল্যান্স রাইটার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, মাগাজিনে লেখালেখি করে। ইংরেজি-হিন্দী বাংলা তিনটে ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার পর একটা সর্বভারতীয় সংবাদপত্র চাকরি পেয়েছিল সে। কিন্তু নিয়মমাফিক চাকরি,বাধাগতে লেখা তার ভালো লাগে নি। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো লেখে। একটা বই বেরিয়ে গেছে ইংরেজি ভাষায়। দ্বিতীয় বইটাও প্রকাশিত হবে শীঘ্রই। ছোট থেকেই লেখা,ছবি আঁকা,গান এসব নিয়েই থাকতে ভালোবাসে অন্বেষা। ছোট থেকে পড়াশোনা, বড় হওয়া সবটাই দিল্লিতে।
বাবার কর্মসূত্রে তারা দিল্লিতে ছিল। তবে এখন বিয়ের পর অবশ্য অন্বেষা কলকাতায়। অন্বেষার স্বামী, অভিরূপ রায়, কলকাতার তথা ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট। কয়েক বছর হলো বিয়ে হয়েছে তাদের। ভবানীপুরে অভিরূপদের পুরনো বাড়ি। বাবা মারা গিয়েছিল খুব ছোটবেলায়, বিয়ের মাস ছয়েক পরে মারা যায় মা-ও। অন্বেষা ছোট থেকেই খুব আবেগপ্রবণ, হাসিখুশি ,প্রাণবন্ত, একটা মিষ্টি মেয়ে। এমনিতে সে খুবই সুন্দরী তবে ওর আন্তরিক ব্যবহার, সদা হাস্যময়ী মুখ ওর সৌন্দর্যে একটা অন্য মাত্রা যোগ করে।
ময়না এবাড়িতে প্রায় অনেকটা সময়ই থাকে। রান্না ছাড়াও বাড়ির টুকিটাকি সব কাজই করে সে। সময় থাকলে অন্বেষার কাছে একটু পড়াশোনা করে। উচ্চমাধ্যমিকের পর মেয়েটা পড়াশোনা আর করতে পারে নি। হঠাৎ করে বাবা মারা যায় একটা অ্যাক্সিডেন্টে। বাবা বাস চালাত। যদিও উপার্জনের বেশিরভাগ টাকাটাই খরচ করত মদ খেয়ে। তাই অভাব তো ছিলই তার ওপরে বাবার মৃত্যুর পর মা, ছোট দুটো ভাই বোন, নিয়ে সংসারের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠলো। বাধ্য হয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির এই কাজ নিল ময়না। যদিও অন্বেষা ময়নাকে নিজের বোনের মতোই দেখে। ভালোবাসে, প্রশ্রয় দেয়।
আর সঞ্জয় হলো এবাড়ির পুরনো কাঠের মিস্ত্রী রমেনের ছেলে। আগে বাবার সঙ্গে কাজ করতে আসত। বাবা মারা যাওয়ার পর একাই আসে, যখনই দরকার পড়ে। যখন তাদের পুরনো বাড়ির রান্নাঘরকে মডিউলার কিচেন বানাবে ঠিক করলো অন্বেষা তখন কোন বড় ইন্টেরিয়র ফার্মকে ডাকে নি সে। পুরনো বাড়ির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেই ডিজাইন করে সঞ্জয়কে দিয়ে কাজ করাচ্ছে। বেশ কিছুদিন হলো সঞ্জয় কাজ করছে রান্নাঘরে।
সেই সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল ময়না আর সঞ্জয়-এর মধ্যে। অন্বেষার সামনেই দুজনের সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হয়েছিল। পিতৃহারা দুটো ছেলেমেয়ে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই সমব্যথী হয়ে একে অপরের পাশে থাকে। অন্বেষা জানে সঞ্জয় ছেলেটা ভালো। সৎ ,পরিশ্রমী সর্বোপরি একটা ভালো মানুষ। তাই এই সম্পর্কটাকে অন্বেষা একটু প্রশ্রয় দিয়েছে। জীবন যুদ্ধের এই লড়াই-এ ময়নার পাশে থাকার মত যদি কেউ থাকে,থাক না!
