#অনুভবে তুমি ( অন্তিম পর্ব)
#সুস্মিতা রায়চৌধুরী
কেন ময়নাকে কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি সুখী মনে হয়!
কারণ কি এটাই যে, সে ভালোবাসার কাঙাল!
ঠিক এমন ভাবেই তাকে কেউ ভালবাসবে, আগলে রাখবে, মান অভিমান সব ভাঙ্গিয়ে দেবে, আবেগে আদরে ভরিয়ে দেবে …. মনে মনে এটাই সে চায়! ভালোবাসার ঠিক এই কাঙ্ক্ষিত রুপই কি তার মনের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে, যা সে কখনো পায় নি!
আবহমানকাল ধরে কি মেয়েরা এমন ভাবেই ভালোবাসা চেয়ে এসেছে!
কিন্তু অভিরূপকে তো বিয়ের জন্য সে নিজেই সম্মতি দিয়েছিল। যদিও অভিরূপ ছিল তার বাবার বন্ধুর ছেলে। কিন্তু তবুও বাবা তাকে অভিরূপকে বিয়ে করার জন্য কোন জোর করেনি। দিল্লিতে একটা সেমিনারে গিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছিল অভিরূপ। হঠাৎই অন্বেষা বাড়ি ফিরে এসে দেখেছিল একটা অপরিচিত সুদর্শন পুরুষ তাদের বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে সকলের জন্য কফি বানাচ্ছে। তারপর বাবা -ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। দারুন ফিজিক, প্রথম দেখাতে ডাক্তার নয় কোন স্পোর্টসম্যান মনে হবে। এত বিখ্যাত ডাক্তার, দুর্দান্ত রেজাল্ট,থাকা সত্বেও পা-টা কিন্তু ছিল একেবারে জমির ওপর, একেবারে নিরহংকারী একটা মানুষ। এই গুণটাই খুব ভাল লেগেছিল অন্বেষার। অন্বেষা লেখে শুনে খুব উৎসাহ দিয়েছিল। তারপর ওর বাবা অভিরূপ-এর মায়ের সাথে কথা বলে, বিয়েটাও হয়ে যায়। বিয়ের পর অন্বেষা দিল্লি থেকে আসে কলকাতায়।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই অভিরূপের আচরণ বেশ অদ্ভুত লাগে অন্বেষার।
অন্বেষা যথেষ্ট সুন্দরী। ভিড়ের মধ্যেও সহজে তাকে আলাদা করা যায়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে অন্বেষা অভিরূপের মুখে তার রূপের কোন প্রশংসা শোনে নি। কখনও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নি। বিয়ের পর নতুন বউয়ের জন্য আলাদা করে কোনো আবেগ, উচ্ছ্বাস, অনুভূতির কোনো প্রকাশ দেখেনি। মাঝে দু এক দিন বিশেষ দু-একটা পদ রান্নাও করেছে অন্বেষা। কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ খাবারের মতোই চুপচাপ খেয়ে উঠে গেছে অভিরূপ।
অন্বেষার মনে হয় সে যেন একটা যন্ত্রমানবের সঙ্গে সংসার করছে। অভিরূপ- এর প্রতিটি পদক্ষেপ চলে ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সকালে মর্নিং ওয়াক, ব্রেকফাস্ট, হাসপাতাল, চেম্বার, নিজের পড়াশোনা সবকিছু চলে নিয়ম করে,ঘড়ি ধরে। অন্বেষা সঙ্গে কথাবার্তা যেটুকু হয় সেটাও খুব গতানুগতিক। একান্ত আলাপচারিতায এখনো হয়ে ওঠে নি।
বিয়ের পরের দিনই অভিরুপ বলেছিল “সবসময় অন্বেষা বলে ডাকাটা কঠিন তার থেকে আমি তোমাকে অনু বলে ডাকবো।” অন্বেষা খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু অন্বেষা থেকে অনু হাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। প্রতিদিনই একই সংলাপ। সকালবেলা উঠে গুড মর্নিং দিয়ে শুরু। তারপর ব্রেকফাস্ট টেবিলে তোমার লেখালেখি কেমন চলছে অনু, তোমার এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ,তোমার কিছু লাগলে বল। আমাদের ড্রাইভার খুব পুরনো। রাস্তাঘাট সব চেনে। তোমার যেখানে দরকার বোলো,ও নিয়ে যাবে।
আর শুধু কথাবার্তায় কেন,শারীরিক সম্পর্কের মধ্যেও নেই কোন আবেগের ছোঁয়া।
বিয়ের পরপরই অভিরূপের মা একপ্রকার জোর করেই হানিমুনে পাঠিয়েছিলেন। পাহাড়ি রাস্তায় প্রতিটি যুগল খুব ঘনিষ্ঠভাবে হেঁটে যাচ্ছিল। অন্বেষাও অভিরূপের স্পর্শটুকু পেতে মরিয়া হয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল হয়তো ওর হাতটা ধরবে অভিরূপ। তারপর একসাথে হাত ধরে হেঁটে যাবে পাহাড়ি রাস্তায় কিছুক্ষন। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। অভিরূপ নিজের মতো হাঁটতে হাঁটতে অন্বেষাকে পাহাড়ি অঞ্চলের আবহাওয়া পরিবর্তনের তথ্য দিতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বেশ হতাশ হয়ে ফিরেছিল অন্বেষা।
তবে অন্বেষা হাল ছাড়ে নি। অভিরূপকে নিজের মত করে পাওয়ার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
আসলে অভিরূপের বেশ কিছু গুণ ছিল। অভিরূপ ভীষণভাবে স্বাবলম্বী। কোন কিছুর জন্য কারোর উপর নির্ভর করে না। প্রতিদিন সে কি জামা কাপড় পরে বাইরে যাবে সেটা সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়। তার ওয়ারড্রব খুব সুন্দর করেই গোছানো। কখনো সেমিনারের জন্য বাইরে যেতে গেলে নিজে ব্যাগ প্যাক করে নেয়। ড্রাইভার না আসলে নিজে ড্রাইভ করে হসপিটালে যায়। রাত্রে কখনো কফি খাওয়ার ইচ্ছে হলে নিজেই বানিয়ে নেয়। কখনো মাকে বা অন্বেষাকে বলে না।
মাঝে মাঝে অন্বেষার মনে হয় কেন আরো অনেকের মত অভিরূপ নিজের স্ত্রীর উপর একটু নির্ভরশীল হলো না! কেন কোন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় হঠাৎ করে ফিরে এসে অভিরূপ বলে না ‘অন্বেষা, আজ খুব ক্লান্ত, একটু চা করো দুজনে মিলে বসে খাব। অথবা অন্বেষা আজ একটু খিচুড়ি বানাবে। ‘
হাসপাতালে বেরোনোর আগে কেন বলে না অন্বেষা আমার ঘড়িটা কোথায়, পেনটা খুজে পাচ্ছি না,একটু দেখো না।’
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের মনেই হাসে অন্বেষা। নির্ভরশীল তো দূরের কথা বরং উল্টোটাই হয়েছে।
বিয়ের পর একটা রবিবার অভিরূপের বন্ধুরা বাড়িতে এসে তার হাতের রান্না খেতে, গান শুনতে চেয়েছিল। অন্বেষা খুব খুশি হয়ে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এইদিন অভিরূপ নিজেই বলেছিল তুমি আর ময়না মিলে এত জনের রান্না করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাবে আমি তোমাদের বরং সাহায্য করে দি। সেদিন রান্নাঘরের কাজে অনেকটা সাহায্য করেছিল অভিরূপ। অন্বেষার ভালো লেগেছিল সেদিন অভিরূপের সহমর্মিতা দেখে।
সন্ধ্যেবেলা খুব সুন্দর করে সেজেছিল অন্বেষা। রয়েল ব্লু কালারের মাইসোর সিল্ক, ডিজাইনার ব্লাউজ, প্লাটিনাম জুয়েলারি, হালকা লিপস্টিক, আইলাইনার। ঘরের ড্রইংরুমের হালকা নীল আলোয় একেবারে অপ্সরার মতো ছিল অন্বেষাকে।
অভিরূপ- এর বন্ধুরা গানের অনুরোধ করলে, অন্বেষা কোল্ড্রিংসের হালকা চুমুক দিয়ে সিক্ত ঠোঁটে গান ধরল ,
“প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা।
সুন্দর এসে ফিরে যায়
তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা।
উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল অন্বেষার দিকে। গান শেষ হতেই প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল সকলে। কিন্তু এত সবকিছুর পরেও একটা মানুষ ছিল একেবারে নিশ্চুপ, উদাসীন। অন্বেষা যখন গান গাইছিল তখন অভিরূপ টেবিল সাজাতে বা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল। গান কানে গেছে ঠিকই কিন্তু অন্বেষার দিকে একবারও তাকায় নি।
স্বাভাবিকভাবেই অন্বেষার মুখে আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল। অভিরূপ- এর বন্ধুরা বুঝতে পেরে তারাই অন্বেষার সঙ্গে গল্প শুরু করে। ” জানোতো অন্বেষা, আমরা হলাম গিয়ে সব শুধুই ডাক্তার আর অভিরূপ হলো গিয়ে ডাক্তার রূপে ভগবান। হসপিটালের দারোয়ান থেকে নার্স, সমস্ত পেশেন্ট, সবাই অভিরূপকে ভগবান মনে করে।পারলে তো ফুল চন্দন দিয়ে পুজো করে। মাঝে মাঝে অভিরূপকে হিংসা হয় বুঝলে! সেই কলেজ লাইফ থেকে দেখছি।
কলেজে আমরা যখন গার্লফ্রেন্ড খুঁজতে ব্যস্ত তখন অভিরূপ বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকত। আসলে ও তো জানে ভগবানের তো গার্লফ্রেন্ড দরকার নেই। তার জন্য স্বয়ং দেবী মর্তে আগমন করবেন। কথাগুলো বলে সকলে হো হো করে হেসে উঠেছিল। পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করেছিল সকলে। অন্বেষা সেই মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেও বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট থেকে গিয়েছিল। কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুরা তার সামান্য একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকতো। আর অভিরূপ এতটা নিস্পৃহ, উদাসীন কী করে থাকে!
রাত্রিবেলায় বেশ আবেগভরা সম্মোধন করে অন্বেষা জিজ্ঞাসা করল,”অভি আজকে আমাকে কেমন লাগছিল? ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা বিছানায় রেখে অভিরূপ বলল, “তুমি তো খুব সুন্দর অনু, তুমি তো নিজেই সেটা জানো। আমি আর নতুন করে কি বলব।”
আবার একবার অন্বেষার হৃদয়ে বিষাদজলের বান ডাকলো।
শুধু মুখ ফুটে বলতে পারল না, মাঝে মাঝে সব মেয়েরাই শুনতে চায় তার কাছের মানুষ তাকে বলুক সে খুব সুন্দর। সে তাকে খুব ভালবাসে। এটুকু বড় দরকার জীবনে। মন তো কোন যন্ত্র নয়, শুধু সময় ধরে কাজই করে যাবে।”
অন্বেষা মনে মনে ভাবে আচ্ছা মানুষ বেঁচে আছে তাইতো কাজ করে নাকি কাজ করার জন্যই বেঁচে আছে। এই তো ময়না,সঞ্জয় এরাও তো কাজ করে। নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। তাও তো দুটিতে নিজেদের জন্য কেমন সুন্দর একটু সময় বের করে নেয়। পাড়ার কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে একসাথে খায় মাঝে মাঝে, সিনেমা দেখে। একটু সময়ও কী অভিরূপ বের করতে পারে না শুধু তারই জন্য।
অন্বেষার দুঃখের সঙ্গী হতে সেদিন রাত্রে হঠাৎ করেই আকাশ চিরে নেমেছিল বৃষ্টি।
অন্বেষা ধীর পায়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ছোট্ট ব্যালকনিতে। বৃষ্টির সাথে ছিল ঝড়ো ঠান্ডা হাওয়া। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছিল অন্বেষার মুখে। চুলগুলো এলোমেলো উড়ছিল হাওয়ায়।
কিছুক্ষণ পর অভিরূপ এসে দাঁড়িয়েছিল। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,”এখানে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন অনু? ঠান্ডা লাগছে তো তোমার! ঘরে এসে শুয়ে পড়ো। অন্বেষা বলেছিল, “বৃষ্টির শব্দ শুনছি, তুমিও দাঁড়াও না একটু আমার সাথে।”