দিন পনেরো আগে হঠাৎ করেই খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ছিল ময়নার ছোট ভাই-এর। ডাক্তার,ওষুধ,প্লাস্টার সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে বেশ অনেকটাই। সঞ্জয় নিজের খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা দিয়ে ময়নাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু ময়না সেটা নেয় নি। উল্টে বলেছিল,”ডাক্তারদাদা আর বৌদি তো সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে আর লাগবে না।” এই কথাতেই সঞ্জয়বাবু অভিমান করে কোন খবর না দিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিল।
তবে এই কদিনের অদর্শনে ময়নার অবস্থা যে একেবারে বিরহিনী রাধার মতো হয়েছিল সেটা অন্বেষা ভালো বুঝতে পেরেছে।
কিছুক্ষণ পরই সঞ্জয় এল। ময়নার সাথে চোখাচোখি হতেই ময়না চোখ নামিয়ে সরে গেল।
যদিও অন্বেষা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পদ্ম পাতায় থাকা জলের মতো ময়নার চোখের জল টলটল করছে। এই বুঝি বর্ষণ শুরু হবে।
কিছুক্ষন পর অন্বেষাই বলল, “ময়না ছাদে গিয়ে শুকনো জামা কাপড় গুলো তুলে নিয়ে আয় তো।” ময়না গম্ভীর গমনে গেল ছাদের দিকে।
তারপরেই অন্বেষা সঞ্জয়কে বলল, “সঞ্জয় জানোতো ছাদের দরজাটা ভাল করে বন্ধ হচ্ছে না। বর্ষাতে বোধহয় দরজার কাঠগুলো ফেঁপে উঠেছে, একটু দেখতো গিয়ে।”
এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এই মুহূর্তটুকুর অপেক্ষাতেই ছিল সে। দ্রুতগতিতে ছাদে উঠলো সঞ্জয়। দরজায় আওয়াজ শুনেই এগিয়ে এলো ময়না। ছাদের সিঁড়ির দেয়াল ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো।
চোখের জল তখন চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নেমে চিবুক ছুঁয়েছে। দুজনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। আসলে নৈঃশব্দেরও একটা ভাষা আছে ।
তারপর সঞ্জয় বেশ আবেগঘন গলায় ময়নার চোখের জলটা মুছে দিতে দিতে বলল, “কাঁদছো কেন!”
ময়না কোন উত্তর না দিয়ে শুধু নীরবে অশ্রু সিক্ত হতে লাগলো। সঞ্জয় ময়নার হাত দুটো ধরে বলল, “চুপ করো আর কেঁদো না। আমার ভুল হয়ে গেছে। এভাবে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। আর কখনো এমন হবে না। বৌদি বলেছে তোমার ভাই ভালো আছে।”
তারপর নিজের যন্ত্র রাখার ব্যাগ থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে বলল, “তোমাদের জন্য আমাদের গ্রামের মিষ্টি নিয়ে এসেছি। বৌদির জন্যও এনেছি। তারপর মিষ্টির প্যাকেটটা খুলে একটা মিষ্টি ময়নার মুখের কাছে ধরে বললো,”খেয়ে দেখ, আমাদের গ্রামের এই মিষ্টির স্বাদ কিন্তু একদম আলাদা। একটা খাও আমার সামনে, তারপর প্যাকেটটা বাড়ি নিয়ে যেও। ময়না চোখের জল মুছে মিষ্টিটা খেতে লাগলো সঞ্জয়ের হাত থেকেই।
অন্বেষা নিচের সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে আড়ালে থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখছিলো মুগ্ধ নয়নে। একটা চোরা অপরাধবোধ কাজ করছিল মনে মনে। অন্য দুজনের এমন ব্যক্তিগত দৃশ্য কেন এভাবে দেখছে সে! আর শুধু আজই তো নয় এর আগেও ওদের কথাবাত্রা, ছোটখাটো ভাবের আদান-প্রদান, সবটুকু সে কান খাড়া করে দেখে এবং শোনে।
কিন্তু কেন! কেন তার বাড়িতে কাজ করা, তার চেয়ে অনেক ছোট দুটো ছেলে মেয়ের এমন আন্তরিক ভালোবাসার দৃশ্য দেখার জন্যে সে উদগ্রীব হয়ে থাকে!
ক্রমশ