অভিরূপ খুব গম্ভীর মুখ করে বলেছিলো, “আমার কালকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ওটি আছে। খুব ক্রিটিকাল কেস। রাত্রে ঠিকমত ঘুম না হলে আমি কাজে মনঃসংযোগ করতে পারবো না। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা লাগিও না, অনু। প্লিজ শুয়ে পড়ো। আর কথা বাড়িয়ো না।”
অন্বেষা চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। শুধু চোখ দিয়ে গরম তরল গড়িয়ে পড়ে ছিল কয়েক ফোঁটা। এরপর নিজেকে ব্যস্ত করে নিয়েছিল লেখার মধ্যে। এরপর হঠাৎ করেই অভিরূপের মা অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। এত বড় বাড়িতে অন্বেষা একদম একা হয়ে গেল।
দিল্লির বাড়িতে সে লেখালেখি করত, তার সাথে মাঝে মাঝেই বাবা মায়ের সাথে গল্প করত। সেই সঙ্গে দিল্লিতে তার অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, ছোটখাটো ট্যুর লেগেই থাকত। কিন্তু কলকাতায় তার কোনো বন্ধু নেই। অপরিচিত একটা শহরে একা একা কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে না। হসপিটাল, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বাইরে যেটুকু সময় পায় অভিরূপ সেটুকু সময় মেডিকেল জার্নাল,বই নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
তবুও একদিন এক ছুটির দিনে অভিরূপ যখন চেয়ারে বসে বই পড়ছিল, অন্বেষা চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে অভিরূপের গলাটা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলেছিল,”অভি, আজ একটা মুভি দেখতে যাবে?”
অভিরূপ লঘু স্বরে বলে,”এতক্ষণ ফোন বন্ধ করে রাখাটা একটু অসুবিধে,অনু। তুমি বরং নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখো। আর যতটা ফাঁকা সময় থাকবে তার মধ্যে বই পড়ো। ভালো লিখতে গেলে কিন্তু অনেক পড়তে হয়। নিজের জন্য একটা টার্গেট ফিক্স করো। বছরে একটা দুটো নয় আরো বেশি সংখ্যায় বই প্রকাশ করার চেষ্টা করো।”
এরপর অন্বেষা নিজের ঠোঁটদুটো অভিরূপের কানে ঠেকিয়ে আস্তে করে বলল “ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু এখন চলো একসঙ্গে দুজনে সিনেমা দেখি।”
অভিরূপ ব্যস্ত হয়ে বলেছিল ” না, অনু, আজ একটু ব্যস্ত। পরে অন্য কোনোদিন না হয় দেখব। তুমি দেখো।”
অন্বেষা অভিমান করে চলে এসেছিল। সিনেমা দেখে নি। ল্যাপটপ খুলে বসে ছিল লেখার জন্য। কিন্তু একটা লাইনও লিখে উঠতে পারে নি।
এমন ভাবেই কাটল আরো কয়েকটা মাস। আস্তে আস্তে অন্বেষার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে লাগলো। চোখের সামনে দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ের স্বতস্ফূর্ত ভালোবাসার ছবি দেখে সে রোজ। গলার কাছে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে কেমন উঠে আসে আজকাল। লেখাতেও খুব একটা মনঃসংযোগ করতে পারছে না। মনে হয় এই বাড়িতে সে একটা অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের মতো রয়ে গেছে শুধু। আসলে অভিরূপের জীবনে তার কোন প্রয়োজন নেই। নিজের চিকিৎসা জগৎ নিয়েই অভিরূপ ব্যস্ত।
অন্বেষা দিল্লি ফিরে যাবে ঠিক করল। ফিরে গিয়ে বাবা মাকে বুঝিয়ে বলবে। তেমন হলে না হয় ডিভোর্স নিয়ে নেবে। কি লাভ এই প্রেমহীন লোকদেখানো দাম্পত্যকে বয়ে নিয়ে গিয়ে!
অভিরূপকে না জানিয়েই ট্রেনের টিকিট কাটলো অন্বেষা।
তারপর একদিন রাত্রে খাবার টেবিলে পরিবেশন করতে করতে অন্বেষা অভিরূপকে বলল আমার এক পাবলিশার্স-এর সাথে কথা হয়েছে নতুন একটা বই নিয়ে, দিল্লির পটভূমিকায়। তাই দিল্লি যাচ্ছি। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। থাকবো কিছুদিন। হয়তো….
বিদ্যুৎ চমকের মত চমকে উঠল অভিরূপ। খাওয়া বন্ধ করে শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,”কতদিন থাকতে হবে দিল্লিতে?”
অন্বেষা নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো, “জানি না।”
এবার অভিরূপ বেশ গাঢ় স্বরে বলল, “অনু তুমি ফ্লাইটে কেন গেলে না! সময় বেঁচে যেত অনেকটা।”
“আমি তো তোমার মত অত ব্যস্ত নই, অভি। আর ট্রেনের অভিজ্ঞতাটাও আমার লেখার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।”
এবারও বেশ উদাসীন অন্বেষা।
অভিরূপ খেতে খেতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। তারপর খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেল।
অন্বেষার যাওয়ার কথা শুনে ময়নার খুব মন খারাপ। একপ্রকার কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। একদিন করুন মুখে এসে বলল, “বৌদি জানি ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, তবু তুমি তো আমাকে বোনের মতো ভালোবাস তাই জিজ্ঞাসা করছি,”তুমি ডাক্তার দাদাকে ছেড়ে থাকতে পারবে! তোমার কষ্ট হবে না! ডাক্তারদাদার কিন্তু খুব মন খারাপ। দেখো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না ক’দিন।”
অন্বেষা উদাস দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল তোর ডাক্তারদাদা হয়তো কোন ক্রিটিক্যাল কেস নিয়ে ভাবছে।
“না, গো বৌদি কতদিন তো দেখছি ডাক্তারদাদাকে। তোমার মনে নেই বৌদি, ফল কাটতে গিয়ে ছুরিতে যেদিন তোমার হাত কেটে একটু রক্ত বেরিয়েছিল, ডাক্তারদাদা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল ওইটুকু রক্ত দেখে।”
অন্বেষা কোন কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতরে। সেদিন সে ও অবাক হয়ে গেছিল। অভিরূপের মত বড় ডাক্তার, সেদিন ওইটুকু রক্ত দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিল। পরম মমতায় তাঁর হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল। বারবার জিজ্ঞাসা করছিল ‘খুব ব্যথা লাগেনি তো, অনু।’
ঘরের মধ্যে এসে চুপ করে বসে পড়ল অন্বেষা। নিজের হাতেই এই ঘর সে সুন্দর করে সাজিয়ে ছিল। শুধু যদি অভিরূপ একবারে এসে বলতো,”অনু, দিল্লি যেও না। এখান থেকে কাজটা করা যায় না! অথবা যদি রাগ করে বলতো ‘আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কেন টিকিট কেটেছ! এখন নয়,পরে যেও।’
চোখের কোনটা ভিজে উঠলো অন্বেষার। তার দিল্লি যাওয়ার কথা মা-বাবাকে জানাতেই মা ফোনে তাকে বুঝিয়ে ছিলো খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন নে, মা। সকলের ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি তো এক হয় না, নিজেকে বুঝে নিতে হয়।
কিন্তু কিছুতেই নিজের সিদ্ধান্ত বদল করেনি অন্বেষা।
নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে চড়ে বসে ছিল অন্বেষা। সকালবেলায় একসঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট করেছিল, অন্বেষা, অভিরূপ। যদিও এক কাপ চা ছাড়া অভিরূপ আর কিছুই খাই নি। যাবার সময় লাঞ্চ প্যাকও নিয়ে যায় নি। শুধু যাবার আগে অন্বেষাকে বলেছিল,”অনু পৌঁছে গিয়ে আমায় একটা খবর দিও,প্লিজ। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আসার আগে অন্বেষা একটা চিরকুটে শুধু লিখে এসেছিল, আমি চললাম অভি। ভালো থেকো।
মনের গহীনে জমে থাকা কষ্ট গুলোকে জমিয়ে রেখে বিকেলবেলায় শিয়ালদহ রাজধানীতে চড়ে বসে ছিল অন্বেষা।
উঠেই দেখল সামনের সিটে বসে আছে একজন ভদ্রমহিলা। আর তার সাথে বছর তিনেকর একটা ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে। দেখে অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা ভালো হলো অন্বেষা। বাচ্চাটার গাল টিপে আদর করলো।
ট্রেন চলতে শুরু করল হঠাৎ সামনে বসা মেয়েটির ফোনে একটা ফোন এলো।
ফোন ধরে মেয়েটি কথা বলা শুরু করলো।
—হ্যালো, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি বল।
——কি বলছিস ডা. অভিরূপ রায় কালকের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিয়েছে! তো পরের নিশ্চয়ই অন্য কোন ডেট দিয়েছে।
——দেয় নি! কি বলছে ক্লিনিক থেকে? কী বললি ক্লিনিক থেকে বলেছে ডাক্তারবাবু অন্য কোনো ডেট দেয় নি। কবে চেম্বারে আসবেন কিছু জানায় নি।
——ডাক্তারবাবু জানালে তবে ওরা বলতে পারবে। ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছিলি ফোন সুইচ অফ। কিন্তু এমন তো কখনো হয় না। অন্য চেম্বারেও বসবেন না জানিয়ে দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপেও রিপোর্ট দেখেন নি!
—– তুই মন খারাপ করিস না, মুন। ভগবান যখন আমার প্রতি সদয় হয়েছেন তখন তোরও হবে। হয়তো ডাক্তারবাবুর কোন ইমারজেন্সি হয়েছে। উনি নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবেন কিছুদিনের মধ্যেই।
তারপরই ফোনটা কেটে গেল।
অন্বেষা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল “আপনি কি গাইনোকোলজিস্ট অভিরূপ রায়ের কথা বলছেন? যিনি আরোগ্য নিকেতন চেম্বারে বসেন।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি তো ওনার কথাই বলছি। আপনিও ওনাকে দেখান বুঝি? খুব ভালো ডাক্তার তাই না, বলুন! ডাক্তার নয় ভগবান। খুব দায়িত্বশীল মানুষ। কিন্তু কেন যে হঠাৎ এমন করলেন বুঝতে পারছি না।
“কি হয়েছে বলুন তো!”গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল অন্বেষা।
“দেখুন না, উনি আমার বোনের চিকিৎসা করছেন এই কয়েক মাস হল। অনেকটা এগিয়েছে। কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিলেন। কালকে ওনার সাথে অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ছিল। রিপোর্ট দেখে পরবর্তী চিকিৎসার কথা বলবেন। কিন্তু কালকে উনি সব অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। আসলে আমার আর আমার বোনের দেখুন না,একই সমস্যা। আমার বিয়ের আট বছর পরও আমি মা হতে পারি নি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছিলাম, কিছু হচ্ছিল না। আমার বর বা শ্বশুরবাড়ির লোক আমাকে কিছু বলে নি। কিন্তু আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সুইসাইড এটেম্পট করেছিলাম একবার। তারপর অভিরূপ রায়ের কাছে যাই। উনি চিকিৎসা শুরু করেন। আমাকে সাইকোলজিস্ট-এর সাথে কনসাল্ট করতে বলেন। তারপর ওনার চিকিৎসাতেই আমার মেয়ে হয়। উনি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
আর শুধু আমি কেন কত মেয়ের মুখে যে উনি হাসি ফুটিয়েছেন তা শুধু ঈশ্বর জানে। এই তো আমার পাশের বাড়ির কাজের মেয়েটা, দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেছিল বাচ্চা হয় নি। শ্বশুর-শাশুড়ি অত্যাচার করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছিল। আমি ওকে বলেছিলাম। হসপিটালে গিয়ে ডাক্তার বাবুকে দেখিয়েছিল। প্রাইভেট চেম্বারে দেখানোর মতো অর্থ তো ওর নেই। ওর কিছু টেস্টের দরকার ছিল যেগুলো সেই মুহূর্তে হসপিটালে হচ্ছিল না। উনি নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে ওকে দিয়েছিল বাইরে থেকে টেস্ট করিয়ে আনার জন্য। ওর একটা ছেলে হয়েছে, জানেন। এখন খুব আনন্দে সংসার করে। আমাকে সব সময় বলে ‘আমি ঈশ্বর দেখিনি দিদি,কিন্তু ডাক্তারবাবুকে দেখেছি।’
অন্বেষার মনের মধ্যে ঝড় উঠেছে। প্রথমেই ফোন করল অভিরূপকে। ফোন সুইচ অফ।
অস্থির হয়ে উঠল অন্বেষা তারপর ফোন করলো অভিরূপের ড্রাইভারকে।
“তোমার স্যর, এখন কোথায়?
স্যর,তো আমাকে স্যর বলতে বারণ করেছিল। বলেছিল আমায় দাদা বলবি। সেই থেকে দাদা-ই বলি,ম্যাম। কিন্তু দাদা তো অনেকক্ষণ হসপিটাল থেকে বাড়ি চলে গেছেন। কোন প্রাইভেট চেম্বারে যায় নি আজ। দুপুরের লাঞ্চ পর্যন্ত করে নি। খুব অন্যমনস্ক আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো দাদাকে আজকে। আমাকে বলল ‘তোকে আর আসতে হবে না। আমি যখন বেরোবো তোকে ফোন করে নেব। তুই চিন্তা করিস না। তোর মাইনে আমি তোর একাউন্টে ট্রান্সফার করে দেবো। আমি দাদাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি। কিন্তু বলুন না, ম্যাম, ‘দাদার কি হয়েছে?’
ছেলেটির গলার স্বরের কাতরতা অন্বেষাকে ছুঁয়ে গেল।
‘আমি বাইরে আছি, কিছু জানি না।’ শুধু এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলে অন্বেষা।
অন্বেষার মনের মধ্যে ওঠা ঝড়ের গতিবেগ বাড়লো। কি করবে এখন কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। নিজের হাত দুটো কপালের দু পাশে দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পরলো।
যে মানুষটা কখনো ফোন সুইচ অফ করে না, তার ফোন সুইচ অফ কেন! কেন সমস্ত অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করেছে! কেন ড্রাইভারকে আসতে বারন করেছে! কিছু বুঝতে পারছেনা সে। তবে কি অন্বেষার ওপর তীব্র অভিমান করে অভিরূপ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে! না খেয়ে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে!
সামনে বসা ভদ্রমহিলাটি বলল “আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? আপনি তো খুব ঘামছেন। বাড়ির কাউকে ফোন করুন। কিভাবে এতটা পথ যাবেন একা। তেমন হলে সামনেই তো দুর্গাপুর স্টেশন,নেবে, বাড়ি ফিরে যান।”
অন্বেষা আলোর দিশা খুঁজে পেল। নেমে পড়লো দুর্গাপুর স্টেশনে। তাড়াতাড়ি কলকাতার জন্য একটা গাড়ি বুক করল।
খুব অপরাধী লাগছে এখন নিজেকে।যে মানুষটা এতগুলো মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, কাউকে বা বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছে। যার দিকে তাকিয়ে আছে এখনো অনেকগুলো মানুষ, সেই মানুষটাকে কি এমন ভাবে ছেড়ে আসা ঠিক হলো! বৃহত্তর স্বার্থের জন্য কি মাঝেমাঝে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়! আজকে তো শুধু তার জন্য বেশ কিছু মানুষ অসুবিধায় পড়ল। একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার নিজের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। আচ্ছা ড্রাইভার ছেলেটির মনে কী এমনই কোন প্রশ্ন ছিল? সকলে শুনলে তো তাকেই দোষী মনে করবে।
আসলে এই সমাজে এটাই প্রচলিত যে, ব্যস্ত সফল মানুষের পাশে তার স্ত্রী বা প্রেমিকা সবকিছু মানিয়ে নিয়ে রয়ে যাবে। নিজের ভাললাগার কথা ভেবে তারা কখনো ছেড়ে যাবে না।
বাড়ি এসে পৌঁছাতেই হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নামল অন্বেষা। নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবিটা দিয়ে দরজা খুলল।
তারপর সোজা চলে গেলে অভিরূপের ঘরে। দেখল অভিরূপের ঘরটা অন্ধকার। স্টাডি টেবিল এর উপর হাত রেখে মাথাটা নামিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছে। ঘরে ঢুকেই আলোটা জ্বালিয়ে দিলে অন্বেষা। হঠাৎ আলো জ্বালাতেই অভিরূপ অন্বেষাকে দেখে একদম চমকে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তাড়াতাড়ি।
তারপর প্রায় চিৎকার করে বলল,”অনু, তুমি এখানে ! এখন! তুমি কি ট্রেন মিস করেছ!
তারপর খুব কাছে এসে অনুর দুই কাঁধে হাত দুটো রেখে, তার দিকে তাকিয়ে বললো “তোমার কিছু হয় নি তো অনু, তুমি ঠিক আছে তো!”
অন্বেষা তার আয়ত চোখের কালো আলো ফেলে অভিরূপ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একদম ঠিক আছি। ভাবলাম কাজটা এখান থেকেই করব। তাই ফিরে এলাম।”
সহসাই অভিরূপের মুখটা খুশিতে একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বললো, “কিন্তু তুমি…”
অন্বেষা অভিরূপকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তোমায় পরে সব বলব। আগে তুমি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন তোমার মোবাইল সুইচ অফ! কেন তুমি ড্রাইভারকে কাল থেকে আসতে বারণ করেছ! কেন কাউকে কিছু না জানিয়ে সব অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করেছে!
কেন তুমি সারাদিন কিছু খাও নি! কেন অন্ধকার ঘরে এভাবে বসে আছো! কেন! অভি কেন! কথাগুলো বলতে বলতে অন্বেষার গলা রুদ্ধ হয়ে এলো।”
এবার অভিরূপ প্রায় অশ্রুত কন্ঠে বলল “জানি না অনু, ক’দিন ধরে কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে, মন খারাপ লাগছে কোথাও ভালো লাগছে না। না হসপিটালে, না বাড়িতে, না চেম্বারে। আমি তো তোমার মত অত সপ্রতিভ নই। গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, লিখতেও পারি না। সারা জীবন শুধু বইখাতা নিয়ে কেটে গেছে। তাই কিছু বলতে পারি নি। মনে মনে ভেবেছিলাম ….আর হয়তো তোমার সাথে কখনো আমার দেখা হবে না! আর হয়তো তুমি কখনো ফিরে আসবে না! চারদিক বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।” কথাগুলো বলতে বলতে গভীর আবেগে অভিরূপ অন্বেষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অন্বেষাও অভিরূপের চওড়া বুকে মুখ মুখ গুজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ছোট বাচ্চাদের মত। জমে থাকা চোখের জল অভিরূপেরও দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। এইভাবে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলল কিছুক্ষণ। আজ অভিরূপের বুকে মাথা রেখে অভিরূপের না বলা অনেক কথা খুব সহজেই পড়ে ফেললো অন্বেষা। আর তার কোনো কষ্ট নেই। অনেক মাস, অনেক সপ্তাহ, অনেক দিন সে অপেক্ষা করেছে শুধু এই মুহূর্তটুকু জন্য। বহু কাঙ্খিত, বহু প্রতীক্ষিত এই মুহূর্তটুকু। যা তার উপস্থিতিতে কখনো অনুভব করতে পারেনি অভি, তা তার সামান্য অনুপস্থিতিতে সে করতে পেরেছে।
এরপর হঠাৎই অন্বেষা ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
অভিরূপকে বললো ” চলো, চলো, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। সারাদিন তোমার কিছু খাওয়া হয় নি। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল তোমাকে হসপিটালে যেতে হবে। তারপর চেম্বারেও। তুমি সকালে ক্লিনিকে ফোন করে জানিয়ে দিও,ওরা যেন তোমার সব পেশেন্টকে ইনফর্ম করে দেয়।।”
অভিরূপ আঙ্গুল দিয়ে অন্বেষার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল,”থাক না, অনু, কালকের দিনটা অন্তত আমি তোমার সাথেই থাকি।”
অন্বেষা অভিরূপের নাকে,নাক ঠেকিয়ে, মাথার চুলগুলোর ভেতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল, “না, অভি, তুমি যাও। সম্ভব হলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”
খাওয়া শেষ করে রাত্রে শুতে এসে অভিরূপ বলল, “অনু,আজ আমায় একটা গান শোনাবে।”
অনু গান ধরল
“ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার।”